মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৪৯
গোপালচন্দ্র দাস অধিকারী (স্বাধীনতা সংগ্রামী, সবং)
ভাস্করব্রত পতি
সবাই চেনে 'সবংয়ের রূপকার' নামেই। তিনি গোপালচন্দ্র দাস অধিকারী। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থানার ৪ নং দশগ্রাম ইউনিয়নের খাজুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০১ এর ১ লা সেপ্টেম্বর। দিনটা ছিল জন্মাষ্টমী। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। আর সবং পেলো একজন লড়াকু শ্রীকৃষ্ণকে। বাবা ছিলেন বৈকুন্ঠনাথ দাস অধিকারী এবং মা দৈবকী দাস অধিকারী। ১৯৮৮ এর ১ লা সেপ্টেম্বর তারিখেই জীবনাবসান ঘটে এই মহান মানুষটির। জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখের অদ্ভুত মিল থাকা মেদিনীপুরের এই মহান মানুষটি ছিলেন একজন সত্যিকারের লড়াকু সংগ্রামী। ভারত সরকার স্বাধীনতার পঁচিশতম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামী (স্বতন্ত্রতা সৈনিক) হিসাবে তাঁকে তাম্রপত্র দেয় ১৯৭২ এর ১৫ ই আগস্ট। 'স্বতন্ত্রতা সৈনিক সম্মান পেনশন' পেতে শুরু করেন তখন থেকেই।
সতীশচন্দ্র দাস অধিকারী ছিলেন তাঁর দাদা। এনাকে সবাই চেনেন 'সবংয়ের রাষ্ট্রগুরু' নামে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি যখন ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন নিতান্ত বালক ছিলেন গোপালচন্দ্র। তিনিও দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পড়াশুনা ছেড়ে আন্দোলনের ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন। কিন্তু দাদা সতীশচন্দ্র নিরস্ত করলেন ভাইকে। ফলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হল। ১৯১৮ সালে খেলাটচন্দ্র ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হলেন কলকাতার রিপন কলেজে। সেখান থেকে ১৯২০ সালে আই.এস.সি. পাশ করেন। ফের এখানেই শুরু করলেন বি.এস.সি. র পঠনপাঠন। রিপন কলেজে বি.এস.সি. পাঠরত অবস্থায় দাদা সতীশচন্দ্রের 'ইউনিয়ন বোর্ড বর্জন' আন্দোলনের ডাকে ১৯২১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি যোগদান করলেন।
তাম্রপত্র
কেলেঘাই কপালেশ্বরীতে যখন ১৯২৬ সালে বন্যা হল, তখন কংগ্রেস থেকে থানা রিলিফ কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির 'যুগ্ম সম্পাদক' হলেন গোপালচন্দ্র। কর্মমুখর এই মানুষটি সেদিন আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণকার্যে নেতৃত্ব দেন। এরপর সবং থানা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হিসাবে ১৯২৭ -১৯৩০ পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে কার্যভার পরিচালনা করেন। ঠিক এই সময়ে তথা ১৯২৭ সালে অকালে মৃত্যু হয় সতীশচন্দ্র দাস অধিকারীর। ভেঙে পড়েননি তখন। বরং এক বছরের মাথায় ১৯২৮ সালে 'লোকাল বোর্ড'-এর সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩০ এর ২৬ শে জানুয়ারি হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে উদ্যোগী হন। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং প্রথমবারের জন্য ২১ শে এপ্রিল থেকে এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। যদিও ব্রিটিশ বিরোধী আরও নানা কাজের জন্য পরবর্তীতে আরও দু'বার কারাবরণ করতে হয়েছিল তাঁকে।
এইসময় স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে দ্রুত সংবাদপ্রচারের জন্য 'সবং সমর বার্তা' নামক একটি সংগ্রামী সাপ্তাহিক বুলেটিন প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। সেসময় এই পত্রিকাটি ছাপানো হত একটি 'সাইক্লোস্টাইল' মেশিনে। যা কিনেছিলেন জমিদার ডমন আদিত্য। এই সংগ্রামী বুলেটিনে গোপালচন্দ্র দাস অধিকারী লিখতেন ব্রিটিশদের অত্যাচারের কাহিনি। আর নবকুমার শেঠ সেই বিবরণ মোতাবেক আঁকতেন ছবি। শুধু তাই নয়, এসময় 'ট্যাক্সবন্ধ আন্দোলনেও গোপনে নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৩৩ সালে আবারও কেলেঘাই কপালেশ্বরীর প্রবল বন্যায় গোটা সবং জলমগ্ন। ওয়ারেন্ট জারির জন্য গোপালচন্দ্র সহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা তখন আত্মগোপন করে রয়েছেন। ফলে বন্যার্তদের জন্য সরকারি ত্রাণকার্যের বিলিবণ্টন প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। প্রমাদ গুনলেন সার্কেল অফিসার। আশু সমস্যার সমাধানে বাধ্য হয়ে গোপালচন্দ্রের ওয়ারেন্ট সাময়িক রদ করলেন। মুক্তি পেয়েই তিনি ত্রাণ বিতরণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এক অনন্য মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৭ এ গোপালচন্দ্র কংগ্রেসীদের নেতৃত্ব দেন সবং থানার 'ইউনিয়ন বোর্ড' দখলের। তিনি নির্বাচিত হলেন ৪ নং দশগ্রাম ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।
১৯৪২ এর 'ভারতছাড়ো আন্দোলন' এ যুক্ত হন। এমনকি ছোট ছোট ছাত্রদেরকেও যুক্ত করেন। ফলে সরকারের বিষ নজরে পড়েন তিনি। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে তেমন কোনও নঞর্থক ফন্দি নিতে পারেনি সরকার। সেসময় একটার পর একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিদ্ধস্ত মেদিনীপুর। ১৯৪৩ এর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষদের ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজেও তিনি সর্বাগ্রে। আবার ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে যাওয়া স্কুলঘর নির্মাণেও ত্রাতার ভূমিকায়। পরের বছর ১৯৪৪ এ শুরু হল দুর্ভিক্ষ। কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হল না খেতে পেয়ে। মানবিক গোপালচন্দ্রের মনপ্রাণ কেঁপে উঠলো দুঃখে। ধনী মহাজনের কাছে দশ হাজার টাকা ধার করলেন নিজে। এক মাড়োয়ারি সমাজসেবী ঝুনঝুনওয়ালাকে দিয়ে বিভিন্ন স্থানে খুললেন লঙ্গরখানা। আর্ত মানুষজন পেলো বেঁচে থাকার উপাদান।
১৯৪৫ এর ২৯ শে ডিসেম্বর মহিষাদলে এসেছিলেন গান্ধীজী। পাঁচ বছরের ছেলে স্বরাজকে নিয়ে দেখা করলেন গান্ধীজীর সাথে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল খুবই। এরপর দেশ স্বাধীন হল। পটাশপুরের বিখ্যাত 'তুলসীচারার মেলা' পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন গোপালচন্দ্র। মেলা হয়ে উঠলো আরও সুশৃঙ্খল। মেলায় আগত পুণ্যার্থী, দর্শনার্থী ও দোকানদারদের পানীয় জল সরবরাহ সহ নানাবিধ স্বাচ্ছন্দ্যের সুব্যবস্থা করলেন। ক্রমশঃ এই মেলার প্রচার ও প্রসার বাড়তে লাগলো। তিনি ছিলেন উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে একমেবাদ্বিতীয়ম একজন কর্মঠ পুরুষ। দশগ্রামে ১৯৫১ তে রবিবারের করমুক্ত হাটের প্রচলন হয় তাঁর হাত ধরেই।
রাজনীতিতেও তাঁর দৃপ্ত পদচারণা ছিল। ১৯৫২ সালে প্রথমবার এবং ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয়বার সবংয়ের বিধায়ক পদে নির্বাচিত হলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ৪ নং দশগ্রাম অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচিত হন। সবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ১৯৬৬-১৯৭৭ পর্যন্ত। সেসময় নানা উন্নয়নমূলক কাজে তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি।
দাদা সতীশচন্দ্রের স্মৃতিতে দশগ্রামে ১৯৪০ সালের ১৮ জানুয়ারি একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করে নাম দেন দশগ্রাম সতীশচন্দ্র এম.ই. স্কুল'। পরবর্তীকালে এটির নতুন নামকরণ হয় 'দশগ্রাম সতীশচন্দ্র সর্বার্থসাধক শিক্ষাসদন'। এই বিদ্যালয়ের আজীবন (১৯৪৪-১৯৮৮) সম্পাদক ছিলেন গোপালচন্দ্র দাস অধিকারী। গোপালচন্দ্র দাস অধিকারীর হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছে দশগ্রাম সতীশচন্দ্র সর্ব্বার্থসাধক শিক্ষাসদন এবং দশগ্রাম মঙ্গলভারতী খাজুরী বালিচক বালিকা বিদ্যালয়। এছাড়া তিনি যুক্ত ছিলেন খাজুরী বালিচক প্রাথমিক বিদ্যালয়, সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়, বসন্তপুর ঝাড়েশ্বর বাণীভবন, দশগ্রাম গিরিশচন্দ্র নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়, চাঁদকুড়ি ইউনিয়ন হাইস্কুল, আদাসিমলা দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ, হরিরহাট অনাথ স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয়, দশগ্রাম মঙ্গলভারতী প্রাক্ বুনিয়াদি বিদ্যালয়, বাদলপুর হাইস্কুল (নিম্ন বুনিয়াদী), বেনেদিঘী হাইস্কুল, পটাশপুরের 'তুলসীচারা মেলা', বেল্কীর হাট, দশগ্রাম হাটের সঙ্গে। সবংয়ের মাদুর শিল্পের উন্নতিসাধনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাদুর শিল্পী ধরনিধর জানাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কাছে।
কৃতজ্ঞতা -স্বরাজ রঞ্জন অধিকারী, গৌতম কুমার পাত্র ও শান্তনু অধিকারী
🍂
0 Comments