মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
|| স্বপ্ন দেখব বলে ||
বেশ ক'মাস পর বাড়ি এসেছে বলে মা রান্না করেছে, ঝিনির প্রিয় কই মাছ,মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল রান্নায় ছোট ছোট নারকেলের টুকরো ভেজে দিয়েছে । পাটিসাপটা বানিয়েছে। খাবারের স্বাদ আর ঘ্রাণ পুরনো দিনের সুসময়ের সাথে আস্টেপিস্টে বেঁধে ফেলল তাকে আর অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল সে। ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করিস কেন?নুন ঝাল ঠিক হয়েছে? খুব ভালো হয়েছে।
মেঘলা করেছে বিকেল থেকে। হাওয়া উঠল এখন।মার্চের হু হু হাওয়ায় মিশেছে নিম্নচাপের বাতাস। ঝরঝর করে কাঁঠাল আর পেয়ারা পাতা পড়ছে উঠোনে।কাশীর পেয়ারা গাছটা ডালপালা নাড়ছে খুব।আগে এমন বাতাস উঠলেই সরসর করে ওর ডালে চড়ে দোল খেতে।ডালপাতা নেড়ে ডাকছে নাকি ও? উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই অন্ধকারে উড়ো পাতা কুটোর সঙ্গে শুকনো পাতার সুবাস লাগলো নাকে।ঝিনিইই ঝড়ের মধ্যে বাইরে থাকিস নাআআ।
অনেক দিন পরে আবার সে মা'র কাছে শুলো।
হ্যাঁ রে ঝিনি মন বসেছে পড়ায়? জানোই তো পড়ায় আমার কোনো কালেও মন বসে না মা। না এই ডাক্তারি তো পড়তেই চাসনি,আমরাই ধরে বেঁধে পাঠালাম তাই জিজ্ঞেস করছি।ধরে বেঁধে পাঠালে যখন আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে!
চুল আঁচড়ে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে থমকে গেল মা। বিনুনিটা পিঠের দিকে ঠেলে মা বলল,আমার প্রথম ছাত্রী তুই যে মেডিকেল পড়তে গেল। ফালতু বড়াই করে লাভ নেই।কলকেতায় এর'ম মেডিকেল স্টুডেন্ট ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে বলতে বলতে মা'র নিবে আসা মুখের দিকে তাকিয়ে কী একটা টনটন করে উঠল দেখে মাকেই জড়িয়ে ধরলো সে।
আর ঝপ করে তার মনে হলো সেই দূরবীনটার কথা। যাতে চোখ রেখে সেদিনের মতোই সে দেখতে পাচ্ছিলো বাবার সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের পরপর ব্যাজার মুখে ঝিনি যাচ্ছে পিসতুতো ধলুদার বাড়ি। জয়েন্টের সিট পড়েছে বারাসতে। কাজেই বাধ্যতামূলক দুদিনের জন্য তাকে সেখানেই ঘাঁটি গাড়তে হবে।
🍂
দাদারা তখন মেডিকেল ক্যাম্প নিয়ে বাঁকুড়া না ঝাড়গ্ৰমে চলে যাচ্ছে বারবার। ওদের সংগঠন ওদেরকে ডিক্লাসড হতে শেখাচ্ছে। বলছে গ্ৰামে গিয়ে থাকো কয়েকদিন। গ্রামের যে সব লোকজনের সাহায্যে ওরা ক্যাম্প করবে তাদের ব্যবস্থা মতোই ভাগাভাগি করে ওদের থাকতে হবে সেখানে তা সে খড়ের চালা হোক বা তালপাতার ঝুপড়ি।
রোগী দেখার সঙ্গে সময় সুযোগ মতো লোকজনকে সচেতন করে তোলার চেষ্টাও তাদের কাজ। কিন্তু দুদিনের জন্য ক'টাকার ডিম ডাল কিনে দিয়ে বাবুগিরি ফলানো বারণ। টাকা পয়সা খরচা করে দয়া দেখানোর জায়গা নেই বরং গরিব গুরবো মানুষের সহজ অনুগ্রহের আতিথেয়তা নেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারলে তবেই তোমার কথা শোনার জন্য বিশ্বাসের জন্ম হবে।চিঠি দিয়ে ছোড়দা জানিয়েছে ওরা সেই চেষ্টাই করছে।
অবশ্য গ্ৰামে কাজ করতে চাইলে ছোট বুলাদার মতে সবাইকে ডাক্তার হতে হবে এর কোনো মানে নেই। গ্ৰাজুয়েশান বা মাস্টার ডিগ্রী করেই গ্ৰামের দলছুট বাচ্চাদের পড়ানো বা নাইট ইস্কুল চালিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে বিশ্বাস অর্জন করাও যায়। ভারি মনে ধরেছে ছোট বুলাদার কথাগুলো।
মেডিকেল সাইন্স পড়তে ঝিনির ইচ্ছেও নেই।সে ঠিক করেই নিয়েছে ডাক্তারি পড়তে সে যাচ্ছে না।তবু জোরজার করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য
বাবা তাকে পাকড়ে নিয়ে চলেছে পিসতুতো দাদার বাড়িতে।
ইংরেজির শিববাবু স্যারকে ধরে এনে অনেক ভুজুংভাজুং দিয়ে এন্ট্রান্সের আ্যডমিটের জন্য দিয়ে সই করানো হয়েছে।
দুচারটে জামাকাপড় ব্যাগে ভরে গলায় অদৃশ্য এক দূরবীন ঝুলিয়ে ঝিনি অতীত না ভবিষ্যের দিকে যাবে ঠিক করতে না পেরে চেপে বসেছে বনগাঁ লোকালে।
বড় হচ্ছো ঝিনুক মা, বুঝতে চেষ্টা করো আমাদের দেশে, শুধু এ দেশেই বা কেন সারা দুনিয়ায় মেয়েদের সম্মান আদায় করতে অনেক কষ্ট করতে হয় আর তার প্রথম ধাপটাই হলো রোজগার।ডাক্তারি প্রফেশনে আর্থিক স্বাধীনতা পাবে অনেক সম্মানের সাথে।অরু মিতু ডাক্তার না হয়ে অন্য জীবিকা বেছে নিলেও আমার কিচ্ছু যেত আসত না।
বাঁচার জন্য রোজগারপাতি তো সবার দরকার তা আমি করবোও কিন্তু মেয়েদের জন্য সেটা আলাদা নাকি? ঝিনি ফোঁস করে ওঠে। একটু হাসলো তাদের বাবা।দল বেঁধে অর্ধেক আকাশের গান যতই গাও সমাজটা আজো পুরুষরাই শাসন করে ।পায়ের তলায় মাটি খুঁজে নিতে মেয়েদের তাই অনেক বেশী করে লড়াই দিতে হয়। নিজেকে তৈরি না করতে পারলে কোনো কাজই ঠিক করে হয়ে ওঠে না।মুখ বন্ধ করে ঝিনি চলন্ত জানলার বাইরে তাকায়।
মা'র কড়া মেজাজের কারণে ঝিনি বরাবর বাবার কোলঘেঁসা।আদর আবদার তার বাবার কাছেই। বাবার সঙ্গে না বলা একটা চুক্তিও আছে।নিজের কাজের পেছনে যুক্তি ঠিকঠাক থাকলে একে অন্যের কাজ মেনে নেবে তারা।
কিন্তু এই মুহূর্তে ইচ্ছেগুলো ছাই যুৎসই যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে গত রাতে মা'র নিজের কথা শুনে অব্দি ঝিনির অনেক কিছুই জট পাকিয়ে গেছে। উত্তর না দিয়ে তাই সে দূরবীনে চোখ রাখে।
কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলছলে... সন্ধেবেলা চুল বাঁধছে মা।গলায় গুনগুন সুর।গা ধুয়ে কাপড় বদলেছে বলে কিউটিকুরা পাউডার আর লিরিল সাবান মেশানো গন্ধ আসছে গা থেকে।ঝট করে ঝিনির চুলটা আঁচড়ে পাউডার পাফ বুলিয়ে দিল। কিন্তু সোনার বরণী মেয়ে/বলো কার পথ চেয়ে/আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া শুনেই ভুরু কুঁচকে যায় তার। নিশ্চয়ই দুঃখী কোন্ রাজকন্যের গান গাইছে মা।তাই ছোট মেয়েটা বলে বাজে গান এটা। তুমি ওই গানটা গাও না।কোনটা?ওই যে ওগো আমার কোকিল কালো মেয়ে...মা যেই গাইল শঙ্খ নদীর দুধারেতে কাশের বন বেয়ে/আবার এলে এ কোন সুরে গান শোনাতে ... অমনি সে দেখতে পেল নদীর ধার দিয়ে ধার দিয়ে শেষ দূর অবধি ফুটে গেছে কাশ।একটা ছোট মেয়ে ছুটে আসছে সেখান থেকে। মা কালো বললেও যে রাগ করে পা ঠোকে না।
স্কেলপেটা প্রবল বকুনি আর গনগনে চোখের উল্টোমুখো দূরবীনটা বসিয়ে ঝিনি দেখতে পায় সস্তা ছিটের ফ্রক গায়ে বগলে চাটাই জড়ানো কাঁথা বালিশ আর একখানা পাতলা কাঁসার থাল আর খানকতক বইখাতা নিয়ে ছোট এক মেয়ে চলেছে মাস্টার মশাইয়ের পেছু পেছু।
আশুবাবু লম্বা লম্বা পা ফেলে হনহনিয়ে চলেছেন।বিছনাকাঁথা বইপত্তর সামলে বারবার পিছিয়ে পড়ছে মেয়েটা। তার ওপর এক সাইজ বড় হাওয়াই চটিটাও পা থেকে খুলে খুলে আসছে। এই চটি তো সমস্যা করছে।একটু না বেশী সমস্যা।চটি তার নয়।চটি হলো বিন্দুর।বড় চটি পরে হাঁটার ঝকমারি আছে।
ওদিকে তরাতরি আউগা বলে কিছুদূর হেঁটে আশুবাবু পেছন ফিরে ফিরে হাঁক পাড়ছেন আর অচেনা সদরে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে দৌড়ে দৌড়ে তার নাগাল ধরছে মেয়ে। খালি পায়েই তো হাঁটা অব্যেশ। চটি পরে আবার হাঁটা যায় নাকি তাও আবার অন্যলোকের বড় হোগলবোগল চটি পায় দিয়ে?নরেরকাঠি গ্ৰামে জ্ঞাতি গুষ্টি নিয়ে তাদের পাড়া। এই যে সে সুতির ফুল ছাপ ছিটের ফ্রকটা পরে চলেছে এই জামাটাও পিসাতো দিদি বিন্দুবাসিনীর। বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাবে বলে জামা আর চটি সে দিদির কাছে চেয়ে এনেছে।
নারকেল পাতার কাঠি বিককিরি করে পঁচাত্তর নয়া পয়সা জমিয়ে ছিল আর তার মা দিতে পেরেছে আরো পঁচাত্তর।তার মধ্যে একটাকা দিতে হলো আশু বাবুকে পরীক্ষার ফি আর রাহা খরচ বাবদ। মাস্টার মশাইয়ের কুটুমবাড়িতে তিন দিন থেকে পরীক্ষা দেবে সে।বৃত্তি পেলে ইস্কুলের নাম হবে বলে হেড মাস্টার মশাইয়ের কথামতো আশুবাবু তাকে নিয়ে যাচ্ছেন ঝালকাঠির সদরে।
মাস্টার মশাইয়ের কুটুমবাড়ি তাই থাকা খাওয়া ফিরি বটে কিন্তু এ বাড়ির বউ কেমন ভারি মুখ করে তাকে ভাত দিতে আসে। শাঁখা রুলি আর সোনার তাগা পরে বগি থালায় ভাত তরকারি এনে বারান্দার কোণে বসা ছোট মেয়ের থালে আলগোছে সব ঢেলে দেয়। খেয়ে উঠে বাসন মেজে খাবার জায়গা গোবর দিয়ে নিকিয়ে দিতে হয়। প্রথম দিন দুই হাফে পরীক্ষা দিয়ে হেঁটে ফিরতে ফিরতে শীতের বেলা গড়িয়ে সন্ধে হলো। সে দেখল খেজুর পাতার চাটাই জড়ানো তার ছোট্ট বিছানা পড়ে আছে হিম উঠোনে।
চাটাইখানা কুড়িয়ে এনে দাওয়ায় পেতে কাঁথা জড়িয়ে ভয়ে আর অনেকখানি অভিমানে কাঁপছিল ছোট সেই মেয়ে। বালিকা বয়সের অপমান জেদের জন্ম দিচ্ছিল। খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠছিল সেই মেয়ে। চারধারের অনেক না-এর সামনে দাঁত চেপে লড়াইয়ের জন্য মেধা ছাড়া কোনো হাতিয়ার না পেয়ে সেটাকেই ঘষে মেজে সে শানিয়ে তুলছিল।
অত ভাবনার কিছু নেই ঝিনুক মা, বাপির কথায় ট্রেনের জানলা থেকে ঘুরে আনমনে তাকালো সে। কিছু বলছো? বলছি ভয় পেয়োনা তোমার যা প্রিপারেশন আছে চান্স পেয়ে যাবে। আবছা হাসলো ঝিনি। বইপত্তর নিয়েছো তো ? নিয়েছি। কিন্তু তুমিই বা অত ভাবছো কেন বাপি? অন্যমনস্কভাবেই বলে সে।না না এমনিই বলছিলাম আর কি।আর জামাকাপড় কিছু নিলে?ধলুর ওখানে দিন দুই থাকতে হবে তো।তোমার মাকেও জিজ্ঞেস করা হলো না। তাকে আবার ডি আই অফিসে যেতে হয়েছে আজই। নিয়েছি নিয়েছি জামা টামা বলতে বলতে আবার তার চোখ চলে গেল দূরবীনে।
কাল রাতে মা'র গল্পে যে মেয়েটার সঙ্গে নতুন আলাপ হলো তাকেই সময়ের এপার থেকে মন দিয়ে দেখছে ঝিনি।
দেখল একটা পুরনো জামা ফড়ফড় করে খুলে জামার কাপড় কিভাবে কাটে দেখে নিয়ে মার্কিন কাপড়ের ওপর ফেলে কাটারি দিয়ে কেটে হাতে সেলাই করে নিজের আর ছোট দুই বোনের জামা বানিয়ে নিচ্ছে মেয়ে। সস্তায় পড়ে বলে একই মার্কিন কাপড়ের দুখানা করে জামা বানিয়ে গায় দিচ্ছে তাও বইখাতা ছাড়ছে না।
ফোর,সিক্স, এইট এবং ম্যাট্রিকে বৃত্তি পাওয়া মেয়েটাকে তবু ফাইভ থেকে সিক্সে ভর্তি হতে একবছর অপেক্ষা করতে হলো। কারণ দাঙ্গার বছরে ফসল না পেয়ে তারা আরও গরীব হয়ে যাওয়ায় বই কেনা হয়নি। সহপাঠীরা পাশ করে সিক্সে উঠে গেলে ক্লাসের নারানের কাছে অল্প পয়সায় ফাইভের বই কিনে জিদ্দি মেয়ে আবার ভর্তি হলো বড় খালের ওপারে আপার প্রাইমারি ইস্কুলে। খাল বিলভরা বাংলাদেশের অজ পাড়া গাঁয়ে খেয়ে না খেয়ে তবু লেখাপড়া সে করবেই।
নৌকো পেরোতে পয়সা লাগে বলে সহপাঠীদের কাছে বইখাতা শুকনো জামা দিয়ে খাল সাঁতরে পার হয়ে ভেজা জামা ছেড়ে শুকনো কাপড় পরে ইস্কুলে ঢুকতো। পরপর কদিন দেখে মাঝি তাকে মিনিমাগনায় পার করা ধরল।
প্রথম প্রথম হস্টেলে থাকতে একটু কষ্ট হবে কিন্তু পরে দেখবে কত নতুন বন্ধু। সবার সঙ্গে মিলেমিশে কত মজা লাগবে দেখো হস্টেলে। ইচ্ছে হলেই দাদাদের মতো বন্ধুদের নিয়ে শনি রোববার দেখে হুট করে বাড়ি চলে আসবে।
শুনতে পাচ্ছি না তো ও বাপি?আমায় কিছু বলছো? চলন্ত জানলার হু হু হাওয়া উড়িয়ে নিচ্ছে তাদের বাবার আদ্ধেক কথা।
হস্টেল নিয়ে কী কথা বলো তুমি? গলা উঁচু করে বাবা,বলছি আমিও তো হস্টেল থেকে পড়েছি কলেজে। তোমাদের মা তো একেবারে স্কুল থেকেই। সঙ্গী সাথীদের নিয়ে খুউব মজা হয় কিন্তু।
ঠিক ঠিক।ছোট থেকেই হস্টেলে তাই না?বলে বিড়বিড় করে ঝিনি।সেই ছোট মেয়েটা তো ক্লাস সেভেন থেকে হস্টেলে। যেই মেয়েদের হস্টেল খুলে গেল তাদের ইস্কুলে আর ভালো রেজাল্টের জন্য হেডস্যারও সবকিছু ফ্রি করে দিল তার, বইপত্তর ,কাঁথা বালিশ পুঁটলি করে আর মুড়ির টিন হাতে করে হস্টেলে ভর্তি হয়ে গেল।সে অবশ্য একা গেল না ঘেঁটি ধরে ছোট বোন দুটোকেও তাদের দরমার বেড়া আর মাটির মেঝের হস্টেলে নিয়ে তুলল। নতুন হস্টেলে বোর্ডার কম বলে তাদেরো নিয়ে নিল হেডস্যার শর্ত একটাই ইস্কুলের গ্ৰান্ট পেতে চাই ভালো রেজাল্ট। স্যারদের মুখ রক্ষে করেছিল ভাগ্যিস।
পাস দিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলে পাড়া পিতিবেশী ভিড় দিয়ে এল বাড়ি। বাহবা টাহবা নয় ভয়ানক উদ্বেগে ভুগে ভুগে পড়শীকুটুমরা শেষটায় তার বাপকে ধরে পড়ল। আক্কেল দেহি কিছুই হয়নায় তোমাগো।ল্যাহাপড়া শিইখ্যা অহন ঢাকায় যাইব মাইয়া তোমার?আ্যতো বিদ্যধরীরে বিয়া দিবা কাইর লগে ভাবছো নি?
আ্যতফোর ডাঙ্গর হইছে কুদু আফন ক্ষমতায়। দাদুভাই বলল,অর ল্যাহাপড়ায় মুই সাহাইয্য করতেও পারি নাই।মোর পুত্রসমান মাইয়া নিজো চ্যাষ্টায় আ্যতোদূর গ্যাছে যদি ;অরে মুই বাঁধা দিমু না। দাদুভাইয়ের কথায় খোলা আকাশের তলায় মাথা খাড়া রেখে রাজধানী শহরে পা রাখল মা।
ঝিনির গম্ভীর রাশভারি মা কাল রাতে শুয়ে শুয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে সব দূরত্ব সরিয়ে কাছে এসেছিল তার।
এম এ পার্ট ওয়ান পড়ার পর খরচ বাড়লো আর তোদের বাবার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধটাও এল। বিয়ে করবার একটাই শর্ত দিলাম পার্ট টু টা পড়াতে হবে। তোদের বাবাও রাজী হয়ে গেল।
ছোট থেকেই সাইন্স নিয়ে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। স্বপ্ন দেখতাম ডাক্তারি পড়ার। কিন্তু ডাক্তারি পড়ার খরচ চালানো তো যাবে না ভেবে ওসব আকাশকুসুম কল্পনা হঠিয়ে আর্টসই নিলাম। আমার কোনো ছাত্রীও আজ অবধি ডাক্তার হলো না।লাজুক হাসছিল মা। সন্ধেবেলা যে মা কড়া গলায় বলছিল,ভেবেছো আঁচলের তলায় রেখে দেব? বাঁকুড়া বর্ধমান নর্থবেঙ্গল যে মেডিকেলেই পাও ,যেতে তোমাকে হবেই আর শুনেই দাঁত কিড়মিড় দিচ্ছিলো ঝিনি। কিন্তু এখন এই মাঝরাতের মাকে বেজায় অসহায় লাগল তার।
একজনের স্বপ্ন আরেক জনের চোখে দেখা সম্ভব কি? তবু নরের কাঠি গেরামের রায় বাড়ির মনসা মন্দিরের ধারে ধারে যা কিছু কুড়িয়ে তোলা বকুল মা ছুঁড়ে দিয়েছিল ভাঙা ঘাটলায়, আজ আবার তা বেঁধে দিল চিনির উচ্চমাধ্যমিকের ওড়নায়, সে কীভাবে খুলবে সেই গিঁট?
আর তিন বছর পর আজ এই ঝড়বিষ্টির রাত্তিরে দেখো মার চোখে অবিকল সেই শুকনো বকুল ফুলের সৌরভ হালকা কাজলের মতো লেগে আছে। বাইরে মেঘ ডেকে উঠল। মাকে জড়িয়ে সে লম্বা শ্বাস নিল। করিস কী ছাড় ছাড় জানলাটা বন্ধ করি।আসুক না বিষ্টির ছাঁট মা। একটুখানি আসুক।জানলায় কপাটে হাত দিয়ে বাইরে তাকালো মা। ছোট পুকুর পাড়ে বকুল গাছটায় এবারই ঝেঁপে ফুল এসেছে জানিস?
0 Comments