জ্বলদর্চি

শিশির কুমার ভাদুড়ী (নাট্যাচার্য, চলচ্চিত্রাভিনেতা, মেদিনীপুর)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫৩
শিশির কুমার ভাদুড়ী (নাট্যাচার্য, চলচ্চিত্রাভিনেতা, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

সালটা ছিল ১৮৮৯ এর ২ রা অক্টোবর। মহাত্মা গান্ধীর জন্মের ঠিক কুড়ি বছর অতিক্রান্ত। বাংলার বিখ্যাত অভিনেতা এবং নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী জন্মগ্রহণ করলেন মেদিনীপুর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ছোটবাজারে। এখানে ছিল তাঁর মামাবাড়ি। সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। যদিও তাঁর পৈতৃক বাসস্থান ছিল হাওড়ার রামরাজাতলাতে। কিন্তু মেদিনীপুরের মানুষ হিসেবে গর্ব করা যায়। তবে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নাটোরের আদি বাসিন্দা ছিলেন তাঁদের পূর্বতন লোকজন। 

বাবার নাম হরিদাস ভাদুড়ী। তাঁর ছেলে মেয়েরা হলেন গৌরী, শিশিরকুমার, তারাকুমার, বিশ্বনাথ, হৃষীকেশ, মুরারিমোহন এবং ভবানীকিশোর। এই পরিবারের একজন পূর্বপুরুষের নাম ছিল সুবুদ্ধি খাঁ। মোঘল আমলে তিনি ঢাকার সুবেদার ছিলেন। বহু পুরুষ ধরে তাঁদের পদবি ছিল ‘খাঁ ভাদুড়ী’। শিশির কুমার ভাদুড়ীর বাবার সময় থেকে এই 'খাঁ' বাদ দিয়ে কেবল 'ভাদুড়ী' ব্যবহৃত হতে লাগলো। 

মেদিনীপুরের কৃষ্ণকিশোর আচার্যের প্রথম সন্তান কমলেকামিনীকে বিয়ে করেন এই হরিদাস ভাদুড়ী। তিনি ছিলেন দারুণ সুন্দরী মহিলা। হরিদাস কাজের জন্য বার্মাতে থাকার ফলে মেদিনীপুরে বাপের বাড়িতেই থাকতেন কমলেকামিনী। সেখানে দাদু কৃষ্ণকিশোরের তত্বাবধানে শুরু হয় শিশু শিশিরের প্রাথমিক পাঠ। রামায়ণ, মহাভারত থেকে মাইকেলের কবিতা পাঠ করে শোনাতেন তিনি। দুই মামা দেবকিশোর এবং ফণীন্দ্রকিশোর ছিলেন মেদিনীপুরের নাট্যজগতের প্রতিনিধি। ফলে এভাবেই নাটকের প্রতি শিশির কুমার ভাদুড়ীর ভালোবাসার বীজ বপন শুরু হয়ে যায় সেসময় থেকেই। 
বিভিন্ন চরিত্রে শিশির কুমার ভাদুড়ী

ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষা মেদিনীপুর শহরেই করেছেন। এখানকার বিখ্যাত টাউন স্কুলে তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনার পর বাবা কলকাতায় বদলি হয়ে চলে আসায় কলকাতার সানকিডাঙায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এরপর কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় বসবাস। কখনও পার্শিবাগান, কখনও ঘোষ লেন। সবশেষে ২৭৮ বি টি রোড। এখানে থেকেই হয়ে ওঠেন অন্যতম নাট্য ব্যক্তিত্ব। 

১৯০৫ সালে তিনি কলকাতার বঙ্গবাসী স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯১০ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ (তখনকার জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ) থেকে ইংরাজী সাহিত্যতে স্নাতক ডিগ্রী (বি এ) অর্জন করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি নাট্যচর্চা থেমে থাকেনি এই মানুষটির। চুটিয়ে অভিনয় করতেন ছাত্রাবস্থাতেই। এই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে তিনি অসংখ্য অভিনয় করেছেন সেসময়। ১৯১২ সালে এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বৈকুণ্ঠের খাতা' নাটকে 'কেদার' চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন - 'কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। একদা ওই পার্টে আমার যশ ছিল'।
নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী

পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে (মেট্রোপলিটন কলেজ) অধ্যাপনা শুরু করেন। অসাধারণ কন্ঠের অধিকারী এই মানুষটি শ্রেনীকক্ষের মধ্যেও সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন। চাকরিরত অবস্থায় থেকেই ইংরেজী ও বাংলা ভাষার বহু নাটকে অভিনয় করে প্রতিষ্ঠিত হন। এতদিন তিনি সৌখিন অভিনেতা হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝলেন, চাকরি আর অভিনয় একসাথে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি অবশেষে ১৯২১ সালে কলেজে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে অভিনয়কেই বেছে নেন পেশা হিসেবে। অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন পেশাদারি নাট্যমঞ্চে। শুরু হল বাংলা নাট্যজগতের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাঁর অভিনয় দক্ষতার গুণে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বহু মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। একসময় নাটকের জন্য মেদিনীপুর শহরের বিদ্যাসাগর হলেও এখানকার অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করে গিয়েছেন। 

তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা থিয়েটারের অন্যতম পথিকৃৎ। একজন দক্ষ অভিনেতা, সুচারু পরিচালক, মহান নাট্যকার এবং করিৎকর্মা দৃশ্য ডিজাইনার। নাট্য ব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষের পর তাঁকে সবাই ভারতীয় নাট্যজগতে বাস্তববাদ এবং প্রকৃতিবাদের অন্যতম প্রবর্তনকারী এবং সূচনাকারী হিসেবে মান্যতা দিয়ে এসেছে। 

১৯২০-২১ সালে সেসময়কার নামকরা চলচ্চিত্র নির্মাতা সংস্থা ম‍্যাডান কোম্পানি সিনেমার পাশাপাশি থিয়েটার ব্যবসায় যুক্ত হয় 'বেঙ্গল থিয়েট্রিক‍্যাল কোম্পানি' নাম দিয়ে। এই ম্যাডান কোম্পানি প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ (১৯১৯) এবং প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাইষষ্ঠী’ (১৯৩১) নির্মান করেছিল। ম‍্যাডান কোম্পানির মূল মালিক জে. এফ. ম‍্যাডানের জামাই রুস্তমজী ধোতিওয়ালা ছিলেন এই ‘বেঙ্গল থিয়েট্রিক‍্যাল কোম্পানি’র দায়িত্বে। তিনি শিশির কুমার ভাদুড়ীকে রাজি করালেন তাঁদের কোম্পানিতে যোগ দিতে। এখানে যোগ দিয়ে প্রথমেই তিনি মঞ্চস্থ করলেন ‘আলমগীর’। 

১৯২১ সালের ১০ ই ডিসেম্বর ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানির রঙ্গালয়ে 'আলমগীর' নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেন শিশির কুমার ভাদুড়ী। পেশাদার নাট্যমঞ্চে তাঁর আবির্ভাব নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের এই ‘আলমগীর’ নাটক দিয়েই। আলমগীরের পরেই ১৯২২ সালে ‘রঘুবীর’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯২২ সালেই মঞ্চস্থ করেন 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটক। এতে রাজগুরু চাণক্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ১৯২৩ এ মঞ্চরূপ পায় 'সীতা' নাটক। একসময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাতটি নাটকের পরপর প্রযোজনা করেছেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 'কাহিনি' অবলম্বনে ‘বিসর্জন’ নাটক (১৯২৬)। ঠিক পরের বছর (১৯২৭) 'প্রজাপতির নির্বন্ধ' অবলম্বনে মঞ্চস্থ করেন 'শেষরক্ষা'। ১৯৩০ এ করেন 'তপতী' নাটক। শুধু কবিগুরুর রচনা নয়, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'ষোড়শী'রও নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করেন। নাটক সম্পাদনা থেকে শুরু করে নাটকের সামগ্রিক উপস্থাপনায় তিনি আনলেন নতুনত্বের ছোঁয়া। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পেলেন বিপুল জনসমর্থন। 

ইডেন গার্ডেন্স-এ অনুষ্ঠিত 'ক‍্যালকাটা ফেস্টিভ্যাল' এ মঞ্চস্থ করলেন 'সীতা'। নাম ভূমিকায় প্রভা দেবী এবং রামচন্দ্রের ভূমিকায় শিশিরকুমার ভাদুড়ী। পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করে সকলের সমীহ আদায় করে নেন তিনি। এছাড়াও এতে অভিনয় করেছিলেন বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, ললিতমোহন লাহিড়ী, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, জীবন গঙ্গোপাধ‍্যায়, রবি রায় প্রমুখ। সীতার সাফল্যে শিশির কুমার চাইলেন নিজের একটা পৃথক নাট্যদল তৈরি করতে। ১৯২৩ সালে তিনি নিজে একটি নাট্যদল গঠন করেন। এরকম অসাধারণ সাংস্কৃতিক মানুষ নাট্যজগতে প্রবেশ করার ফলে বহু মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকেন রঙ্গমঞ্চের প্রতি। ফলে নাট্যজগতে শুরু হয় একটা জোয়ার। 

সেসময় 'সীতা' দারুণ জনপ্রিয় হওয়ায় অ্যালফ্রেড থিয়েটার (গ্রেস সিনেমা) ভাড়া নেয় 'সীতা' মঞ্চস্থ করার জন্য। কিন্তু সেখানে তা অভিনয় করানো সম্ভব হয়নি কপিরাইট আইনে বাধা পেয়ে। ফলে সেখানে 'বসন্তলীলা' গীতিমালা অভিনয় করেন শিশির কুমার ভাদুড়ী। এই গীতিমালাতে কিছু পুরোনো গানের সাথে হেমেন্দ্রকুমার রায় ও নৃত‍্যবিশারদ মণিলাল গঙ্গোপাধ‍্যায়ের লেখা বেশ কয়েকটি গান গাইলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। শুরু হল কৃষ্ণচন্দ্র দে'র যুগ। সেই দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের ২১ শে মার্চ। 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা 'সীতা' নাটকের সত্ত্ব আর্ট থিয়েটারের হাতে চলে গেলেও তিনি দমে যাননি। বরং রামায়ণের এই পৌরাণিক কাহিনিকে পাথেয় করে নতুনভাবে চিত্রনাট্য লিখে দেন যোগেশ চৌধুরী। এছাড়াও এই নাটকের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় এবং তথ্য যাতে অক্ষুন্ন থাকে, সে বিষয়ে নজরদারির দায়িত্ব নেন সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যামিনী রায়, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, নলিনীকান্ত সরকার প্রমুখ বিশিষ্ট লোকজন। আর সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নেন কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে শিশির কুমার ভাদুড়ী মনোমোহন পাঁড়ের বিডন স্ট্রিটের ‘মনোমোহন থিয়েটার’ লিজ নিয়ে নতুন করে সাজিয়ে নাম দিলেন ‘নাট‍্যমন্দির’। এখানেই ১৯২৪ সালের ৬ ই আগস্ট এই নতুন ‘সীতা’ মঞ্চস্থ হল। এতে অভিনয় করলেন বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, তারাকুমার ভাদুড়ী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, ললিতমোহন লাহিড়ি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, তুলসীচরণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, পান্নারানী, ঊষারানী, নীরদাসুন্দরী, জীবন গাঙ্গুলি, রবি রায় প্রমুখ। গান লিখলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, সুর রচনায় নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার, নৃত‍্য পরিকল্পনায় মণিলাল গঙ্গোপাধ‍্যায় এবং শিল্পনির্দেশনা ও রূপসজ্জায় চারু রায় ছিলেন। ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেল এই 'সীতা'। ঝামা ঘসে দিলেন আর্ট থিয়েটারকে। পরে ১৯৩১ সালে 'সীতা' নাটক মঞ্চস্থ করতে আমেরিকাও গিয়েছিলেন তিনি। 

বিশাল জনপ্রিয়তা পেলেন তিনি। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একটার পর একটা নাটক উপহার দিয়ে গিয়েছেন সেসময়। 'চাণক্য' ও 'রঘুবীর' চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল নজরকাড়া। একজন জাত অভিনেতার ছাপ রেখে গিয়েছিলেন প্রতিটি অভিনয়ে। নাট্যমঞ্চ ছেড়ে পা দিলেন চলচ্চিত্র মঞ্চে। তাঁর সাফল্য এখানেও আটকে রাখতে পারেনি কেউ। ম্যাডান কোম্পানির স্টুডিয়োতে শিশিরকুমার ‘মোহিনী’ আর ‘একাদশী’ নামে দুটি নির্বাক ছবি পরিচালনা করেন। তিনিই ছিলেন প্রধান অভিনেতা। ১৯২২ সালের ২ রা সেপ্টেম্বর কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে সেই ছবি মুক্তিলাভ করে। ম্যাডানদের হয়ে তাঁর পরিচালিত নির্বাক ছায়াছবি ‘কমলে কামিনী’ মুক্তি পায় ১৯২৪ এ। এই ম্যাডান কোম্পানির সঙ্গেও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সম্পর্ক। যে ম্যাডন থিয়েটারে তাঁর উত্থান, সেখানে মতানৈক্য দেখা দিলে পরবর্তীতে ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানিও ছেড়ে দেন। 

ক্যামেরাম্যান ননী স্যান্যাল এবং নরেশচন্দ্র মিত্রকে নিয়ে শিশিরকুমার তৈরি করলেন 'তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি'। এটির স্টুডিয়ো ছিল দমদম রোড এবং নাগেরবাজার রোডের সংযোগস্থলে। প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ব্যারিস্টার বি কে ঘোষ। সিনেমায় সম্পূর্ণ বাঙালি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল এটি। বহু মানুষ যুক্ত হলেন এখানে। এই কোম্পানির প্রথম ছবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আঁধারে আলো’। শিশিরকুমার ভাদুড়ী পরিচালনা ও অভিনয় করেন এতে। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশ চৌধুরী, দুর্গারাণী প্রমুখ। ১৯২২ এ রসা থিয়েটারে এটি মুক্তি পায়। রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র(১৯২৯) নির্মাণ করেন। এটির প্রযোজনা করে ইস্টার্ন ফিল্ম সিন্ডিকেট। এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী, বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, যোগেশ চৌধুরী, কঙ্কাবতী, শেফালিকা প্রমুখ। ১৯৩২ সালের ১ লা জুলাই নিউ থিয়েটার্সের সবাক ছবি ‘পল্লীসমাজ’ মুক্তি পায়। এটির চিত্রনাট্য এবং পরিচালনা করেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। নাট্যমঞ্চে দাপিয়ে দেওয়া 'সীতা' তাঁর পরিচালনায় ১৯৩৩ এর ২৮ শে অক্টোবর চিত্রা এবং নিউ সিনেমায় চলচ্চিত্র আকারে মুক্তিলাভ করে। এতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন বিষাণচাঁদ বড়াল এবং সম্পাদনা করেন সুবোধ মিত্র। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আঁধারে আলো' এবং 'চন্দ্রনাথ' সিনেমাতেও অভিনয় ও পরিচালনার দায়িত্ব নেন। শিশির কুমার পরিচালিত ও অভিনীত সবাক ছবিগুলোর মধ্যে ‘পল্লীসমাজ’, ‘সীতা’, ‘টকি অব টকিজ’, ‘চাণক্য’, ‘পোষ্যপুত্র’ উল্লেখযোগ্য। অনুরূপা দেবীর এই 'পোষ্যপুত্র' সিনেমায় নিজের পরিচালনার বাইরে তিনি অভিনয় করেন। ছবিটি ভ্যারাইটি পিকচার্সের প্রযোজনায় সতীশ দাশগুপ্তের পরিচালনায় নির্মিত হয়। 

এই ‘টকি অব টকিজ’ ছিল শিশির কুমার ভাদুড়ীর জনপ্রিয় নাটক 'রীতিমতো নাটক' এর চলচ্চিত্র রূপ। এটির প্রযোজনা করে বিখ্যাত কালী ফিল্মস। ১৯৩৭ এর জানুয়ারিতে শ্রী সিনেমায় মুক্তি পায়। উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, এই মুহূর্তে শিশির কুমার ভাদুড়ীর এই 'টকি অফ টকিজ' সিনেমাটি ছাড়া আর কোনও সিনেমাই সংরক্ষিত নেই। তাঁর পরিচালিত 'চানক্য' চলচ্চিত্র ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে উত্তরায় মুক্তি পায়। পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে তিনি যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ ও অভিনয় করেছেন সেগুলি হল -- চাণক্য (১৯৩৯), টকি অফ টকিজ (১৯৩৭), সীতা (১৯৩৩, রাম চরিত্র), পল্লী সমাজ (১৯৩২, রমেশ চরিত্র), বিচারক (১৯২৯), আঁধারে আলো (১৯২২, সত্যেন্দ্র চরিত্র), বারের বাজার (১৯২২), কমলে কামিনী (১৯২২), মোহিনী (১৯২১), পোষ্যপুত্র ইত্যাদি ছায়াছবিগুলি।

১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান 'পদ্মভূষণ' সম্মাননায় ভূষিত করে। কিন্তু তিনি এই পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন। আসলে তাঁর বক্তব্য ছিল, যদি তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করেন তবে জনসমাজে ভুল ব্যাখ্যা যাবে যে, ভারত সরকার এদেশে নাট্য সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে আন্তরিক। 

তিনিই বাংলা নাটকের আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন বলা যায়। বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগে তিনিই প্রথম নাটকের মঞ্চসজ্জা এবং আলোর ব্যবহারের প্রচলন করেছিলেন। এরফলে নাট্যশিল্পীরা আরও সুন্দরভাবে তাঁদের দক্ষতা পরিস্ফুটন করতে সচেষ্ট হয়। শিশির কুমার ভাদুড়ী এবং উষাদেবীর একমাত্র সন্তান হলেন অশোক ভাদুড়ী। ১৯৫৯ সালের ৩০ শে জুন কলকাতার বরাহনগরে নিজের বাড়িতেই মৃত্যু হয় এই মহান নাট্যাচার্যের। মেদিনীপুরের সাথে নিবিড় সম্পর্কের জেরে আজও মেদিনীপুর মনে রেখেছে মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটিকে। 
তথ্যসূত্র : শহর মেদিনীপুরের কথা (সম্পাদক - তাপস মাইতি, আনন্দবাজার পত্রিকা, বাংলালাইভ ডট টুডে, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, যাপনচিত্র, অনুশীলন ডট ওআরজি, অবসর ডট নেট, দি ওয়াল ইত্যাদি।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments