জ্বলদর্চি

জাদু-নগরী /পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

জাদু-নগরী

পুলককান্তি কর

‘লেকে পহলা পহলা প্যায়ার/ ভরকে আঁখো মে ফুঁ মার/ জাদু-নগরী সে আয়া হ্যায় কোই জাদুগর...’ ব্রেকফাষ্ট বানাতে বানাতে ইউটিউবে গানটা চালিয়ে রেখেছে মিনু, আমার গিন্নী। রোজ সকালে তার এই এক অভ্যেস। গানটা শুনতে গিয়ে হঠাৎ করে ভেতরটায় কেমন শূন্য হয়ে গেল আমার। সত্যি সত্যি কোন সে জাদু-নগরী আমরা লালন করে চলেছি প্রতিনিয়ত রোজকার অন্ধকারে, তার আর হিসেব পাইনা। কখনও বছরে, কখনও মাসের কোনও একদিন হঠাৎ চোখ বন্ধ করলে সেই জাদু নগরীর ঝলক পাই, আবার কখন যেন সে হারিয়ে যায় তার দরজা জানালা সব বন্ধ করে। গিন্নীর হুকুম হয়েছে আজ পয়লা বৈশাখ, সুতরাং বাজারে বেরিয়ে একটু খাসির মাংস আর এটা ওটা নিয়ে আসতে হবে, যদিও এই দিনে বাজার যেতে একদম ইচ্ছে করে না আমার। একে তো বেজায় ভিড়, আর তার উপর আজন্ম এক সংস্কার – নববর্ষে যা করি, তারই অনুবর্তন চলে সারা বছর … বাজারে যেতে একদমই ভালো লাগে না,  কিন্তু উপায় কি! বাড়ীর সামনের গেট খুলে একজন বয়স্ক লোককে ঢুকতে দেখে একটু অবাকই হলাম! দেখে তো ভিখিরি মনে হচ্ছে, কিন্তু চলন বলনটা ঠিক তেমন নয়। ভদ্রলোক একটু দোনামনা করে বললেন, ‘মা জননী একটু সিধা দিবেন? আপনারা হইলেন গিয়া আমাগো যজমান বংশ’। 
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনার নাম?’
এজ্ঞে, হারু চক্কোত্তি! আমারে আপনার বাবা চিনতেন! কার্ত্তিকবাবু কি এখনও বেঁচে?
না। তিনি প্রায় দশ বছর আগে গত হয়েছেন।
বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে হারু চক্কোত্তি বললেন, মশায় আপনে আমায় চিনতে পারতাসেন না? আপনে যখন ছোট্টটি আসিলেন, আমি বচ্ছরের প্রথম দিন আইস্যা আপনাগো বর্ষফল শুনাইয়া যাইতাম।
ও আপনি কথকঠাকুর! হ্যাঁ এবার একটু একটু মনে পড়ছে। কিন্তু আপনার চেহারাটা একদম ভেঙে গেছে!
তা আর ভাঙব না! ছিলাম কথক, এখন ভিখারী। আজকাল আর বর্ষফল কেডায় শুনতে চায়! সবই মোবাইল!
কথাটা সত্যি। আগে একটা পঞ্জিকা বেরোতো চৈত্র মাসের সংক্রান্তির আগে আগে। মোটা বই, সবার কেনার সামর্থ্যও হত না। তখন এই কথক ঠাকুরেরা পঞ্জিকা থেকে বর্ষফল, মাসের ফল, দেশের ভাগ্যের বিধান দিয়ে যেতেন। দেবী ঘোড়ায় আসবেন, নাকি দোলায় – সেই হিসেবে ঠিক হতো সে বছর খরা হবে নাকি দুর্ভিক্ষ – সেই দিন আর নেই। কথকঠাকুর এই বাবদ কিঞ্চিত দক্ষিণা নিয়ে বিদায় নিতেন – বৃত্তিটাই লুপ্ত হয়ে গেল। আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ‘তা আপনি একটু বর্ষফল শোনাবেন নাকি’?
কী কইরা শুনামু বাবা, হাতে তো পঞ্জিকা নাই!
আজকাল তো ছ’মাস আগেই পঞ্জিকা বেরিয়ে যায় – 
হারু চক্কোত্তি কথা শেষ হতে দিলেন না, বললেন, কেডায় শুনবো বাবা? ওই কডা টাকাও নষ্ট!
তা আপনি এতদিন পরে কোত্থেকে উদয় হলেন?
বহু জায়গায় ঘোরাঘুরি কইরা আসামে থিতু হইসিলাম বাবা, ওইখানে আবার কাগজ দেখতে চায় – আইজকাল এন.আর.সি. না কীসব হইসে – এই জীবনডায় আর থিতু হওয়া হইল না রে বাপ! কী যে পাপ আছিল আগের জন্মে!

🍂

এই আফসোস আমি প্রায়ই শুনতাম বাবা বেঁচে থাকতে। যে কোনও কথার প্রেক্ষিত খুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন আমাদের একখান দেশ আছিল! শেষ দিকে কথাটা আর বলতেন না, দীর্ঘশ্বাসটুকুই দীর্ঘতর হত! হারু চক্কোত্তি কথার খেই ধরে বললেন, দারিদ্র হয়তো বা আছিল, কিন্তু বড় সুখ ছিল রে বাপ! ওইখানডার হাওয়াতেই সুখ, নদী দেখলে মনে হইত জীবনডা যেন স্থির হইয়া বইয়া চলতাসে – তোমাগো বাড়ীডা মনে পড়তাসে বড়! তুমি কি দেখস সেই ঘর?
আমি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালাম, বললাম, কিছুটা শুনেছি! হারু চক্কোত্তি উদাস হয়ে গেলেন ঘোরে … যেন বিুস্মৃতিগুলোকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। ওঁর চোখে যেন পরতে পরতে সেই আলোর ছায়া সরে সরে যেতে লাগলো। বললেন, ‘বাড়ী তো নয়, প্রাসাদ। দুপুর-রাত্রতে খাবার লিগা ঘন্টা বাজাইতে হইতো ইস্কুল বাড়ীর মতো- বড় কত্তা হুঁকাডা লইয়া মস্ত একডা আরাম কেদারায় ভুড়ুর ভুড়ুর ধুঁয়া উগরাইতেন, কথা কইতেন না বড় একডা … শুধু চক্ষু দুইডা এধার ওধার হইতো …
ইচ্ছা হল বলি দুপুরে একটু ডালভাত খেয়ে যান, কিন্তু গিন্নির ভাবগতিক দেখে বলার সাহস হল না। একটু চাল কলা আলু সাজিয়ে গিন্নি সিধে সাজালেন, আমি উঠে গিয়ে আড়াল করে একশোটা টাকা দিয়ে বললাম, ‘ঠাকুরমশায়, সময় পেলে আবার আসবেন’।
বোধহয় আর হইয়া উঠবো না বাপ! আমি আর কলকাতায় থাকুম না, দু-চারদিনের মধ্যেই ফিইরা যামু!
কেন?
যজমান বাড়ী ত চিনতেই পারি না। সবই ফ্ল্যাট। যদিও বা জিগাইয়া টিগাইয়া খোঁজ পাই, তারাও চিনতে চায় না। শ্রদ্ধা সম্মান তো দূর থান! এই বয়সে আইসা এই ভিক্ষাবৃত্তি আর মনে লয় না। আসামে বইস্যা ভাবতাম, একবার কইলকাতা যাই, হয়তো বুড়া বয়সে ওইখান গিয়া পরানডা জুড়াইব, কিন্তু এ যে আরও কালি!
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হারু চক্কোত্তি আরও বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওপারে বড় মায়ার দ্যাশ আছিল বাবা, একবার চুরি কইরা বি.এস.এফ.রে ধইরা গেসিলাম ওইপার – কোথায় মায়া, কোথায় সেই সুর! সেই দ্যাশটাই যেন জাদুর মতো উইরা গ্যাসে!
আর দেরী করা চলে না। গিন্নির চোখে দিব্যি তাড়া দেখতে পারছি; তাছাড়া আমার ওবেলা একটা সান্ধ্য অনুষ্ঠানও আছে মহামায়া তলার কাছে। মনটা ভারি হয়ে গেল বেশ। আর তাছাড়া বাজারে খাসির দোকানে লাইন পড়ে গেছে এতক্ষণে নিশ্চই!
(২)
মহামায়া তলার নাম শুনলে বুকের ভেতরটা বড় মোচড় দিয়ে ওঠে। এখানে এসেছিলাম বত্রিশ বছর আগে গৌরীর বিয়েতে কন্যাযাত্রী হয়ে। তারপর মনে মনে এসেছি কতবার। গাড়ী থেকে নামতে অনুষ্ঠানের কর্মকর্তা বললেন, এবছর করোনা পরিস্থিতিতে অবস্থা এমনিতেই খারাপ, তার উপর ভোটের পঞ্চম দফার প্রচারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এমন দাপাদাপি, এবার আর ঘটা করে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হবে না। সময় মতো আপনাদের জানাতেও পারিনি, কেননা, পুলিশের থেকে আমদের কাছে বার্তা এল ঘন্টা দেড়েক আগে। চলুন বরং ক্লাব ঘরে বসে ঘরোয়া বৈঠক করি। আমি একটুক্ষণ বসে বললাম, আপনারা বৈঠক করুন, আমি আজ উঠি। আমার অন্যত্র যাওয়ার আছে।
কলকাতার অলিগলি সব বদলে গেছে। মহামায়া তলার সেই রাস্তাঘাট, সেই দিক নির্দেশ কিছুই আর আগের মতো নেই। বত্রিশ বছর বড় কম সময় নয়। অনুমান করে একটা তিন রাস্তার মোড়ে গলির মুখটায় এসে দাঁড়ালাম। চারপাশে বিরাট বিরাট ফ্ল্যাট। তবু ভাগ্য ভালো, তেতলা একটা বাড়ী এখনও কোণাটায় দাঁড়িয়ে – বত্রিশ বছর আগে আলোর রোশনাইতে প্যাণ্ডেলে ফুলে বাড়ীটা কেমন ছিল, মনে নেই এখন। পথ চলতি লোককে জিজ্ঞেস অরে জানা গেল এটাই গৌরীর শ্বশুর বাড়ী। কলিং বেলে হাত দিতে গিয়ে নিজের বুকের ধড়ফড়ানি দেখে অবাক হলাম। এতদিনে কি উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি, নাকি দীর্ঘদিন জানলা দরজা বন্ধ করে রাখা ঘরের দ্বার হঠাৎ খুলে দিলে যেমন করে দুনিয়ার বাতাস জোর করে ভেতরের গুমোট হাওয়াকে বের করে দিতে চায়, সেরকম চাপা কৌতূহল, হতাশা এসে দাঁড়িয়ে আছে আমার আঙুল আর হৃদয়ের মাঝখানটিতে! বোধহয় একজন কাজের মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গৌরী আছেন’?
মহিলা কোনও কথা না বলে ভেতরে চলে গেলেন। একটুবাদে যে সামনে এসে দাঁড়ালো, সে গৌরীই বটে! দু-একটা চুলে পাক ধরেছে, আগের মতোই উজ্জ্বল রঙ, অল্প পৃথুলা, সেই আগের মতোই গভীর চাউনি নিয়ে তাকিয়ে রইল দু-একক্ষণ।
চিনতে পারছো? আমি ব্রজদা।
কোনও উচ্ছ্বাস কিংবা আশ্চর্য হওয়ার লক্ষণ চোখে পড়ল না আমার। এ যেন অতি প্রত্যাশিত, অথবা এই আসা না আসা গৌরীর জীবনকে যেন ছুঁতেই পারে না! খুব শান্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘এসো’।
মস্ত সাজানো সুন্দর ঘর। আমি জানতামই খুব পয়সাওয়ালা বনেদী ব্যবসায়ী বাড়ীতে বিয়ে হয়েছে গৌরীর। একটু পরেই চা নিয়ে এলো গৌরী – দক্ষিণ কলকাতার কেতা মেনেই।
টি-পট, সুগার কিউব আলাদা, কাপ প্লেট সুন্দর করে সাজানো। বলল, চিনি খাও তো?
জীবনে তো ওটুকুই মিষ্টি!
চুপচাপ চা বানাতে লাগলো গৌরী। আমি একটু অসহায়ের মতো বললাম, ‘তোমাকে বিব্রত করলাম না তো’?
কিসের বিব্রত?
না মানে – আজ বত্রিশ বছর বাদে – পাড়াতুতো কেউ এসেছিল তোমার ঘরে – তোমার স্বামীকে কী জবাব দেবে?
সেই চিন্তা করতে হবে না!
তোমার স্বামী এখন কোথায়?
গৌরী আঙুল তুলে দেওয়ালের একটা ফটোর দিকে নির্দেশ করলো। আমার চোখ গেল সিঁথি আর হাতের মনিবন্ধের দিকে। চিৎকার করে বললাম, ‘সে কী? কবে?’
বিয়ের সাত বছর পর। হঠাৎ কিডনির সমস্যা ধরা পড়লো, তারপর যা হয় আর কি! যমে মানুষে কয়েক মাস … শেষ রক্ষা হয় নি!
তোমার ছেলেপুলে?
একটি ছেলে। পৈতৃক ব্যবসা দেখে।
সে না হয় এখন! এতদিন কে দেখতো?
শ্বশুর মশাই যতদিন বেঁচেছিলেন, তিনি দেখতেন। তার পর আমি।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আমি কিছুই জানতাম না’।
জানলেই বা আর কী!
কথাটা ঠিক। জানলেই বা কী করতে পারতাম আমি? সামনে এসে হাতটা ধরতে চাইতাম? পথের কষ্ট লাঘব করতে চাইতাম নানান ছলে? হয়তো এই ভালো; লক্ষ্যটা কখনও দ্বিধার সামনে দাঁড়ায়নি কোনওদিন। গৌরী একমনে তার অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছে নিঃসংশয়ে!
তোমার ছেলের বিয়ে হয়েছে?
হয়নি এখনও। দেখাশোনা চলছে।
ওর পড়াশুনো?
বি.টেক. পাশ করেছে। তারপর ফ্যাশন ডিজাইনিং-এর উপর একটা মাষ্টার্স কোর্স করেছে।
বাঃ খুব ভালো লাগলো শুনে।
তুমি আজ হঠাৎ এদিকে এলে কী মনে করে? কোনও অনুষ্ঠান ছিল বুঝি?
তোমার এমন অনুমানের কারণ?
তোমার আজকাল কাগজে টাগজে লেখা বেরোয় তো! তোমার অনেক নামডাক। তাই কিছুটা খবর টবর পাই।
ঠিকই ধরেছ। মহামায়াতলায় একটা অনুষ্ঠান ছিল আজ, যদিও কিছু অনিবার্য কারণে তা বাতিল হয়েছে।
তোমার মায়ের মৃত্যুর খবরটা পেয়েছিলাম। তুমি জানাওনি যদিও, ভেবেছিলাম শ্রাদ্ধের কাজে যাবো। আমাকে তো খুব ভালোবাসতেন তিনি। সেইসময় তপুর বাবারও খুব বাড়াবাড়ি, হাসপাতালে ভর্তি,  সারাদিন ঘর আর হাসপাতাল করতে করতে যাওয়া আর হয়ে ওঠে নি।
চুপ করে বসে রইলাম। মা গৌরীকে খুবই ভালোবাসতেন। গৌরী ওঁর ‘গঙ্গাজল’ সই কৃষ্ণামাসীর মেয়ে। পাশের পাড়াতেই থাকতো ওরা। ছোটবেলায় খেলাধূলো – লুকোচুরি, বুড়িবসন্ত – সবকিছুতেই গৌরী ছিল আমার চ্যালা। কৈশোর পেরিয়ে যখন তরুণী হল গৌরী, একদিন আচমকা শাড়ীতে দেখে মা সাধ করলেন ওকে ছেলের বৌ করবেন। বাবা তখনও বেঁচে। বললেন, ‘সবুর ধরো। পোলার কানে তুইলো না এখন। পড়াশুনা ডকে উঠবো’। পড়াশুনো এমনিতে আমার ডকেই উঠেছিল বহুদিন। লুকিয়ে চুরিয়ে সাহিত্য সেবা করছি ভেবে আত্মপ্রসাদ বোধ করতাম ঠিকই, কিন্তু বি.এ. পাশ করে আর এম.এ.’র দরজা খুললো না। গৌরীর অনেক সম্বন্ধ আসতে লাগল। কৃষ্ণামাসী একদিন মুখ ফুটে বলেই ফেললেন, ‘কী লো সই, গৌরীর বাপরে যে আর ঠেকাইতে পারি না! হ্যাঁ কি না, কিছু একডা তো কইবা’! মা নিরুপায় হয়ে আমায় বললেন, আমি তখন আকাশ থেকে পড়লাম – ‘গৌরী? ওকে আমি বিয়ে করবো’?
কেন? না করার কী আসে? অরে তোর পছন্দ নয়?
আরে ও তো গৌরী! ওকে পছন্দ অপছন্দের প্রশ্ন আসে কোত্থেকে?
অর বিয়ার বয়স থাইম্যা নাই! কিছু একডা তো কইতে হইব।
না বলে দাও। ওকে বিয়ে করার কোনও প্রশ্নই নেই।
মা হতাশ হলেন। আমি জানতাম না গৌরী সেদিন পাশের ঘরেই ছিল। নিজের কানেই শুনেছিল সব। যেদিন ওর বিয়েটা হয়ে গেল, সেদিন মনে হল, গৌরীকে বাদ দিয়ে আমার জীবনটা একেবারেই বৃথা! সিগারেট কেনার পয়সা ছিল না তখন। বিড়ি খেতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে অনুভব করলাম মায়ের থেকে লুকিয়ে দেশলাই এনে দেওয়ার লোকটাই সাথে নেই। ছেলের বেকারত্ব নিয়ে বাবার ধিক্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কথা শুনবার ধৈর্য্য এবং সহিষ্ণুতার মানুষটাই নেই। মনের ভেতরে যে জগৎটা ছিল, তার মধ্যে কে যে মন্ত্র বলে আমার চোখ কানা করে রেখেছিল, টের পেলাম অনেক পরে। তখন বুঝলাম, এত ভালোবাসা আমি জীবনে কাউকে বাসিনি। তবু একথা বলা হবে না কোনওদিন।
গৌরী বলল, ‘তোমার চেহারাটা এমন বুড়িয়ে গেছে কেন ব্রজদা? তোমরা হলে সেলিব্রিটি মানুষ! এমন রুক্ষ চুল, গাল ভাঙা মুখ – দেখলে চেনাই যায় না। কেমন বাহারী চুল ছিল তোমার – হিপিদের মতো টেরি বাগাতে’!
কালস্রোতে তো সবই যায় গৌরী! জীবন-যৌবন-ধন-মান, সবই পদ্মপাতায় জল। স্ট্রেসও তো কম নয়!
সবই ধরে রাখতে জানতে হয় ব্রজদা। তোমরা শব্দ অক্ষরে এত জাগলারি খেল, জীবনকে নিয়ে খেলতে পারো না?
কীভাবে খেলব? ওই খেলাটা তো উনি খেলেন!
নিশ্চই! কিন্তু আমাকে নিয়েই যখন খেলা, আমি নিজেও কি একটু খেলে নেব না?
বুঝলাম না গৌরী! তোমার জীবন তো আরও বড় ঝড় গেছে; তুমি তোমার কষ্ট, তোমার একাকীত্ব কিভাবে সামলেছো?
জানো ব্রজদা, আমি জানিনা তুমি বিশ্বাস করবে কিনা? তুমি কবি মানুষ, এসব কথা তুমিই লিখেছ, আমি সেটা করে দেখেছি মাত্র … 
কোন কথা?
তুমি একটা কবিতা শুনিয়েছিলে মনে পড়ে? আমার বিয়ের আগে? ‘যে কথা তোমায় বলতে পারি না মোটে / সে কথা আড়ালে হাওয়াকেই বলে আসি / বিষাদে হয়তো আমার ফুরোত বেলা / সিন্ধু তখন শোক নিয়ে আগ্রাসী / তোমার সঙ্গে সেরে নিত বোঝাপড়া …’
মনে পড়লো, ব্যারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে একদিন লেখাটা শুনিয়েছিলাম গৌরীকে। ও যে বিরাট একটা কবিতা বুঝতো তা নয়, তবু কাউকে একটা শোনানো দরকার সেই লোভে শোনানো। বললাম, ‘ভালোই মনে রেখেছ। কিন্তু এর সাথে তোমার কথার মিল তো পেলাম না’!
জানো ব্রজদা, আমি যখন খুব কষ্ট পাই, দিশেহারা হয়ে যাই, আমার মনে অনেক কথা জন্ম নেয় – অথচ আমি কাউকে পাই না সে সব শোনাবার – তখন আমি হাওয়ার কানে কানে বলে দিই সব কথা… সত্যি সত্যি আমার সব কষ্ট কমে যায়!
আমি অবাক হয়ে গৌরীর দিকে চেয়ে রইলাম। গৌরী বলল, তুমি তোমার লেখায় এতবার ‘আয়না’ শব্দটা ব্যবহার কর। সব সময় আয়নার সামনে দাঁড়াবে। দেখছো না, আমার ঘরে কত বড় বড় আয়না? আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমি নিজেকে ফিরে পাই। তুমিও চেষ্টা কোরো, স্ট্রেস কমবে।
কী লাভ হয় এতে?
আয়নার মধ্যে একটা আলাদা জগৎ থাকে ব্রজদা। সেই জগৎটা আমাদের এই বাস্তব জগতের মতোই, তবে তার প্রতিচ্ছবি। তুমি এই জগতে যেভাবে থাকো, আয়নার জগতেও তোমার অস্তিত্বটা সেইরকমই। তুমি আয়নার সামনে দাঁড়ানোর অনেক আগে থেকেই তোমার চারপাশের প্রতিচ্ছবিগুলো ওই জগতে থাকে, তাই তুমি অনেক কথার আভাস পেয়ে যেতে পারো আগেভাগেই।
আমি অবাক চোখে তাকালাম গৌরীর দিকে। একটু চুপ থেকে বললাম, আমাদের ছোটবেলার একজন কথকঠাকুর এসে নববর্ষের দিন পাঁজি দেখে বর্ষফল শোনাতেন, তোমার মনে আছে?
আবছা আবছা মনে পড়ে।
জানো, আজ সেই কথকঠাকুর এসেছিলেন আমাদের বাড়ী!
ওমা! তাই নাকি? শুনলে বর্ষফল?
না। পাঁজ়ি কেনার আর সামর্থ্য নেই তাঁর! গৌরী তুমি বর্ষফল পড়ো কখনও পাঁজি থেকে?
না।
গ্রহ নক্ষত্রে তোমার বিশ্বাস নেই?
তুমি বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিতে বলে আমি কখনও বিশ্বাস করবার চেষ্টা করিনি। আজকাল তুমি মানো বুঝি?
কথাটা এড়িয়ে বললাম, জানো গৌরী, সকাল থেকে একটা কথাই বারবার মনে আসছে, ভদ্রলোক আজই বা কেন হঠাৎ এলেন!
ওটা কাকতালীয়।
দ্যাখো, ছোটবেলায় তো উনি বছরে একদিন এসেই কর্পূরের মতো উবে যেতেন কোনও অন্য জগতে … হয়তো সেটাই ছিল তাঁর বাস্তবের জগৎ ... হয়তো তিনি কোনও কল্পনার জগৎ খুঁজতে খুঁজতে আবার এসে পড়তেন আমাদের কাছে … হয়তো বোঝাতে পারছি না তোমায় …
ছাড়ো, গভীর কোনও লেখা ভাবছো হয়তো! অকারণ স্ট্রেস নিওনা।
তুমিই তো আমায় আয়নার অন্যপারের জগতের গল্প শোনালে গৌরী!
তুমি ইতিমধ্যেই অন্য জগতের গল্পে মেতে আছো, তাতো বুঝতে পারিনি ব্রজদা। ছাড়ো, কী খাবে বলো। মিষ্টি খাবে? তুমি তো ভালোবাসতে খুব!
সুগর ধরেছে।
চা-এ এত চিনি খেলে যে!
ওটা ছাড়তে পারি না।
তাহলে রাতের খাবার খেয়ে যেও!
না গৌরী। বছরের প্রথম দিন তো; মিনু অপেক্ষা করে থাকবে।
মিনু তোমার বৌ-এর নাম?
হ্যাঁ। ওর নাম মীনাক্ষি।
কিন্তু বছরকার দিনে তুমি কিছু না খেয়ে আমার বাড়ী থেকে যাবে? আমারই বা কেমন লাগবে?
তোমার বাড়ীতে পাতিলেবু আছে?
হ্যাঁ।
তাহলে সেই আগেকার মতো সরবৎ করে খাওয়াতে পারবে? আমি যখন টোটো কোম্পানির কাজ সেরে দুপুরে বাড়ী ফিরতাম, মা হয়তো রান্না সেরে গা ধুতে যেতেন, তুমি ঠাণ্ডা সরবৎ বানিয়ে আনতে – প্রাণটা কেমন জুড়িয়ে যেত! জানো গৌরী, ওই রকম সরবৎ কেউ বানাতে পারে না … ওই শীতলতা – ওই জুড়িয়ে দেওয়া … ওই নুন-চিনির প্রোপরশানটাই পারে না কেউ!
গৌরী বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই শ্বাসের মানে আমি বুঝি। সবটুকু অনুপাত নয়। হয়তো আজও সেই স্বাদ হবে না … অনেকখানি কাল এসে দাঁড়িয়ে পড়বে স্মৃতি এবং স্বাদ কোরকের মাঝখানে। বললাম, ‘তোমার আয়নায় কখনও পুরোনো দিনের ছবি দেখতে পাও গৌরী’?
আয়নার জগৎটা বর্তমানকে কেন্দ্র করেই ব্রজদা। ওটা প্রতিচ্ছবি জগৎ। অতীতও বলেনা, ভবিষ্যৎও বলে না। আমরা অনুমান নির্ভর প্রাণী বলে আগুপিছু আভাস পাই।
তুমি কি জানো গৌরী, আমাদের পৃথিবীর মতো আরো অনেক পৃথিবী আছে – যেখানে আমি আছি, তুমিও আছো … আমাদের ইচ্ছেগুলো আছে?
জানি না। এই সম্বন্ধে আমার কোনও ধারনাও নেই।
এই বিষয়টাকে মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্স বলে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় জায়গায় রীতিমতো এই নিয়ে গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে।
এসব তো ম্যানড্রেক-এর কমিকস্‌-এ পড়েছি মনে পড়ছে। 
হ্যাঁ, কমিকস বা সায়েন্স ফিকসনেই এইসব আমরা পড়েছি। কিন্তু ইদানীং পাঁচ পাঁচটা থিওরী দিয়ে কিছু বিজ্ঞানী  (ইনফাইনিট ইউনিভার্স, বাব্‌ল্‌ ইউনিভার্স, ডটার ইউনিভার্স, ম্যাথমেটিক্যাল ইউনিভার্স, প্যারালাল ইউনিভার্স) এই বিকল্প ব্রহ্মাণ্ডের স্বপক্ষে কথা বলেছেন।
ওই সব বিকল্প বিশ্বে কি এখন ঠিক এইরকমই হচ্ছে, যা এখানে ঘটছে? যেমন মনে করো তুমি আমার কাছে এসেছো, কথা বলছো?
বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন – ঘটনাটা একইরকম ঘটছে, কিন্তু হয়তো একটু আগে বা পরে। আবার কারোর ধারণা, আমরা জীবনে যত ইচ্ছে নিয়ে আসি বা চলার পথে আমাদের যে ইচ্ছেগুলো তৈরী হয়, তার প্রত্যেকটি কোনও না কোনও বিকল্প বিশ্বে সফল হচ্ছে।
তাহলে হয়তো কোথাও এখনও তপুর বাবা বেঁচে আছে?
হয়তো। বলেই খটকা লাগলো আমার। অনু বিশ্বে সময়ের আগুপিছু হয় শুনেছি, কিন্তু এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অতিরিক্ত দাম্পত্যও কি সম্ভব? বিজ্ঞানীরা বলছেন – সেসব বিশ্বে আলোর গতিবেগ আমাদের থেকে ভিন্ন, জাগতিক পরিমাপ আমাদের থেকে ভিন্ন। আর ইচ্ছেগুলোর কথা ভাবলে হয়তো কোনও এক বিশ্বে আমার সাথে গৌরীর দাম্পত্য চলছে এখন চুটিয়ে। এই কথা যদিও আমার মনে এল, গৌরীর এলো না। বা এলেও তার প্রকাশ নেই মুখে। এটা তো আমার প্রাপ্যই। একদিন যে প্রত্যাখানের বিষ পুঁতে দিয়েছিলাম ওর জঠরে, সেই বিষগর্ভা আজ যদি কেবল অন্য কোনও মায়ার পৃথিবীতে স্বামীর সাথে সংসারের স্বপ্ন দেখে – তাকে দোষ দেওয়া যায় না। আর বিকল্প পৃথিবীতে বিকল্প সম্পর্কের মোহ বিস্তার করাও কি আমার সাজে? আমি তো কেবল শব্দের জগতে বাঁচি। চোখ তুলে দেখলাম, গৌরী একদৃষ্টে চেয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে – হয়তো প্রতিচ্ছবির জগতে গিয়ে নিজের অবসাদ আর বিষন্নতা রেখে আসছে কিছু সময়ের জন্য। আমার কোনও প্রতিচ্ছবির জগৎ নেই, কোনও জাদুনগরী নেই – যেখানে আমি হারিয়ে যেতে পারি। আমি তো আসলে এক আকাশময় জগতে থাকি – যার তন্মাত্রিক প্রকাশ হল শব্দ। আমি কেবল মাঝে মাঝে মিনুর জগতে নেমে আসি, খাইদাই – আর শব্দগুলোকে লিখে রাখি। ভাবছিলাম, যাবার সময় আজ একটা পঞ্জিকা কিনে নিয়ে যাবো, কিন্তু এখন ভাবছি পৃথিবীর বর্ষফল নিয়ে মিছিমিছি মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?! আমি উঠে বললাম, চলি?
সরবৎ?
থাক! ওই স্বাদটুকু স্মৃতিতেই ভালো।
                                       

Post a Comment

0 Comments