কবিতা গুচ্ছ
কমলিকা ভট্টাচার্য
কবিতার দিন
কবিতা আছে তাই …
কবিতা আছে তাই আমি আছি,
কবিতা হাসে তাই আমি হাসি,
কবিতায় তুমি আমি কাছাকাছি,
কবিতা আছে তাই ভালোবাসি।
কবিতা আছে রঙ-তুলি হয়ে,
খুশি আঁকে মনের ক্যানভাসে,
অশ্রুতে গলে যায় জীবন ক্ষয়ে,
কবিতা আছে তাই আজও স্বপ্ন আসে।
কবিতা আছে তাই আছে প্রাণ,
সুখ-দুঃখ, আনন্দ, মন খারাপ,
পুতুল নাচে পড়লে সূতোর টান,
কবিতা আছে তাই জীবন মাপে মাপ।
কবিতা আছে তাই আমি সুন্দর,
মনকে বোঝানো রোজ রোজ,
ভাগ্যিস! কবিতা গড়েছে মনে বন্দর,
সে ছাড়া কে রাখে আমার খোঁজ?
একান্তে
আমার কবিতা হতে চেওনা,
আমার কবিতা যে সবার,
তুমি যে শুধু আমার
অগোচরে, নিভৃতে, গোপনে।
আমার প্রতিভার আলোতে রেঙনা,
সে আলো যে ক্ষণস্থায়ী,
সময়ের স্রোতে মিলিয়ে যায়
মনের আলোই যে সত্যি সুখদায়ী,
সেখানে শুধু তোমার জন্য দীপ জ্বালাই।
আমার নাম হতে চেওনা,
সে নামে আছে শুধু পরিচিতি,
নির্বাক শব্দের আনাগোনা।
তোমার নামেই লুকোনো আমার নামের মতি,
তুমি ডাকলেই সে নামে প্রাণ জাগে,
তোমাকে পাই আমি একান্তে!
কবিতা ভরা চোখ
সে চোখে ছিল রূপকথার স্বপ্ন, ছাইভস্মের মাঝে জাগা কিছু লুকোনো সন্ধ্যা। সে চোখে ছিল শীতল জোনাকি রাত, হারিয়ে যাওয়া দূর আকাশের ছন্দহীন নক্ষত্রপাত।
সে চোখে ছিল ভোরের হরিণী মায়া, গোপনে জড়ানো এক বিরহী সুরের কাব্য। সে চোখে ছিল অলিখিত মধুর মোহ, বৃষ্টির মতো নিঃশব্দে ঝরে পড়া সোহাগ।
তবু কেউ পড়েনি সে চোখের ভাষা,
শুধু এক কবি বোঝে সে চোখের আশা।
অশ্রু কালিতে লেখা হাজারো কবিতা
হালকা হাওয়ায় উদাস
তাই কবির খোলা মনের পাতা...
🍂
কবিতার প্রতিধ্বনি
এক অচেনা প্রভাতে কবিতার ক্লাস বসলো,
হৃদয়ের মঞ্চে বেজে উঠল নতুন শব্দের তাল।
আলো-ছায়ার খেলা ছাড়িয়ে,
শব্দেরা ফোটাল রূপকথার রং।
কবিতা, যে বেগবতী, সে তো চলে অবিরাম,
অথচ বয়স তাকে স্পর্শ করে না।
কবি খুঁজছেন অনন্তের ঠিকানা,
প্রতিটি লাইন ছুঁয়ে যায় অসীমের অঙ্গুলি।
নির্বাসিত সূর্য যেন নতুন ভোরের সাক্ষী,
শরতের পাতা নাচছে বৃষ্টির রিমঝিমে।
তুমি আমি, আমরা মিলে
কথার রোশনাই ছড়ালাম নতুন আকাশে।
মঞ্চের সাদা আলোয় বোনা হলো
অস্পষ্ট ইডেনের প্রান্তর,
তবু সময়ের শিকড়ে জমা হলো
একটি অসম্ভব কবিতার সম্ভাবনা।
কোনো ব্যাকরণ মানা না মানার দ্বন্দ্ব নেই,
শুধু শব্দেরা ভাসছে শূন্যে
চাঁদের মত ঝরে পড়ছে অন্তরে।
তবু কবিতা থেকে যায় তার শাশ্বত রূপে,
দর্শকের কান ছুঁয়ে যায় তার অনন্ত কলতান।
কবির নির্মাণে গাঁথা এই অসীম অক্ষরগুলো
ফিরে আসে বারবার,
মিশে যায় হৃদয়ের সমুদ্রে
প্রজাপতির ডানার স্পর্শে।
আজ কবিতা থাক...
আজ কবি, তারা খচিত রাতের আঁধারে,
কবিতার খাতা বন্ধ করে নিভৃতে ভাবে,
আমরাও শুধু আজ নিঃশব্দ শোকে
কি পেলাম প্রেমের ছলনাময় যাত্রাপথে।
পাখিদের ডাকে নেই তো আর সুরের ঝংকার,
শুধু হাহাকারের গান, জনমানসের আর্তনাদ,
শূন্য দোয়াত যেন প্রশ্নবিদ্ধ কলমের আধার,
তবুও লেখা হলেই আসে হৃদয়ের কান্না, ছড়ানো ফাঁদ।
তুমি কি আমায় নিঃশব্দে ডাকছো কবি?
গান গেয়ে ভেঙে যাবে শোকের পাথর?
প্রেমের ডাকেও আজ মায়াহীন ছবি
কি করে মানবতার হবে সোপান আরো দরদী আরো কাতর।
তাই চলো যাই, কবি, সুখ ঘাটে বাঁধা থাক,
বিচ্ছিন্ন শোকের পাতালও ছুঁতে চায় মন।
আমরা লিখবো না....
আজ কবিতা থাক
চল খুঁজি সেই শূন্যতায় মানবতার একটু ক্ষণ।
প্রতিবাদী হোক কবিতা!
সভ্যতা নাকি? লোভের কবর
ক্ষমতার সোনালি পেয়ালা উপচে পড়ে,
রাস্তায় ঝরে পড়ে অনাহার
দগ্ধ হাতেরা আকাশ সেলাই করে,
আর রাজারা ছাই দিয়ে লিখে যায় জমি কার।
বাতাসে পুড়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরের গন্ধ,
অহংকারের মিনারের নীচে শৃঙ্খলিত
যেখানে লোভ তার রুপালি দাঁত ধারালো করে
তাদেরই হাড়ে, যারা তার সিংহাসন গড়ে।
তবু
শেষ আগুন নিভে যাওয়ার আগে,
নিজের নাম ভুলে যাওয়ার আগে,
নীরবতা যেন চূর্ণ কাঁচের মতো ভেঙে পড়ুক
দ্বিধাগ্রস্থ ক্লান্ত তালু থেকেও ঝড় উঠে আসুক
ধোঁয়ার কুন্ডলী শ্বাসরুদ্ধ করুক সর্বোচ্চ মিনার
এ জমি নয় কারুর
এ সব কিছু শুধু তার।
যখন নিঃশ্বাসের ঘড়ি থেমে যাবে,
আর সোনার মুদ্রা মরদেহের আঙুলে কালো হয়ে যাবে,
তখন কোথায় লুকোবে ক্ষমতার কাঁপা কণ্ঠস্বর,
যখন তার ছায়াও সঙ্গ ছাড়বে?
মুদ্রারা বাতাসে নাম ফিসফিস করে না,
অট্টালিকারা শূন্যতায় কাঁদে না
কিন্তু যদি তুমি ভালোবাসা জমিয়ে রাখো,
তবে থেকে যাবে কারও চোখের জলে,
কোনও কাঁপা কণ্ঠের স্মৃতিতে,
যা তোমার নাম ডাকে ধুলোয় মিশে যাওয়ার পরেও।
আর যদি তুমি একটিমাত্র হাসির জন্য
অশ্রু মুছে নিতে পারো,
যদি ক্ষতগুলোকেই সেলাই করো
মানচিত্র আঁকার বদলে,
তবে পৃথিবী তোমার ছোঁয়া মনে রাখবে, ফুল ফোটাবে
মাটির ঠান্ডা আঁচলে ঢেকে ফেলার পরেও।
কিন্তু যদি লোভ শহরকে হাড়ে পরিণত করে,
যদি রাস্তাগুলো কবর হয়ে যায়,
তবে দয়া ভিক্ষা করার সময় থাকে না
কারণ গহীন মাটিচাপা শহররা শোক করে না,
তারা অপেক্ষা করে,
তারা শক্ত হয়,
তারা কয়লা, তারা পেট্রোলিয়াম হয়ে ওঠে,
অপেক্ষায় থাকে আরেক সভ্যতার,
যারা একদিন তাদের কঙ্কাল খুঁড়ে বের করবে,
আর প্রতিশোধের আগুন হয়ে জ্বালাবে আরেক সভ্যতা শান্ত হবে তাদের অতৃপ্ত আত্মা।
কবিতা কিছু কথা শুনতে চায়
কবি! যদি তুমি কবিতাকে সত্যি মিস করো,
তাহলে বলো, তুমি তার জন্য কী করতে পারো?
কবি! তুমি ভয় পেলে নাকি?
সত্যি কি তুমি চিনতে পারো তাকে?
কবিতা খুব সাধারণ,
চায় না উপমা, জটিল অলঙ্করণ।
হতে চায় সে জীবনের আয়না,
কিছু কথা শোনার আছে তার বায়না।
কবিতা আমার খুব প্রিয় সই,
চলো, তার চাওয়ার কথা কই।
ইচ্ছে করে শুনতে কিছু কথা,
আয় না বস, একটু পাশে,
আঁচল দিয়ে মুখটি তোর দিই মুছে।
চিন্তা করার কী আছে?
আমি আছি তো, তোর পাশে।
একলা একলা কী করছিস?
সময় পেলে চলে আসিস।
আজ আমি নয়,
তুই ঠিক বলেছিস,
বেলা হয়েছে, খাবার খেয়েছিস?
যা করেছিস,
ভালো করেছিস!
রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়,
কাজ করেছিস দিনভর।
তোর জন্যে বসে আছি,
দেখ, তোর জন্যে কী এনেছি।
তোর কথাটাই তো মেনেছি,
তোর জন্যই সব করেছি,
তোর জন্যই সব ছেড়েছি,
তোর কাছেই তো সব পেয়েছি,
তোকেই তো ভালোবেসেছি।
তোকেই আজ খুব মিস করছি...
শুধুই কি কবিতা?
আমরা সবাই কি শুনতে চাই না এসব কথা?
কবিতা সবার হতে চায়,
হতে চায় না শুধু একলা কারো।
কবি! তুমি কি তোমার কবিতাকে এতটুকু দিতে পারো?
2 Comments
কবিতার প্রতিধ্বনি _কবিতাটি ভালো লাগল।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteকবিতায় থাকুন
আনন্দে থাকুন