ভবেশ মাহাত-র হৃদয়ে আঁকা কবিতা : লঘু মুহূর্তের উচ্ছ্বাস
তনুশ্রী ভট্টাচার্য
(হৃদয়ে আঁকি কবিতা কবিতা সংকলনের আলোচনা)
কবিতা আসলে কি?-- আবেগের বহিঃপ্রকাশ? উচ্ছ্বসিত না সংযত? লঘু ভঙ্গিমায় না গাম্ভীর্যে? জীবনের বহিরঙ্গের ভাষ্য না অন্তরের নিগূঢ় দর্শন? উত্তর নেই বা আছে। তবে যে কোনো কবিতার বই হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে একটা জিজ্ঞাসা , একটা দর্শনের সামনে পাঠক দাঁড়াতে চায়। কবিতা পড়া টা একটা অভ্যাস। একটা পাঠ্যাভ্যাস যেটা একজন পাঠককেও তৈরী করে। বিচিত্র বিষয় ,বিভিন্ন আঙ্গিক, শব্দের বহুমুখীনতা , গভীরতা, ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা উপমা রূপকল্প চিত্রকল্প সব নিয়ে যখন একটি কবিতার বই পড়া শেষ হয় তখন পাঠক একটা লম্বা বারান্দা দেখতে পান শব্দরা সেখানে বৈঠক করছে ,অর্থ গুলো একে অপরের সঙ্গে জোড় খাচ্ছে বা ছেড়ে যাচ্ছে। আর মধ্যরাতের গভীরতার মতো একটা নিবিড় নিস্তব্ধতা তাকে আনন্দ--সমাহিত করছে। কবিতাপাঠ মানে একদিকে যেমন আনন্দযাপন অন্যদিকে ভাবনার ঘুড়ির বিচিত্রগামীতা। খানিকক্ষণ চুপ করিয়ে রাখবে ,খানিকক্ষণ ভাবাবে ,আর শেষ পর্যন্ত কলম তুলে নিয়ে একটা নতুন কবিতার জন্ম দেবে।
কবি ভবেশ মাহাতর প্রেমের কবিতার সংকলন' 'হৃদয়ে আঁকা কবিতা' লঘু মুহূর্তের উচ্ছ্বাসে ভরপুর । তিরিশটি কবিতাতেই কবি প্রেমের উদযাপন করেছেন, প্রেম খুঁজেছেন ,প্রেম বিলিয়েছেন। তোমার-- আমার জোট বাঁধা কবিতাগুলো কিশোর বয়সের চপল প্রেমের বাঁধন হারা বিকাশ। নব প্রেমের অঙ্কুরোদ্গমে যেমন আবেগের বাহুল্য থাকে তেমনই--- মনের গভীরে শোক,চল গ্রহান্তরী হই,শূন্য হৃদয় পুরে,তুমি আছো বলে, তুমি আছো তাই, গোলাপের কাঁটা,যদি এমনটা হয়, নীরব কল্পকাহিনী প্রভৃতি কবিতায় ঢলঢলে আবেগের শাব্দিক প্রকাশ। লাগামছাড়া আবেগী পংক্তি কবিতার গভীরতায় ঢুকতে বাধা দেয়। প্রেমের গভীরতা অনেক সময় লঘু হয়ে যায়। অন্বেষণ দিগভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। হৃদয়ে আঁকা কবিতার রঙের ওপর রঙ উঠে আসে। 'কখনো তোমাকে গুলিয়ে ফেলি/চাঁদের সৌন্দর্যের সঙ্গে'--। হ্যাঁ,গুলিয়ে যায়। কোথায় রাখি প্রেম আর কবিতা?তবু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান কবি --'আসলে তুমি ত তেমনি আছো/তোমারই মতো অবিকল।' সত্যিই আমরা সকলেই আমাদের মতো। কথাগুলো আর কেবল কথা না থেকে হয়ে উঠেছে চিরকালীন আবেদন। কবিতার ও প্রেমের। সাধু,সাধু।
মুহুর্ত কালকে অনন্তে পরিণত করার ক্ষমতা কবিরই থাকে। যখন কবি বলেন ---ও মেয়ে তোর হাজার কথা রাখ/ আমার সাথে মুহূর্তকাল থাক---তখনই উত্তরণ ঘটে প্রেমের এবং কবিতাটিরও। এখানেই প্রেম কবিতা হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে বিশুদ্ধ, মৃত্যুঞ্জয়ী। 'তুমি যদি বিশল্যকরণী হও/ মুখোমুখি হবো মৃত্যুর'---(তুমি যদি রাজী হও ) এ বলিষ্ঠ উচ্চারণ নিখাদ মনে হয়। তখন কবিতাটিও রসোত্তীর্ণ হয়। বর্তমানে কবিতাবিশ্বে 'তুমি তত্ত্ব' নিয়ে কাজ হচ্ছে। তুমিটি আসলে কে? আরেকজন বাইরের মানুষ না আমার মধ্যেই বাস করে আরেকটা আমি তাকেই করছি 'তুমি' সম্বোধন। কবি খুঁজেছেন 'তুমি'কে। প্রয়োজন বোধ করেছেন শুধু একটা তুমি র।
খোঁজা চলুক। আর একটু গভীরে। আরো গভীরে যাও কবি।
প্রচ্ছদটি ছিমছাম।
কবিতার বই হৃদয়ে আঁকা কবিতা
কবি ভবেশ মাহাত
প্রকাশক জ্বলদর্চি।
🍂
0 Comments