ভাঙা আয়নার মন
পর্ব -৪৫
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
|| মিমোসা... জলের গভীরে ঋতু ফুল...||
ফাইনাল এম.বি.বি.এসের ভাইভা দেওয়ার আগে ঝিনি চেঁচালো,আ্যই কল্লোল,বাপির নামটা লিখে আমার আ্যপ্রনের পকেটে ভরে দেতো।কেন রে?না মানে, হল থেকে বেরিয়েতো ভুলে যাবো!প্রলয় কিসব বিড়বিড় করে হাতটা ঘোরায় মাথার চারপাশে তারপর একটা ফুঁ দিয়ে বলে যা এবার, এক্সটারনালের বাপের সাধ্যি নেই তোকে ফেল করায়।ডোন্ট মাইন্ড, এক্সটারনালের পিতৃদেবও কি পরীক্ষা নিতে এসেছেন? বন্ধুরা হ্যা হ্যা করে হাসতে থাকে, সে ঢুকে যায় ভাইভা দিতে।
ইদানিং স্কুলের বন্ধুরা ছিটকে পড়েছে নানান দিক।পড়ার চাপে বাড়ি যাওয়াও কমে গেছে তার।
ঋতা অবশ্য ছাড়েনি কখনো।রবীন্দ্রভারতীতে ক্লাস ছাড়াও মায়া সেনের কাছেও গান শেখে আজকাল। বাড়ির খবর, খাবার দাবার সবই আসে ঋতার সঙ্গে।জয়ন্তীদি আর আলু ঘুমিয়ে পড়লে গেরামের ভাষায় কথা শুরু করে তারা।গল্পে গল্পে রাত ফুরোয়। এট্টা মজার কথা শোন ঝিনি।সুধা স্মৃতি লাইব্রেরীর সামনেকার সেই বিরাট তেঁতুলগাছটা কাটতে নিয়ে লোকেদ্দের ভুতে ধরতিছ বলি কেউ আর কাটতিই চাচ্ছে না ও গাছ।বোসেরা বিককির করিউ টাকা ফেরত দেছ মানে দিতি বাধ্য হয়িছ। হিহি।
জল খেতে খেতে গ্লাস থেকে মুখ তুলে তাকায় সে।গেল্ গেল্!বিষম খেয়ি মরবি নাকি? গোল গোল করি কী দেখতিলি ওর'ম জল মুখে নে?তোরও কি ভুতি পেইছ নাই? উহু ! দেখতিলাম না,জল খাবো না গেরামের ভাষাডা আগে শোনবো তাই ভাবতিলাম।
আর ভুত আবার কী? অত পুরোনো আর বড় গাছ। গাছটা কাটতিলো যারা তাদের মাস হিস্টেরিয়া হই গেছ নিশ্চয়ই।
তোর মাথা।চার পাঁচ জন একসঙ্গে দাঁত খিঁচিয়ে ভুল বকতি বকতি অজ্ঞান হই যাচ্ছিল কী জন্য? হিস্টেরিয়া না কী বললি পরপর সবার তা হতি পারে?এ তোর সর্দি কাশি না চোখ ওঠা অসুখ?যে একজনের থেকি আর একজনের হই যাবে?ভয়ের ইনফেকশন হয় নাকি?
ঠিক বলিছিস। ইমোশনাল ইনফেকশন মানে যাকে বলে মানসিক সংক্রামণ তো হতিই পারে যেখানে একজনের ভয় ,রাগ, কান্না এসব আবেগ অনুভূতি আর একজনের উপর প্রভাব ফেলে। গলায় দড়ি দেছ কতজনায় ওই গাছটায় বলদিন? ও গাছে ভুত দেখার গল্প কত শুনিছি তাও ভাব।যারা গাছ কাটতি গিয়িছিল তারাও তো ওসব গল্প শুনিছ। সেই ভয় আর হয়তো খানিক অপরাধ বোধ নিয়ে গাছে কোপ বসালে এর'ম তো হতেই পারে।তাই বলি পরপর পাঁচ জন? আরো বেশী হলেও কিছু বলার নেই।ওই দাঁত খিঁচুনি পরপর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া পুরো মাস হিস্টেরিয়ার সিম্পটম।
বেশ হইছ। গাছটা তো বেঁচি গেছ।লাইব্রেরি যেতি যেতি ওর ছায়ায় সাইকেল থামিয়ে আমরা ক্যালোর ব্যালোর করতাম কত সেটা বল? ধারেই ছিল সেই বিরাট মেহগনি গাছটাও।ইচ্ছামতীর জল মেখে উড়ে আসত হাওয়া। আর হাওয়া খা হাওয়া খা বলে মাছের মতো হা করে বুবাইয়ের সেই হাওয়া চিবিয়ে গিলে খাওয়ার চেষ্টা?
বুড়ো গাছের ছায়ায় ডুব দিয়ে কথায় মশগুল রাত ভোর হয়ে এলে ঘুমো ঘুমো কাল ক্লাস আছে বলে এ ওর মুখ চেপে ধরে যাতে আর কথা না বেরোয়।
প্রায়ই একটা নীলচে বিষন্ন আলো ঘিরে থাকতো ঋতুর মুখ।যাকে ভালোবাসতো তার বাড়ির অমত থাকায় নিজে মহোৎসাহে বিয়ে দিয়েছে সে ছেলের। খুব ভালো সাজাতে পারতো বলে শ্রী ডালা আলপনা মায় ফুলশয্যার কনেকে পর্যন্ত নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়ে এসে তার বুকে মুখ রেখে ভেসে গেল গোপন কান্নায়। ভালো হয়েছে ;আমি তো বলবো খুবই ভালো হয়েছে ও বিয়ে না হয়ে তোর। যে ছেলের শিড়দাঁড়া নেই, মায়ের কথায় ফস করে ভুলে যায় ভাল তো সে বাসতেই জানে না নিজেকে ছাড়া। তুই কাঁদিস কেন ওরকম বেহেড স্বার্থপ্পর অমানুষের জন্যে?ঋতুর চুলে হাত বুলিয়ে দেয় সে আর গাল পাড়ে অচেনা কোন হতচ্ছাড়া ছেলেকে।
তুই কি কলকাতা আসার কদিন আগে থেকে মা ঠাকুমার মতো পোঁটলা গোছাস আমার জন্য? অবশ্য মাও কখনও এমন তেলের পিঠে,মাছের ঝাল, কদবেল বা কুলের আচার বাড়ি থেকে বয়ে আনেনি।ধোকা এনে এই হিটারে ডালনাও চাপায়নি। তুই ঋতু ভাগ্যিস।
বা এলি ঋতু এলি তুই? কোথায় ডুব মারিস বল তো ।কদ্দিন বাড়ি যাই না বলে কী যে মেজাজ খারাপ করছিল ।আর যেই আসলি হস্টেলটাই বাড়ি হয়ে গেল। শুনে ওর চোখে একঘেয়ে দিনরাত্তির মতো গলে গলে পড়ে যেন মোম জ্বলছে চোখের তারায়।
🍂
নতুন বন্ধুর গল্প বললো একবার এসে।পোড়ামুখি!ফের তুই প্রেমে পড়েছিস? শুনে ভারি লাজুক হাসছিল ও। ভালবাসার মায়াবী আলোমাখা মুখখানা একঝলক দেখে ঝিনি বলল হাঁদারাম!কে বলে তুই সুন্দর নোস? ঝিনি,তোর এই পারফিউমটার গন্ধটা ব্যাপক।নিবি এটা? উঁহু! নতুন একটা কিনে দিবি। আচ্ছা।
দ্বিতীয়বার বিশ্বাস ভাঙাটা নিতে পারেনি ও।বড্ড বেশি নাজুক ছিল তার কিশোরবেলার মিমোসা।টাচ-মি-নট লতার মতোই নুয়ে যেত আঘাত পেলে। লম্বা এক চিঠিতে লিখলো এমন কিছু নেই তোদের ডাক্তারিতে যাতে পৃথিবী থেকে চুপচাপ চলে যাওয়া যায়? উত্তরে লিখল সে,প্রাণ বাঁচানোই আমাদের কাজ বুদ্ধুরাম। তোর জন্য অনেক ভালবাসা আর আদর রাখা আছে। নিয়ে যাস।ঋতা লিখলো, বাড়ি আয় ঝিনি ওকে একটু বোঝা।
হাউসস্টাফশিপে ছুটি মিলছিল না তার। অবশ্য বুঝতেও পারেনি দারুণ পুড়ছিল ও।এতটাই সে দহন,যেএক সকালে সারা শরীর কেরোসিনে ভিজিয়ে দেশলাই জ্বেলেও চুপ করে নাকি দাঁড়িয়ে ছিল ও। কতটা আগুন বুকে জমলে অমন বোবা হয়ে যায় মানুষ? ওর বোন সোমা পাগলের মত দরজা ধাক্কিয়েছে। চিৎকার করে সবাইকে ডেকেছে।ও কোনো আওয়াজ করেনি অথচ হসপিটালে যাওয়ার পথেও নাকি জ্ঞান ছিল ওর।
অবাক লাগে তার ,অত নরম সেই মেয়ে এতটা জেদি আর কঠিন হোল কোন অভিমানে?সহ্য ক্ষমতার এতখানি কিনারে সে পৌঁছেছিল নাকি আরও অনেক বেড়ে গেছিল সহনশীলতা? আগুনের জামা পরে দাঁতে দাঁত চেপে তাই পরীক্ষা করে দেখছিল কতটা ও সহ্য করতে পারে?
বাবা এসেছিল হস্টেলে। একথা সেকথার পর কী একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।কী বলছিলে ও বাপি? বলছিলাম খাটুনি যাচ্ছে তো তোর। খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করিস।আজ উঠি রে। ভিজিটর রুমের বাইরে গিয়েও ফিরে তাকালো তারপর হনহন করে হাঁটা দিল তাদের বাবা। মনখারাপ কেন ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক সেও ডিউটিতে গেল।আরও দিন দুই পর মায়ের ফোনে সে ঋতুর চলে যাওয়া জানলো। তোদের বাবা ঠিক বলে উঠতে পারেনি খবরটা।তুইও সে সময় ডিউটিতে যাচ্ছিলি। কী রে চুপ করে গেল কেন? কাঁদিস না। আমি কাঁদছি না।পরে কথা বলবো মা।রাখছি এখন বলে ফোন ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
ঘরে ঢুকে ওর জন্য কিনে রাখা ওড়না, পারফিউম,আরও টুকিটাকি কিসব কাবার্ড থেকে বার করে ছুঁড়ে দিল হাউস স্টাফ হস্টেলের জানলা দিয়ে। ওপর থেকে আছড়ে পড়ল কোথায় সেসব নাকি উড়ে গেল ছেঁড়া খোঁড়া পালকের মতো তাকিয়েও দেখলো না সে।নিজের হাতে এমব্রয়ডারি করে ঋতু তাকে বানিয়ে দিয়েছিল বুকে হাতে কুচি দেওয়া ধবধবে এক ব্লাউজ।সেটাকেও ছুঁড়তে গিয়ে হাত গুটিয়ে ফেরত আনল। গুঁজে দিল জামাকাপড়ের নিচে কোথাও।
চোখ দিয়ে জল পড়ছিল না তার,কান্না আসছিল না শুধু ছটফট লাগছিল যেন জ্বালা ধরেছে চামড়ার তলায়। হাত পা পচে যাচ্ছে বলে উল্টে পাল্টে দেখছিল।হাওয়া খামচে ধরছিল সে।নড়তে নড়তে সে কুঁজো হচ্ছিলো,উঁকি দিচ্ছিল জানলায় ,ডিং মেরে দেখছিল চারতলা থেকে চলমান পার্ক সার্কাসের রাস্তা।সব তো ঠিকঠাকই আছে তাহলে।অথচ ঘরের এধার ওধার জানলা করিডোর সিঁড়ি সব জায়গায় এমনি এমনি সে খালি খালি হাঁটা চলা করছিল। পলাশ এলে ঋতুর খবরটুকু বলল। তিন চারটে শব্দ। ব্যাস।আর কিছু না।
কাজ করতে পারছিল না সে। শনিবার বিকেলে বাড়ি গেল ওদের। পেছনের বারান্দায় ওল্টানো একটা লোহার বালতির সামনে ভুরু কুঁচকে উবু হয়ে বসে ছিল ঋতুর মা। তাকে খেয়াল করেনি প্রথমে। ঘরে ঋতুর ছবির সামনে ধুপ জ্বলছিল। উঃ কেন যে সবাই এই গ্ৰিনচম্পা জেসমিন ধুপগুলো জ্বালে।জ্বালা করে বুক। দম বন্ধ লাগে।ধুপের গন্ধ আর মাংস পোড়ার গন্ধ আলাদা করতে পারে না সে।
তাকে দেখেই কাকিমা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদলো। সে বিলাপের মধ্যে শুধু "ঝিনির কাছে যাবো"ছাড়া আর কিচ্ছু সে শুনতে পাচ্ছিল না। বড় করে বাঁধানো ওর মালাপরা শাদাকালো ছবিটার দিকে সে তাকিয়েই রইল।যেন ওটাই তার কাজ।
জন্মান্তর মানে না সে।বিয়েও হয়নি তখন। তবু মনে মনে বলছিল সে ,আর একবার আসবি ঋতা? আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবি বেশ। এবার তোকে ঠিকঠাক বাঁচতে শেখাবো।
0 Comments