কমলিকা ভট্টাচার্য
সকালবেলা থেকে দুবার চায়ের কোটা পূরণ করে বাজারের ঝোলা হাতে নিয়ে মধুবাবু বেরিয়ে পড়লেন। বাজারের বাইরে একটি বড় ব্যানার তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বড় বড় করে লেখা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা। মনে মনে ভাবলেন এই এতটা বয়স হল আগে তো কখনো এইরকম ভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস এসব পালন হতো বলে তিনি মনে করতে পারছেন না, হতো হয়ত তবে ওনার মত সাধারণ মানুষের দিন আটটা পাঁচটা ডিউটি করে কেটেছে, তাই এসব জিনিসের আর খোঁজ করা হয়নি। গত পাঁচ বছর হল মধুবাবু চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ওনার মনে আজ একটা অদ্ভুত ভাবের উদয় হলো। মনে মনে ভাবলেন যাই হোক এসব কিন্তু বেশ ভালো একটা উদ্যোগ ,নেতারাও নারী শক্তি বন্দনা করছেন, তিনি সারা জীবন মা দুর্গা, মা কালীর বন্দনা করে এসেছেন ,সত্যি ঘরের মানুষটিরও বন্দনা করা উচিত।
তাই ঠিক করলেন বাড়ি ফিরে কল্যাণীদেবী মানে ওনার স্ত্রীকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানাবেন। কোনদিন তো সেভাবে কিছু শুভেচ্ছা বা ভালোবাসার কথাও বলা হয়নি, আজ নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানালে কল্যাণী নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। একে ফাগুন মাস চলছে, মধুবাবুর মনের ভেতরে প্রেমের মধু জেগে উঠলো।এদিকে বাজারের ভেতর থেকে ফাগুনের বাতাসে মাছের গন্ধ ভেসে আসছে।
মধুবাবুর মনে হল খালি হাতে কি এরকম ভাবে শুভেচ্ছা জানানো যায়। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোর কাছ থেকে যাই হোক এই গিফট দেওয়া-নেওয়া প্রেমটা যদি শেখা যেত বেশ ভালো হতো। নাতিটাও বিদেশে নাহলে ওর কাছ থেকে আইডিয়া নেওয়া যেত। তবে যাই হোক ভাবেন কল্যাণী রান্না করতে খুব ভালোবাসে, ওর রান্নার হাতেই তো বাঁধা পড়েছি।
🍂
গাছপাঁঠাটা পেঁয়াজ রসুন ছাড়া হালকা গরম মসলা দিয়ে কল্যাণী যা রাঁধে আসল পাঁঠার মাংস ছেড়ে হাত চেটে খাওয়ার মত। তাই কচি দেখে একটা এঁচোড় কিনেই ফেললেন। সেই দোকানে থোড় দেখে মনে হলো কল্যাণীর বরাবরই হিমোগ্লোবিনটা কম, থোড় খেলে আয়রন হবে তাছাড়া কুচো চিংড়ি দিয়ে খেতেও অসাধারণ হয়। বাজারে একটু এগোতেই পিছন থেকে মঞ্জু ডাক দিল "দাদাবাবু আজ কচি মোচা এনেছি, একটুও তেতো হবে না।"মঞ্জু বাজারে সবজি বেচে, মধুবাবু ওর কাছ থেকে প্রায়ই সবজি কিনে থাকেন। মধুবাবু বললেন "আজ থাক, তোর বৌদি বড় রাগ করে, মোচা দেখলেই মুখ ভার কুটতে হবে ভেবে।"
কিন্তু কল্যাণীর হাতে মোচার চপের কথা মাথায় আসতেই আর লোভ সামলাতে পারলেন না,মোচাটাও কিনে ফেললেন। সঙ্গে পেঁয়াজকলি আর বেগুন ,ট্যাংরা মাছ দিয়ে দারুন হবে।
তারপর মাছের বাজারে গিয়ে কুচো চিংড়ি ,বাগদা চিংড়ি , ট্যাংরা মাছ, ভেটকি মাছ কেনার পর সবে ক্ষান্ত হবেন ভাবছেন।পাশের দোকানের অজয় ডাক দিল" দাদা ভালো পারশে মাছ ছিল,এই কটা পড়ে আছে নিয়ে নিন,কিন্তু কেটে দিতে পারবো না।"
মধুবাবু ভাবেন পারশে মাছ কল্যাণীর খুব প্রিয় কিন্তু না কেটে নিয়ে গেলে ও খুব রাগ করবে, একেই বাগদাগুলো ছাড়াননি, এদের ছাড়াতে বললে মাথাগুলো সব কেটে বাদ দিয়ে ঘেটে চটকে দেয়। মালাইকারির চিংড়ির মাথার ভেতরে মশালা নারকোলের অপূর্ব রসের স্বাদের কথা ভেবে মধুবাবুর মুখে জল চলে এলো। অজয় কে বললেন"দে দে তাড়াতাড়ি প্যাক করে দে।"মনে মনে ভাবলেন পারশে মাছ তো কল্যাণী ভালোবাসে তাই ভেবেই নেওয়া তার ওপর আজ নারী দিবস আর নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানাতেই তো আজ এত বাজার করেছেন।
ঘন্টাখানেকের বাজার পর্বটি সেরে মধুবাবু যখন বাড়ি ফিরলেন তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা। সারা রাস্তা মনের ভেতরটা উথাল পাথাল হচ্ছিল, ভাবছিলেন কি করে গিয়ে কল্যাণীকে নারী দিবসের শুভেচ্ছাটা দেবেন। কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না। ইংরেজিতে বলবেন হ্যাপি উইমেন্স ডে নাকি বাংলাতে শুভ নারী দিবস।
বাড়ি ফিরে মধুবাবু সোজা রান্নাঘরে গেলেন। রান্নাঘরে মেঝের উপর বাজারের ব্যাগ দুটো নামিয়ে রাখলেন। কল্যাণী তখন কিচেন বেসিনে বাসুন ধোয়ায় ব্যস্ত। মধুবাবু কল্যাণীর একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন" শুভ নারী দিবস।"
ততক্ষণে বাজারের থলি থেকে কয়েকটা আলু লাফ দিয়ে বেরিয়ে কল্যাণীর পায়ের কাছে ,কয়েকটা পেঁয়াজ টেবিলের নিচে কয়েকটা টমেটো ফ্রিজের নিচে ঘাপটি মেরেছে।
এ মধুবাবুর বড় বদ অভ্যাস। বাজার করে এসেই ব্যাগটাকে এমন মাটিতে ছুঁড়ে রাখেন যে আলু পটল চারদিকে ছড়িয়ে যায়। কল্যাণী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে " আমার কোমরটা কি কোমর নয়, আমারও তো বয়স হচ্ছে, এই আলু, পেঁয়াজ কুড়িয়ে আমার তিরিশটা বছর কেটে গেল,কিন্তু তুমি শোধরালে না।"
আজ কিন্তু এইরকম কিছুই ঘটনা ঘটলো না, কল্যাণী মুখ ঝামটা দিল না বরং ব্যাগ থেকে আস্তে আস্তে সব কটা ঝোলা বার করে একবার খালি দেখল তারপর চেয়ারে গিয়ে বসলো।
মধুবাবু মনে মনে খুব খুশি হলেন ভাবলেন নারী দিবসের শুভেচ্ছা পেয়ে কল্যাণী আজ সত্যিই খুব খুশি হয়েছে। এইরকম হলে উনি ভাবেন আজকাল তো অনেক শুভেচ্ছা হয়েছে নাতির মুখে শুনেছেন রোজ ডে ,হাগ ডে না জানি আরো কত কি,গুগল করে দেখবেন আর কি কি শুভেচ্ছা দিলে মুখঝামটা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
প্রফুল্লিত মনে মধুবাবু কল্যাণীর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলেন আর বললেন "হ্যাপি উইমেন্স ডে।"কল্যাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করলেন। মধুবাবু লক্ষ্য করলেন কল্যাণীর মুখে কেমন যেন একটা ছেলেমানুষী হাসি, যে হাসি এই বয়সেও মধুবাবুকে বেশ ঘায়েল করছে। কল্যাণী হেসে বললো" সুন্দরী আজ ছুটি নিয়েছে।"
মধুবাবু বললেন "কেন আজ আবার কিসের ছুটি?"
কল্যাণী এবার মুচকি হেসে বলল "ওই যে তুমি বললে কি যেন নারী দিবস, উইমেন্স ডে, তাই ও আজ নিজের বরের সঙ্গে উইমেন্স ডে পালন করবে, ও বলেছে, আজ ওর বর সব কাজ করবে। ও কোন কাজ করবে না।
আমিও ভাবছি ...এই আমি বসলাম তুমি যে শুভেচ্ছা দিলে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। তাই যে কটা বাসুন বাকি আছে সে কটা মেজে ফেলো ,ঘরটা ঝাড়ু পোছা করে নাও আর তারপর এঁচোড়,থোড়, মোচা সব কেটে ফেলো। চিংড়িগুলো ছাড়িয়ে নাও তারপর পার্সে মাছ কেটে, বেশ ভালো করে রান্না করো দেখি।আজ আমার ছুটি, আজ আমি খালি বসে বসে খাব আর নারী দিবস পালন করব।"
এতক্ষণে মধুবাবুর ঘোর কেটেছে, আঁচ করতে পারছেন আসন্ন বিপদের কথা।
কল্যাণী গলায় যতটা মধু ঢালা সম্ভব ততটা ঢেলে বলে উঠলো "বসে রইলে কেন, যাও সবার আগে এক কাপ চা করে আনো দেখি,মাথাটা বড় ধরেছে।"
আসন্ন বিপদের কথা বুঝতে পারলেও মধুবাবু হারার পাত্র নন, তিনিও বলে উঠলেন "কি ভেবেছো আমি এসব করতে পারিনা নাকি? এক্ষুনি যাচ্ছি। চা বানিয়ে আনছি আর এমন চা বানাবো যা তুমি কখনো বানাতে পারোনি।"
কল্যাণী মজা করে বলে "আজ এতদিন বাদে আমার ভাগ্য খুলেছে।"
মধুবাবু রান্নাঘরে ঢোকেন কল্যাণী দূর থেকে চেয়ারে বসে খালি মজা দেখতে থাকে।
মধু বাবু দেখেন চায়ের বাসন কাপ কিছুই এখনো মাজা হয়নি,তাই সেগুলো মাজতে গেলেন আগে, গিয়ে দেখেন তার মধ্যে চা পাতা, সব দিলেন বেসিনে ঢেলে, ব্যস আর কি বেসিনে জল গেল আটকে, বেসিন উপচে জল রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে একাকার কান্ড। মুখ ফুটে বেরোতে চাইলো হ্যা করে বসে দেখছো কি? ওগো এদিকে এসে আমাকে একটু হেল্প করো না, কিন্তু তখনই পুরুষসত্বা ভেতর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো এত সহজে হার মানবি, না না।
কোনভাবে সামাল দিয়ে উনুনে চায়ের জল চাপালেন, যতটা জল চাপালেন তাতে পাশের বাড়ির দাসবাবুর চারজনের ফ্যামিলির সবাইকে ডেকেও চা খাওয়ানো যাবে। একদিকে চাপিয়ে দিলেন দুধ। চায়ের জল ফুটে যেতেই না কম করেই তার মধ্যে ঢেলে দিলেন এক মুঠো চা পাতা, ব্যস চা পাতা ফুলে ফেঁপে উনুনের উপরে ছড়িয়ে পড়ল ,ওদিকে দুধ উপছে বার্নারের ফাঁক গলে কিচেন প্ল্যাটফর্মে পড়ে খরস্রোতা নদীর মত বইতে লাগলো।হতবম্ব হয়ে মধুবাবু বুঝতে পারলেন না এখন কি করা উচিত ,তাড়াতাড়ি গ্যাস বন্ধ না করে দুধের বাসনটিকে ধরে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে ফোস্কা।
এতক্ষণ বসে বসে কল্যাণী ফোনে সবার সঙ্গে তার নারী দিবসের ছুটির কথা ,গিফটের কথা খুব গর্বের সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার করছিল, কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে মধুবাবুকে লক্ষ্য করছিল।
মধুবাবুর হাত পুড়ে ফোস্কা পড়ে গেছে এরপরেও যদি কল্যাণী চুপ করে বসে থাকে তাহলে হয়তো আগে কেউ আর কোনোদিন নারী দিবস মানাবে না।
কল্যানী এগিয়ে এসে বলে অনেক হয়েছে এবার বাইরে গিয়ে বসো। হাতে একটু টুথপেস্ট লাগিয়ে দিই,জ্বালাটা কমে যাবে।"
কল্যাণী মধু বাবুর হাতে টুথপেস্ট লাগিয়ে দিতে থাকে, মধুবাবু অপলক ভাবে কল্যাণীর মুখের দিকে এক শ্রদ্ধার ভাব নিয়ে চেয়ে থাকে।
কল্যাণী লজ্জা মাখানো গলায় বলে" বুড়ো বয়সে ভীমরতি হলে এই রকমই হয়।"
দুপুরে শুকতো, ডাল, পেঁয়াজকলি দিয়ে ট্যাংরা,থোড় চিংড়ি, চিংড়ি ভাতে,পারশের ঝাল,ভেটকি মাছের ডালনা,টমেটোর চাটনি সব দিয়ে নারী দিবসের খাওয়া-দাওয়া বেশ জমজমাট আর বিকেলের চায়ের সাথে মোচার চপ আর রাতে লুচির সাথে চিংড়ির মালাইকারি রইল খালি বাকি।
খাওয়া দাওয়া সেরে উঠে সবে মধুবাবু
মধ্যাহ্ন নিদ্রাটি সেরে বাঙালিয়ানার ষোলআনাটি পূর্ণ করার কথা ভাবছেন ঠিক তখনই মধুবাবুর ফোনে টং করে একটা মেসেজ এল আপনাকে নারী দিবসের অনেক শুভেচ্ছা।
তাড়াতাড়ি ফোনটা অফ করতে গিয়ে ফোস্কাটা ফেটে যায় ,ব্যথাটা টন টন করে উঠে।
এদিকে ঠিক সেই সময়ই কল্যাণী দেবী ঘরে ঢুকে মধুবাবুর হাতে ফোন দেখে একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন
বলে উঠলেন খেটে খেটে আমি মরছি উনি এদিকে..
তা এখন সোহাগ করে কোন বান্ধবীকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে শুনি।
0 Comments