জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(চতুর্থ পর্ব) /মলয় সরকার

মার্কেজের খোঁজে
(চতুর্থ পর্ব)

মলয় সরকার


আমরা, মোটামুটি বিশ্রাম করে বিকালের দিকে বেরোলাম , কাছাকাছি জায়গাটার একটা প্রাথমিক পরিচয় নিতে। ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া রয়েছে একটা ব্যালকনি। সেখান থেকে দেখা যায় , সামনের রাস্তা তার এদিক ওদিক আর দূরে উঁচু বাড়িগুলোর বা চার্চের চূড়া।

 ভাবতেই আশ্চর্য লাগছে যে, আমি এখন কলম্বিয়াতে, যে কলম্বিয়া একসময় স্প্যানিশদের রাজত্বের মধ্যে ছিল এবং এই কার্তাহেনার  খ্যাতি এর দেওয়াল ঘেরা বৈচিত্র্যময় শহরের জন্য।এর আসল নাম Cartagena de Indias. স্পেনীয়রা এই শহরকে ব্যবহার করেছিল প্রধানতঃ ক্রীতদাস ব্যবসার জন্য, যাদের তারা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ধরে আনত; আর বলিভিয়ার থেকে আনা রুপো ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে।


 ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যে ১২০০০ খ্রীঃ পূঃ তেও এখানে জনবসতি ছিল। এখানেই হয়েছিল ১৭৪১ খ্রীঃ তে ব্রিটিশ আর স্পেনীয়দের মধ্যে যুদ্ধ।

এই কার্তাহেনার প্রতিষ্ঠা করেন ১৫৩৩ সালে  Pedro de Heredia, আর তার কিছুদিন মাত্র আগেই ১৫২৫ সালে  Bastidas যখন সান্তা মার্তা (Santa Marta) প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন, তখনই আসল কলম্বিয়ার বিজয়ের ভিত তৈরী হয়।১৪৯৯ সালে  কলম্বাসের সহযোগী Alonso de Ojeda প্রথম এখানে এসে নামেন। 
তিনি Santo Domingo বন্দর থেকে এখানে আসেন।

কার্তাহেনা স্পেনীয়দের কাছে অন্যতম  ব্যবসায়িক নৌবন্দর হিসাবেই গুরুত্ব পায়। এর পর ১৫৩৮ সালে Gonzalo Jiménez de Quesada বোগোটার প্রতিষ্ঠা করেন। কলম্বিয়ার সোনা ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিক্রী করে চটজলদি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নেই এখানে এই স্পেনীয়দের আগমন।
Iglesia de Santo Domingo র প্রধান দরজা

এই সোনার খনির বেশিরভাগটাই ছিল উত্তর , উত্তরপূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের কাছে।যখন স্পেনীয়রা এখনে এসেছিল, তারা সঙ্গে করে এনেছিল তাদের খ্রীষ্টধর্ম, তাদের সংস্কৃতি ও তাদের রোগব্যধি, যা বাইরের সভ্যতার থেকে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বেঁচে থাকা এখানকার সভ্যতাকে শেষ করে দিয়েছিল।

🍂
ad

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৮৩০-১৮৫৬) এই জায়গার নাম ছিল নিউ গ্রানাডা ।পরবর্তী কালে এর নাম হয় ইউনাইটেড  স্টেটস অফ কলম্বিয়া, এবং পরে ১৮৬৩ সালে এর নাম হয় রিপাব্লিক অফ কলম্বিয়া।

একটা কথা কিন্তু খুবই আশ্চর্যের যে, যে কলম্বিয়ার নাম ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নামে , তিনি কিন্তু এর আবিষ্কারকও নন, কখনও পা-ও রাখেন নি এখানে।অথচ তাঁকে সম্মান জানানোর জন্যই এই নাম দেওয়া। আর একটা কথা, জন্মসূত্রে কিন্তু কলম্বাস স্পেনীয়ও নন, ইটালিয়ান। তিনি যখন সমুদ্রযাত্রার যোগাড় করছিলেন, তার খরচের জন্য কিছুতেই কেউ এগিয়ে আসছিলেন না, তখন স্পেনের রাণী ইসাবেলা তাঁকে সমস্ত সাহায্য করেছিলেন। তাঁর যে তিনটি জাহাজ, সান্টা মারিয়া, পিন্টা এবং  নিনা ,তার খরচের জোগান দিয়েছিলেন এবং স্পেনের বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। তবে তাঁর সর্ত ছিল , এর থেকে যা পাওয়া যাবে তার ভাগ তাঁকে দিতে হবে।সেই শুরু স্পেনের সাথে তাঁর পরিচয়ের। মোট চারবার যে তাঁর সমুদ্রযাত্রা , তাতে প্রায় সমস্তটাই স্পেন সাহায্য করেছিল। ফলে, ইটালী যা লাভবান হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি হয়েছিল স্পেন।এবং সারা পৃথিবীর ইতিহাস তাতে বদলে গিয়েছিল।বাইরের পৃথিবীর সাথে পরিচয় হয়েছিল ইউরোপের। স্পেন পেয়েছিল বাইরের দেশ জয়ের রাস্তা আর নতুন সব্জী আর বাইরের দেশ পেয়েছিল ইউরোপীয় সভ্যতার সাথে পরিচয়, আর তার সঙ্গে অবশ্যই শোষণ ,পরাধীনতা, আর নতুন রোগব্যাধি। ছড়িয়ে পড়েছিল খৃষ্ট ধর্ম।এই অসামান্য প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতায় স্প্যানিশরা কলম্বাসকে স্মরণীয় করে রেখেছে এই নামকরণের মাধ্যমে।তবে একটা কথা, মনে রাখতে হবে,কলম্বাসের নাম কিন্তু Columbus আর দেশটির নাম Colombia- বানানের তফাত আছে।

আজটেক ইনকারা যখন এখানে রাজত্ব করত, তাদের আমলে বা তার আগে এখানে নানা ছোট ছোট উপজাতিরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দলে বাস করত, যেমন Tayronas ও  Musicas ইত্যাদি।১৫০৯ সালে যখন স্পেনীয়রা এখানে আসে তখন কেচ্যুয়া(Quechua) , ওয়ায়ু (Wayuu), আয়মারার মত প্রায় ৬০ টি ভাষার প্রচলন ছিল এখানে।

এখানকার বেশিরভাগ মানুষ রোমান ক্যাথলিক। তাই স্বভাবতঃই এখানকার  চার্চগুলোও বেশিরভাগই রোমান ক্যাথলিক।

পরবর্তী কালে এই স্প্যানিশদের হাত থেকে এই অঞ্চল গুলিকে মুক্ত করেন সাইমন বলিভার (Simon Bolivar)(১৭৮৩-১৮৩০) । তিনি প্রায় দু’ শোর বেশি যুদ্ধে স্প্যানিশদের বিরূদ্ধে জয়লাভ করার ফলে মুক্তি পেয়েছিল বলিভিয়া ,কলম্বিয়া,পানামা ,পেরু, ভেনেজুয়েলা ইত্যাদি। এই জন্য তাঁকে বলা হয়  “ The Liberator “। কলম্বিয়া প্রায় ২৫০ বছরের পরাধীনতার গ্লানি কাটিয়ে ১৮১১ সালে কার্তাহেনাতে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা তোলে।তার পর এর বর্তমান রাজধানী বোগোটাও স্বাধীনতা লাভ করে। সেই হিসাবেও ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসে কলম্বিয়ার এক আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। 

এখানে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে যে ক্রীতদাসদের এখানে আমদানি করেছিল তারা, তারা প্রধানতঃ সোনা ও নানা খনির কাজে নিযুক্ত ছিল।পরবর্তী কালে তারা এখানে এক মিশ্র জাতির সৃষ্টি করে।

এখানে দেখছিলাম ব্যালকনি দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে, নীচে হেঁটে যাচ্ছে নানা ধরণের মানুষ। বাড়িগুলো প্রায় সবই দুই বা তিন তলা ।তবে আমাদের দেশের ফ্ল্যাটের মত নীচু উচ্চতার তলা নয়, ব্রিটিশ আমলের বাড়িগুলোর মত, অর্থাৎ যথেষ্ট উঁচু। আর আগেই বলেছি, দুটো বাড়ির মধ্যে কোনও ফাঁক নেই, সব জোড়া জোড়া, কলকাতার মতই। হয়ত তখন এটাই রীতি ছিল। আর রাস্তা, ফুটপাথ, দরজা একেবারে পরপর। ফুটপাথও অনেক জায়গাতেই বেশ সরু, এর মাঝে কিছু ছাড় নেই।সেটাও আমাদের কলকাতার মত।এছাড়া প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই রয়েছে ব্যালকনি।

 আর একটা ব্যাপারেও কলকাতার মত। সেটা হল, কোন বাড়ির কোন সানশেড বা এই জাতীয় কোন কিছু নেই। রাস্তার পথচলতি মানুষদের হঠাৎ বৃষ্টি বা চড়া রোদে অনেক সময়েই অসুবিধা হয়।ফলে শীতের জায়গা থেকে এসে হঠাৎ এই গরমে বেশ অস্বস্তিই হচ্ছে।এর মধ্যেই বেশিরভাগ বাড়িতেই নীচের তলাটা দোকান। আর একটা ব্যাপার, এখানে কোন রাস্তায় বক্রতা নেই। সব সোজা সোজা, জ্যামিতিক।এতই সোজা যে,চৌমাথায় গাড়ি বাঁক নেওয়ার সময় অসুবিধা হতে পারে।অবশ্য ওরা এতেই অভ্যস্ত।আরও দেখলাম যে, যদিও সব বাড়িতেই দোকান, কেউ কিন্তু ঘরের দরজার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ফুটপাথের উপর এসে পড়ে নি। যা করেছে ঘরের মধ্যেই। তবে ফুটপাথের ওপর যে অল্প স্বল্প কোন জিনিস বিক্রী হচ্ছে না, তা নয়, তবে তারা নিছকই ছোট হকার।বিজ্ঞাপনেও রাস্তা আটকায় নি, বা আড়াআড়ি হয়ে দৃষ্টি রোধ করে নি। দোকানের সাইনবোর্ডগুলো দোকানের দরজার উপরে এমন ভাবেই আছে যে, কাছে না গেলে,  দূর থেকে দেখার উপায় নেই। রাস্তায় ছোট গাড়িতে করে বিক্রী হচ্ছে, ফল, কিছু খাবার বা ছোট ছোট জিনিসপত্র, ঠিক আমাদের দেশে ঠেলা গাড়িতে যেমন বিক্রি হয়। 
চার্চের  ঘণ্টা ( আপাততঃ চার্চের ভিতরে)

আমরা একটু এগিয়েই, দেখি কাছেই রয়েছে একটি চার্চ। দেওয়ালের গায়ে দেখলাম নাম লেখা রয়েছে Iglesia de Santo Domingo। বাকী  সমস্ত কিছু লেখা স্প্যানিশে। চার্চটিও অন্যান্য বাড়িগুলোর সাথে তাল রেখে বিশাল জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে নয়, অন্যান্য বাড়ির সঙ্গে ঘেঁসাঘেঁসি করে দাঁড়িয়ে আছে আরও উঁচু চূড়া নিয়ে। দেওয়ালের রঙ হলদেটে।এর বাইরের অসাধারণ স্থাপত্যের কাজ কিছু দেখলাম না। শুধু উঁচু দরজার দুপাশে দুটি করে চারটি থাম ও তার উপরে একটি দরজার আকৃতি করা আছে। উপরে, যেমন হয়, চার্চ বোঝানোর জন্য যীশুর মূর্তি আর অল্প কাজ রয়েছে। 
চার্চের ভিতরে  সন্ন্যাসীদের জন্য সিঁড়ি

ভিতরেও যে অসাধারণ কিছু আছে , তা নয়। প্রার্থনা করার জন্য বসার জায়গা ছাড়া রয়েছে ডানদিকে একটা  উঁচুতে উঠে যাওয়া ঘোরানো সিঁড়ি , সম্ভবতঃ সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের বাসস্থানে যাবার জন্য।
যেখানে যীশুর মূর্তি আছে, সেই মঞ্চটি ছোট জায়গার মধ্যে বেশ উঁচু, অবশ্য এটি ছোট মঞ্চ।দুপাশে কারুকাজ করা তিনটি করে থাম। মঞ্চটিও বেশ উঁচু। একা যীশুই দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
এছাড়া প্রধান মূর্তি যেখানে থাকে , দরজা দিয়ে ঢুকেই সোজা ,সেই মঞ্চটির উপরে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে রয়েছে যীশু, মেরী ইত্যাদির মূর্তি নিয়ে আর এটি সাদা পাথরের। কাজেই সাদায় শুভ্রতা যেন আরও বেশি প্রকটিত হচ্ছে।

ক্রমশঃ-
অপেক্ষা করতেই হচ্ছে পরের পর্বের জন্য।লম্বা রাস্তায় তো ধীরে ধীরে এগিয়ে চলাই নিয়ম তীর্থযাত্রীর মত, পথের দু’পাশের সব কিছু আত্মস্থ করতে করতে, উপভোগ করতে করতে।এ তো ঝটিকা সফর নয়, যে কেবল বুড়ি ছুঁয়ে গেলাম, অথচ দেখা হল না। তাই সঙ্গে থাকুন।

Post a Comment

0 Comments