জ্বলদর্চি

সুস্মিতা সিংহ রায় (হেপ্টাথলিট, মেদিনীপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫১

সুস্মিতা সিংহ রায় (হেপ্টাথলিট, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুর শহরের রাজা রামমোহন নগরে বাড়ি। বাবা ছিলেন পুলিশ। তাই পুলিশ লাইনের কোয়ার্টারে থাকতে হত। ছোট্ট সুস্মিতা পুলিশ লাইনের মাঠে বড়দের খেলা দেখতে দেখতে বড় হতে লাগলেন। ইচ্ছে করত খেলতে। মনের মধ্যে একটা গভীর ইচ্ছেশক্তি তৈরি হতে লাগলো। মনে সাধ 'আমিও খেলবো। আমিও দৌড়াবো। আমিও ছুটবো'। কিন্তু খেলাধুলার সঙ্গে সংযুক্তিকরণটাই হচ্ছিল না। 

পুলিশ লাইনের প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় এলো সেই সুযোগ। এখানকার শিক্ষক রফিক স্যারের কথায় সুস্মিতার বাবা মা সুস্মিতাকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেন। সুব্রত পানের তত্বাবধানে শুরু হল অ্যাথলেটিক্স প্রশিক্ষন। ধীরে ধীরে সুস্মিতা হয়ে উঠলেন মেদিনীপুর তথা পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতের অন্যতম একজন ক্রীড়াবিদ। পুলিশ লাইনের এবড়ো খেবড়ো মাঠ থেকে ওলিম্পিকের অ্যাস্ট্রো টার্ফে তাঁর দীপ্ত দৌড়ঝাঁপ। এই পথটুকু পেরোতে তাঁকে কষ্ট করতে হয়েছে। লড়াই করতে হয়েছে। পরিশ্রম করতে হয়েছে। মাঠে নামার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে নিজের শারীরিক দক্ষতা এবং ক্ষমতা দিয়ে। আজ তিনি তাই মেদিনীপুরের গর্ব। 
দৌড়ের ট্র্যাকে

সুস্মিতা সিংহ রায়। মেদিনীপুরের প্রথম ওলিম্পিয়ান মহিলা। ১৯৮৪ এর ২৬ শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন মেদিনীপুর শহরে। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চির এই দৌড়বিদ অ্যাথলেটিক্সে নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেদিনীপুরের এই অ্যথলিটকে দিয়েছে 'খেলরত্ন সম্মান'। হেপ্টাথলনে তাঁর ব্যক্তিগত সেরা স্কোর ছিল ৬২০৭ পয়েন্ট। জেলার মাঠ থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে ফেলে লড়াই করতে করতে রাজ্যস্তর ডিঙিয়ে জাতীয় স্তরের ময়দানে নামার সুযোগ অর্জন করেছেন সুস্মিতা। প্রথমে ২০০০ সালে সাই ক্যাম্পে সুযোগ জোটে নিবিড় অনুশীলনের। যা তাঁর ক্ষেত্রে উঁচুতে ওঠার জন্য অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এখানে কুন্তল রায়ের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষন চলছিল তাঁর। 

এরপর শুরু হয় মাঠে ময়দানে লড়াই। যুদ্ধজয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। যা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মেদিনীপুর পুলিশ লাইন পার্কের ময়দানে। এই ২০০০ সালেই মস্কো ওয়ার্ল্ড ইউথ গেমসে হাইজাম্পে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। প্রথম বিদেশ যাত্রা শুরু হয়। এরপর ২০০৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ইনচিওনে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে হেপ্টাথেলনে রূপা পান। এবারই প্রথম এইরকম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ তাঁর। ২০০৭ সালে জর্ডনের আম্মান শহরে আইএএএফ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের বিভাগে অংশগ্রহণ করে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। এটি ছিল এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর দ্বিতীয়বারের জন্য অংশগ্রহণ করার ঘটনা। ২০০৯ সালে ক্যালিফর্নিয়ায় ইউএস ইন্ডোর ওপেনে ৬০ মিটার হার্ডলসে রূপো পান। এই ২০০৯ সালেই জার্মানির বার্লিনে আয়োজিত আইএএএফ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে মাত্র ৪৯৮৩ পয়েন্ট নিয়ে ষষ্ঠ স্থান পান। কিন্তু ইনজুরির জন্য ২০০৯ এ চিনের গুয়াংঝাও তে আয়োজিত এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েও নামতে পারেননি। 

তবে ২০০৮ সাল ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। এবছর তিনি চিনের বেজিং ওলিম্পিকে সুযোগ পান অংশগ্রহণ করার। মধ্যপ্রদেশের ভূপালে ভারতীয় ফেডারেশন কাপ থেকে ৫,৮৬৬ পয়েন্টের বি স্ট্যান্ডার্ড লাভ করার ফলে বেজিং ওলিম্পিকে সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে সাফল্য আসেনি। কিন্তু বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন মেদিনীপুরের বুক থেকে উঠে এসে। তিনি সেসময় যে নজির তৈরি করেন তা মেদিনীপুরের ইতিহাসে অন্যতম মাইলস্টোন বৈকি! 

বিশ্বের ৪৩ জন বাঘা বাঘা অ্যাথলিটদের সাথে এই ২০০৮ এর ওলিম্পিকে মহিলাদের হেপ্টাথলনে অংশ নিয়েছিলেন। পেয়েছিলেন ৩১ তম স্থান (৫৭০৫ পয়েন্ট)। ভারতের হয়ে আরও দুই প্রতিযোগী তাঁর সঙ্গে এই হেপ্টাথলন বিভাগে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রমিলা গনপতি (৫৭৭১ পয়েন্ট) পেয়েছিলেন ২৬ তম স্থান এবং জে জে শোভা (৫৭৪৯ পয়েন্ট) পেয়েছিলেন ২৮ তম স্থান। এই প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পান ইউক্রেনের নাটালিয়া ডবরিনস্কা (৬৭৩৩ পয়েন্ট), রূপা পান আমেরিকার হাইলিস ফাউন্টেন (৬৬১৯ পয়েন্ট)  এবং ব্রোঞ্জ পদক পান গ্রেট ব্রিটেনের কিলি সাউদারটন (৬৫১৭ পয়েন্ট)। সুস্মিতা হয়তো কোনও পদক পাননি, কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছিলেন মেদিনীপুরের পান্তা মুড়ি খাওয়া মহিলারাও পারে 'THE GREATEST SHOW ON THE EARTH' এ অংশ নেওয়ার ফাণ্ডা! যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুকরণযোগ্য এবং অনুসরণযোগ্য ঘটনা। 

২০০৬ সালে মেলবোর্নে আয়োজিত কমনওয়েলথ গেমসে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০০৭ এবং ২০০৯ সালে ইতালিতে ওয়ার্ল্ড কম্বাইন্ড ইভেন্টেও প্রতিযোগী হিসেবে নামার সুযোগ পান। ২০১০ সালে চিনে এশিয়ান গেমসে যোগদান করেন। এ বছরেই দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসেও ছিলেন প্রতিযোগী। এখানে সুস্মিতা মোট ৫,১২০ পয়েন্ট নিয়ে মহিলাদের হেপটাথলনে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন। ২০১৩ সালে পুণেতে আয়োজিত এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেন সুস্মিতা। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় আয়োজিত এশিয়ান গেমসে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। ২০০৬ - ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ১২ টি সিনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের হেপ্টাথেলন বিভাগে তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম মহিলা অ্যাথলিট। 
হেপ্টাথলনের প্রতিযোগী

খেলার ময়দানে নেমে তিনি উজ্জ্বল করেছেন ভারতের নাম, রাজ্যের নাম, মেদিনীপুরের নাম। মেদিনীপুরের বুক থেকে উঠে গিয়ে ওলিম্পিকের আসরে দৃপ্ত পদচারণা করা প্রথম মেদিনীপুরের মহিলা তিনিই। আজ তাঁর পদাঙ্ক অনুসরন করে ওলিম্পিকে পা রেখেছেন প্রণতী নায়েকদের মতো মহিলারা। কিন্তু ইতিহাস মনে রাখবে  সুস্মিতা সিংহ রায়ের নাম। কেননা তিনিই হলেন পথপ্রদর্শক। মেদিনীপুরের মানুষ রতন।

🍂

Post a Comment

0 Comments