জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে -২/মলয় সরকার

দেওয়াল ঘেরা শহরের বাইরের রাস্তা ও সমুদ্র

মার্কেজের খোঁজে

মলয় সরকার

(দ্বিতীয় পর্ব)


লোকে বলে আমাদের পায়ের তলায় নাকি সর্ষে! ফোন করলে , প্রথমেই বলে , কি, কোথায় আছেন, স্বদেশে না বিদেশে? অনেককে বোঝাতেই পারি না যে, আমি স্বদেশেই আছি।এবং আমার হৃদয়ের শিকড় স্বদেশের গভীরেই প্রোথিত।তবে এটা ঠিক, শরীর ঠিক থাকলে আর সুযোগ হলে , ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোনোর জন্য আমি সর্বদাই প্রস্তুত একজন মিলিটারী সৈন্যর মতই।

যাই হোক, সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইটে সিয়াটেল থেকে এলাম নেওয়ার্ক। এটি আমেরিকার নিউ ইয়র্কেরই আর একটা এয়ারপোর্ট। এখান থেকে আমরা পৌঁছালাম পানামা সিটি এয়ার পোর্টে। মনে পড়ল ভুগোলের কথা , এই সেই পানামা যেখানে রয়েছে এককালের  বিশ্বের আশ্চর্য পানামা খাল যা ৮২ কিমি লম্বা এক কৃত্রিম খাল এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে এক যোগসূত্র। কাটা হয়েছিল দশ বছর ধরে ১৯০৪ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ,যা সারা পৃথিবীতে ব্যবসায়িক ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে এক বিশাল পরিবর্তন এনেছিল। এর আশ্চর্য ব্যাপার হল, দুই মহাসাগরের দুই দিকে জলের উচ্চতা দু রকম , যা কৃত্রিম ভাবে লকগেটের সাহায্যে জলের উচ্চতার পরিবর্তন করিয়ে জাহাজকে একদিক থেকে আর একদিকে আনা হয়।এরই ছোট সংস্করণ আমরা দেখেছি সিয়াটেলে, Ballard Locks বা  Hiram M. Chittenden locks যা লেক ওয়াশিংটন ও লেক ইউনিয়নের সঙ্গে একই কায়দায় স্যামন বে-র যোগাযোগ রক্ষা করে। তফাত শুধু এই যে, এটি অনেক ছোট আর পানামা খাল অনেক বড় ।

এটা দেখার সৌভাগ্য আপাততঃ হল না। তার পরিবর্তে যা দেখলাম, সেও কম নয়। কি দেখলাম তাই বলি। 
তখন ভোর,  সূর্য ওঠেনি। বসে আছি পানামা সিটি এয়ার পোর্টে। বোর্ডিং গেটের সামনে। ফ্লাইটের সময় এখনও বেশ কিছুটা বাকী, কর্মিরা কেউই আসেন নি।এয়ারপোর্টে বেশ ঠাণ্ডা। আমরা জানি বাইরে যেমনই থাক তাপমাত্রা , অনেক সময়েই এয়ারপোর্টগুলো এসির দৌলতে বেশ ঠাণ্ডা হয় । 

আমরা বসে বসে , কাজ নেই, মোবাইলে এনিম্যাল ওয়ার্ল্ডের ছবি দেখছি। গায়ে দুটো সোয়েটার চাদর জড়িয়েছি।পাশে দেখি একটি খুব তরুণী শ্বেতাঙ্গিনী মা  তার দুই সন্তানকে নিয়ে,যাবে বলে এসে হাজির হল। ছোটটিকে ভালই কাপড় চোপড় পরানো আছে। কিন্তু বড়টির গায়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। 
সে খুব কাঁদতে আরম্ভ করল। তখন , মা ঠিক বুঝতে পেরেছে। সে নিজের গা থেকে জিন্সের মোটা জামা খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিল।দেখা গেল তার নিজের গায়ে প্রায় কিছুই নেই, কোন রকমে আবরু রক্ষা করার মত। আসলে সে বোধ হয়, এই শীতের ব্যাপারে আগে খেয়াল করে নি। ফলে যথেষ্ট জামাকাপড়ও আনে নি। এর ফলে দেখলাম, সে নিজেই কাঁপছে, তবে সন্তানের স্বস্তি দেখে মুখে চোখে তার যে আনন্দের ঔজ্বল্য ফুটে উঠতে দেখলাম, তা সত্যিই আমাকে অন্য কথা মনে করিয়ে দিল। 

মনে পড়ে গেল, সেই হরিণীর কথা, যে নিজেকে সিংহের মুখে ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের দূরে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিল।আসলে , মোবাইলে দেখছিলাম তখন, পাখী মা, কাঠবেরালী মা, হাতী মা ,পেঁচা মা কেমন করে তাদের বাচ্চাদ্দের নিরাপত্তা বা ঊষ্ণতা দেয়। হয়ত এটা কাকতালীয়ই হবে, তবু ঘটনা চক্রে দেখলাম মানুষী মাও এর সঙ্গে একই গোত্রের। মায়েদের বোধ হয় কোন বয়স বা জাত হয় না , এটা সব ক্ষেত্রেই এক, এবং তার নাম ‘মা”।

এখানে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের হাত থেকে হাত বদল হয়ে আমরা এলাম কোপা এয়ারলাইন্সে।

উড়োপাখীর পেটে চেপে আমরা এসে পৌঁছালাম কার্তাহেনার রাফায়েল নুনেয ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে। যেহেতু আমাদের আমেরিকান ভিসা আছে, তাই এ সব দেশে কোথাও বিশেষ আলাদা ভিসা লাগে না বা ইমিগ্রেশনের ঝামেলা তেমন নেই। সমস্ত ব্যবস্থা করা ছিল। তাই বাইরে বেরিয়েই দেখি আমার নাম লেখা বোর্ড নিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে।এ ব্যাপারে যে সমস্যায় পড়েছিলাম তুরস্ক তে ( সে ঘটনার বর্ণনা আছে আমার ‘তুর্কিনাচন” বইতে) সে নিয়ে ভয় আমার সব সময়েই থাকে।

যাই হোক, এখানে নেমেই আগে, সবসময় নতুন দেশে এলেই যা করি, তাই করলাম। অর্থাৎ, যদিও কতটা লাগবে, সবসময় বুঝতে পারি না, তবু আন্দাজে আগেই তুলে নিলাম এয়ারপোর্টের ভিতরের এটিএম থেকে কিছু কলম্বিয়ান পেসো।  এখানকার মুদ্রা হল কলম্বিয়ান পেসো যার মূল্য ভারতীয় টাকার সাথে, এক টাকার সমান ৪৮.৩১ কলম্বিয়ান পেসো আর আমেরিকান এক ডলারের সমান হল ৩৮২৫ কলম্বিয়ান পেসো, বর্তমানে। ভাবছিলাম এত এত সংখ্যার টাকা, হিসাব রাখব কি করে। দেখি কিছু অসুবিধা নেই, ওদের তো আর এক পেসো দু পেসোর নোট নয়, এক সঙ্গে হাজার হাজার পেসোর নোট।  অবশ্য আমাদের খুচরো পয়সার মত ছোট মুদ্রার কয়েনও আছে।কাজেই খুব অসুবিধা নেই। অর্থাৎ কাউকে যদি ১০০০ পেসোর একটা নোট দিই, ভারতীয় মুদ্রায় দিলাম মাত্র ২০.৮৪ টাকা। আর একটা কথা, জেনে নিয়েছিলাম আগেই যে, এখানে মোটেই টিপস চাইবার নিয়ম নেই সাধারণ ভাবে। তবে তা চীন বা জাপানের মত অত কড়াকড়ি নয়, এবং কেউ যদি স্বেচ্ছায় অল্প কিছু দেয়, তাতেই ওরা খুব খুসী হয়ে যায় এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
দেওয়ালের ভিতর দিক ও শহর

ঝকঝকে রোদে গাড়ী ছুটল আমাদের হোটেলের দিকে। যেতে যেতে ড্রাইভার শহরের বর্ণনা দিতে আরম্ভ করল। ড্রাইভার খুব কথা বলে, খুব আলাপী। এখানে এসেই আমি শুনলাম যে, এখানকার শহরের নাম Cartagena ,কার্তাগেনা নয় এখানে ‘জি’ এর উচ্চারণ ‘হ’ এর মত।এই ‘হ’ নিয়ে আমার স্প্যানিশের ধন্দ আছে। কোথাও ‘জি’ মানে ‘হ’, কোথাও ‘জে’’ মানে ‘হ’ এছাড়া ‘এইচ’ তো আছেই। এ ছাড়াও অনেক বর্ণেরই উচ্চারণে এরকম তফাত আছে। ফলে ওদের ইংরাজীতেও এই প্রভাব পড়ে, আর সে ইংরাজী বুঝতে আমার মত আনাড়ীদের তো অসুবিধা হয়ই। 

যাই হোক,  ড্রাইভার চলল আমাদের শহরের পরিচয় দিতে দিতে। শুধু তাই নয়, কোথা থেকে আসছি, প্রথম আসছি কি না , কোথায় থাকি সে সব জানাও তার হল।খুবই কথা বলে আর ’হা হা’ করে হাসে শিশুর মত। ওর কাছেই জানা হল যে, এই দেওয়াল ঘেরা শহর,যার পাশ দিয়ে চলেছি, সেটার দৈর্ঘ্য প্রায় ১১কিমি। পাশেই সমুদ্র। ক্যারিবিয়ান সী। এই ক্যারিবিয়ান সী হল আটলান্টিক মহাসাগরের একটা টুকরো। এ পৃথিবীর মানচিত্রে, মহাসাগরের অনেক অংশের নামই আলাদা আলাদা সাগর , উপসাগর এরকম হয়েছে।   ক্রমশঃ---(যাঁরা চলেছেন আমার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা থাকুন সঙ্গে।আমি আগেই বলেছি, আমার এবারের যাত্রা শুধু চোখে দেখা নয়, সেই বিখ্যাত সাহিত্যিককে আমার মত অখ্যাত মানুষের একটু ছুঁয়ে দেখা বা তাঁর পরিচিত পরিবেশকে বোঝার চেষ্টায় এগিয়ে যাওয়া----আশা করি আপনাদেরও ভাল লাগবে--)

🍂

Post a Comment

0 Comments