স্মৃতির পটে দ্বিতীয় পর্ব
সুদেব কুমার ঘোষ
পাঠশালার জীবন শেষ করে ছ বছর বয়সে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। গ্রামেই প্রধান শিক্ষকের বাড়ি। বাবা , কাকা , দাদা সবাই তাঁর কাছে পড়েছেন। তাঁর নাম শীতল চন্দ্র পাল মহাশয়। শিশু শ্রেণীতে এক বছর পড়ে শচীনন্দন চক্রবর্তী মহাশয়ের পাঠশালাতে দু বছর পড়ার সুবাদে আমরা কয়েকজন প্রথম শ্রেণী না পড়ে সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। স্কুলে ছিল কঠোর শাসন। পড়া না হলে শাস্তি তো পেতেই হত ; এমনকি কামাই করলেও শাস্তি পেতে হত। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি অবসর নিলেন। ওই পদে আসীন হলেন শ্যামবরণ বন্দোপাধ্যায়। তাঁরও বাড়ি আমাদের গ্রামে। স্কুলে তিনটি রুম ছিল। ছোটো একটি স্টোর রুম ছিল। মাঝে বড় রুমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাস হত। তারপরের ছোটো রুমে চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাস হত। শিশু শ্রেণী ও প্রথম শ্রেণীর ছেলে – মেয়েরা বারান্দার দুয়ারে বসত। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জন্য কেবল সিঙ্গল বেঞ্চ ছিল। বাকিরা মেঝের উপর শতরঞ্জি বিছিয়ে বসত। তখনও প্রাথমিকে রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠ চালু হয়নি। সিলেবাস ঠিকমতো মনে নেই।
🍂

তবে মনে হয় দ্বিতীয় শ্রেণীতে বাংলা , ইংরেজী , গণিত , সাধারণ বিজ্ঞান পড়তে হয়েছিল। তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীতে এই চারটি বিষয়ের সাথে ইতিহাস পড়তে হয়েছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাতে যে বিষয়গুলি মনে দাগ কেটেছিল সেগুলি হল আমাদের চারপাশে বিভিন্ন পেশার যে লোকগুলোকে দেখি তারা আমাদের সবাই সমাজের বন্ধু। তখন পরীক্ষাতে গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন ছিল সমাজের বন্ধু কারা ? ডাক্তার কীভাবে সমাজের উপকার করে ইত্যাদি। নিয়মিত নখ চুল কাটা , সর্বদা পরিস্কার – পরিছন্ন থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলি বিজ্ঞান ও পরিবেশ বই থেকে শিক্ষা পেয়েছিলাম। চতুর্থ শ্রেণীর বাংলা বই এ হীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের “ আমাদের দেশ “ প্রবন্ধে লেখা “ দূরে থাকলেই পর কাছে এলে সবাই আপন “ কথাটি বেশ মনে স্থান করে নিয়েছিল। ‘ পুরীর সমুদ্র ‘ প্রবন্ধে সমুদ্র , নুলিয়া , সামুদ্রিক মাছ , লাল কাঁকড়া সমন্ধে অবগত হয়েছিলাম। সমুদ্রের কাঁকড়াদের বলা হয়েছিল ‘ হারমিট ক্র্যাব ‘। কারণ সন্ন্যাসীরা যেমন গুহায় বসে তপস্যা করে , কাঁকড়ারাও বালির গর্তে প্রবেশ করে চুপচাপ বসে থাকে। পুরী না গিয়েও মনে হত পুরীর সমুদ্র যেন চোখের সামনে ভাসছে। এরকম আরো কত কী এখনও মনে উদয় হয়। এখন যেমন স্কুলে মিড ডে মিল দেওয়া হয় তখন প্রাথমিকে গম চাল দেওয়া হত। এটি ঘরে নিয়ে এসে খিচুড়ির মতো করে রান্না করে খাওয়া হত। চতুর্থ শ্রেণীতে তখন ফাইনাল পরীক্ষা বাইরের সেন্টার এ দিতে হত। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমাদের গ্রামে তখন জুনিয়র হাই স্কুল চলছে। তখনও মঞ্জুর হয়নি। একদিন স্কুলে ইন্সপেকশন হবে , আমাদের কয়েকজনের ডাক পড়ল। বেশ কিছু বাড়তি ছাত্র খাতায় নাম লেখা হয়েছে। আমাদের কাজ হল ওই বাড়তি ছাত্রদের হয়ে প্রক্সি দেওয়া। আমরা পঞ্চম শ্রেণিতে এই কাজ করেছিলাম। তার আগে দু - তিন দিন ট্রেনিং দিয়েছিলেন। ইন্সপেকশন এর দিন পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস নিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক মহাশয়। পড়িয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাদেশ কবিতাটি। সেই পড়া এখনও মনে আছে। চতুর্থ শ্রেণী পাশ করার পর ওই স্কুলেই ভর্তি হয়েছিলাম। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত ওই স্কুলেই পড়েছিলাম। তখনও পর্যন্ত স্কুল মঞ্জুর হয়নি। অভিভাবকরা পাশের গ্রাম মাংরুল বিশ্বেশ্বর হাই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। এটি এখন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। ওই স্কুলে পড়ার সুবাদে নতুন নতুন বন্ধু পেলাম। স্কুলটি আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। হেঁটে হেঁটে যেতে হত। দুই গ্রামের মাঝে মাঠ। সেই মাঠ পেরোলেই গ্রাম। গ্রামের সীমানা থেকে স্কুল বেশ কিছুটা দূরে। বর্ষাকালে ঝড় – বৃষ্টি – বন্যা --- এইসব প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পথ অতিক্রম করতে হত। বিভিন্ন ক্লাসের আট – দশজন ছাত্র মিলে আমরা স্কুলে যেতাম। বর্ষাকালে সঙ্গে গামছা রাখতে হত। আমাদের গ্রামে একজন শিক্ষক ওই স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। তাঁর নাম জিতেন্দ্র নাথ ঘোষ। আমাদের ইংরেজী পড়াতেন। ক্লাসে বাংলা বলতেন না। সে সময় ইংরেজীর ব্যাখ্যা সব যে বুঝতে পারতাম তা জোর দিয়ে বলতে পারি না। তবে অনুপ্রাণিত হতাম। চুপচাপ শুনতাম। উনিশশ ছিয়াত্তর সালে নতুন মাধ্যমিক চালু হয়েছে। আমরা উনিশ আটাত্তর সালের মাধ্যমিক ব্যাচ। অ্যাডিশনাল সহ এগার শ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কর্মশিক্ষা ও শরীর শিক্ষা একটি বিষয় ছিল। কিন্তু শিক্ষক নেই। বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক মহাশয়রা কয়েকদিনের ট্রেনিং নিয়ে আমাদের শেখাতেন। তখন শিক্ষক মহাশয়রা ধূতি – শার্ট পরতেন। ফলে ধুতিকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত গুটিয়ে জামা খুলে আমাদের ব্যায়াম শেখাতেন। সেই ব্যায়াম কিন্তু বৃথা যায়নি। এখনও আমার পাথেয় হয়ে আছে। আর কর্ম শিক্ষার নম্বর ছিল আলু ক্ষেতে। স্কুলের সংলগ্ন স্কুলের কিছুটা জমি ছিল। সেই জমিতে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে আলু চাষ করতে হয়েছিল। ঘরে কারো কাজ করার অভ্যাস ছিলনা। নম্বর পাবার জন্য কাজের জন্য কী হুড়োহুড়ি। স্যারেরা থাকলে কে আগে কোদাল ধরবে তা নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। সেটি হল ভূগোলের স্যার কারণে – অকারণে আমাদের খুব বেত্রাঘাত করতেন। আমরা যারপরনাই বিরক্ত বোধ করতাম। সবাই মিলে উপায় বের করার চেষ্টা হল। স্যার ক্লাসে প্রবেশের আগে আমরা বেরিয়ে গেলাম। যথারীতি প্রধানশিক্ষকের কাছে খবর চলে গেল। তাঁকে আমরা আমাদের সমস্যার কথা বললাম। তবে সেই থেকে বেত্রাঘাত বন্ধ হয়েছিল। মাধ্যমিক স্তরে তখন সংস্কৃত বিষয় ছিল। কঠিন বিষয়। কিন্তু কঠিন বিষয় সহজ হয়ে যায় উপযুক্ত শিক্ষকের গুনে।অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় এই রকমই একজন সংস্কৃত স্যারকে আমরা পেয়েছিলাম। নাম তপন চক্রবর্তী মহাশয়। পদ্যগুলি মুখস্থ করাতেন। তাঁর পড়ানোর গুনে কিছু কিছু গদ্যও মুখস্থ হয়ে যেত। চাণক্য শ্লোকের কিছু অংশ আমাদের পাঠ্য সূচিতে ছিল। এখনও মুখস্থ আছে। বিজ্ঞান থেকে আমরা প্রাকৃতিক ঘটনা ও জীবন সমন্ধে জানতে পারি কিন্তু সাহিত্য থেকেও অনেক জ্ঞান লাভ করা যায়। যেমন প্রকৃত বন্ধু কে? এটি বিজ্ঞান থেকে জানা যায়না। সাহিত্যের গল্প থেকে জানা যায়। এই নিয়ে অনেক নীতি মূলক গল্প আছে। সংস্কৃতের চাণক্য শ্লোকে একটি সুন্দর সংজ্ঞা আছে। সেটি হল ---
উৎসবে ব্যসনেচৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্টতি স বান্ধব:।।
এখন যেমন প্রতিটি বিষয়ে টিউশন প্রথা চালু আছে ; তখন এসব ছিলনা। কেবল অঙ্ক এবং ইংরেজী। তাও সবার জুটতনা। তাতেই অনেকে ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন যেমন মাধ্যমিক দেওয়ার পরেই টুই শনিতে একাদশ শ্রেণীর পঠন – পাঠন শুরু হয়ে যায় তখন ওসব চালু হয়নি। কাজেই আমরা খেলা – ধূলা করেছি , আত্মীয় বাড়ী বেড়াতে গেছি , গল্পের বই পড়েছি।
1 Comments
মনে হচ্ছে যুগান্তরের গল্প শুনছি
ReplyDelete