কমলিকা ভট্টাচার্য
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলে উঠে চেয়ারে বসে নাচ্ছেন কেন? আগে স্টেজের কাছে গিয়ে সকলের সাথে নাচুন না।নাচের গান শুনলেই নীলা নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনা,হাত পা সারা শরীর নিজে নিজেই যেন দুলে ওঠে।সেদিন ছিল দুর্গা পুজোর ষষ্ঠী,চেন্নাইতে অ্যাসোসিয়েশনের পূজোয় কলকাতা থেকে নামী শিল্পী গান গাইতে এসেছিল। গান শুনতে নীলা আর জীবন দুজনেই খুব ভালোবাসে, তবে নাচটা যেমন নীলার প্রাণ থেকে আসে ঠিক তেমনই নীলার স্বামী জীবনের কাছে নাচটা ততটাই অপছন্দের।
তার উপর বাড়ির মেয়ে বউরা নাচবে তা প্রায় জাত যাওয়ার সমান।মান্ধাতার আমলের অনেক মূল্যবোধ যা আমাদের সমাজের স্তম্ভ সেগুলো অনায়াসে ত্যাগ করা গেলেও মেয়েদের নাচ নিয়ে তথাকথিত ধারণা গুলো ত্যাগ করা যেন বেশ অনৈতিক কাজ।
তবে সে সব কথা এখন থাক।এতদিনের বৈবাহিক জীবনে সুখের খোঁজে নীলা নিজের অনেক ভালো লাগার সাথে কি করে আপোষ করতে হয় সেটা সে শিখে গেছে, শুধু আপোষ বললে কিন্তু আবার জীবনের উপর অবিচার করা হবে কারণ অনেক কিছুই নীলা নিজের ইচ্ছেতেই ছেড়েছে জীবনকে ভালোবেসেই,জীবনের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে ,যেখানে জীবন তাকে কোনো ভাবে বারণ করেনি।সেই রকম নীলা জানে নাচ জীবনের পছন্দ নয়,অনেকবারই নীলা লক্ষ্য করছে তার নাচের প্রসঙ্গ আসলে জীবন তা এড়িয়ে চলে,কিম্বা বিয়ের প্রথম প্রথম সে একবার দুবার নেচে জীবনকে দেখাতে চেয়েছিল জীবন তখনও তাতে বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি,তাই নাচ নিয়ে নীলা কোনোদিন কোনো কথা জীবনের সাথে বিশেষ বলেনা।
আর মধ্যবিত্তের সংসারে গানের সুযোগ থাকলেও নাচের সুযোগ বিশেষ কোথায়। তাই নাচটা নীলার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কিন্তু নাচ নীলার ভিতরে বেচেঁ আছে ছাই চাপা ঘুমন্ত আগুনের মত ।
তাই সেদিন অনুষ্ঠানে সবাইকে নাচতে দেখে সে নিজেকে আটকাতে পারেনা,নীলা সব ভুলে নাচতে লাগে,যে নাচ বর্ষার মেঘ দেখে ময়ূরের নাচ,যে নাচ কীর্তনের তালে ভক্তের নাচ,যে নাচ সুরের তালে শিশুর নাচের মতই পবিত্র।
🍂
জীবনের ডাকে নীলার ঘোর কাটে,জীবন বলে "অনেক রাত হয়েছে বাড়ি চল"
জীবনের গলায় ঝড়ের পূর্বাভাস টের পায় নীলা।
জীবন গাড়ি আনতে হল থেকে বেরিয়ে যায়।
নীলাকে ঘিরে সবার হাততালি,চেনা অচেনা নানা মানুষের তার নাচের প্রসংশা সবই দূর থেকে ভেসে আসা শব্দের মত লাগে।নীলা এটা ভেবে কষ্ট পায় সে কি করে সব ভুলে এই ভাবে সবার সামনে নাচতে লাগলো,জীবনকে সে আজ বড় আঘাত করেছে।
সে দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে বসে।
জীবনের মুখ গম্ভীর, নীলা কি বলবে ভাবতে পারেনা ,গাড়িতে আসতে আসতে নীলার পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে, বাবারও কোনোদিন পছন্দ ছিলনা মেয়ে নাচ করে তাই কোনদিন নীলার সেভাবে নাচ শেখা হয়নি,তবে নীলা যেদিন সে অল ইন্ডিয়া নাচের প্রতিযোগিতায় ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে প্রথম হয়,সেদিন বাবার মুখে সে গর্বের হাসি দেখেছিল।
তবে
এরপর মাধ্যমিকে পড়া মেয়ে পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চে নাচ করবে,এতটা আশাকরা হয়ত একটু বেশি চাওয়া হত।
বাবার সে ছিল নয়নের মণি,আজকের দিনে এইকথা শুনে হয়ত অনেকে ভাববেন যে বাবা নিজের মেয়ের ভালো লাগার খেয়াল করেনা সেখানে আবার কিসের ভালোবাসা কিন্তু সেখানেই তো ভালোবাসা যেখানে সম্মান আর ভালবাসার জন্য সব ত্যাগ করা যায়।
তাই সেই শেষ নাচ আজ আবার এতদিন পর।
পুরো রাস্তা নীলা আর জীবন দুজনে কোনো কথা বলেনা।
রাতে বিছানায় জীবন আগে শুয়ে পড়ে,নীলা বিছানার ধারে বসে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ,ভেবে পায়না কি করে জীবন কে সরি বলবে। বাতাসে ভেসে আসে,আপনি তো দারুণ নাচেন,একদম ফাটাফাটি নেচেছিস,কি সুন্দর নাচ,অপূর্ব হাতের ভঙ্গিমা, অসাধারণ নাচ....
নীলার হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
হঠাৎ পিছন থেকে জীবন বলে ওঠে "তুমি কিন্তু সত্যিই খুব সুন্দর নাচ করো।"
নীলা একরাশ বিস্ময় নিয়ে জীবনের দিকে তাকায়।
জীবন হাত খেলিয়ে দেয়,নীলা জীবনের হাতে মাথা রাখে,জীবন তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
নীলার সবচেয়ে প্রিয় নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
নীলা মনে মনে হাসে জীবনটা সত্যিই পুতুল নাচ...
নিয়মের সুতোয় বাঁধা সবাই কিন্তু ভালোবাসার টানে সবকিছু আবার কত সুন্দর...
0 Comments