জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত/মেমারি গেম। পর্ব ২

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
মেমারি গেম।  পর্ব ২


কত লোক আসে যায়, পারাপার করে, কিন্তু সবাই পারাপারে সফল হয় না। বেশিরভাগই হয় কিন্তু কেউ কেউ মিস করে যায়। আজ ছিল সুশান্তের মিস করার পালা। ট্রেন দেখার জন্য তাকাতেই হঠাৎ একটা মর্তমান কলার খোসার ওপর পা পড়েই পিছলে গেল। মনে হল তিনি এক মহাকাশযানে সওয়ার গেছেন বিনা টিকিটে, পৃথিবী প্রবল বেগে তাঁর কাছ থেকে দূরে, বহু দূরে সরে যাচ্ছে। জনতা দেখল একটি আধাবুড়ো মানুষ রাস্তার মাঝখানে স্কেটবোর্ডিং করতে করতে একটি তোবড়ানো জং ধরা বৈদ্যুতিক রিকশাকে দিলেন এক সজোরে ধাক্কা। রিকশার চালক তখন তার ইয়ারের পাঠানো একটি হোয়া মেসেজ সদ্য পেয়ে সেটা খুলতে ব্যস্ত। সন্ধ্যায় নিউ ইয়ার পার্টির জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এক মুহূর্তে ধুমধাড়াক্কা ধড়াম।

মহিমা যাচ্ছিলেন তাঁর মন্দিরে। তিনি একাকী বিধবা মানুষ। তাঁর ছেলে জ্যোতির্ময় থাকে বম্বেতে বৌ বাচ্চা নিয়ে। বৌমা এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মডেল। পানমশলার বিজ্ঞাপনে চিরকাল পুরুষদের আধিপত্য ছিল, বৌমাই প্রথম নারী যে পানমশলার বিজ্ঞাপন শুরু করে, এখন সবাই তাকে চেনে মিস মশালা বলে। মহিমা এখন তাঁর দেবতার কাছে সাপ্তাহিক পবিত্র যাত্রায় বেরিয়েছেন, সেই নিম্নগামী স্ত্রীলোকের নাম মনেও করতে চান না। তিনি একটি দোতলা বাড়ির মালকিন। এলআইসির টাকা আর এই বাড়ী এই তাঁর প্রেমময় স্বামী কৌশিক দিয়ে গেছে। তিনি নিচতলাটি ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়াটিয়া তপনদা, ষাটের কাছাকাছি হলেও বেশ গাঁট্টাগোট্টা, একসময় একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পেশীদারের দলে ছিল নিয়মিত কর্মী। তার খ্যাতির মধ্যে, বিরোধী দলের গুণ্ডারা তার ঘাড়ের উপর একটি বাথরুমের সিঙ্ক ফেলে দিয়েছিল, তাও সে দিব্যি বেঁচে, এই গল্পটা। যে কোন দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে ভজনা করলেই যে পুণ্য হবেই, তপনদা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ভোট দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতে বাধা দেওয়ার দায়িত্বে ছিল তপনদা। তার একটা ফিমার আর ঠিক হয়নি, তার দলও ইতিমধ্যে ক্ষমতা হারিয়ে বানপ্রস্থে গেছে। তপনদার প্রতাপ এখন টিমটিমে। সে এখন তার দলের জন্য শ্রমক্যান্টিন চালায়, টুকটাক কুরিয়ারের কাজ করে, তাতে কিছু রোজগার হয়। যারা আগে তোলা দিত, তারা এখন করুণা করে ওকে সস্তায় আলুটা মুলোটা বেচে। তপনদা কিন্তু মহিমার খুব কাজে দেয়। ব্যাঙ্কের কাজ, বিল পেমেন্ট আরো কত কি যে করে দেয়। তবে মাঝে মাঝে ভাড়া বাকীও ফেলে। তিন মাসের বকেয়া ভাড়া নিয়ে আজ সকালে তপনদার সঙ্গে খুব ঝগড়া হল, তপনদার মুখ মিষ্টি, সে কাঁচুমাচু হয়ে চটপট কথা ঘোরালো, জিজ্ঞাসা করল বউদির পরের চেকআপের তারিখ কবে। দলের সাথে যুক্ত এখনো অনেক চেনা ডাক্তারবাবু আছে, বললেই ও সস্তায় ব্যবস্থা করে দেবে।

কিন্তু মহিমা অভিজ্ঞ বাড়ীউলি, তিনি অত সহজে ভোলার নয়। দরজার নীচে একটি নোটিশ ফেলে দিয়ে একটি রিকশা ডেকে এই মন্দিরের দিকে রওনা দিয়েছেন। মন্দির কমিটির অধিকর্তা মেসেজ করেছিলেন, আজ মন্দির থেকে একটি বিশাল পদযাত্রা হবে। সব ভক্তজন মিছিল করে কীর্তন গাইতে গাইতে একটি গির্জায় যাবে। সেখানে যিশুকে গোপাল জ্ঞানে পুজো করে, প্রসাদ বিলি করা হবে চার্চের উপস্থিত সকলকে। এমনকি তিনি শিশু যিশুর জন্য একটি ছোট্ট কমলা রঙের মাফলারও বুনেছিলেন। যেতে যেতে মহিমা কীর্তনের লাইন রিহারসাল দিচ্ছেন আর রিকশাওলাকে দেরি হয়ে যাওয়ায় আরো জোরে চালানোর জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন। হারামজাদা তপনদা এত দেরী করে দিল, এখন মিছিল না বেরিয়ে যায়। 

🍂

হেনকালে হঠাৎ সুশান্ত এসে রিকশায় ধড়াম করে ধাক্কা মারে, তারপর রাস্তায় পপাত ধরণীতলে হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। রিকশাটা কাটাতে গিয়ে একপাশে কাত হয়ে গেল। কিন্তু কলকাতার রিক্সা অটো, ট্যাক্সির চালক, সবাই বিভিন্ন বিভাগে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান, গাড়ী চলে উসেন বোল্টের মত, জিমন্যাস্টিকে নাদিয়া কমানেচি। কোনওরকমে ভারসাম্য বজায় রেখে, রিক্সাওলা উপরে হাত তুলে শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে ধন্যবাদ জানাল। কিন্তু মহিমা বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে রকেটের মত রিকশা থেকে ছিটকে গেলেন এবং পড়লেন সোজা সুশান্তের ঘাড়ের ওপর। পড়লেন এবং অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আর ওদের ঠিক সামনে জেব্রা ক্রসিংকে পাত্তা না দিয়ে আসা একটা বাঘের মত হলুদ এসি বাস হুড়মুড় করে ব্রেক কষল। তার ড্রাইভার বিরোধী নেতার মতো প্রবল গালাগালি করতে লাগল। ভিড়ের মধ্যে অবলীলা ক্রমে পানমশলার লালিমা উত্তেজিত জনতার মুখে স্প্রে হতে লাগল।
 
কথায় বলে, বড় বড় শহরে এমন ছোট ছোট ঘটনা ঘটেই থাকে। যখন এটি ঘটে, তখন যেমন ভূষুন্ডির মাঠ থেকে ভূতের দল বেরিয়ে আসে তেমনি রাজপথে জমে যায় একদল লোকের ভিড় । কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় রূপ নেয় জনতার। সদ্য কাটা কাঁঠালের চারপাশে নীল ফলের মাছির মত জড়ো হয়ে গুনগুন করতে থাকে তারা। ভিড়ের মধ্যে গড়ে তিনটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী । সবচেয়ে আগ্রহীরা তাদের মোবাইল বার করে, ছবি এবং ভিডিও তুলতে শুরু করে এবং তাদের নিজস্ব সামাজিক মিডিয়া গ্রুপে চটপট আপলোড করতে শুরু করে। এমন উপলক্ষ প্রতিদিন আসে না, তাই স্থানীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল বিস্ফোরণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার এটি একটি ভাল সুযোগ। 
আরেক দল হয়ে ওঠে বিবেকের রক্ষক, তাদের অর্ধেক সুশান্তকে তার অসাবধানতার জন্য তিরস্কার যাকে বাংলায় বলে খিস্তি করতে শুরু করে। সুশান্তের অদেখা ছেলেমেয়েকে তারা প্রাণভরে গালাগাল দেয়। যে বাবা ঠিকমতো হাঁটতে পারেনা তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয় কি করে তার বাড়ির লোক? 
বাকি অর্ধেক দ্রৌপদীর সখার মত নারীর রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠে। কারো আবার চোখে পড়ে এই মহিলার গলায় একটি পবিত্র মালা রয়েছে । তারা তখনি ধরে নেয় এটা ধর্মের ওপরে বিধর্মীর বা তাদের সমর্থকদের আক্রমণ। কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নেয় লোকটি মহিলা দেখে স্থির না থাকতে পেরে ইচ্ছাকৃতভাবে জন্য রিকশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আজকাল মানুষ কিভাবে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির বিনাশ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, ক্রিসমাস ভ্যালেন্টাইন ইত্যাদি কিভাবে আমাদের সমাজকে পচিয়ে দিচ্ছে তাই নিয়ে জোর আলোচনায় তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। 

তৃতীয় দলটি করিতকর্মা, তারা তৎক্ষণাৎ তাদের কাজে লেগে পড়ল। কয়েকজন মিলে সুশান্ত এবং মহিমাকে ধরাধরি করে তুলে ফুটপাতে শোয়ালো। জল জল বলে কয়েকজন চিৎকার করলে এক মাছ বিক্রেতা দ্রুত বালতি ভর্তি জল নিয়ে আসে ছুটে এল। জ্ঞান ফেরানোর জন্য ছিটে দিতে হয় সবাই জানে। এ সেই সুরভিত জল যা মাছ কাটার পর হাত ধোয়ার জন্য ব্যবহার হয়। বালতিতে তখনও কয়েকটি ছোট ছোট দলছুট কুচো চিংড়ী সাঁতার কাটছিল। এরই ভিতর দক্ষ হাতে কিছু লোক দ্রুত মহিমার থেকে কমলা রঙের মাফলার এবং সুশান্তের শপিং ব্যাগটি দখল করল। ব্যাগের মধ্যে ছিল একটি বড় ওলকপি। একট আট বছরের ছেলে সেই ওলকপি নিয়ে তার মায়ের কাছে ছুটে গেল। তার মা মাংসের দোকানের কাছে ভিক্ষা করছিল। ওল কপিটি ঢুকে গেল তার ভিক্ষার ঝুলিতে। মহিমার লেডিস ব্যাগটা অদৃশ্য হয়ে গেল যেমন সমুদ্রের এলোমেলো ঢেউয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় রঙ্গীন মাছের ঝাঁক।

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments