কমলিকা ভট্টাচার্য
হোলির সকাল। কল্যাণী দেবী মধুবাবুকে বললেন,
— "সকাল সকাল বাজারটা সেরে এসো। বেলা বাড়লে রং খেলা শুরু হয়ে যাবে, তখন আর বেরোতে পারবে না।"
মধুবাবু বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে পড়লেন। লিফট দিয়ে নেমে পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখ গেল সুইমিংপুলের দিকে। সেখানে অ্যাপার্টমেন্টের মেন্টেনেন্সের ছেলেরা কিছু একটা লাগাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে কালচারাল হেড রাহুল, বছর তিরিশের ছেলেটি, বিহারের হলেও বাংলায় দিব্যি কথা বলে। সদ্য বিয়ে করেছে, সদালাপী ছেলে।
মধুবাবুকে দেখে রাহুল হেসে বলল,
— "কাকু, বাজারে যাচ্ছেন? বিকেলে কিন্তু আসবো আপনার বাড়িতে, নিশ্চয়ই ভালো-মন্দ রান্না হবে?"
— "অবশ্যই! তোমার কাকিমার হাতের মালপোয়া খাওয়াবো, সঙ্গে করে তোমার বউকেও নিয়ে এসো। মজার আড্ডা হবে!"
এরপরই মধুবাবু নজর সুইমিংপুলের দিকে করে জিজ্ঞাসা করলেন
"ওখানে কী হচ্ছে?"
রাহুল বলল,"আঙ্কেল, হোলির জন্য স্পেশাল আয়োজন! ফোয়ারা দিয়ে জল পড়বে, সবাই রং মেখে রেন ডান্স করবে!"
মধুবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন!
"সুইমিংপুলের মধ্যে রং খেলা? সারা জীবন আবীর, পিচকারি, বড়জোর ন্যাড়া পোড়ার ছাই! কিন্তু এটা আবার কেমন হোলি?"
রাহুল হেসে বলল,
"এটা মডার্ন হোলি, আঙ্কেল! আপনিও কাকিমাকে নিয়ে আসুন, দারুণ মজা হবে!"
মধুবাবু মুখে বললেন, "না না, এই বয়সে আর এসব নয়!" কিন্তু মনে মনে কী এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল! সত্যিই কি একটু রেন ড্যান্স করা যায় না?
মধুবাবু বাজারে পৌঁছেও মাছ-মাংসের বদলে সারাক্ষণ ভাবছেন কি করে কল্যাণী দেবীকে রাজি করানো যায় কারণ তিনি জানেন, কল্যাণী বলবে—
— "তোমার এই বুড়ো বয়সে যত ভীমরতি! এসব আমাদের মানায়?"
🍂
কিন্তু মধুবাবু ভাবেন, "আগে করিনি বলে এখনো করব না, তার তো কোনো মানে নেই!" তাড়াতাড়ি বাজার সেরে বাড়ি ফিরলেন, মন একটাই জায়গায় আটকে রেন ড্যান্স করতেই হবে!
বাড়ি ফিরে বাজারের থলি আস্তে করে নামিয়ে রাখলেন।
কল্যাণী দেবী একবার পেছন ফিরে দেখলেন, মধু বাবুর এত শান্তভাবে ব্যাগটিকে রাখা দেখে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগলেও কল্যাণী দেবী আবার নিজের কাজে মন দিলেন।
মধুবাবু মনে মনে ভাবলেন, একটু হোলির গান বাজালে বাড়িতে একটা রোমান্টিক আবহাওয়া তৈরি হবে। তখন না হয় কল্যাণীর কাছে কথাটা পাড়বেন।
আলেক্সাকে ডাকলেন—
— "Alexa, play Holi songs!"
আলেক্সা বাজাতে লাগল হনুমান চালিশা!
মধুবাবু আবার বললেন,
— "Alexa, play Bollywood Holi songs!"
এবার বাজল শিব ভজন!
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
— "Alexa, you are useless!"
আলেক্সা শান্ত গলায় বলল,
— "Sorry, I couldn’t find the song ‘Useless’!"
অ্যালেক্সার দোষ কোথায় সে নিহাতই ছোটখাটো প্রোগ্রামিং করা রোবট, মধু বাবুর রোজকার ভক্তিগীতি শোনার অভ্যাস থেকে সে মধুবাবুর পছন্দের একটা অ্যালগোরিদম বার করেছে বটে কিন্তু মধু বাবুর মনের হঠাৎ রং বদল ধরার মতো AI এখনো তৈরি হয়নি।
কল্যাণী দেবী এতক্ষণ রান্না করছিলেন। বারবার মধুবাবুকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে বললেন,
— "কি ব্যাপার? আসছো-যাচ্ছো, কিছু বলবে?"
মধুবাবু একটু হকচকিয়ে বললেন,
— "কিছু না... জলখাবারে কী বানিয়েছ?"
কল্যাণী দেবী ঢাকনা খুলে দেখালেন, আলুর দম।
— "সুন্দরী আসেনি, একটু দাঁড়াও, লুচি ভেজে দিচ্ছি।"
— "দই এনেছ তো?"
এবার মধুবাবুর মনে পড়ল, রেন ড্যান্সের কথা ভাবতে গিয়ে দই আনতেই ভুলে গেছেন!
— "অরে, মিষ্টির দোকানে এত ভিড় ছিল যে দোকানে ঢুকিনি... তুমি অনলাইনে আনিয়ে নাও!"
কল্যাণী দেবী বাজারের ব্যাগ থেকে জিলিপি বের করে বললেন,
— "তা জিলিপিগুলো কোথা থেকে এলো শুনি? ভুলে গেছো, সেটা সরাসরি বললেই পারতে!"
তারপর বাজারের ব্যাগ থেকে বার করলেন কয়েক প্যাকেট রং,একটু অবাক হয়ে বললেন "এগুলো আবার কেন এনেছো ?"
মধুবাবু একটু হাসলেন। তারপর বললেন,
— "আচ্ছা কল্যাণী, তুমি কখনও সুইমিং পুলে রং খেলে নাচ করেছ?"
কল্যাণী দেবী চমকে উঠলেন,
— "মানে?! তোমার কি সুইমিংপুলে গিয়ে ছেলেপুলেদের সঙ্গে ড্যান্স করার ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?"
— "সত্যি বলব? একটু ইচ্ছে হচ্ছে..."
এবার কল্যাণী দেবীর ধৈর্য চুকল রংয়ের প্যাকেট গুলো বেসিনের পাশে রাখতে রাখতে বললেন
— "সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, বাড়িতে টিভিতেও পাশে বসে সিনেমা দেখলে না কোনোদিন! আর আজ এই বয়সে হঠাৎ রেন ড্যান্স?"
— "চলো না কল্যাণী, কোনদিন তো এভাবে মজা করিনি!"
কল্যাণী দেবী রাগে বললেন,
— "সেসব বাদ দাও, ওপারের বেসিনের কলটা কেন কাজ করছে না, সেটা দেখ দেকি?"
মধুবাবু মনে মনে ভাবলেন, "রেন ড্যান্সের ইচ্ছা করেছিলাম, এখন কল সারাতে বসতে হবে!"
সাধারণত বাড়িতে এই ধরনের কোন কাজ মধুবাবু নিজেই করে থাকেন বাইরে থেকে কোন মিস্ত্রি বাড়িতে আসে না। তার মধ্যে বেশিরভাগ জিনিস একবার খোলা হলে সময় মত আর জোড়া দিয়ে সারানো হয় না খোলাতো খোলাই থেকে যায়।
মধুবাবু রান্নাঘরে গিয়ে কলটা দেখতে লাগলেন। জং ধরা কলটি রেঞ্চ দিয়ে খুলতে গিয়ে ব্যাস! কলটা ভেঙে গেল!
মেন পাইপ থেকে ঝর্ণার মতো জল ছিটকে রান্নাঘরের ছাদ থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে লাগল! সঙ্গে বেসিনের ধারে রাখা রং মিশে পুরো রান্নাঘর রঙিন হয়ে গেল!
মধুবাবু আর কল্যাণী দেবী ভিজে কাকভেজা! রান্নাঘর জলে একাকার! আলুর দমের কড়াইতে এক কড়াই জল! দইয়ের বদলে দই বড়া জলে ভাসমান!
কোনো মতে জল বন্ধ করলেন মধুবাবু। ঠিক তখনই কলিংবেল বাজল।
কল্যাণী দেবী রাগে বললেন,
— "এই অবস্থায় আমি বাইরে যেতে পারবো না, তুমি গিয়ে দেখো!"
মধুবাবু দরজা খুলে দেখেন, রাহুল আর তার স্ত্রী অরিত্রী দাঁড়িয়ে!
মধুবাবুর ভিজে অবস্থা দেখে ওরা প্রথমে চমকে গেল! কল্যাণী দেবীও বাইরে এলেন।
অরিত্রী আর রাহুল ওনাদের পায়ে আবীর দিল।
অরিত্রী মিষ্টি হেসে বলল,
— "হ্যাপি হোলি, কাকু-কাকিমা!"
কল্যাণী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— "সকাল থেকে কল ফেটে সারা রান্নাঘর ভেসে গেছে, কিছুই খাওয়াতে পারলাম না! "
রাহুল হেসে বলল,
"না কাকিমা, আমরা অন্যদিন আসবো, আজ চলি।"
ওরা দুজনে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল, কল্যাণী দেবী ঘরের ভেতরে গেলেন। মধু বাবু তখনো দরজার উপর দাঁড়িয়ে ,
রাহুল একবার পিছন ফিরে মধুবাবুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— "কাকু, বাড়িতেই রেন ড্যান্স! আহ! ক্যা বাত!"
মধুবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন! সঙ্গে যোগ দিল রাহুল আর অরিত্রী।
2 Comments
চমৎকার হয়েছে। পারফেক্ট হাস্যরস
ReplyDeleteThank you ,Happy Holi
ReplyDelete