শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৮
সালেহা খাতুন
জীবনের এক একটি পর্বের গুরুত্ব ভিন্ন ভিন্ন রূপে হাজির হয়েছে আমার কাছে। মন কখনও কখনও খুব দুর্বল হয়ে যায় আবার কখনও কখনও হয়ে পড়ে একগুঁয়ে জেদী। বিশিষ্ট মানুষজনের কাছ থেকে তাই নানান অভিধা পাই – কেউ বলেন সিরিয়াস, কেউ বা বলেন ক্রিটিক্যাল, কেউ বলেন ল্যাদখোর আবার কারো কাছে পরিচিতি ধুরন্ধর রূপে কিংবা নির্ঘাত বোকা মেয়ে বলে। তবে কন্যা আমার চরিত্র চিত্রণ করে বলেছে – “ নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তোমার এক এবং একমাত্র স্বভাব।”
শুধু কি বিলিয়েই দিয়েছি? নিইনি কারো থেকে? ঋণ স্বীকার করবো বলেই তো নিজের জীবনের গল্প বলতে নেমেছি। এ গল্পের শেষ কোথায়? কলেজে এই যে বার বার ন্যাক ভিজিট হয়, এন. আই. আর. এফ. – এর র্যাঙ্কিং বিচার হয় (আমাদের তনুশ্রী, পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক; যে এন. আই.আর.এফ-এর গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে বিরামহীন ভাবে) , সে সবের নিমিত্তে কলেজকে এগিয়ে দেওয়ার বাসনায় নিজেরই তো পুনর্নির্মাণ করি আমরা। প্রথমবার ন্যাক ভিজিটের পর আমার প্রথম মুদ্রিত বই প্রকাশ পায়। দ্বিতীয়বার ন্যাক ভিজিটের আগে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করি, তৃতীয়বার ন্যাক ভিজিটের আগে প্রকাশ করি দ্বিতীয় গ্রন্থটি। ন্যাশনাল সেমিনারে রিসোর্স পার্শন রূপে বক্তব্য রাখি। বক্তব্যকে প্রাঞ্জল করার জন্য পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহার করি। কিন্তু ঐ সময়, ২০১৬ সালে, বাংলায় স্লাইড তৈরি করা বেশ জটিল ছিল আমার কাছে; বক্তৃতার আগের দিন লাইব্রেরিতে বসে লাইব্রেরিয়ান নিতাই মণ্ডলের সহায়তায় মোট বাহান্নটি স্লাইড সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে পিংলা কলেজে বক্তব্য রাখি। ভালো ফিডব্যাক পাই।
মেদিনীপুর কলেজের লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরিয়ান ও লাইব্রেরির সমস্ত স্টাফদের সহায়তা সব সময়ই পাই। অধ্যয়ন থেকে গবেষণা এবং লেখালেখির ক্ষেত্রে এ এক অনন্য নির্ভরতা আমার। যখন পিএইচ.ডি-র কাজ করছি, ২০০৫ সাল নাগাদ ইন্টারনেটের সাহায্য নিতাম লাইব্রেরি থেকেই। লাইব্রেরিয়ান রত্না সনগিরি আমাকে যত্ন করে কালচারের উপর নানান কোটেশন সংগ্রহ করে দিতেন। কম্পিউটার ব্যবহারে তখনও এতোটা দক্ষ হই নি কিনা। পরে যখন কলেজের দেড়শো বছর উদযাপন উপলক্ষে ২০২২-এ মেদিনীপুর কলেজ ম্যাগাজিন থেকে একশোটি প্রবন্ধ সংকলন করে “সিলেক্টেড আর্টিকেল” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ হয়, সেটির প্রধান সম্পাদক মাননীয় অধ্যক্ষ হলেও যাবতীয় দায়দায়িত্ব ছিল সৈকত, রত্নাদি এবং আমার উপর। ঐ ২০২০ থেকে ২০২২ সময়কালীন করোনাপীড়িত পৃথিবীতে আমরা লাইব্রেরির রেয়ার কালেকশানের ঘরে বসে কাজ করে যেতাম সমস্ত বিপদকে তুচ্ছ করে। সে সময় গভীরভাবে জেনেছি এবং চিনেছি মেদিনীপুর কলেজের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে। নিজেই যেন একটা আর্কাইভ হয়ে গিয়েছিলাম।
🍂
লাইব্রেরির তারাপদদা, সুকুমারদা এঁদের কথাও ভোলার নয়। সুকুমারদা এমনও হয়েছে, হয়তো কলেজ আওয়ারে কোনো বই খুঁজেছি অথচ পাই নি; পরে সেই বই তিনি আমার কোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়েছেন। লাইব্রেরি থেকে একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ পঁচিশটি বই নিতে পারেন। পাঁচটা সেমিস্টারে পড়াতে গেলে বা কিছু লিখতে গেলে ঐ পঁচিশটির গণ্ডি মাঝে মাঝেই পেরিয়ে যাই, তখন লাইব্রেরিয়ান অভিজিতদা নিজের নামে বই দিয়েছেন।
এতো পড়াশোনা করে কী লাভ? পড়া ক্রিয়ার সাথে লেখা ক্রিয়াটিকেও তাই জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। চতুর্থবার ন্যাক ভিজিটের আগে নিজেকে কবিরূপে পরিচিতি দেওয়ার চেষ্টা করছি। হাতে তখন অন্তত তিনটি কাব্যগ্রন্থ থাকবে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোয় ২০২২-এ। এর আগে দু’হাজার উনিশ-একুশ মেয়ের উচ্চমাধ্যমিক পর্বের পড়াশোনার দিন। নিজের মেধা-মননকে এক করে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে ভালো কিছু করার।
ইলেভেনের সব পরীক্ষাগুলি মোটামুটি নির্বিঘ্নে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসে গেলো লকডাউনের যন্ত্রণাকাতর দিন। সারা পৃথিবীর সাথে ভুগলাম আমরাও। সত্যিই সময় বড়ো চিকিৎসক। আঘাত হানলেও, সে দুঃসময়ও আমরা পেরিয়ে এসেছি বহু কিছুর বিনিময়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার রুটিন হাতে পেয়েও বার বার বদলাতে লাগল সরকারি সিদ্ধান্ত। পরীক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে সম্পূর্ণ তৈরি থেকেও এক অনিশ্চয়তায় ভুগতে লাগলো। তখন বেঁচে থাকাটাই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, আর পরীক্ষা! তবুও একজন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে দিনরাত কাটিয়ে মানসিক যন্ত্রণাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা করে বিজ্ঞান সম্মত সিদ্ধান্তই গৃহীত হলো। পরীক্ষার্থীদের মতামত নিয়েও জনমত গঠনের চেষ্টা লক্ষ করা গেল। আনন্দবাজারের মেদিনীপুরের পাতায় মেয়ের মতামতও প্রকাশ পেল। মাধ্যমিক এবং ইলেভেনের পরীক্ষায় মেয়ের পরীক্ষার ফল যথেষ্ট ভালো ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে পঁচানব্বই শতাংশের উপর নম্বর পেল। ৯৫.৪০%।
এরই মাঝে করোনা কেড়ে নিল অনেক আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনকে। ২০২০-র ডিসেম্বরে শ্বশুরমশাই চলে গেলেন। তখন কলেজের পড়াশোনা সবকিছু অনলাইনে চলছে। গুগুল ফর্মে ইন্টারনাল পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। মুডুল – এ (LMS) নেওয়া হচ্ছে এণ্ড সেমিস্টারের পরীক্ষা। জুম, গুগুল মিটে ক্লাস নেওয়া চলছে। শ্বশুরের শেষকৃত্যে মেদিনীপুর থেকে আগাপুর প্রায় দুশো কিলোমিটার, যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে লিঙ্ক দিচ্ছি শিক্ষার্থীদের। তাদের সুবিধা-অসুবিধায় ফোন ধরে যাচ্ছি। সামনে বসে আছেন পিতৃহীন ব্যক্তিটি। পিতার শেষকৃত্যে চলেছেন তিনি। অথচ একটুও বিরক্ত হচ্ছেন না আমার উপর। পরীক্ষা মানে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নির্মাণের এক একটি প্রক্রিয়া। বোঝেন সে কাজে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ফাঁক রাখা যায় না। ছোটো থেকেই মৃত্যুসংবাদ আর একজনকে অস্থির করে তোলে। সেও বসে আছে চুপচাপ। তাহলে আমি কি পাষাণ নির্মিত? আসলে গীতার কর্ম করে যাওয়ার বাণীতে অনুপ্রাণিত আমি। বিবেকানন্দের কর্মযোগ পড়েছি মনোযোগ সহকারে।
২০২১ এর নভেম্বরে চলে গেলেন বাবা। পুরো পৃথিবীটাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গেল বদলে। সেদিনও সকালে ঘুম থেকে উঠে ইন্টারনালের প্রশ্ন তৈরি করছি পড়ার টেবিলে বসে, মা ফোন করে বললেন ; “চলে আয় তোর বাবা এন্তেকাল করেছে।” মেদিনীপুর থেকে সাহাপুরের বাড়িতে গেলাম, বোনকে পাঁচলা থেকে সঙ্গে নিয়ে। কেননা বোনকে খবরটা কেউ জানাতেই পারে নি। ঐ যে নরম মনের অধিকারী। প্রত্যেকের শোক প্রকাশের ভাষা ভঙ্গি আলাদা। ভাই বোন কাতর হয়ে পড়লো। আমি নিজেকে দৃঢ় করে রাখলাম। ধর্মীয় এবং সামাজিক কিছু আচার পালন করলাম। পুরুষরা বাবাকে কবরস্থ করে মাটি দিল কিন্তু কী আশ্চর্য এক বিধান! নারীরা মৃত্যুর পর কবরস্থানে মাইয়েত হিসেবে ঢুকতে পারবে কিন্তু জীবিতাবস্থায় সেখানে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাবার স্মৃতিচারণায় আশাকরি কেউ বাধা দেবে না। তাই মেদিনীপুর কলেজের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের যে শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ নম্বর পাবে তার গোল্ড মেডেলটি বাবার স্মৃতিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করি, সেই বছর থেকেই। নাম দিই – “সেখ আব্দুল ওয়াদুদ স্মৃতি পুরস্কার”।
করোনাকালে মেধার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে মেয়ের মতামত
তবে ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। বাবা যখন চলে যান তখন লকডাউন কিছুটা শিথিল ছিল কিন্তু ২০২১ - এর মে মাসে ভাসুরের শেষকৃত্যে যেতে পারিনি। এই যেতে না পারার তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছিল কোভিডকালে।
এসময়ই ২০২০-র জুলাই থেকে ২০২২-এর জুন পর্যন্ত বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। অধ্যাপক ড.ফটিক চাঁদ ঘোষ নিলেন বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব। ফটিকদা মেদিনীপুর কলেজে জয়েন করেন ২০১৫ সালে। করোনাকালে সব কিছু অনলাইনে চলছে। শিক্ষার্থীদের ফেয়ারওয়েল, নবীনবরণ, পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, বীতশোক স্মারক বক্তৃতা নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন হলো জুম এবং গুগুল মিটে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হলো। ফটিকদার সাথে বন্ধনও বেশ দৃঢ় হলো। সমস্ত কাজ সিদ্ধান্ত আমরা নিতে লাগলাম ঐ স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে। আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির অজস্র অবকাশ নির্মিত হয় কিন্তু সেগুলি আমরা দৃঢ় হাতে দমন করি, কেননা আমাকে তিনি সস্নেহ দৃষ্টিতে দেখেন। বোন বলে সম্বোধন করেন। তাঁর কবিতার বই “শ্লোগান যে কবিতা” আমাকে উৎসর্গ করেছেন। একজীবনে আর কত চাই?
0 Comments