জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /মেমারি গেম। পর্ব ৬

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
মেমারি গেম।  পর্ব ৬

দেখতে দেখতে সেই দুর্ভাগ্যজনক রাতের পরে পনেরো দিন কেটে গেছে। মহিমা এবং সুশান্ত এখন একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের আশ্রয়ে। এককালে কেন্দ্রটি কোন এক সাধারণ বৃদ্ধাশ্রমের অংশ ছিল। যার নাম ছিল রেপোজ, যার মানে দিন ফুরানো ঘর হারানো মানুষের শেষ দিনগুলি কিছুটা শান্তি ও বিশ্রাম দেওয়ার জন্য এক আলয়। এখন এরই একটা অংশ হয়ে গেছে সরকারী পুনর্বাসন কেন্দ্র। নানা রকম মানুষ এখানে থাকে। কেউ হয়ত স্মৃতি হারিয়ে ভুলে গেছে ঘরের ঠিকানা, কারো হয়ত সব আত্মীয়রা কোনও দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। 

মহিমা এবং সুশান্ত এখানে আশ্রয় পেলেন, একজন পুরুষ বিভাগে এবং অন্যজন মহিলা বিভাগে। থাকার ঘুমোবার জন্য ঘরগুলো আলাদা আলাদা। কিন্তু সবার বসার জন্য একটা কমন লাউঞ্জ। সেই লাউঞ্জে বসলে কিছুদূরেই দেখা যায় এক নদীর পাড়, অনেক দূর পর্যন্ত চোখ চলে যায়, কোন দেয়ালের বাধা নেই মাঝখানে। আঁকাবাঁকা ছোট্ট সেই নদীর দিকে তাকিয়ে বসে থাকে সঙ্গীহীন অন্ধকার কিছু মানুষ। যাদের জীবন আটকে আছে হতাশা আর অনিশ্চয়তার মাঝখানে। এখানে তারা বসে বসে ভাবতে পারে, কেউ মানা করবে না। আর আঁকাবাঁকা বাগানের চারপাশে ঘিরে হাঁটার পথ। সন্ধ্যে হলেও যেখানে আশ্রিতেরা অন্ধকার অবধি ঘুরে বেড়াতে পারে। আবার ইচ্ছে হলে নদীর দিকে তাকিয়ে দিকহীন শূন্যতার মধ্যে ডুবে যেতে পারে । 
 
🍂
ad

মহিমা এবং সুশান্তর স্মৃতিশক্তি এখনো ফেরেনি। দুজনেই তাই নিয়ে হতাশ হয়ে উঠছেন দিন দিন। তবে একটা পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। দুজনের যে তীব্র বিতৃষ্ণা যা একসময় বিবমিষারই সামিল ছিল, তা যেন একটু একটু করে ফিকে হচ্ছে। হতাশা থেকে নতুন একটা বিকল্প মাঝে মাঝে দুজনেরই মাথায় চকিত উঁকি দিয়ে আবার চলে যায়। কর্তৃপক্ষ এখানে ভালোও না খারাপও না উদাসীন। মানুষের স্মৃতি চলে গেলেও অনুভুতি যায় না, একটু মানবিকতার অপেক্ষা থাকে। সুশান্ত আর মহিমার গল্প প্রায় সবাই জানে। তাদের নিয়ে হাসাহাসি ফিসফাস বা আঙ্গুল দিয়ে দেখানো দুজনের চোখে পড়ে মাঝে মাঝে। তাঁদের মাথায় কথাটা এখন পরিষ্কার, যদি একবার তাঁরা কেবল মেনে নেন পুলিশের কথা, তাহলেই এই নির্লিপ্ত নরক থেকে তাঁরা বেরিয়ে যেতে পারবেন। তখন তাঁদের স্থান হবে বৃদ্ধাশ্রমে, যেখানে যাই হোক স্বাভাবিক মানুষ থাকেন, সেখানে অনেক সামাজিক অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, পুজো আচ্চা এমনকি মাঝে মাঝে এক্সকারশান, সংসার থেকে ছুটি পাওয়া মানুষগুলো চাঙ্গা থাকে অনেক। এনজিওরা এবং মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলি এসে মিষ্টি বিতরণ করে। বিদেশ থেকে অনেকের ছেলে মেয়ে দেখা করতে আসে। দুজনেরই লোভ হয়, কিন্তু তাও কি সম্ভব! এরকম একটা উদ্ভট ব্যাপার কি মেনে নেওয়া যায়?

যেখানে মানুষ ফেল মেরে যায় সেখানে দৈবী শক্তি এসে পথ দেখান। কখনো আসেন দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে, কখনো আসেন ধর্মগুরু হয়ে। আমাদের গল্পে এদিন সর্প দেবতা আবির্ভূত হয়ে নায়ক নায়িকার জীবনে এন্ট্রি নিলেন। 

তখন বেলা প্রায় বিকেল চারটা, ছায়াগুলো ছিল দীর্ঘ এবং পথটি আলো এবং অন্ধকারের মিশ্রণ ছিল যা প্রায়শই আপনাকে প্রলুব্ধ করে এবং কখনও কখনও আপনার কাছ থেকে ইচ্ছামতো কিছু লুকিয়ে রাখে। সাপটি দু ফুট লম্বা ছিল এবং সম্ভবত এটি একটি ব্যাঙকে তাড়া করছিল এবং পায়ের শব্দ শুনে পথে আটকে যায়। 
 
মহিমার দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। তিনি দেখলেন ও তা দেখে রক্তের মধ্যে বরফ জমে গেল, তিনি নিথর হয়ে গেলেন। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার, ঠিক বিপরীত দিক থেকে সুশান্তও হেঁটে আসছেন সোজা তাঁরই দিকে। কি করে থামাবেন তাঁকে? হাত নাড়ালেই হয়ত সাপটা লাফ দেবে। চোখের ভঙ্গি করলেন, চোখ পাকালেন, চোখ পিটপিট করলেন, সুশান্ত দেখছেনই না তাঁর দিকে, নিজের মনে গুন গুন করতে করতে এগিয়ে আসছেন আরো কাছে। আর মাত্র ১০ ফুট দূর। মহিমা বুঝলেন যে করেই হোক সুশান্তকে থামাতে হবে। শুধু সুশান্ত নয়, তাঁরও বিপদ, সাপটা যে কাকে এটাক করবে বলা যায় না। মহিমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল ভেবে। খুব আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে তিনি এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে পিছিয়ে যেতে লাগলেন। সাপটি মাথা উঁচু করে স্থির হয়ে রয়েছে, মাথায় শ্রীকৃষ্ণের পায়ের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না তার জিভ বা সেটা মাঝখান থেকে কাটা কিনা। 

মহিমাকে পেছন দিকে হাঁটতে থাকা দেখা সুশান্ত খুব অবাক হয়ে গেলেন ও দাঁড়িয়ে পড়লেন। মহিমা কি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে নাকি? এই বয়সে এক মহিলাকে আক্রমণ করার কোনরকম ইচ্ছা বা সম্ভাবনা নেই সেটা কি মহিমা বোঝেন না? ঠিক এমন সময় সাপটার দিকে চোখ পড়ল সুশান্তর আর সাপটিকে দেখতে পেয়ে তিনিও নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, পা দুটো সীসের পাতের মত ভারী হয়ে যেন মাটিতে গেঁথে গেল। 

এই ফ্রিজ শটটা সম্ভবত দশ বারো সেকেন্ড ছিল কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা বাদ অনুযায়ী এই কয়েক সেকেন্ডই মনে হল একটি যুগ। দু'জনেই ঘামছেন, এই শেষ শীতের নরম ঠান্ডাতেও টপ টপ করে কপাল থেকে ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল শরীরে। ঘামতে ঘামতে দুজন অনন্তকাল অপেক্ষা করতে লাগলেন আর অপেক্ষা করতে লাগলেন। 

সাপেরা আইনস্টাইন পড়েনি, হয়ত তার কাছে এই অপেক্ষা দশ পনেরো সেকেন্ডের বেশী নয় তবু সাপটি বিরক্ত হয়ে গেল অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে। এই দুই স্মৃতিহীন, সংসারহীন মানুষের কাছ থেকে কোন বিপদ আসবে তার মনে হল না । তাই আলতো করে মাথাটা নামিয়ে আবার ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল সুট করে এক লহমায়। । মহিমা আর সুশান্তএর মনে হল একটা বিদ্যুতের রেখা এক ঝলক দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। সাঁঝবেলায় বিষ নামিয়ে দিল না সাপটি, কিন্তু এর ফল হল অতি বিষম। মহিমা ভীষণ নারভাস হয়ে একদৌড়ে সুশান্ত এর দিকে এগিয়ে গেলেন এবং আকুল হয়ে জড়িয়ে ধরে ঝর্ণার মত কান্নায় আছড়ে পড়লেন সুশান্তর বুকে। সুশান্ত একই সঙ্গে দু দুটো বিপন্নতার সামনে পড়ে কি করবেন বুঝতে পারলেন না। সমুদ্রের ফেনার মত নীল অশ্রুতে তাঁর শার্ট ভিজে যাচ্ছিল। শুধু এক উপলব্ধি হল, বার বার দুবার জীবন চলে যেতে যেতে আবার ফিরে পেয়েছেন দুজনেই। এই ঘোরলাগা সন্ধ্যার অন্ধকারে আবেগের বন্যা এসে আছড়ে পড়ল হঠাত আধবুড়ো সুশান্তর আত্মায়। মনে হল এই সন্ধ্যা রোজকার মত না, এতে বিশেষ কিছু আছে। নিজের অজানতে সুশান্ত হঠাৎ দেখতে পেলেন তিনি মহিমার গাল দুই হাতে পদ্মফুলের মত ধরে রয়েছেন, আর তাঁর ব্যগ্র অব্যবহৃত ঠোঁট দুটি নেমে যাচ্ছে এই মহিলার নোনতা ঠোঁটে। সুশান্ত মহিমাকে চুমু খাচ্ছেন এমন একটা প্রাকৃত অসম্ভব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মহিমা প্রতিরোধ করছেন না, তাঁর ঠোঁটদুটি ফুলের পাপড়ির মত খুলে যাচ্ছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের মধ্যে হেঁটে আসছে আঁকা বাঁকা নদী থেকে উঠে আসছে এলোমেলো হাওয়া। তাতে উড়ছে দুজনেরই গায়ের চাদর। 

কয়েক পলক মাত্র। একটু পরেই মহিমা প্রায় কিশোরী মেয়ের মত সুশান্তর শরীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। সুশান্ত বোকা মুখ করে নদীর দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। 
 
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments