মেমারি গেম। শেষ পর্ব
সাপের ঘটনার পরের দিন সকাল। মহিমা দেখলেন সুশান্ত দূর থেকে তাঁর দিকে হাত নাড়ছেন, মুখে একগাল হাসি। কয়েক মিনিটের জন্য জন্য তাঁদের সেই এনকাউন্টার এবং ‘থামিল কালের চির চঞ্চল গতি’র আলিঙ্গনের পরে কোন কথা না বলে দুজনেই নিজের নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন। মাথার মধ্যে দপদপ করছিল রক্তপ্রবাহ, আর একটা প্রচন্ড শক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল তাঁদের ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক, তার নিউরন, এক্সন হিপোক্যাম্পাস। একটা ঝড় বইতে শুরু করেছিল মাথার মধ্যে, আর সেই ঝড়ের নিষ্ঠুর ইস্পাত লাংগলের মত মাথার অন্ধকার কূপ থেকে সমস্ত ভুলে যাওয়া স্মৃতি খুঁড়ছে খুঁড়ছে আর তুলে আনছে একের পর একটা দিন, একের পর একটা নাম, স্থান ঘটনা বন্যার মত ভাসিয়ে দিচ্ছে মনের দুকুল।
তারপরে আজ আবার এই দেখা। সন্ধ্যার ষড়যন্ত্র নয়, এখন উজ্জ্বল সকাল, সূর্যের রশ্মি প্রাণবন্ত এবং সবুজ ও পবিত্র পরিষ্কার। শীতের কুয়াশার পরে আকাশ আজ হঠাত নীল নীল যেদিকে চোখ যায়।
=আপনি কি জানতেন এখানে কমলার বাগান ছিল? এইমাত্র দেখলাম, কয়েকটা বেশ পাকা, রঙ ধরেছে, কমলা রঙ। দার্জিলিং বা নাগপুরের বাইরে কোথাও কমলালেবু জন্মায় তা কল্পনাও করতে পারিনি। দেখবেন? চলুন দেখাই।
খুবই অপ্রত্যাশিত। যিনি সোজাসুজি তাকাতেন না কখনো, চোখে চোখ পড়লেই মুখ বেঁকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরাতেন, সেই মহিমার আজ যেন নতুন প্রকাশ হল সুশান্তর চোখের সামনে। গত সন্ধ্যার দুর্ঘটনার পর মনে মনে আশঙ্কা ছিল, আজ কিছু একটা গোলমাল না পাকায়। কাজটা ভালো হয়নি, কিন্তু যা হয়ে যায়, তাকে আর নাহয়েছে করে দেওয়া তো যায় না। অশান্তির পর সুশান্ত-ও আজ তফাৎটা অনুভব করছিল। সন্ধ্যার সব মুহূর্ত গুলো এখনো জ্বলজ্বল করছে মনের মধ্যে। আরও মনে হচ্ছে দীর্ঘ বিদ্যুৎ বন্ধের পরে আলো ফিরে এসে পৃথিবী আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে।
=হ্যাঁ, আমি জানতাম।
=কিন্তু আপনি আমাকে এ ব্যাপারে বলেননি তো কখনো?
সুশান্ত উত্তর দেওয়ার জন্য কোনও শব্দ খুঁজে পেলেন না। যখন কখনো একসঙ্গে কথাই বলেনি কেউ তখন কমলা বাগানের কথা কে বলবে সাহস করে।
কিন্তু কমলা বাগানের চেয়েও কিছু জরুরী কথা আছে আজ। সুশান্ত সময় নষ্ট না করে সরাসরি আসল কথায় চলে গেলেন।
=আপনার সাথে আমার দরকারী কিছু কথা আছে। আপনি কি এই চেয়ারটি নিয়ে কিছুক্ষণ বসবেন?
মহিমা এমনভাবে বসে পড়লেন যেন তিনি জানতেন সুশান্ত তাকে বসতে বলবেন। আর এটাও যেন জানেন তিনি কী বলবেন। এই সকালে মহিমা এরও তো অনেক কিছু বলার ছিল।
🍂
=এই বসলাম। এবার বলুন। আপনাকেও আমার কিন্তু কিছু বলার আছে।
=আমার স্মৃতি ফিরে এসেছে।
এই বাক্যটি দুজনে বলে উঠলেন একই সময়ে, কোরাসের মতো। বলে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল সম্মোহিত হবার মত। অস্পষ্টতা, অনিশ্চয়তা ভরা চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। তাদের কথা শুনতে যেন সারা নীল আকাশ এই বাগানে নেমে এল, কিন্তু মহিমা বা সুশান্ত তা জানতেই পারলেন না। কি একটা মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হল, এই বেলা গড়ানো দুটি মানুষ সাহস করে ভাবতেই পারেন না, যে এটা কি প্রেমের মতো কিছু ?
পরদিন সকালে সূর্য অদৃশ্য। হঠাৎ পশ্চিমী ঝঞ্ঝা বাংলার দিকে ঘুরে গেল, আর্দ্রতা কুড়ি শতাংশ বাড়ল এবং তাপমাত্রাও বেড়ে গেল পাঁচ ডিগ্রি। লিটন তার ব্রেকফাস্ট চেয়ারে বসে কফিটি একটু ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ততক্ষণ চলছিল ফোনে আঙ্গুল চালিয়ে ওয়েদার রিপোর্ট স্ক্রোল করা। করতে করতে তিনি আবহাওয়ার খবরের থেকে এগুলো উদ্ধার করলেন আর দেখতে দেখতে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। আজ সারাদিন প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হবে, আর এই জাতীয় আবহাওয়া দেখলে সকালেই মেজাজটা খিচড়ে যায়। জরুরী কাজ হল ম’ এর ছেলেকে খবর দিতে হবে এবং তাকে ইম্প্রেস করতে হবে, যাতে মায়ের দায়িত্বটা সে নেয়, মার যত্ন নিতে রাজি হয়। আইনি পরিভাষা দিয়ে তাকে কিছুটা হুমকি দিতে হতে পারে, কিন্তু লিটন ভালোই জানেন আইন দিয়ে সবকিছু হয় না। কিন্তু একজন পুলিশ আর কী করতে পারে? তার একহাতে লাঠি আর এক হাতে আইনের বই। পাবলিক, কোর্ট, মিডিয়া সুশীল সমাজ সব প্রতিপক্ষ। সৌভাগ্যক্রমে সুশান্তের এ জাতীয় কোনও সমস্যাই নেই। তাঁর ভূ ভারতে কোনও আত্মীয়ই নেই যাকে তার যত্ন নেওয়ার জন্য আইনত ডাকা যেতে পারে। উনি নিজের বাড়িতে চলে যাবেন যখন ইচ্ছে, কাউকে ডাকাডাকি করতে হবে না
"হারামজাদা"। এটা ছাড়া আর কোন বিশেষণ মনে এল না । এই দুই হাড় বজ্জাত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এক্টিং করে গেল আমার সঙ্গে। যাই জিজ্ঞেস করি, কিছু নাকি মনে পড়ছে না। আর হঠাৎ আজ সব মনে পড়ে গেল, এটা এটা রসিকতা নাকি? লিটন নিশ্চিত যে হঠাত সাপ দেখে দুজনে শক পেয়েছে আর দুম করে সব মনে পড়ে গেছে এটা পুরোটাই একটা ধাপ্পা। আষাঢ়ে গল্প একেই বলে।
কিন্তু এতদিন লুকিয়ে রাখার পিছনে কারণটা লিটনের ঝানু মাথায় ঢুকছে না। আর হঠাৎ তারা সব স্বীকার করে নিল সেটাই বা কেন? মোটিভ কী হতে পারে?
"মহিমা কি ওর ছেলেকে ভয় পায়? নিশ্চয়ই ছেলেটা মাকে টর্চার করত। ওর বৌ তো আবার মডেল, মার হয়ত ব্যাপারটা পছন্দ না। এই এঙ্গেলটা কেস বন্ধ হবার আগে ভাল করে তদন্ত করে দেখতে হবে। সে না হয় হল, কিন্তু সুশান্ত? তার ব্যাপারটা কি? জেরাতে তিনি ইতিমধ্যে স্বীকার করেছেন ক্যান্সারে স্ত্রীকে হারিয়েছেন আর পাহাড়ে এক্সিডেন্ট হয়ে মেয়েটি গেছ। আচ্ছা। হারামজাদা এই সুযোগে সরকারী অতিথি হয়ে কিছুদিন সরকারি যত্ন নিয়ে দেখছিল? তবে এটি আইন বিরোধী কিনা তা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারল না লিটন। কফি এবার ঠিকঠাক হয়েছে, লিটন অভ্যাস মত লম্বা চুমুক দিয়ে কাপ শেষ করে বাইরে অপেক্ষারত জীপের দিকে এগিয়ে গেল।
মহিমার ছেলে জোজো যখন লিটন-এর সঙ্গে রিপোজে পৌঁছল, তখন মেঘের আচ্ছাদন ছিঁড়ে গেছে আর সূর্য মেঘের আড়াল থেকে একটুখানি উঁকি দিচ্ছে। পাখিরা হাওয়ায় বেরোয়নি, কিন্তু আলো আরো উজ্জ্বল হলেই কমলালেবুর বাগানের ভেজা কাদা থেকে পোকাগুলো যেই বেরিয়ে আসবে অমনি তাদেরো দেখা মিলবে। জোজো বসে ছিল জিপে। দীর্ঘ যাত্রায় সে খুব ক্লান্ত। তার ওপর এসব আইন টাইন সে মোটেই বোঝে না, মা এবং তার আইনী সমস্যাগুলি কী করে কি হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আরও উদ্বিগ্ন যে স্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে প্রতি ঘন্টায় ফোন করার কথা কিন্তু সেটা পুলিশ বারণ করে দিয়েছে।
সুশান্ত কে সনাক্ত করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি, তাই লিটন বাজার থেকে কেকের দোকানের মালিককে ধরে এনেছে। সুশান্তর জবানবন্দীমত কেকের দোকানেই তিনি শেষ কথা বলেছিলেন। বলতেই লোকটা খিচিয়ে ওঠে, বলে
=খুব মনে আছে ঐ খাড়ুশ বুড়োকে, কিচ্ছু কিনবেন না, খালি দরাদরি করবেন। দেখলেই চিনতে পারবো, চলুন যাচ্ছি।
কেকের দোকানের মালিক দোকান ছেড়ে যাবার কোন ইচ্ছেই ছিল না। কিন্তু পুলিশ মা বাপ। কখন কি আইন ভেঙ্গে ফেলে, আইন তো আর মুখস্থ থাকে না, সাধারণ এক দোকানীর। আর লিটন চাইলেই দু ঘা দিতে পারেন বা কদিনের জন্য ঢুকিয়ে দিতে পারেন। কেউ বাঁচাবে না।
সবাই মিলে রিপোজের গেট দিয়ে ঢুকলেন প্রায় মিছিল করে। পুলিশ আসে যায় এখানে, কাজেই সিকিউরিটি চটপট গেট খুলে দিল।
তবে তাদের সবার জন্যই ছিল এক খবর। পাখিরা উড়ে গেছে। মহিমা বা সুশান্ত এর কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। ঘরগুলো ফাঁকা। লিটন হম্বিতম্বি করতে জানা গেল তাদের শেষবার দেখা গিয়েছিল ভোরের বাগানে ঘুরতে পাশাপাশি।
=পাশাপাশি? হাত ধরাধরিও ছিল নাকি? লিটন ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
বাগানের মালি কাঁচুমাচু করে তাকায়। সে যে আরো এক নিষিদ্ধ ঘটনা দেখে ফেলেছিল সেটা বলতে গিয়ে আবার গিলে ফেলে। তাড়াতাড়ি বলে,
=গত কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করেই খুব ধর্মে মতি হয়েছিল স্যার, ঠাকুরঘরে গিয়ে কীর্তন গাইতেন মাসিমা, আর ঐ কাকুও হাত তালি দিতেন শুনতে শুনতে। খুব মিষ্টি গলা কিন্তু।
রেগে জোরে হাততালি দিয়ে ওঠেন লিটন
=কীর্তন গাইতে গাইতে বোধহয় এখন নবদ্বীপে চলে গেছেন এতক্ষণ। জত্ত সব।
ঘরগুলো সারচ করতে গিয়ে দেখা যায়, দুজনেরই বিছানায় অজস্র হাস্নুহানার পাপড়ি ছড়ানো। বাতাসে তার আকুল করা গন্ধ। লোককাহিনী বলে হাসনুহানা সাপকে ডাকে।
সর্প দেবতা এত বোঝেন না। তিনি ব্যাং পেলেই খুশি।
0 Comments