জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /মেমারি গেম। পর্ব ৪


গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
মেমারি গেম।  পর্ব ৪

এদিকে এসে গেল আর এক উৎসবের সন্ধ্যা । সব উৎসব বার বার, হ্যাপী নিউ ইয়ার একবার। সেদিনটা ছিল নিউ ইয়ার ইভ। আমাদের গল্পের রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলেও তাঁদের স্মৃতিশক্তি এখনও আশানুরূপ ফিরতে দেরি হচ্ছে। এদিকে শহরের নিয়মমত ও পরিসংখ্যান মত ধারাবাহিক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকায় কয়েকদিন আইসিইউ বেশ সচল হয়ে যায়। একটি গাড়ি পুকুরে পড়ে চালক সহ দুইজনের পাতাল প্রবেশ। একটি বিএমডব্লিউ ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে দু'জনকে দুরমুশ করে দেয়, দুজনেই তখনও বেঁচে ছিল তবে তাদের বেশ কয়েকটি হাড্ডী টুকরো টুকরো। দুটি মোটরবাইক উড়ালপুলের উপর দিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে উড়তে থাকে ও শেষে একটি ফাঁকা পুকুরে পড়ে যায়। এরাও হাসপাতালে আসে, আইসিইউতে থেকে তাড়াতাড়ি মৃত্যু বরণ করে। খবরের কাগজের হেডলাইনে পয়লা জানুয়ারিতে উৎসাহব্যঞ্জক এই সব সংবাদ পাঠকের মন ভরিয়ে দেয়। 
 
মহিমা এবং সুশান্তর কেসটা এখন হাসপাতালের করিডরে সবাই জেনে গেছে, তাঁদের নাম হয়েছে সুইসাইড কাপল। আইসিইউ থেকে এখন তারা এইচ ডি ইউতে। কৌতূহলী লোকজন, হাসপাতালের কর্মীরা মাঝে মাঝে দেখে যায়, আঙ্গুল দিয়ে দেখায় আর ফিসফিস করে। আর তা দেখে দুজনেরি গা জ্বলে যায়। অনেক খোঁজ করেও কারো আত্মীয় স্বজনের ঠিকানা এখনো পুলিশ বার করতে পারে নি। ফলে তাদের সনাক্ত করতে পারে এবং আর নিয়ে যেতে পারে এমন কাউকে পাওয়া যায় নি। পুলিশের আর হাসপাতালের একমাত্র আশা হঠাৎ এরা সব মনে করতে পারবে ও কথা বলা শুরু করবে। 

🍂

এই দিনগুলিতে মহিমা এবং সুশান্ত ধীরে ধীরে উদ্ভিদ অবস্থা থেকে বেড়ে উঠে মানুষের মতো ব্যাবহার শুরু করে। প্রথমেই উৎপন্ন হয় বিরক্তি। গাছেদের বিরক্তি থাকে না, যদিও পোষা বেড়ালদের বিরক্ত হবার কথা শোনা যায়, কারটুনেও দেখা যায়। এ দেখে নন্দিনীর মনে হয় মানুষের সত্যিকারের আদিম রিপু নিশ্চয় বিরক্তি। দুজনে একে অপরের দিকে কি অপরিসীম বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছিল ভাবা যায় না। আবার দুজনের চোখে এক ভয়ও খেলা করছিল যদি হাসপাতাল তাদের একসাথেই থাকতে বাধ্য করে তাহলে কি হবে। 

ইতিমধ্যে কিছু ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়েছে, মহিমার ডান পা এখনও প্লাস্টারে। ব্রেন নিয়ে ডাক্তাররা নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন বলে দুজনেরি মাথা ছাঁটাই করতে হল। এখন দুজনকে কোনও কৃষ্ণ কাল্টের সন্ন্যাসীদের মতো দেখাচ্ছে। সুশান্ত শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন। সুশান্তর আবছা আবছা মনে হয় তিনি যেন একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার ছিলেন। কিছু কিছু ক্লায়েন্টের নাম ও তাদের প্রোজেক্ট মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ছিল কিছু চতুর অ্যালগরিদম যার জন্য তাকে কোটি বা কোডার অফ দি ইয়ার দিয়েছিল কমপানী থেকে, সে অনেক বছর আগে। কিন্তু সুশান্তর পরিষ্কার মনে পড়তে থাকে সেই কোডের লাইনগুলো। অথচ কিছুতেই কোনো মানুষের নাম মনে পড়ে না। কি মুষ্কিল। 
ওদিকে শুয়ে শুয়ে আঙুল দিয়ে বাতাসে আঁক কাটতে কাটতে মহিমা লুকিয়ে লুকিয়ে সুশান্তকে দেখছি্লেন। সুশান্তের অদ্ভুত নেড়া মাথা আর বিড়বিড় করে কিসব বলা দেখে হাসি পাচ্ছিল খুব। আবার সুশান্তও লুকিয়ে দেখছিলেন, মহিমা কেমন আকাশে আঁক কাটতে কাটতে ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন তাকে কোনও মঠের সন্ন্যাসিনীর মতো দেখাচ্ছিল, দুর্বল, ফ্যাকাশে এবং সুন্দর। 

সকালে উঠে হঠাৎ মহিমার একটা গানের লাইন মনে পড়ে গেল । ‘বাল খ্রিষ্ট যশোদা কোলে, ঘুমিয়ে পড়ে দুলে দুলে।‘ সেই কীর্তন যা তিনি গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন রিক্সাতে। মনে পড়ল এটা তাঁরই লেখা, তাঁরই সুর দেওয়া। সুরটা অবশ্য একটা সুপরিচিত ভজনের সুর থেকে নেওয়া। একটু গুন গুন করে গাইতে গাইতে মহিমার হঠাৎ মনে পড়ল হাতে একটি মালা এবং একটি কমলা রঙের মাফলার ছিল। কোথায় গেল সেগুলো? 
সুশান্ত ঘুমিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন মহিমা। ঐ বুড়ো সন্ন্যাসী তাঁর ব্যক্তিগত কথা শুনে ফেলুক সেটা হতে দেওয়া যায় না। সুশান্ত এবারে একটু ঝিমিয়ে পড়েছে দেখে ইশারায় নন্দিনীকে ডাকলেন। 
=দিদিভাই, আমার সঙ্গে একটা মালা আর মাফলার ছিল কোথায় গেল বলতে পারো? এই আমার হাতেই ছিল, তারপর আর কিছু মনে নেই। 
নন্দিনী খোঁজ খবর করে এসে জানাল এরকম কিছু তাদের কাছে নেই। কিন্তু মহিমার স্মৃতি যে ফিরছে সেটা খুবই ভাল খবর। হাসপাতাল থেকে পুলিশের কাছেও খবর গেল মাফলার আর মালার। পুলিশ খবর পাঠাল ইনফরমারদের। 
এরপরে অকস্মাৎ মহিমার মনে পড়ে গেল তিনি সম্প্রতি দহি বড়া তৈরি করতে শিখেছিলেন। আরো মনে পড়ল একটি বিশাল মন্দিরের কথা যার মধ্যে এক ঘন কালো বর্ণের দেবতা অন্ধকারে শুয়ে আছেন। পরের পর ভক্তেরা আসছেন আর নিঃশব্দে চলে যাচ্ছেন। শুধু ছবি। একটা নাম মনে পড়ছে না। কি মন্দিরের নাম, কে দহিবড়া শিখিয়েছিল তার নাম। 
 
এতসব মনে পড়ছে কিন্তু কেউই মনে করতে পারছে না তারা জীবনে একে অপরকে আগে কখনও দেখেছে কিনা। হাসপাতাল থেকে জোর দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের ঘনিষ্ঠভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আর তাঁদের বয়স ও চেহারা দেখে তাঁদের দম্পতি হওয়ার সম্ভাবনা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 

এ এস আই লিটন পাল আবার এসেছিলেন তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো জে এবং জেকে নিয়ে। তিনি এবার দৃশ্যমান বিরক্তি প্রকাশ করেই বললেন, 
=আচ্ছা মুশকিলে ফেললেন, আপনারা স্বামী স্ত্রী তা অস্বীকার করছেন কেন? কম বয়স হলে ভাবতাম লিভ ইন বা এমনি মা বাবা বিয়ে দিচ্ছে না তাই ঝাঁপ দিয়েছেন। এখন যদি অঘটন একটা ঘটতো তাহলে আলাদা কথা, আপাতত তো বেঁচেই গেছেন ঘরের লোক ঘরে ফিরে যান একসঙ্গে। ভাবছেন আমাদের কাছে কিছু লুকিয়ে রাখা যাবে? বাঘা বাঘা ক্রিমিন্যাল আমাদের থেকে পালাতে পারে না। অনেক হয়েছে, এবার একটু দয়া করে সহযোগিতা করুন এবং আপনাদের নাম ঠিকানাগুলো এবার ঝেড়ে কাশুন। দেখুন, আপনারা যদি বাড়িতে ফিরে না যান তাহলে কিন্তু আমাদের আপনাকে সরকারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখতে হবে। সেটা বাড়ীর তুলনায় খুব একটা ভালো হবে কি?

মহিমা আর সুশান্ত দুজনে এসব শোনে আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এরা কি জোর করে আমাদের বিয়ে দেবে নাকি? একবার যদি মনে পড়ে নাম, বাড়ির ঠিকানা, আত্মীয়… নাঃ কিচ্ছুই মনে পড়ে না। সব অন্ধকার। 

এদিকে হাসপাতালে আসার পর থেকে যা হয়েছে সব দিব্যি মনে থাকছে। নার্সের নাম নন্দিনী, অফিসারের নাম লিটন পাল, আর দুটো জোকারের মত সঙ্গী যতীন আর যতীন সব মনে আছে। এমনকি বড় ডাক্তার নিউরোসারজন দেবীদয়াল এলেন, বললেন এরকম হতেই পারে, আর এর নাম যে পোস্ট ট্রমাটিক এম্নেসিয়া বলে গেলেন তাও দিব্যি মনে আছে। কিন্তু আর কিচ্ছু না। মাথার চুল নেই নইলে দুজনেই মাথার চুল টেনে এতক্ষণে হয়ত ছিঁড়েই ফেলতেন। মহিমার হতাশ লাগে। একবার ভেবে দেখার চেষ্টা করলেন, সত্যিই কি ঐ লোকটা আমার স্বামী, হতেই পারে না, যা তা একটা লোক। ঠিক কি কারণে যা তা মনে হল সেটা অবশ্য ঠিক করে বুঝতে পারলেন না মহিমা। আর স্বামী না হলে একজনের সঙ্গে গিয়ে থাকা, ছিঃ। 

এর মধ্যেই একদিন রাতে হাসপাতালে আগুন লেগে গেল। 

কলকাতায় সাধারণত উইকএন্ডে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। সেটাই মোটামোটি নিয়ম। কখনই সপ্তাহের দিনগুলিতে কিচ্ছু হবে না। যখন অফিসগুলি খোলা থাকে, শহরের প্রতিটি অট্টালিকায় মানুষের ভীড়, ব্যবসা মামলা, ষড়যন্ত্র মানুষের বাচ্চারা মন দিয়ে এসব কাজ করতে থাকে। তখন আগুন ধরে না। হঠাৎ শনিবার রাত এলেই সব জিনিস দাহ্য হয়ে যায়, এসিগুলো হয়ে যায় শর্ট সার্কিট বা গ্যাস সিলিন্ডারগুলো কেমন ফাটাকেষ্ট হয়ে যায়। আগুনের খুব খিদে পায়, আর তার বড় বড় ভবন বা ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে অরুচি । সে শুধু গরিব মানুষের নোংরা নোংরা ঝোপড়ি বা কুঁড়েঘর খেতে পছন্দ করে। ফায়ার সার্ভিসের অনেক অনেক ইঞ্জিন দৌড়য়, হৃদয় ও ঘর একসঙ্গে জ্বলে পুড়ে হাহাকার হয়ে যায়। সঙ্গে লেগে থাকে কিছু অস্বস্তিকর মৃত্যু। স্বস্তির ব্যাপার একটাই, একটি বিশাল অঞ্চল পরিষ্কার হয়ে যায়। বস্তিবাসীরা কিছুক্ষণ ইউটিউবারের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করে, তাদের ছবি পৌঁছয় দু একটি খবরের কাগজে, টিভিতে এক সন্ধ্যার জন্য দেখা যায়, তারপর তলিয়ে যায় অথই সময়ের অতলে, ওদের গল্প আর শোনাই যায় না। পরিষ্কার হওয়া জমিতে চটপট শুরু হয় কর্মযজ্ঞ, নির্মাণ ও বিকাশ দুই ভাই হাতধরাধরি করে আনন্দ করে। 

তবে আমাদের কাহিনীর কেন্দ্র ঝুপড়ি নয়, একটি সরকারী হাসপাতাল। রাত তখন ১টা। 
 
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

1 Comments