পর্ব -৪১
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
|| লেবু ফুলের গন্ধ||
রাত আটটা নাগাদ ফোন করে মা ফুঁপিয়ে উঠল।কান্না শুনে খুবই ঘাবড়ে গেল সে।এই বিল্ডিংটার একতলায় কলেজের অফিস। দোতলায় অডিটরিয়াম। তিন আর চারতলা নিয়ে তাদের লেডিস হস্টেল। একতলায় সিঁড়ির নিচে ছোট্ট ঘরে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ডিউটি কল্পনাদি নয় অণিমাদি।পরিচিত কেউ এলে বা ফোন এলে ডেকে দেয় আর পাহারায় থাকে কোনো ছেলে ফস করে তাদের হস্টেলে না ঢুকে পড়ে।রাতে নিতাই কাকা গার্ড দেয়। নিচের ফোন রিসিভ করা যায় কিন্তু কোনো ফোন করতে হলে হস্টেলের মেয়েদের এক টাকার কয়েন ফেলতে হয়। সব হস্টেলেই ফোনের একই নিয়ম। তবে বয়েজ হস্টেলের ছেলেরা কী করে যেন একটা কয়েন ফুটো করে সুতো বেঁধে নিয়েছে। যার যখন দরকার সুতো ঝুলিয়ে ফোন করে আবার কয়েনটা উঠিয়ে নিয়ে যায়।
কী হয়েছে মা?বছর তিন পর তোদের বাবা রিটায়ার করবে বলে তো দুহাত উঁচিয়ে আছে। সব আয়োজন সারা।বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভোরের আলো নামে ক্লাবও খুলেছে। যে দুদিন বাড়ি থাকে ক্লাবে মর্নিং ওয়াক আর হা হা হো হো করছে। আমাকেও করতে হচ্ছে। প্রায়দিনই মেম্বারদের চা জলখাবারের ব্যবস্থাও পাকা। এক ঘর লোকের মধ্যে আজ আবার বলে কিনা বাদাম দিয়ে চিড়ে ভাজা না করে চিড়েটার পোলাও বানালেই তো পারতে! রিটায়ার না করতেই এই। করলে পরে কোন নাচনকোঁদন যে শুরু হবে।আবার নাকি দিন বদল নামে পত্রিকার সম্পাদক হয়ে বসেছে।
তা বাপি তো লেখাপড়া নিয়ে থাকতেই ভালবাসে। মায়ের কথার মাঝে একটু ফাঁক পেয়ে ঝিনি বলে, এতদিন সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে বই আর গাছপালা নিয়ে পড়ত। রিটায়ার করে শান্তিমতো সব কিছু করতে পারবে ভেবে একটু আগেভাগে খুশি থাকলে তো ভালোই। তুমি কাঁদো কেন?
🍂
আদিখ্যেতা করবি নে মোটে। ঝামেলা তো আর পোয়াতে হয় না! হুড়ুদ্দুম যত উৎপটাঙ লোক জুটিয়ে আনলে আমি করব কী?আমি কি শুধু ওই ভোরের ক্লাবের জন্য রান্নাবান্না করব? মজা পেয়েছে?
আমি রিটায়ার করলেই ব্যাগ গুছিয়ে সোজা ভুবনেশ্বর মেজদির কাছে চলে যাব।সমুদ্রের ধারে বেড়াবো। সন্ধেবেলা উল বুনতেও পারি তবে রোজ রোজ মনে হয় বোর লাগবে। আমি বাপু তোদের মতো গল্পের বই মুখে করে সারাদিন বসে থাকতে পারি না।
খুব ভালো কিন্তু তোমার তো রিটায়ার করার এখনো সাত বচ্ছর দেরি।বাপির চাইতে তোমার প্ল্যান একটু বেশিই আগে হচ্ছে না?কী যে করো না মা।
তোরা তো বলবিই।সংসারের ঊনকোটি চৌষট্টি হাজার কাজ আমার ঘাড়ে ফেলে খালি খালি আইডিয়া ভর করে সে জীবন কাটিয়ে দিল এখন রিটায়ার করার আগেও তার মাথায় কেবল আইডিয়ার ভুত ঘুরছে।
আমি না থাকলে টের পেতো যত ঢঙের আদর দিয়ে দিয়ে আউপাতালি করে উনি ছেলেমেয়ে মানুষ করতেন!
আউপাতালি মানে কী মা? সেই কোমাক্কোলার মতো কিছু?ফিক করে হেসে ফেললো মা। ফোনের এধারে সে চেঁচিয়ে উঠল মেঘ কেটে গেছে মেঘ কেটে গেছে! অমনি ঝমঝমিয়ে সবুজ হাওয়ার পাল্লা খুলে দিনগুলো পেছন থেকে গড়িয়ে সামনে এসে পড়ল।মা রাগ করলেই তাদের বাবা আড়চোখে মার দিকে তাকিয়ে আবহাওয়ার খবর পড়ে যেত।
রাগলে মায়ের মুখ দিয়ে আবার অদ্ভুত সব গালাগাল বেরুতো।হয়তো গরমের দুপুরে না ঘুমিয়ে সে আর ছোড়দা টইটই করছে। ছোড়দা নিয়েছে বাঁশের বন্দুক আর সে ছোড়দার গুলতিটা। ঘরে নেই টের পেয়ে মা শুরু করল মিতুউউ ঝিনিইইই এক্ষুনি ঘরে না ঢুকলে কপালে দুঃখ আছে।
আহা বিনু,দুপুর হলো গিয়ে দার্শনিকদের চিন্তা ভাবনার উপযুক্ত সময়।স্মরণ করে দেখো ওই বয়সে তুমি তোমাদের গইয়া কান্দির প্যায়রা গাছে চড়ে উচ্চ ভাবনায় মগ্ন থাকতে আর ওরা না হয় লিচু গাছে বসে ভাবাভাবি করছে।
রাখো তোমার ঢঙের কথা।তোমার আস্কারাতেই মাথায় চড়ে বসেছে। চড়িয় দাঁত ফালায় দেবো আজ এমন থাপ্পড় মারবো কপাল প্যাঁচাইয়া ফুটবলের মতো ছিটকাইয়া পড়বে রাস্তার ওই ধারে শয়তান ময়তান জন্মিছে জানি কোন খান দিয়া। উত্তেজনায় দেশজ ভাষায় এতবড় একখানা গালাগাল গড়গড়িয়ে মা'র মুখ থেকে বেরোতেই বাবা মিটমিট করে হাসল।
তা চড় তো ওদের তুমি দিতেই পারো ওতে হাতের ভালো ব্যায়াম হয় কিন্তু ভেবে দেখো বিনু; ব্যাকরণগত কিছু ত্রুটি থেকে যাচ্ছে না কি?প্রথমত কপাল পেঁচিয়ে থাপ্পড় দেওয়া কি সম্ভব?দ্বিতীয়ত হাতের কারবার যখন,ফুটবল না হয়ে ওটা হ্যাণ্ডবল হবে।
ময়তান মানে কী মা? ততক্ষণে ভাইবোনের হাস্যরত বদন ভেসে ওঠে জানলায়। মানে বার করছি তোদের ঘরে ঢোক আগে। বাংলা ভাষাকে তোমাদের মা যে কত রকমভাবে সমৃদ্ধ করে তুলছে।
মা আমাকে সকালে কী একটা কোলা ব্যাঙ বলেছে। গরমের ছুটির হোম ওয়ার্ক করতে করতে মাঝের ঘর থেকে ভালো মানুষ দানির নালিশ ভেসে এল।
আমি আবার তোকে কখন ওসব বললাম? এবার মা নিজেই অবাক।ওই যে বইখাতা সব মাদুরে ছড়িয়ে রেখেছিলাম তাই বললে কোম আক্কোলার গু সাত ঠাঁই।আরে ব্যাঙ ট্যাঙ বলিনি তোকে।কম আক্কেল জ্ঞান তোর,তাই কোম আক্কোলা বলেছি।বিপুল প্রতিভাময়ী!বাবা মাথা নাড়তে লাগল। তোমাদের জননীর এসব নিত্যনতুন শব্দর আমদানি অভিধানে যোগ করা খুবই জরুরি। এসব জানার আগেই ফস করে সুনীতি চ্যাটুজ্যে মারা গেলেন।ভাষার এই বিরাট ক্ষতি!
কথা শুনে গা রি রি করে;মাথায় আগুন ধরে যায়।অরুউউ, বার্ণল নিয়ায়। বলতে না বলতেই পিতৃ ভক্তির মুর্তিমান নিদর্শন দানি বার্নল উঁচিয়ে হাজির। রঙ্গ দেখে পিত্তি জ্বলে আমার। চিড়বিড়িয়ে ওঠে মা।বার্নল আনলি কেন?দেখছিস না পিত্তি জ্বলছে মানে গলব্লাডারের প্রবলেম। অ্যান্টাসিড নিয়ায় শিগগির।ঢাল এবার,ঢেলে দে আমার মাথাডার ওপরে।আ্যন্টাসিডের বোতল হাতে দানিকে দেখে রাগের চোটে চোখে জল এসে যায় মায়ের।
বাপি আড়চোখে মার দিকে তাকিয়ে বলে আকাশে আজ দারুণ মেঘ।দু এক পশলা বৃষ্টি কিংবা বজ্র বিদ্যুৎসহ বৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা। তাদের বাবার ইশারায় জানলার বাইরে থেকেই দু ভাইবোন হাত জোড় করে জননী জন্মভূমিশ্চ টা শুরু করে। সদ্য পড়া টিনটিন থেকে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের বাণী সমেত মা মাগো আমরা তোমার অধম সন্তান বলে দানি ধড়াস করে মার পায়ের ওপর সটান শুয়ে পড়ে।ফিক করে হেসে ফেলে মা।
অমনি তাদের বাবা মেঘ কেটে গেছে মেঘ কেটে গেছে সুয্যি উঠছে বলে হাততালি দিয়ে উঠল।আবহাওয়া অনুকুল দেখে ঝিনি মিতুরাও ঢুকে পড়েছিল । তিন ভাইবোনই মেঘ কেটে গেছে মেঘ কেটে গেছে বলে দোহারকি দিয়ে হাত তালি দিয়ে লাফাতে লাগল।ফলত তখনকার মতো হ্যাপি এন্ডিং দিয়ে একাঙ্ক নাটকের পরিসমাপ্তি।
শোনো মা, এতদিন চাকরি আর সংসারের চোটে যে যে কাজ তোমার করা হয়নি রিটায়ার করলেই আর রিটায়ারের দরকারটা কী এখন থেকেই শুরু করো। তোদের বাবাও তো ওই পাগলামি নিয়ে পড়েছে। বাড়ির হারমোনিয়াম তো মিতু নিয়ে গেছে কবেই। তোদের বাবা গেল সপ্তায় হারমোনিয়াম কিনে এনেছে আবার। মিতুর ছাত্র পরিমলকে ঠিক করেছে গান শেখাবে আমায়। আমাদের বাবা ছাড়া এত ভালবাসা তুমি কোথায় পাবে মাগো? নালিশ টালিশ বাদ দিয়ে দুজন মিলে প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে প্রেম করো দেখি চুটিয়ে। থাপ্পড় খাবি ঝিনি।
ঝিনির মনে এলো কিছুদিন আগে বাড়ি গেলে পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানে মাবাপি এক গাঁয়ে কবিতা পড়বে বলে শেখাতে গিয়ে মাকে সে যেই বলেছে "তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা/আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে/তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ-ধারা/আমার বনে কদম ফুটে ওঠে" খুব নরম একটা ব্যাপার মা। তুমি মনে মনে দেখতে পাচ্ছো ওই দখিন হাওয়ার ছুটে আসা আর শ্রাবণ ধারায় ফুটে উঠছে কদম এই রোমান্টিক ভাবনাটা মনে রেখে স্বগত কথনের মতো মৃদু অথচ দূর থেকে ভেসে আসার মতো নরম করে বলো দেখি।কিছুদিন থেকেই বিনুর রোমান্স টোমান্স মোটেও আসছে না।দিন কে দিন সে দেখি শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে পড়ছে ।বাবার কথায় হো হো করে হেসে ওঠে তারা। কী আমার সুশীতল তরু এয়েচেন রে!আদিখ্যেতা বলে চা করতে উঠে পড়ল মা।
গম্ভীর গাম্ভার মাথা নেড়ে সে বললো ভাববার বিষয়!এসে অব্দি আমাকেও তো একবারের জন্য সুনমন বলে ডাকোনি মা। কাজেই বাপির কথা পুরো উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না কিন্তু।শুনেই মা হাত বাড়িয়ে বলল আ যা মেরে দুশমন। অবজেকশন!বাপি দেখো ,মা কিন্তু আমায় দুশমন বলল। বিচারক থেকে এবার সে নিজেই বাদী হয়ে নালিশ এবং পেশ করে বসে। ওরে ওটা দুশো মন হবে।তা শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে দিন কে দিন তুই আড়েই যে রেটে বেড়ে যাচ্ছিস সেটাই মিন করছে আর কি। আরও জোরে হেসে ওঠে তারা।
গোলাপি পাড় দেওয়া সবুজ বাড়িটাও তাদের সঙ্গে হাসে।ছোট পুকুরে ঘাই দেয় মাছ।গাছগাছালি মাথা নাড়ে দেদার।
ফোন ছেড়ে হস্টেলের সিঁড়ির বেয়ে হাসতে হাসতে উঠছিল ঝিনি আর দূর পর সে সব দিনের গা থেকে বাতাবি ফুলের গন্ধ আসছিল। আচমকাই সিঁড়ির ল্যাণ্ডিংএ দাঁড়িয়ে পড়ে সে। অতীতের তীক্ষ্ম সৌরভেই চটকা ভাঙলো তার।লেবু ফুলের গন্ধে হস্টেলের সিঁড়ি ম ম করছে।
আখাম্বা হস্টেল বাড়ি আর ছড়ানো কলেজ বিল্ডিংগুলোর বাঁধানো এই চত্বরে লেবু ফুলের গন্ধ আসে কোত্থেকে?স্মৃতির গন্ধ এত তীব্র হয়? পরের দিন অবশ্য হস্টেলের পেছনে গিয়ে ডোমদের কোয়ার্টারের গায় ফুলে ভরা বাতাবি গাছটা আবিষ্কার করে একইসাথে আনন্দ আর বেদনা মেশানো অনুভব জাগল। গাছটাকে পাড়াগেঁয়ে আত্মীয় বলে চেনা লাগছে ভেবে খড়খড়ে বাকলে আঙুল বুলিয়ে ফিরে আসতে আসতে সে ভাবছিল,স্মৃতির সত্যিই কোনো গন্ধ হয় না তাহলে?
0 Comments