জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন/ পর্ব -৪৪/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

 
ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -৪৪
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 


  || বাঁধি সেতু বাঁধি রে ||

               
ফাইনাল এম বি বি এস এর মাস দুই আগে আগে অসুস্থ হয়ে পড়ল ঝিনি। কদিন ধরে ঘুসঘুসে একটা জ্বর হচ্ছিল। দৌড়ঝাপ করে ক্লাসে যেতে ক্লান্তি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে ধপাস করে না খেয়েই শুয়ে পড়ে।হিটারে খাবার বানাতে বানাতেও খানিক শুয়ে নেয়।ভেবেই পায় না এত তার ক্লান্তি কিসের।
    এক সকালে বেসিনে হড়হড় করে বমি হয়ে গেল আর অবাক হয়ে সে দেখল পুরোটাই রক্ত। আলু দৌড় দিল পলাশদের হস্টেলে খবর দিতে।কলি,পর্ণা, সুপ্তি, প্রিয়া সবাই মিলে তাকে মেডিসিনের এ সি দাস স্যারের আন্ডারে  হসপিটালের স্টুডেন্টস কেবিনে ভর্তি করে দিল।
       পলাশের হস্টেলের চারজন জুনিয়র ফটাফট ব্লাড ডোনেট করল কেননা ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না বলে স্যারের কথা মতো চার ইউনিট ব্লাড তাকে নিতে হলো পরপর।
       এক্স রে প্লেটে বাঁ দিকের ফুসফুসে নিখুঁত গোল  ক্ষতটা দেখে স্যার সুদ্ধু চুপ করে রইলেন। কী হয়েছে  আমার? স্যার বলেন না কেন রে? স্যার না বললে কী করে বলব বল।আর একটা এক্স রে লাগবে বলছেন।তিন দিন পর রিপিট এক্স রে দেখে স্যার বললেন ককস ডিজিজ। 
            অত কায়দা করে রেখে ঢেকে ককস টকস বলছেন কেন স্যার, টিবি হয়েছে বললেই তো হয়।  ওষুধের নিদান দিয়ে দলবল নিয়ে স্যার কেবিন থেকে বেরিয়েছেন খানিক আগে। গোমুখ্যুর মতন কথা বলিস না।মেডিকেল টার্ম বলবেন না স্যার?এ কদিন স্যাররা তো সবাই লাং কার্সিনোমা ভেবে বসেছিল। তাই কেউ তোকে কিচ্ছু বলছিল না।
         এখন টিবি বেরোলো বাঁচা গেল বাবা। যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলি।এ তো অনেক ভালো।ছমাস মেডিসিন গিলে নিবি ব্যাস। 
        পলাশ বেরিয়ে গেলে টিনটিনের দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড হাতে করে শুয়ে ছিল চুপচাপ। দরজা নক করে পুরে একলা চুপ করে শুয়েছিল সে কেবিনের দরজা নক করে এ সি দাস স্যারের হাউসস্টাফ অর্জুনদা ঢুকলো।  বইটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল দ্য ক্র্যাব উইথ গোল্ডেন ক্লস পড়েছিস? ওটা আমি বাংলায় পড়েছি, ঝিনি বলল।আনন্দমেলায় বেরোতো। ঠিক ঠিক  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চমৎকার অনুবাদ। শোন স্রোতস্বিনী,এক্স রে রিপোর্টটা তার বেডের মাথার কাছে ঝুলিয়ে বলল, ঘাবড়ানোর কিছু নেই।এই রিপোর্টটাই হোক সবাই মিলে চেয়েছিলাম কেননা এটাই সেফ    কম্পারেটিভলি ।

🍂
ad

     সামনে তোর দুটো লড়াই।ছ'মাসের এই মেডিসিন কমপ্লিট করা আর ফাইনাল এম বি বি এস।সময় আছে। জানি দুটোই টপকে যাবি।কী করে জানলে? আরে! আমার  ক্লিনিক্যাল আই আর ডায়াগনোসিস চাড্ডিখানি ব্যাপার ভেবেছিস নাকি? হাত নেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে ইয়ে শোন। এখান থেকে ছেড়ে দিলে ছুটিতে যাবি নিশ্চয়ই। স্যার সেভাবেই লিখে দেবেন।  ক্লাস না করতে পারলে অসুবিধে বা যে কোনো অসুবিধেয় জানাবি আমায়। ঝিনি অবাক হয়ে তাকালো কেননা দুবছরের সিনিয়র অর্জুনদার সাথে তার আগে কখনো কথা হয়নি।
          পাহাড়ে গিয়েছিল ছোড়দা।দানির পোস্টিং গুজরাটে। বন্ধুরাই তার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছে এই কদিন।কেমন আছিস মা? খবর পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের বাবা এলে  ঝিনি বলল খিদে পেয়েছে বাপি এরা চার দিন কিচ্ছু খেতে দেয়নি। খাবি খাচ্ছিলি যে রেটে তুই। পলাশ বলল,গ্যালগ্যাল করে ব্লিড করছিলি এমন,স্টমাক না অন্য কোথাও থেকে রক্ত আসছে তাই তো বোঝা যাচ্ছিল না। কোন হিসেবে তোকে খাওয়া আ্যলাউ করবে বল? আজকের দিনটা কষ্ট কর।  বমি তো আর  হয়নি আজ।কাল থেকে স্যার ডায়েট দিতে বলেছেন। বাপি শুধু তার স্যালাইন চলা হাতটার ওপর একটা আঙুল রেখে চুপ করে বসে রইল। 
             বাপিকে চাঙ্গা করতে ঝিনি ফিক করে হেসে বলল "এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম আজ বসন্তের শূন্য হাত/ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক"। বাবাকে  ভয় পেতে দেখেনি কেউ,চোখ ভিজে উঠতেও না। অথচ অবাক হয়ে সে দেখল  ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে বাবা ।পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে পলাশ আর আলুর দিকে তাকিয়ে বলল তোমাদের স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
              দিন তিনেক পর হসপিটাল থেকে মাস দুইয়ের টিবির ওষুধ,ছুটি আর  বইপত্র নিয়ে ঝিনি বাবার সঙ্গে বাড়ি এল।তাদের বাবাও ছুটি নিয়ে জরুরিভিত্তিক রুটিন তৈরি করে তাকে খাওয়ানো ধরল। 
           দু সপ্তা গেলে কলি আর পলাশ হাজির। দিব্যি তো দুধ ডিম ছানা ওড়াচ্ছিস এদিকে কান্নাকাটি করে রোজ লেডিস হস্টেলের সিঁড়ি ধুচ্ছে একজন।আমায় ধরে পড়েছে এখানে আসার জন্য।
       ও বললেই আসতে হবে?জানিস না পালমোনারি টি বি ইনফেকশাস?লে ম্যানদের মতো কথা বলিস না।জানিস না দু সপ্তা মেডিসিন নিলেই যে রেটে ব্যাকটেরিয়াগুলো মরতে শুরু করে পেশেন্ট আর ইনফেকশন ছড়ায় না? হসপিটালে এত যে তোর দেখভাল করল ছেলেটা তখনও তো হতে পারত।তাছাড়া বাতাসে এত টিবির জীবাণু ছড়িয়ে আছে  ড্রপলেট থেকে যখন খুশি হতে পারে।না খেয়ে দেয়ে ইমিউনিটি কমিয়ে ঝঞ্ঝাট বাঁধালি তুই ,পেরেশানিতে আদ্দেক হয়ে আ্যদ্দুর থেকে দেখতে এলাম তা কেমন মাৎ মাৎ করে তেড়ে আসছে দ্যাখো।
         দুদিন পর পলাশরা ফিরে গেলেও প্রতিদিন একখানা করে ইনল্যান্ড আসা ধরল। প্রযত্নে বাবার নাম থাকে বলেই পৌঁছয় নয়তো ঠিকানায় নামের জায়গায় লেখা থাকে ইচ্ছামতী। বইখাতা মেলে বিকেলে রোজ সে পুবের ঘরে ওৎ পেতে থাকে পিওন ভূষণ কাকার জন্য। মায়ের ইস্কুলের নানা অফিসিয়াল চিঠির সঙ্গে ইনল্যান্ডটাও তার হাতে দিয়ে ভুরু কুঁচকে কাকা বলে একই রকম চিঠি রোজ আসতিছ কোত্থেকে বলোদিন?কে জানে বলেই গম্ভীর মুখে সে চিঠি হাতে সরে পড়ে।
       শরীর সেরে উঠছে বলে পড়াশুনোও শুরু করেছে সে। টিভি দেখতে ওপরের ঘরে সে যায় না। সত্যি বলতে পুবের ঘরখানায় রোদ আর হাওয়ার জন্য তাকে বরাদ্দ করা হয়েছে আর বইখাতা নিয়ে সে গুহাবাসীর দিন কাটাচ্ছে। ঋতু তবু কিচ্ছু না শুনে রোজ হানা দেবেই।রোজ ছোলা বাদাম ভেজানো বা পাকা একখানা পেয়ারা বা গাছের কলা নিয়ে তাকে গিলতে বাধ্য করবেই। এমনকি তার থালা গ্লাস সে কাউকে মাজতে না দিলেও ঋতু থাকলে ছোঁ মেরে তার থালা ধুয়ে আনবেই। 
            এটা আনসায়েন্টিফিক তাছাড়া ডাক্তারদের ঘেন্না পিত্তি কম থাকে কিন্তু  সঙ্গীত শিল্পীদের কম থাকার কথা নয়।ডেভিডসন থেকে মুখ তুলে বিরক্ত হয় সে।এত পড়েশুনে ঘোড়াড্ডিম শিকিছিস, ঋতু উত্তর দেয়, আমি হাত ধুয়ে ফেলি সাবানে তাছাড়া ঘেন্না আসে সেরেফ ভালবাসার কমতি হলে, ওদিক ফের এখন চুল বেঁধে বাড়ি যাই আজ;তুই পড়। হাল ছেড়ে সে মেডিসিন বইয়ে ডুব দেয় আবার।
         আচমকাই ডিসেম্বরের ছ' তারিখ চারধারের দুনিয়া থমথম করে এল।আগের রাতে ছোড়দা এসেছিল। টি ভি দেখতে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ওপর থেকে নেমে এসে বলল করসেবকরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলছে।
       বাগানের কাজ সেরে পুবের ঘরে রোজ তার শরীরের খবর নিয়ে যায় করিম ভাইও।
আজ মুখ বাড়িয়ে বলল, সত্যি সত্যি ওরা ভেঙি দেলে ছোড়দি?সে মাথা নিচু করে বললো আজ তাতাড়ি বাড়ি যাও গে ।নেভা বিড়ি মুখে বিশুদাও থম ধরে রইল খানিক। ছোড়দি বলিছ ঠিক।বাড়ি চলো ভাই  কখন কমনে কী বা হব্যান।
      রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে পড়ল।ঝিনি দৌড়ে টিভির সামনে গেল আর ছোড়দা বেরিয়ে গেল বাজারের দিকে।
        পরের দিন এলাকার মুসলমান দোকানদাররা বনধ্ ডেকেছিল। দাপুটে একদল লোক এসে জোর করে দোকান খোলার চেষ্টা করতেই বচসা শুরু।   থানা থেকে দুজন কনস্টেবলক বাজারে মোতায়েন থাকলেও  গোলমাল দেখেই টুপ করে ভিড়ে মিশে হারিয়ে গেল তক্ষুনি।
        ছোড়দা, ছোট বুলাদারা সবাই তখন বাজারেই ছিল। হাতাহাতি থেকে বাঁশ লাঠি এসে পড়ার আগেই
হাত ধরাধরি করে চার পাঁচজন ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে। কী করছেন আপনারা?কাকে মারতে চাচ্ছেন?আগে আমাদের মারুন শুনে মারমুখীরা একটু থমকালো। ঠিক।মারবা কাদের তোমরা?কাছাকাছি আরও কজন ঘনিয়ে এসে ওদের সঙ্গে দেওয়াল বানালো। 
             লাফিয়ে একটা ঠেলা ভ্যানে উঠে দাঁড়ালো ছোড়দা। বাবলা,ছোট বুলাদারা ধরে রাখল ভ্যানটাকে। আপনারা শুনুন, আমাদের এখানে আজ অবধি কখনও দাঙ্গা হয়নি...এই খুনোখুনিতে রক্ত ঝরবে কেবল আমাদেরনিজেদের!
           লাঠি একবার কারো গায়ে উঠলে আর তাকে থামানো যায় না। প্রথম বাঁশের বাড়িখানা কোন ম্যাজিকে ওরা কজন মিলে রুখে দিতে পেরে উঠেছিল কে জানে। তবে ধাক্কাধাক্কিতে ছোড়দা স্টিল ব্যান্ডের এইচ এম টি হাতঘড়িখানা খুইয়ে  বাড়ি এল। হাটবার ছিল পরদিন। ঝিনি, ঋতু,কণা বুবাইরা সারাদিন সারারাত শুধু টুথব্রাশ ঘসে উলের গোলা থেকে খুব ছোটো ছোটো বল বানিয়ে তাতে সুতো বেঁধে রাখি বানালো। এমনকি রাত জাগার জন্য তাকেও বাবা বারণ করল না।
         দুপুর দুপুর হাট লাগার আগেই তারা সবাই হাটখোলায় পৌঁছে গেল।হসপিটাল থেকে আসা অব্দি সেই প্রথম ঝিনি বাড়ির বাইরে এল।
       বাড়ির হারমোনিয়াম ভারি আর বড়ো বলে অহনাদির হারমোনিয়ামটা গামছা দিয়ে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে… ধরলো ছোড়দা। মায়া ডেকরেটরের প্রণবদা বিনে পয়সায় মাইক দিয়ে গেল। গান থামিয়ে ছোড়দা মাইকে বলছে এই এলাকায় আজ পর্যন্ত কোনো মন্দির মসজিদ আমাদের আলাদা করতে পারেনি। ছেচল্লিশের দাঙ্গা পারেনি।আজো আমরা কেউ কারো হাত ছাড়ব না।
      হাতে তালি বাজিয়ে তক্ষুনি ঝমঝমিয়ে একসাথে গেয়ে উঠল সবাই,ও মোদের দেশবাসী রে/আয় রে পরাণ ভাই/আয় রে রহিম ভাই/ কালো নদী কে হবি পার...
        হাটবারের দিনকে লোক হয় অনেক। কিন্তু অন্যদিনের তুলনায় ব্যাপারীদের হাঁকডাক কম সেদিন। বাজার জমে উঠলে ধুলো আর মানুষের সাথে ঘামের,গুনগুন কথার,ভাজা চপের আর টাটকা তরিতরকারির যে  পাঁচ মিশেলি হাসিখুশি গন্ধ ওঠে তার বদলে গোমড়া এক বাতাস ঘুরছিল হাটখোলায় সেদিন।মানুষজন কথা কইছিল নিচু গলায় ওজন করে।
      ...এই নদী তোমার আমার খুনেরি দরিয়া...হাটুরে লোকজন ভুরু কুঁচকে ঘুরে দাঁড়ালো কান পাতলো কেউ কেউ ; কাছিয়ে এল আরো কিছু লোক।
ছোড়দা আর অহনাদি তখনো সোলো গাইছিল 
...এই নদী আছে মোদের আঁখিজলে ভরিয়া... ভিড়ের মধ্যে  অনেক চেনা আধচেনা মুখ দেখা গেল এবার। ব্যাপারখানা বোঝার চেষ্টা করছিল সবাই।
...এই নদী বহে মোদের বুকের পাঁজর খুঁড়িয়া...। প্রাইমারি ইস্কুলের মজিদ মাস্টার, দাঁতের ডাক্তার বাকী চাচা,হাতুড়ে ফয়িম ডাক্তার,মিষ্টির দোকানের ভবো ঘোষ প্রত্যেকে খানিক দূর থেকে লক্ষ্য রাখছিল তাদের।
  ...মোরা বাহু বাড়াই দুই পারেতে দুজনাতে থাকিয়া...
সবাই একসাথে বেজে উঠল দুপুরের উন্মাদ কোরাসে ওরে এই নদীর পাকে পাকে কুমীর লুকায়ে থাকে/ভাঙে সুখের ঘর ভাঙে খামার...
হেঁইয়া হেঁই মারো, জোর বাঁধি সেতু বাঁধিরে ... দলের সাথে গাইতে গাইতে বড় বুলাদা এগিয়ে যাচ্ছে সবার মাঝখানে।বলছে ভালবাসা  আমাদের শক্তি।ধর্মের ওপরে ভালবাসাই আমাদের সবাইকে বেঁধে রেখেছে, ভালবাসা তা রাখতে পারেও। আসুন সবাই আসুন আজ অন্তরের মায়া দিয়ে বুকে বুকে সেতু  বাঁধি আসুন।
             ছোট ছোট কাগজে রঙিন স্কেচ পেনে লেখা তোমার হাতে পরিয়ে দিলাম ভালবাসার রাখি। ঝিনিরা হাটের সবার হাতে রাখি পরিয়ে সেফটিপিন দিয়ে সেই কাগজের টুকরো এঁটে দিচ্ছে তাদের জামায়। তুষারদা ছোট বুলাদারা জড়িয়ে ধরছে সবাইকে।ও চাচা ও ভাইজান  আমাদের সবার এই ভালবাসার মাটি। আমরা একে অন্যের পড়শী-স্বজন আমরা সবাই আত্মীয় কুটুম।এখানে কোনো ভাইয়ের রক্ত ঝরবে না। হাটসুদ্ধু লোকও জড়িয়ে ধরছে দাদাদের তারপর পরস্পরকে।
         শরীল খারাপ নে তুমি যে হাটে এইছো ছোড়দি? আব্বা জানে?মা বকপ্যান বলো।টপ করি বাড়ি যাও নয় আমি তোমার এগুই দে আসি চলো। হাটখোলার ভিড়ের মধ্যে করিম ভাই তাকে বকাঝকা শুরু করল। কতা না শুনলি দাদার কাছ এই  বলো যাচ্চি  আমি।     
        ও করিম ভাই বাবার বলি এসিছ আমি।অসুখ টসুখ বাদ দেও দিনি।আজ না আসলি হয়? সে করিম ভাইয়ের ফতুয়া টেনে ধরে।
          সন্ধে নামলে ছোড়দার কথায় ঋতুর সঙ্গে  বাড়ি 
ফিরে এল সে।গরম জলে হাত পা ধুয়ে বাবার কথা মতো খেয়ে শুয়ে পড়ল। আরও রাত নামলে হাটের শেষে ছোড়দা ফিরে তাদের বাবাকে বলল কিছু লোক চাইছে দাঙ্গাটা বাঁধুক।কাল পোলতা,বেল গড়ের পাড়ায় পাড়ায়  যাব। বাড়ি বাড়ি না গেলে এটা রোখা যাবে না। ঝিনি শুনল বাপি ছোড়দাকে বলছে তোমরা যা করছো আমি তোমাদের বয়সে থাকলে তাইই করতাম। খুব ভেতর থেকে বদল না হলে মানুষের প্রবৃত্তি আসলে পাল্টায় না। রক্ত করবীতে অন্তত তাইই বলছেন রবীন্দ্রনাথ। আর তা পারে মানুষের ভালোবাসা।
         ঝিনির ঘুম আসছিল না।পলাশের খবর না পেয়েও সে উতলা হয়ে পড়ছিল। চিঠি আসছে না কারফিউয়ের জন্য নিশ্চয়ই। 
টিভিতে খবর দেখে চুপ করে থাকে সবাই। তার মনে হলো  ভূমিকম্প আর তার আফটার শক কিছুতেই থামছে না।কেন্দ্র বিন্দু যার অযোধ্যা  হলেও গুজরাট মহারাষ্ট্র,ভোপাল,অসম, কলকাতা সবজায়গাই কাঁপছে পাশের বাড়ির মতো। কোথাও  পটকা ফাটিয়ে এবং মিষ্টি খাচ্ছে দল বেঁধে তো কোথাও লুটপাট করে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে জ্যান্ত মানুষ। 
         ছোড়দা গান বেঁধেছে তোমার দুচোখে ঝরে... একা এক নদী/ আমার দুহাতে ঝরে আমলকী বন/ঢেউয়র জানালা খুলে দেখি ইচ্ছামতী এখানে হলুদ পাতা ঘুমাবে এখন....
      মানুষের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরির ভয়ানক কৌশলী এক কারিগর নিপুণ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পিছিয়ে পড়া এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের
 হিন্দু যদি হও তো মারো ওদের এই ধর্মীয় উসকানি দেওয়া শুরু করল কাজেই তার দাঙ্গা এবং সহিংসতা   ছড়ালো বহুগুণ।
       প্রতিরোধ বা প্রতিবাদে নেমে পুলিশের গুলি খেয়েও মরছে কারণ অনেক রাজ্যের প্রশাসন আর পুলিশরাও মেরুকরণের ধর্মে অন্ধ।রোজ রোজ খবরের কাগজে শুধু খুনের খবর। জলজ্যান্ত মানুষ সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে নানা রাজ্যে। ধোঁয়া উঠছিল ওর গানটা থেকে যেন প্রতিদিন  কথাগুলো আরও বেশী করে জ্যান্ত হয়ে উঠছিল।
     ...বৌবাজারের মোড়ে চৌরাস্তায়/ভোরের কাগজ এসে ছুঁড়ে দিয়ে যায়/শাহেদল সুমিতের কাটা লাশ মুখ/ধার্মিক চাটছে রক্তের সুখ...
        সে শুধু গোপালেধোপা আমগাছ তলায় করিম ভাইয়ের মাটি মাখা খরখরে আঙুল ধরে চুপ করে বসে থাকে।
          মানুষ কেরাম বোকা বলো দিন। মসজিদ ভেঙি দে মানুষ মেরি কিছু হয় কোনোদ্দিন? ঘেন্না দে, হিংসা হিংসি দে কেউ কিছু জেতপে না। তুমি বলতুছ  ভোটের কতা।ও ভোটে আজ জিতলিউ কাল হারব্যান। দুঃখু কিসির ছোড়দি;আল্লার জিনিস আল্লাই গড়ি নেব্যান। আমার দেলডা শান্তি পেয়িছ কণে বলো দিন?এই যে তুমি, ছোড়দা আর তোমাদ্দের মতুন ছোট মানুষিরা মানুষির ভালো কতা বুঝোই বলতিছো ইতিই আমরা বেঁচি থাকপো।মরি গেলিউ খোদার রহমত আর মানষির ভালপাসা টিকি থাকে জানবা। বিস্তর  পড়াশুনো করা তাদের বাবার কথা  আর নিরক্ষর করিম ভাইয়ের মুখে একই 
কথার সামনে সে হতবাক হয়ে বসে থাকে।
          দিন দশেক পর  বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতি এমএস লিবারহানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন হয়  তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়াও বাধ্যতামূলক করা হয় তবে তা থেকে কোনো বিশ্বাস খুঁজে পায়নি তারা। শুধু তাদের ওই ছোট্ট এলাকায় ধর্ম নিয়ে হিংসা ও মৃত্যুকে রুখে দিতে পারাটুকু  দুঃস্বপ্নের রাতগুলোতে ডুবতে ডুবতে বাতিঘরের মতো সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল‌।
      আড়াই মাস  পর ফাইনাল পরীক্ষার আগে হস্টেলে থিতু হয়ে আলুর কাছে শোনে কিভাবে তারা কয়েকজন ওইসময় হস্টেলেই থেকে গিয়েছিল। খাবার প্রায় ফুরিয়ে এলেও বেনিয়া পুকুর বাজারে যেতে সাহস পায়নি। পুলিশ আর আর্মির পাহারায় থেকেও ভয় ধরে গেছিল তাদের।
           ঝিনি ভাবে ইতিহাসে ধর্মের বিদ্বেষ যখন  মানুষের  সবটা গিলে খায় তখন সব দেশে সব কালে তালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেই  তাদের বোকামি আর বেহদ্দ নিষ্ঠুরতা সবচে ' বেশী ফুটে ওঠে?
ছোড়দার গানটাই বিড়বিড় করে সে ... কোথায় কিশোর ঠোঁটে অপাপ ঝিনুক/প্রতিটি মানুষে খুঁজি মানুষের মুখ/তোমার নদী কি জানে এখনো জীবন/এখানে হলুদ পাতা ঘুমাবে এখন...

Post a Comment

0 Comments