জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প— ২৩৭মাঝ রাতের ছাগল চোরজিম্বাবোয়ে (পশ্চিম আফ্রিকা)চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোকগল্প— ২৩৭

মাঝ রাতের ছাগল চোর

জিম্বাবোয়ে (পশ্চিম আফ্রিকা)

চিন্ময় দাশ


এক খরগোশের ভারি মন খারাপ। একা একা থেকে হাঁফিয়ে উঠেছে বেচারা। দুটো কথা বলবে, তেমন একজনও কেউ নাই তার ধারে কাছে। অনেক ভবে চিন্তে, একটা জুড়িদার জোগাড়ের কথা ভাবল।

কিন্তু ভাবলেই তো আর জুড়িদার পাওয়া যাবে না। তার জন্য খোঁজ নিতে হবে। সে কাজের জন্য ঘর থেকে বে্রোতে হবে। কিন্তু এ দেশের আবার নিয়ম, একা একা কেউ বাইরে বেরয় না।

তখন করল কী, এক বেবুন (আফ্রিকার বেশ বড়সড় আকারের এক জাতের বানর)-এর বাড়ি গিয়ে হাজির হোল খরগোশ। কথায় কথায় বেশ একটু ভাবসাব জমিয়ে, বলল—বেবুন দাদা, আমার সাথে একটু গাঁয়ের দিকে যেতে পারবে? ভারি সমস্যায় পড়েছি। 

--বলছো কী, ভাই? তোমার সমস্যা। আর আমি যাবো না? বেবুন এক কথায় রাজি।  

🍂
ad
খরগোশ আর বেবুন চলেছে গ্রামের দিকে। রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি এসেছে। ছোট্টমতন একটা ঝোপ। খরগোশ বলল—বেবুন দাদা, এই ঝোপটা চেনো তুমি? 

বেবুন কিছু বুঝতে না পেরে, বলল— ঝোপের আবার চেনা না -চেনার কী আছে?

--না, না। আমি বলছি, এই গাছগুলো চেনো তুমি?

--কেন চিনব না? খুব ভালো মতন চিনি।

--কী গাছ এগুলো?

বেবুন বলল—জেনে রাখো তাহলে। এই গাছগুলো ভারি উপকারি। কখনও কোন কারণে যদি পেট কামড়ায় তোমার, এর দুটো শেকড় চিবিয়ে খেয়ে নিও। সাথে সাথে উপকার। 

ঝোপের গাছগুলোর গুণের কথা খরগোশও ভালোই জানে। আসলে, অন্য ফন্দি খেলা করছে তার মাথায়। তাই না জানবার ভান। খরগোশ উৎফুল্ল গলায় বলল—তাই না কি? ভালোই হয়েছে। কুটুমের বাড়ি যাচ্ছি। ভালোমন্দ খাবার দেবে নিশ্চয়। তখন যদি পেট কামড়ায় আমার, তুমি  এসে দুটো শেকড় নিয়ে যাবে আমার জন্য?

বেবুন বলল- এ আর এমন কী কথা গো। দরকার পড়লে, নিশ্চয় আসব। তোমার জন্য এটুকু করব না?

খরগোশ বলল—আসলে, সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি তো। খেতে গেলেই না পেট কামড়ায়।

--আগে তো পেট কামড়াক। তখন দেখা যাবে।

দুজনে গ্রামে এসে পৌঁছল যখন, সূর্য ডুবতে বসেছে। এক গেরস্তবাড়ির সাথে ভাব ছিল খরগোশের। দুজনে পৌঁছতে, বাড়ির কর্তা ভারি খুশি। বেশ আদর করেই একটা ঘরে থাকতে দিল দুজনকে। 

বেশ ভালোমন্দ খাবারই তৈরি হয়েছে তাদের জন্য। খেতে বসে, দু’-এক কামড় খেয়েই, খরগোশ মুখ বাঁকাতে শুরু করেছে। বেবুন বলল—হোলটা কী তোমার? এমন করছো কেন?

--আর বোল না, দাদা। যা ভয় পেয়েছিলাম, তাই। পেট কামড়াতে শুরু করেছে।

শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বেবুন। ঝটপট উঠে পড়েছে—ভয় পেয়ো না, ভাই। আমি যাচ্ছি। শেকড় তুলে আনছি। খরগোশকে কিছু বলতে না দিয়ে, বেরিয়ে গেল বেবুন।

খরগোশের তো আনন্দ ধরে না। এই মওকাটাই তো খুঁজছিল  সে। পেট-ফেট কিছুই কামড়াচ্ছে না তার। আসলে, বেশি খাবার ফন্দি।

চেটেপুটে দু’জনের খাবারই সাবাড় করে দিল খরগোশ। গেরস্তকে ডেকে, থালাগুলো তুলে নিয়ে যেতে বলল।

এক সময় বেবুন ফিরে এলো হাঁফাতে হাঁফাতে। খাবারের থালা উধাও। খরগোশও বসে আছে দিব্বি আরাম করে। বেবুনের মাথায় কিছু ঢুকছে না। খরগোশ বলল—আর বোল না, দাদা। তুমি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলে। তা দেখে, কত্তামশাই এসে জানতে চাইল। আমার পেট কামড়াচ্ছে শুনে, কী সব জড়িবুটি এনে খাওয়াল। বেশ আরাম বোধ হচ্ছে তাতে।

--বাহ, এ তো ভালো কথা। বেবুন জানতে চাইল—কিন্তু আমার খাবার?

--কী বলি বলো তো তোমাকে? দুটো থালাই তুলে নিয়ে চলে গেল ওরা। 

ভারি হতাশ হয়ে পড়ল বেবুন। কিন্তু এ কথার আর কী জবাব হয়? চুপচাপ শুয়ে পড়ল দুই বন্ধু। 

সবে মাঝরাত হয়েছে। ঘুম ভেঙে গেল বেবুনের। খিদের জ্বালায় পেট গুলোচ্ছে তার। একটা ফন্দি এলো খরগোশের মাথায়। বলল—একটা কাজ করি, চলো। অনেকগুলো ছাগল আছে এদের গোয়ালে। চল, চুপিচুপি একটা ছাগল মেরে খাওয়া যাক।

বেবুনের তখন পেট চুঁই-চুঁই। সে এককথায় রাজি। আর দেরি করে কী লাভ? দু’জনে গোয়ালে ঢুকে, কাজে লেগে গেল। দেখতে না দেখতে, পুরো ছাগল সাবাড়। কাজ শেষ। ঘরে এসে শুয়ে পড়েছে দুজনে।

পেট ভরেছে। গভীর ঘুমে নাক ডাকতে শুরু করেছে বেবুনের। খরগোশ কিন্তু চোখটিও বোজায়নি। মটকা মেরে পড়েছিল।

গোয়াল থেকে ফেরার সময়, লুকিয়ে ছাগলের খানিকটা রক্ত নিয়ে এসেছিল সে। চুপিসারে বেবুনের হাতে পায়ে আর মুখে খানিকটা করে রক্ত ছিটিয়ে, ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে গৃহস্থ দেখল, তার একটা ছাগল উধাও। দুই অতিথিকে জিজ্ঞেস করল, তারা কিছু জানে কি না। দুজনেই মাথা নেড়ে জানাল, তারা কিছু জানে না। কিন্তু বেবুনের গায়ে রক্ত দেখে কিছু বুঝতে বাকি রইল না গেরস্তের। বেদম মার মারতে লাগল বেবুনকে।মার খেয়ে, মরেই গেল বেবুন বেচারা। 

এখানে থাকাটা আর নিরাপদ নয়। সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ইনিয়ে বিনিয়ে,পাঁচ কথায় বন্ধুর কুকর্মের জন্য ক্ষমা-টমা চেয়ে, সরে পড়ল খরগোশ।

হয়েছে কী, বনের এক শেয়াল ছিল বেবুনের বন্ধু। ক’দিন বন্ধুকে দেখতে না পেয়ে, খোঁজ শুরু করে, খরগোশের কীর্তি জেনে ফেলেছে সে। ভয়াণক রাগে গরগর করতে লাগল শেয়াল। শেষমেষ ভাবল, এর যোগ্য জবাব দিতে হবে হতভাগাকে।

খরগোশের ডেরায় এসে হাজির হয়েছে শেয়াল। খরগোশ খাতির করে বসিয়েছে। জানতে চাইল—হঠাৎ কী মনে করে এখানে?

--শুনলাম, তুমি নাকি গাঁয়ে তোমার কোন কুটুমবাড়ি গিয়েছিলে। তা আমাকে একদিন নিয়ে যাবে, ভাই? 

খরগোশ বলল—এই কথা? চলো, কালকেই যাওয়া যাক। 

পর দিন। দুজনে তখন মাঝরাস্তায়। সেদিনের সেই ঝোপের কাছে পৌঁছেছে। শেয়াল বলল—একটা জরুরী কথা বলার ছিল তোমাকে।

খরগোশ বলল—বলো, কী কথা?

--আমার একটা উপকার করতে হবে তোমাকে। কথা দাও, করে দেবে?

--ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি, করে দেবো। 

শেয়াল বলল—এই ঝোপটা চেনো তুমি?

--কেন চিনব না? এর শেকড়ে সব রকমের পেট কামড়ানো সেরে যায়। কেন বলো তো?

শেয়াল বলল—আসলে তোমার কুটুমের বাড়ি যাচ্ছি তো। ভালোমন্দ খাওয়া হবে নিশ্চয়। আমার আবার পেট কামড়ানোর রোগ আছে। যদি তেমনটা হয়, আমাকে এর একটু শেকড় এনে দিতে হবে। 

--এ আর এমন কি কঠিন কাজ হোল? নিশ্চিন্ত থাকতে পার তুমি। ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে।

দুজনে রওণা দিতে যাবে, খরগোশ বলল—একটু দাঁড়াও, ভাই। জল ছেড়ে আসি। 

বলেই আড়ালে গিয়ে, খানিকটা শেকড় তুলে নিয়েছে । শেয়াল কিছু টেরই পেল না। 

গল্প করতে করতে চলেছে দুজনে। সূর্য ডোবার মুখে, সেই গৃহস্থের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। কর্তামশাইও খুশি মনে ভেতরে ডেকেছে তাদের। 

রাতের খাওয়া-দাওয়া শুরু হয়েছে দুজনের। একটু পরেই শেয়াল বলল—ভায়া, সেই যে বলেছিলাম না, পেট কামড়ানো শুরু হইয়েছে। উপকারটুকু করে দাও আমার। নইলে, আজ রাতেই অক্কা পেতে হবে আমাকে। ছুট্টে যাও একটি বার। 

শেকড় তো খরগোশের কাছেই ছিল। সাথে সাথে  সে বের করে দিল। বলল—বলেছিলাম না, চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। এই নাও শেকড়।

দুজনের খাবার একাই সাবাড় করবার ফন্দি খাটল না শেয়ালের। খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল দুজনে। 

মাঝরাতে খরগোশকে ডেকে তুলল শেয়াল। চলো, গোয়ালঘরে যাই। একটা ভেড়া মেরে খাওয়া যাক। 

খরগোশ তাতে এক কথায় রাজি। ছোট্ট শরীর তার। ভেড়া মেরে পেট ভরানো কি আর তার পক্ষে সম্ভব কোন দিন? খরগোশ ভাবল, সুযোগ এসেছে ঘর বেয়ে। এমন মওকা ছাড়তে নাই। 

ভেড়া মেরে, ভালোই ভোজ হোল দুজনের। শোবার জায়গায় ফেরার আগে, চুপিচুপি খানিকটা রক্ত হাতে নিয়ে নিয়ছে শেয়াল। খরগোশের কিন্তু চোখ এড়ায়নি সেটা।

শুয়ে পড়েছে দুজনে। শেয়াল শুয়ে আছে দু’চোখ বুজে। কিন্তু চোখে ঘুম নাই। মটকা মেরে শুয়ে আছে। তার নজর খরগোশের দিকে। কখন ঘুমায় হতভাগা। ফন্দি এঁটে বন্ধু বেবুনকে মেরে ফেলার বদলা নিতেই হবে আজ।

খরগোশ তো শেয়ালের ফন্দি বুঝে গেছে। সেও শুয়ে আছে ঘুমের ভান করে। শেয়াল যতো বার দেখে, খরগোশের চোখ দুটো খোলা। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে গেল এক সময়। একটি বারের জন্যও চোখ কিন্তু বোজায়নি খরগোশ।

সকাল হতেই হইচই পড়ে গেছে বাড়িতে। আজ একটা ভেড়া উধাও!

কর্তামশাই দুই অতিথির ঘরে এসে হাজির হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে কিছু জানে কি না, জানতে চাইল।

খরগোশ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমার গায়ে কি আর ভেড়া মারবার ক্ষমতা আছে? বড় জোর দুটো একটা মশা বা মাছি মারতে পারি। এই পর্যন্ত। বিন্দু-বিসর্গ কিচ্ছুটি জানি না আমি।

কর্তামশাইও সেটা ভালোই জানেন। শেয়ালের দিকে তাকাতেই, আর কোন প্রশ্নই করতে হোল না। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে শেয়ালের হাত দুটি।

তার পর? তার পর যা হবার, তাই হোল। মার শুরু হোল। বন্ধুর মৃত্যুর বদলা নিতে গিয়ে, বেঘোরে নিজের জীবনটাই দিতে হোল বেচারা শেয়ালকে।এ

এই জন্যই বলে, ধুরন্ধরদের সঙ্গ এড়িয়ে চলা উচিৎ।


Post a Comment

0 Comments