জ্বলদর্চি

ঘুমন্ত শব্দের অযোধ্যা পাহাড়/ শাশ্বত বোস

ভ্রমণ কাহিনী
ঘুমন্ত শব্দের অযোধ্যা পাহাড়
                           
শাশ্বত বোস

প্রথমেই বলি, আজ যে ওয়ান ডে ট্রিপ টির কথা লিখতে বসেছি, সেটা আমি পুরোটাই কভার করেছিলাম প্রাইভেট কারে। হ্যাঁ জানি, নিম্নমধ্যবিত্তের কাছে সেটা হয়তো আজও বিলাসিতা! আসলে অনর্গল দিনের কোণায় লুকিয়ে পড়তে চাওয়া রাস্তাটার ভিতরে শ্লথ গতিতে গড়ে ওঠা, একটা অনুদ্ধৃত ‘আমি’ আছে। যেন কোটেশনের ভেতরে সযত্নে রাখা তামাটে প্রেমিকার লাল রঙা ‘প্রথম পুরুষ’। নির্ভেজাল সীমাবদ্ধ যাপনের ঘুমন্ত বুকে বেড়ে ওঠা কাল্পনিক সমারোহকে স্বেচ্ছায় নির্ভয়ে পদতলে মাড়িয়ে, মোলায়েম স্বাধীনতার সেন্টিমেন্টটাকে কশেরুকার অগ্রভাগে ঠেলে দিতে চাইলে, আমার মতে ভোর ভোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ুন সিলেক্টিভ যে কোন ভালো লাগা মুহূর্ত কিংবা দৃশ্যমান সত্যসুন্দরের উদ্দেশ্যে! এই স্বাধীনতার বিষয়টা তুল্যমূল্য আপেক্ষিক হলেও এই ‘আমি’ র জায়গাটাতে কিন্তু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীতা নেই! আর এই গভীর আত্মানুসন্ধানের পথে এই নিছক চারপেয়ে যানটিকেই আমি নির্ভেজাল নিরাপদে ভরসা করি বরাবর।
“চলছে আমার রাস্তা,রাস্তা উদ্দেশ্যহীন
উড়িয়ে যাচ্ছে হাইওয়ে জুড়ে
আরও একটা দিন
আরও অনেক অনেক দূর পরের শহর
চলতে হবে আমায় রাত্রি ভোর
নেই যে আমার কোন অবসর
যদি খুঁজে পাওয়া যেত একটা ঘর।”

🍂

এবারে আমাদের গন্তব্য ছিল পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়। ছোটনাগপুর মালভূমির বুকে ক্রিয়াশীল রূপ-রস-গন্ধের ঢিবি হয়ে জেগে থাকা অযোধ্যা সার্কিটের দেখবার জায়গাগুলো, ঝটিতি সফরে চাক্ষুশ করে দিনে দিনে ফেরত আসতে হবে, এই ভাবনা নিয়ে যখন গুগল ম্যাপ ঘাঁটতে শুরু করলাম তখন দেখতে পেলাম আমার বাড়ি থেকে জায়গাটার দূরত্ত্ব, প্রায় ৩৩০ কিমির কাছাকাছি। সুতরাং খুব ভোরে বেরোলেও রাত এগারোটার আগে কোনোভাবেই বাড়ি ফেরা সম্ভব হবে না। তবু লক্ষ্য করে দেখেছি এই পাহাড় নামক নিষ্প্রভ জড় অট্টালিকাসম বস্তুটির উপরও পরমাত্মীয়ের মত একটা উষ্ণ সম্পর্কের টান আছে আমার চিরকালই! তা সে সুউচ্চ হিমালয়ের কুমায়ুন রেঞ্জই হোক কিংবা নিদেনপক্ষে কোন ঘুমন্ত স্থিরচিত্রের বুকে, দুঃসাহসী কোন ট্রেকারের খুঁজে নেওয়া জীবনবোধের গল্পটার শেষে, প্রোটাগোনিস্ট হয়ে ভেসে ওঠা ছোটখাট কোন টিলা! এই ভালোলাগা আমার জীবনে এক পৃথক গন্ধ এনে দিতে পারে সবসময়ই। বেসামাল হতে পারি, প্যালেট তছনছ করে আঁকা তার বাদামি শরীরে। 

বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম সাতটারও আগে। আর বাঘমুন্ডির আঁকা বাঁকা পার্বত্য পথের শরীর বেয়ে উপর নিচে রমণ করা কুয়াশার সরটাকে সরিয়ে, মুন্ডা-ওঁরাও-কিস্কু মরদদের মত এক বুক পর্ণমোচী কেশরে ঢেউ তুলে, শিলার শল্কমোচনে বাদামী রং থেকে সরে এসে সাদা হতে থাকা তার অসম শরীরটা যখন চোখে পড়ল, তখন সময় দুপুর ছাড়িয়েছে। পেলব পিচ রাস্তাটার শেষে আপাত নিরীহ দুঃসময়ের মত উঁচু নীচু এবড়ো খেবড়ো পথের প্রতিটি বহুমাত্রিক ওঠানামায়, তখন যেন মোহময়ী কুহকের অতল আহবান খেলা করে যাচ্ছে! অফুরন্ত আবিষ্কারের আনন্দে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত গানের স্বরলিপি! অযোধ্যা পাহাড়ে বেশ কিছু ভাতের হোটেল দেখতে পাওয়া যায় পার্বত্যপথের দুপাশে। তাদেরই কোন একটাতে মধ্যাহ্নভোজ সেরে প্রথমে গেলাম মার্বেল লেক দর্শনে। ভালো নাম তাপানিয়া হ্রদ। চতুথ বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সময় আশেপাশের পাহাড়ে ব্লাস্টার কারণে ভূগর্ভস্থ জলের প্রবাহ থেকে এই হ্রদের জন্ম। পুরুলিয়া যেন এরকম অজস্র প্রাকৃতিক ঝর্ণা ও হ্রদের দৈবী সমাহার! এ যেন নিরাকার ব্রম্ভের নিজে হাতে আঁকা ভালোবাসার রামধনু! নিজস্ব ঢঙে বানানো ছেঁড়া জোড়া নৌকা জীবন! রাস্তায় আসার পথে পরপর কয়েকটা আদিবাসী গ্রাম চোখে পড়ল। সাথে আরো চোখে পড়ল ছাতনি, শিলিংদা মোড়, লাহা ডুঙরি, ঘোলশোরিয়া, শালুনী, ভগবানপুর, শিমুলিয়া, সালুই ডহর, লছমনপুর, অহঢ়ার মতন গ্রামগুলোয় কীটপতঙ্গের মত মিশে থাকা অনভিজাত আদিবাসী জনজীবন ও লাগোয়া অরণ্যের সাথে ইকোরিসর্টের মতন নগরকেন্দ্রিক বিলাসিতার যত্নশীল যৌথ যাপন! কেউ যেন কারো ব্যাপারে অপ্রাসঙ্গিক কৌতূহলী নয়। একটা বহমান জীবন, অমিত আয়ুর অপেক্ষায় কমলা রঙের রোদে গা ধুয়ে জলের মতন সহজ হতে চায়, রোজ শান্ত হয় আবার রোজ চঞ্চল হয়ে ওঠে! 

মার্বেল লেক থেকে কিছুদূর এগোলে পড়বে ‘বামনী ফলস’। রাস্তাটা বেশ কাঁচা, বিশেষ করে শেষের দিকটা! গাঢ় সবুজ বা সর্ষেফুলের হলুদ শ্যাওলাগুলো বুকে করে, আর্দ্র বাতাস আর স্যাঁতস্যাঁতে জল হাওয়াকে প্রায় র কাছাকাছি নিয়ে এসে, নির্মল প্রকৃতির কিংবা সংঘর্ষ ক্লান্ত পান্থজনের মিছিলের ভালবাসা হয়ে, উঁচু থেকে সমানে ঝরে পড়ছে ‘বামনী’। এ যেন ঈশ্বরের আপন ভূমিতে, নিথর জ্যামিতিক ছন্দে ঢেউ খেলে যাওয়া মায়াময় বিভঙ্গ! প্রবেশপথে কয়েকটা দোকানপাট পেরিয়ে এলে সামনে পড়বে কয়েকটা লোহার ব্রিজ। এখান থেকেই বেশ টের পাওয়া যায় দূর থেকে ভেসে আসা তার ফোঁসফোঁস গর্জন! তারপর শুধুই উৎরাই! তা প্রায় শচারেক পাথুরে সিঁড়ি। পাহাড়ের শরীর খুঁড়ে জন্ম নেওয়া কখনো পাটা আবার কখনো অসমান, ক্রনিক ছলাকলাকে কোন এক অনির্দিষ্ট অলৌকিক চলনে পার করে দিতে পারলে ছুঁয়ে দেখা যাবে, বিশুদ্ধ ছাঁকনির মত সেই ভালোবাসাকে। যার আবেগের বশীকরণ শব্দে একটা বৃষ্টিবিহ্বল জীবনানন্দ খেলা করে যায়। একমাত্র কোন শুদ্ধ প্রেমিকই তাকে চোখের দেখায় দেখতে পায়, নিজের বিক্ষিপ্ত উপলব্ধি দিয়ে। চারপাশে তখন শুধুই গাঢ় সবুজ! ভেসে আসছে আদিবাসী গান। কোন এক স্থানীয় ছেলে খেঁজুর পাতা কেটে তখন ‘ফুল’ তৈরীতে ব্যস্ত! এখানে বাতাস ভারী। তাকে লুকিয়ে রেখেছে গাছের ছায়ার অন্ধকার! হয়তো কখনো তার নিজস্ব গন্ধ ছিল! যেন কিশোরীর মনের গন্ধ, তার নাগরের হাত ছোঁয়া বেসামাল শরীরের গন্ধ! ফেরার সময় চরাই বেয়ে উঠতে গেলে হাঁটুতে ওঠা কম্পন বৃত্তান্ত অবশ্যই মনে রাখার মতো। 

এর পরের গন্তব্য হতেই পারে তুর্গা ড্যাম। পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা নিরীহ, শান্ত জলের তুর্গা পর্যটকের মন কেড়ে নিতে বাধ্য। লেকের জলে আছে প্রচুর মাছ। দেখে ইচ্ছে হয় তার অতল শরীরে গভীর ডুব দিই, তুলে আনি খনিজ আকর! কিন্তু তাতে সরকারি নিষেধ আছে। ফিরতি পথে দেখে নেওয়াই যেতে পারে কংসাবতী নদীর ওপর বানানো আপার ড্যাম ও লোয়ার ড্যাম। সর্বক্ষণই কোথাও না কোথাও চোখে পড়বে আদিবাসী রমণীর দল, মাথায় জংলী কাঠের বোঝা। এই পরবাসে একটা বিশল্যকরণী সন্ধ্যেবেলার দিকে তাদের শরীরে বেয়ে চুয়ে আসা গন্ধ আর শব্দের গুঞ্জন, “হাজুক মে উসারা” (এস তাড়াতাড়ি), যেন ছায়াপথ জুড়ে অমানিশা খোঁজে অদৃশ্য জোনাকির দল! আসলে নগরজীবনের কংক্রিট কেটে বার করা এই টুকরো সফরটা ছিল আমার কাছে ঠিক যেন একটা তির্যক ছুরি কিংবা পিছটানহীন মোহনার মত, আগামী জলোচ্ছ্বাসে যার মানচিত্র হারাবে। জাত, কুল, মানের অ্যাটাস্টেশন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এই প্রকৃতিজীবনের সাথে একাত্ম হয়ে গেলে, এই সংক্ষিপ্ত সরলতা ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় হয়তো নিজের মগজের পেরিটাল লোবেই ঘটে যাবে ইন্দ্রিয়সচেতন প্রবৃত্তির কোন সুপারনোভা বিস্ফোরণ! তার এক অর্ধ বলবে “তাহ এন মে” (থেকে যাও)। পাশাপাশি গজিয়ে ওঠা বিবাদী স্বর হয়তো নির্দেশ দেবে “অরাক চালাক মে” (ঘরে ফিরে যাও)। “অবশ্যই দাহরাতে এম হাজুক আ” (অবশ্যই আবার এস), “আলুম বিল্মবক আ” (দেরী কর না)। এ আসাটাই শেষ নয় তো! আরো অনেক আসার আছে পুরুলিয়ার গ্রামগুলোতে, যেখানে ভূমির অধিকার, জঙ্গল আর পাহাড়ের সামঞ্জস্যহীন আকৃতির ভেতর লুকিয়ে আছে একটা মসৃণ চলে যাওয়া। গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে গভীর দাগের ধীর রেখায় যা লিখে দিয়ে যায় বিপরীত চিন্তার শীতলতা।

Post a Comment

0 Comments