সুপ্রিয়া মুর্মু
ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের বয়স হয়েছে। তার জন্য একজন সুলক্ষণা কন্যার সন্ধান করা হচ্ছে। গান্ধার রাজ সুবলের এক পরমা সন্দরী কন্যা আছে, সেখানে দূত প্রেরণ করা হল। অন্ধ পাত্রে কন্যা দানের ইচ্ছা কোন পিতা মাতার থাকে না। গান্ধার রাজ সুবলেরও ছিল না।তিনি তাই অন্ধ পাত্রে কন্যা সম্প্রদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগল ধৃতরাষ্ট্রের।গান্ধার রাজ্য জয় করার জন্য তিনি সৈন্য প্রেরণ করলেন। গান্ধারীকে পত্নীরূপে বরণ করার জন্য সত্যবতী ও ভীষ্মের আগ্ৰহের কারণ হল তারা জানতেন যে, গান্ধারী শিবের আরাধনায় শিবকে তুষ্ট করে শত পুত্রের জননী হবার বর পেয়েছেন।
দূরদৃষ্টিসম্পন্না গান্ধারী জানতেন যে, তার পিতার সাধ্য হবে না দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ভীষ্মের গতিরোধ করা। ফলে গান্ধার রাজ্য শেষ হয়ে যাবে। তাই তিনি যুদ্ধ সজ্জায় সজ্জিত পিতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন যে তিনি ঐ অন্ধ পুরুষটিকেই পতিত্বে বরণ করতে চান। গান্ধারী তাঁর নয়নযুগল বস্ত্রাঞ্চলে আবদ্ধ করেন। তিনি বিশ্বকে দেখবেন না বলে ঠিক করেন।
গান্ধারী স্বেচ্ছায় পিতা মাতার অনুমতি নিয়ে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে পতিত্বে বরণ করে নিলেন। গান্ধারী তাঁর সদাচার, সদ্ব্যবহার ও সুশীলতা দ্বারা কৌরবদের অন্তর অচিরেই জয় করেন। গান্ধারীর শুধু একটাই মনোবাসনা ছিল তা হল, তার স্বামী যেমন জন্মান্ধ হয়ে জ্যেষ্ঠ হয়েও রাজ্যভারের দ্বায়িত্ব কনিষ্ঠ পান্ডুকে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার সন্তানদের ক্ষেত্রে তা যেন না হয়। তাঁর সন্তান যেন পান্ডুর সন্তানের পূর্বে জন্মায় এবং সেই যেন রাজ্যাধিকার পায়।
একদিন ব্যাসদেব ক্ষুধার্ত হয়ে গান্ধারীর আলয়ে উপস্থিত হলে গান্ধারী পরম সমাদরে তাকে শুশ্রূষা করলে মহর্ষি খুশি হয়ে বর দিতে চান। গান্ধারী বলেন যদি সত্যিই আমাকে বর দিতে চান তাহলে এই বর দিন যাতে আমার গর্ভে আমার পতির মত গুণবান শতপুত্র জন্মে।ব্যাসদেব বর দিয়ে চলে গেলেন।
এরপর গান্ধারী অন্তঃসত্ত্বা হলেন। কিন্তু দু বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রসবের লক্ষন দেখা গেল না। সেই সময় তিনি শুনলেন তার দেবরপত্নী কুন্তীর এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।একথা শুনে ঈর্ষান্বিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতসারে গর্ভপাত করলেন। গর্ভপাত করে এক বিরাট মাংসখন্ড বের হল। অতিশয় দুঃখ পেয়ে তিনি ঐ মাংসখন্ডকে জলে ভাসিয়ে দিতে উদ্যত হলে মহর্ষি ব্যাসদেব সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।তিনি বলেন এই মাংসপেশী থেকেই তার শতপুত্র জন্ম নেবে। ব্যাসদেব তখন শীতল জল সেচন দ্বারা সেই মাংসপেশীকে এক এক ভাগ করে এক একটি ঘৃতকুম্ভের মধ্যে রাখতে লাগলেন। গননা করে দেখলেন শতভাগের পর এক ভাগ বেশি হয়েছে। তখন তিনি গান্ধারী কে বললেন তোমার শতপুত্র হবে এবং অবশিষ্ট এক ভাগে এক কন্যা সন্তান জন্ম নেবে। ঐ খন্ডগুলিকে গুপ্তস্থানে রেখে রোজ জল দিতে বললেন এবং দুবছর পর এইসব কুম্ভ উদঘাটন করতে বললেন।
🍂
ব্যাসদেবের কথামত দুবছর পর ঐ কুম্ভের প্রথমটি উন্মোচন করলে প্রথমে দুর্যোধনের জন্ম হল। ঐ দিন কুন্তী পুত্র ভীমেরও জন্ম হয়।দুর্যোধন জন্মেই গর্ধভের মত কর্কশ ধ্বনি করতে লাগল এবং নিশীথে কাক ডাকতে লাগল। এসব অশুভ লক্ষণ দেখে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী অতিশয় ভীত হলেন।বিদুর ও ব্রাহ্মণগণ ধৃতরাষ্ট্রকে সতর্ক করলেন যার জন্মলগ্নে এমন অমঙ্গল সূচিত হয় তাকে পরিত্যাগ করাই ভালো।এতে কুরূকুল ধংস হতে পারে।
কিন্তু স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র কারও কথায় কর্ণপাত না করায় এক মাসের ভিতর শত পুত্র ও এক কন্যা জন্মে। কন্যার নাম ছিল দঃশলা। সিন্ধুদেশাধিপতি জয়দ্রথের সাথে দুঃশলার বিবাহ হয়;শত রাজপুত্রদের রাজকন্যাদের সঙ্গে।
বিদ্বান, গুনবান ও চরিত্রবান পুত্র প্রতিটি জননীর কাম্য। কুন্তী তা সবই পেয়েছিলেন, গান্ধারী পান নি।গুনবান, কৃতি পুত্রের জননী কুন্তী। শতপুত্র থেকেও সামান্য একটি চাহিদা পূরণে ব্যর্থ গান্ধারী।
দুঃখে ভরা জীবন গান্ধারীর। চোখ থেকেও তিনি ষোড়শ বৎসরান্তে কোনদিন পৃথিবীর আলো দেখেননি। আশা ছিল রাজমাতা হবেন, তার পুত্র রাজা হবে জ্যেষ্ঠের অধিকারে। কিন্তু তা হয়নি। অন্তঃসত্ত্বা হয়েও যুধিষ্ঠির জন্মাবার দুবছর পরে দুর্যোধনের জন্ম হয়।দুর্যোধন সারা জীবন দুর্জন ব্যক্তি দের মূলধন করে রাজ্য শাসন করেছেন অতএব তার পরিনাম ধ্বংস।পান্ডবদের সাথে যুদ্ধ যাত্রাকালে মা হয়েও তিনি পুত্রকে বলতে পারেননি, যাও বিজয়ী হয়ে এসো। শুধু বলেছেন ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। কিন্তু তিনি জানতেন ধর্মের জয় হবেই। তাই হল যুদ্ধক্ষেত্রে শত ভ্রাতা সহ ভীমের গুরু গদাঘাতে দুর্যোধন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গান্ধারী তখন আর ধৈর্য ধরতে পারেন নি।তিনি ভীমকে দোষারোপ করলেন তার পুত্র দুর্যোধনকে নিধন করার জন্য, কনিষ্ঠ ভ্রাতা দুঃশাসনকে মেরে ফেলার জন্য। ভীম মাতা গান্ধারীর কাছে একে একে সব বৃত্তান্ত বর্ণনা করলে গান্ধারীর ক্রোধ প্রশমিত হল। তিনি আপন পুত্র শোক বিস্মৃত হয়ে যুধিষ্ঠির ও ভীমকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে বললেন যুধিষ্ঠির, তোমাদের চিরকাল আপন পুত্রের মত দেখেছি। দুর্যোধন ও তোমাতে বিভেদ করিনি। আজ ও তোমাদের আশির্বাদ করি, তোমরা সুখী হও শান্তিতে রাজত্ব কর।সদ্য পুত্রহীনা কোন জননী পুত্রহন্তাদের অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ করেছে এ দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। গান্ধারী ছুটে চলে গেলেন রণক্ষেত্রে। সঙ্গে শত বিধবা পুত্রবধূ।রণক্ষেত্রে মৃত দুর্যোধনকে অবহেলায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে তিনি আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না।বিলাপ করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।তিনি জানতেন যে তার জৈষ্ঠ্য পুত্রের কুকর্মই তার শত ভাইয়ের বিনাশের কারণ। তিনি এটাও জানতেন যে কৃষ্ণ না থাকলে পান্ডবরা জয়ী হতে পারতো না।
অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্না, ধৈর্যশীলা, অনন্যা, অদ্বিতীয়া জননী গান্ধারী।
গান্ধারী বস্ত্রাঞ্চলে সব সময় নয়নযুগল আবদ্ধ করে রাখতেন। অন্তঃপুর বাসিনী ছিলেন। কিন্তু তার স্বামীর মতো স্নেহান্ধ হয়ে সব কিছু জেনেও না জানার ভান করেননি তিনি শুধু তার শত পুত্রের জন্য গর্বিতা ছিলেন। ভাবতেন এদের মধ্যে কেউ না কেউ তো ভালো হবে । কিন্তু
বার বার তাঁর আশা নিরাশায় পরিনত হয়েছে।
যুদ্ধের পরিনাম, কে বা কার নির্দেশে যুদ্ধ,সব তিনি জানতেন। কুরুক্ষেত্রে তার পুত্রদের কাটা মুন্ডু নিয়ে শৃগাল কুকুরের ক্রীড়া, বালক অভিমন্যুর মৃত্যুতে তিনি চঞ্চল ছিলেন। তাঁর হৃদয় ছিল এক সাম্যবাদী নারীর মমতাগার। তাই তিনি কর্ণ ও দুর্যোধনকে এক নজরে দেখেছিলেন, তার শতপুত্র যাদের দ্বারা নিহত হল সেই পঞ্চপাণ্ডবের প্রশংসা শোকের মাঝেও তিনি করেছেন। এরপর গান্ধারী স্বামী ধৃতরাষ্ট্র ও কুন্তী সহ বনে আশ্রয় নেন এবং বনে এক প্রবল দাবানলের আগুনে তাঁদের সকলের প্রাননাশ ঘটে।।
0 Comments