পর্ব ৪২
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
|| গহন ঘন ছাইল ... ||
হ্যাঁ রে ঝিনি দুইদিন হস্টেলে থেকে কলকাতা চিনেছিস খুব।সেজোর বাড়ি তোমার আর মনেই পড়ে না কেমন? গতবছর সেই যে অষ্টমীর দিন এলি তারপর এতগুলো মাস কাটল,সেজো মরল কী বাঁচল কোনো খবর নেই?কোলে পিঠে বড় করেছি এই তোমায়?ফোনে সানার জন্মদিনের নেমন্তন্ন দিতে সেজো প্রথমেই একচোট বকুনি দিয়ে নিল।
হইছে কী অ হেম?মুই তো খুবই তরে ভালো পাই। ফাইজলামি করবি না।ফোনেই তোমার দরদ উতলাইয়া পড়ে!
ততদিনে ঝিনি কলেজ আর হস্টেলের সিঁড়ি ওঠানামা করতে করতে বইখাতার মধ্যে ঢুকে আর বেরিয়ে ভাঁজ করা ছাতার মতো বারবার নিজেকে খুলে আর বন্ধ করে সত্যিই বেশ কয়েকখানা ঋতু পার করে এসেছে। জন্মদিনটা সানার রোববার পড়েছে যখন পেটপুরে খেয়ে হস্টেলে ফিরে একখানা ঘুম লাগাবে ভাবতে ভাবতে অনিমাদির কথায় দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
তোমার ভিজিটর দেখা না পেয়ে এই কাগজ দিয়ে গেছে। চিরকুটটা পড়ে খুব অবাক লাগলো না। যেন জানতই এরকম কিছু ঘটবে।
স্টুডেন্টস কেবিনে সেই যে কলির সঙ্গে পলাশকে দেখতে গিয়েছিল; আর তাইতো এত কবিতার বই পড়ে কোন মেয়ে বলে পলাশ তার দিকে তাকিয়ে রুগ্ন অথচ ঝকঝকে একমুখ হেসেছিল। শুনে কলি ফোড়ন দিল ,শুধু পড়েই না হে!মেয়ে আবার লেখেও,তুই থামবি?বেশ তো , স্রোতস্বিনী আমাদের অর্ক পত্রিকায় এবার নিশ্চয়ই তোমার লেখা পাওয়া যাবে, পলাশ উৎসাহিত হয়ে পড়ল।
না। পলাশ আর কলি দুজনেই চমকে গেল।না কেন রে? কলি ভুরু কোঁচকালো। সে অবশ্য পলাশের দিক ফিরে বললো ,আমি লিখিইনা প্রায় আর লিখলেও তোমাদের ইউনিয়নের পত্রিকায় লেখা দিতাম না কারণ তোমাদের আদর্শ ঠিক বুঝতে পারি না আমি।তৃতীয় ফ্রন্টের একটি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আছি।
পলাশ হেসে বলল নো প্রবলেম আজ থেকে নাম বদলে দিচ্ছি অর্ক পত্রিকার। নতুন ম্যাগাজিনের নাম জানলা রাখবো ভাবছি। কথা বলবো আমাদের নেক্সট মিটিংয়েই। মিটমিট করে হাসল ঝিনি।হাসছ যে?
খামোখা পত্রিকার নাম বদলাতে যাবে কেন?আর পাল্টালেই বা কী? পত্রিকা তো তোমাদেরই।ওসব থাক। এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো দেখি।আমি চললাম। আর বইগুলো পড়া হয়ে গিয়ে থাকলে কলি ,পর্ণা বা সুচেতা কারো হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিও।
পলাশ একটু জোর করে হেসে বলল তোমার তাইলে চাই নয়া ইস্তেহার?তা বলতেও পারো।ঝিনিও হেসে হাত নাড়ল।আর সপ্তাখানেক পর হেমের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ঘরে ঢোকার আগেই সে ভিজিটর রুমের অণিমাদির কাছে চিরকুটখানা
পেয়ে নিজের মনেই হাসল। যেন এমনটাই ঘটার কথা ছিল। এটা না পেলেই বেশী অবাক হতো সে।
কথারা নানা দিক থেকেই আসছিল। হাওয়ায় ভাসা কথাদের হাওয়াতেই উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও ছূঁচ ফোটানোর মতো কোথাও কোথাও তারা জমাও হচ্ছে বুঝতে পারছিল সে।এই যেমন প্রিয়া পর্ণারা সন্ধেয় তার ঘরে হামলা দিল। খোলসা করে বল তো স্রোতস্বিনী ফয়সালা হয়েই যাক। কী ব্যাপারে? ন্যাকা।ছুপকে ছুপকে তুই করছিস কী?
মুখ দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছের সোজা দিকটাও বেছে খেতে জানিস না।আর ডুবে ডুবে এতদূর গেছিস ফিফথ ইয়ারের সাগরদারা পর্যন্ত ক্যান্টিনে ধরেছে আমাদের। ক্যামোফ্লেজ বুঝলি না। প্রিয়া ফুট কাটল,হাবভাব এমন নিরীহ যে বোঝাই যায় না।
নিরীহ মুখ দেখে আ্যদ্দিন বুঝতেই পারিসনি যে
বইপত্তরের আড়ালে আমি বোমা বাঁধি? রবিনস এর নিচে,খাটের তলায় জলের বালতিতে সব ডুবিয়ে রেখেছি। তবে পেটোর সাথে আমিও ডুবে ডুবে চললে আর তোদের সাগর অবধি যাবো কী করে বুঝিয়ে দে। ফালতু কথা ঘোরাস না।
চল তা'লে আমার সঙ্গে; ঝিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কোথায় যাব?হরিদার কাছে আবার কই!হরিদা মানে?মেসের হরি ঠাকুর?তা নয় তো কে?এর মধ্যে হরি ঠাকুর ঢুকলো কোথা দিয়ে স্রোতস্বিনী?এই যে চার বচ্ছর ধরে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা রোজ দুপুরে হরিদা সিলভার কার্প খাওয়াচ্ছে কোনোদিন বলতে পারবে যে মাছ বেছে আমি খেতে জানি না।
বাজে ইয়ার্কি বন্ধ কর। পলাশ ইউনিয়ন ছেড়ে দিচ্ছে। নেক্সট ইলেকশনে ওর দাঁড়ানোর কথা আমাদের ইয়ার থেকে। এখন দুম করে সব ছেড়ে ছুড়ে দেওয়ার মানে? সাগরদা আমাদের জানতে বলেছে কেসটা কী?
তোদের ইউনিয়নের তো আমি কেউ নই। আর কে কী করবে তার আমি কী জানি?তোরাও যেখানে আমিও সেখানে। আমি কোনো পলাশ জঙ্গলের ইজারা নিয়ে বসিনি যে ইউনিয়নের সিনিয়র দাদাদের আমায় নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে।
পর্ণা বললো,শুনছি ও নাকি মুনদি আর সৌরভদার সঙ্গে ঘুরছে। কী একটা অদ্ভুত দলের সঙ্গে ও জুটেছে যে ঘোস্ট ইউনিয়নের নাম গন্ধও নেই আমাদের কলেজে। সেটা মুনদি বা সৌরভদার কাছেই জানতে চাইলেই ভালো হয় না? পলাশ তো আর আমার সঙ্গে ঘুরছে না।
আমার মনে হয় তোদের এত প্রশ্নের উত্তর পলাশকে ধরে জানলেই বেটার।আর আমাদের কলেজের বাইরেও একখানা আস্ত পৃথিবী আছে। এখানকার বাইরে যা কিছু আছে সব কি ভুতুড়ে নাকি?
এই তো।এই তো পথে এসেছিস কেমন। সাগরদারা তো ঠিকই ডায়াগনোসিস করেছে। ওঝার দায়িত্ব তা'লে তুইই নিয়েছিস।এর মধ্যে আমি ঢুকলাম কোত্থেকে? তাছাড়া সর্ষের মধ্যেই শুনেছি ভুত টুত বেশী থাকে।ওই সর্ষের মধ্যেই তুমি কোন রাস্তায় ছূঁচ হয়ে ঢুকেছো সেটা তো বল?তা'লে এত কথা না জিজ্ঞেস না করে অপেক্ষা কর।
অপেক্ষা আবার কিসের, তুই আজ এক্ষুনি আমাদের বল।আরে ফাল হয়ে কোন রাস্তায় আমি বেরুবো সেটা দেখার জন্য সবুর তো করতেই হবে। এখন যাচ্ছি আমি। কোথায়? জাহান্নামের কাছেই।
শুধু হস্টেলে নয়,পলাশকে নিয়ে ক্লাসেও একটা গুনগুন ঝিনি আঁচ করছিল। ফার্মা ক্লাসে ঢুকেই সে চাপা একখানা হাআআআআ শুনেও চুপচাপ ব্যালকনির দুতিন ধাপ উঠে আলুকে দেখতে পেয়েই বসে গেল আর আলু তার হাতা খামচে ধরে ফিসফিস করল,বোর্ডে তাকিয়ে দেখ। ভুরু কুঁচকে সে সামনের দেওয়াল জোড়া ব্ল্যাক বোর্ডে দেখল লেখা আছে, স্রোতে ভেসে ভেসে নির্জন /সীমান্ত পেরিয়ে দাঁড়িয়েছি মুখোমুখি মন/হাত ধরো, আমরা দুজন/প্রান্তরে গড়ে নেবো তারার উঠোন। যদিও চমকে গেছে ভেতরে তবু ঠিক বিশ্বাস হলো না যেন তার।
ভুরু কুঁচকে সেও ফিসফিস করল কী ব্যাপার রে?
ক্লাসের বোর্ডে বাংলা লেখা তাও আবার পদ্য! আহা বেচারা ব্ল্যাক বোর্ড তো বুকে অক্ষর নিয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।প্রাণ থাকলে পদ্যের শকেই মারা পড়ত
নিঘঘাত।তা কম্মটি কার? আমাদের ক্লাসে কেউ বাংলা লিখতে পড়তে জানে তাই তো জানতাম না।
ন্যাকা! আলু ফিসফিস করে। এই তো পলাশ লিখল তুই ঢোকার খানিক আগে।ও বাবা! পলাশ কি আজকাল ওদের পত্রিকার পদ্য টদ্য ক্লাসেই মকশো করছে নাকি হ্যাঁ রে! তাও আবার হুঁকোর ক্লাসে! ধড়ের ওপর গোটা মুণ্ড নিয়ে ফিরতে পারলে হয়।
ওরে আমার স্যায়না ষষ্ঠী! পলাশ দেওয়াল জোড়া বোর্ডে কার জন্য এসব প্রোপোজ মার্কা পদ্য চমকাচ্ছে যেন উনি বুঝতেই পারছেন না। ফিসফাস থেকে আলুর গলার ভল্যুম বাড়ে আর উজান এসে বোর্ডের সীমান্ত শব্দ থেকে আ -কারটা যত্ন করে মুছে দিলে সীমন্ত শব্দটা জ্বল জ্বল করে ওঠে। এবার তারও কান গরম হয়ে যায়। সিঁথি বলতে উজান কী বোঝাতে চায়? পলাশের লেখা সত্যিই কি তাকে প্রপোজ করছে এভাবে এবং ক্লাসসুদ্ধুর সবার সামনে? আর প্রত্যেকে সেটা বুঝেও গেছে?সেই কিছু জানতে পারল না?নিজেরাই ওরা তার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে নাকি? ক্লাস থেকে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটা করলে উজান সমেত বাকিদের গুরুত্ব দেওয়া হবে।
দাঁতে ঠোঁট চেপে ঘাড় গুঁজে সে বসেছিল হঠাৎ আলুর গুঁতো খেয়ে তাকিয়ে দেখল পলাশ উঠে ডাস্টার দিয়ে সব লেখাটা ঘসঘস করে মুছে ক্লাস থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল।
প্রায় সাথে সাথেই হুঁকো ঢুকল ক্লাস নিতে।দাড়িওলা যে ভদ্রলোক পিছলে বেরিয়ে গেলেন ওনার নামটা জানতে পারি? স্যারদের নিক নেমগুলোই এত চলে যে আনেক স্যারেরই আসল নাম আর মনে থাকে না। হুঁকোর দাপটে তটস্থ সবাই। স্টুডেন্টরা আবার লিফটে উঠবে কী ?সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠুন ভাই বলে এই সেদিনও হসপিটালের লিফট থেকে বেড়াল আর ইঁদুর মানে তাদের ইয়ারের রঞ্জন আর বিদুরকে নামিয়ে দিয়েছে হুঁকো।
আর আজ পলাশ কিনা হুঁকোর নাকের ডগা দিয়ে তারই ক্লাস না করে বেরিয়ে গেল। পদ্য ভুলে সবাই নতুন নাটকের বোবা সৈনিক হয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ।
ভেরি স্লিপারি ক্যারেকটার! বোঝা যাচ্ছে লেখাপড়ার চাইতে দাড়ি গজানোর যত্নেই উনি বেশী সময় দেন। নাম কি ওনার?ক্লাস সুদ্ধু চুপ সবাই। বন্ধুকে বাঁচাতে চাইছেন?সবাইকে আপনি বলা ওনার অভ্যেস।রোল কলের খাতা হাতে নিয়ে নাটকীয় হুঙ্কার দিল হুঁকো।অ্যান্ড নাও টেল মি দ্য নেম অফ দিস গাই।ক্যান ইউ হিয়ার মি? সে ইয়েস অর নো। আবৃত্তি, ক্লাস লেকচারিং , লেখাজোকা না কোন অজানা কারণে গোঁয়ার গোবিন্দ স্বভাব সত্ত্বেও ইউনিয়নের ছেলেমেয়ে বাদে বাকিরাও পলাশকে পছন্দ করে। কাজেই হুঁকোর জাঁদরেল হুঙ্কারের সামনে কুলুপ এঁটে রইল ক্লাস।
পচে গেছেন আপনারা। দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।বাঞ্চ অফ রটন এগস। অ্যাটেন্ডস রেজিস্ট্রার আছড়ে ফেলে হুঁকোও ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। আলুর সঙ্গে চুপচাপ হস্টেলে ফিরল সে।
আলু হরিদাকে বলিস আমার রাতের মেস অফ।সানার জন্মদিনের জন্য কেনা টিনটিন ইন টিবেট নিয়ে সে পঁয়তাল্লিশ নাম্বার বাসে চড়ে বসল।
পলাশের সঙ্গে অবশ্য দেখা হয়নি তার। হস্টেলে রেখে যাওয়া চিরকুট অনুযায়ী লেডিস পার্কের বেঞ্চে ঘন্টাদেড়েক বসে থেকে থেকেও পলাশ সেদিন আসেনি।এটা কেমন হলো? হতভম্ব ঝিনি হস্টেলমুখো হাঁটতে হাঁটতে ভাবল এক্ষুণি এর নিস্পত্তি না হলে বইপত্তর নিয়ে বসাও যে অসম্ভব। বেকার এসব বোকামোর আজই নিস্পত্তি হওয়া দরকার ছিল।হাতের দলা পাকানো কাগজটা ছুঁড়ে ফেলল সে।
সেকেন্ড এম বি বি এস এর ভারী পাথর কাঁধে চেপে বসছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতন
এখন পলাশের পাগলামি ঘাড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সে বলতে চায় কী এটা শুনতেই স্রেফ সে লেডিস পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসেছিল এই স্তোক ঝিনি মনকে একশ বার শোনালেও একশো একবারের মাথায় ফের টিকটিক করে ওঠে কী একটা। তাহলে তার নিজেরও কি কিছু চাওয়া তৈরি হচ্ছে?
চিরকুটের আগে আনন্দ এসেছিল ওদের দীনবন্ধু হস্টেল থেকে। কিছু ভাবলি? এট্টু ঝেড়ে কাশ না মা ।কী নিয়ে ভাবতে বলছিস সেটাই তো জানি না। ওরে আমরা সবাই জানতে পারছি।জানার গুঁতোয় আমাদের জান কোরবান হয়ে যাচ্ছে আর সাত কাণ্ড রামায়ণ গেয়ে সীতা কার বাপ! ফালতু বকবি না।সীতা কখনো কারো কারো বাপ না। তোমার তো আর গরু হারায় নি মাগো। ওদিকে হারা উদ্দেশে কবিতা করতে করতে একজন দৌড়চ্ছে চিলের ছায়ার নীচে।
তা সঙ্গদোষে তুইও দেখি বেশ পোয়েটিক হয়ে উঠছিস। কেমন "চুনীলাল উড়ে যায় চিল/ল -এ ল -এ মিল" এর মতো চিলের ছায়া টায়া বললি হ্যাঁ রে আনন্দ,তোরও কি কিছু হারালো নাকি? আমাদের কলি কিন্তু তোর খুবই প্রশংসা করে। বলে কেমন ন্যালাক্ষ্যাপা চাউনি তোর। কেমন পাগলা দাশুর মতো ল্যাকপ্যাক করে হাঁটিস। সত্যি খুবই অরিজিনাল।
মারব এক থাবড়া। আমার হাঁটাচলা নিয়ে কে ওকে মাথা ঘামাতে বলেছে?আর প্রেম?রক্ষে করো।যা ডেঞ্জারাস তোরা।ভাবলেও বুক ধড়ফড় করে। আমি বলে তোদের হস্টেলের সামনে দিয়ে ভব সাগর তারণ গাইতে গাইতে পার হই।গায়ত্রীটা ভুলে গেছি।তার ওপর হতচ্ছাড়া ওই পলাশটার জন্যই পইতে ফেলতে হয়েছে হস্টেলের পায়খানায়। তবু ভাগ্যিস রামকৃষ্ণ মিশনের প্রেয়ারটা ভুলিনি।ওই গানখানা ভরসা করেই তো আসি তোর কাছে। একটা হেস্তনেস্ত সুরাহা দে মা।গত হপ্তায় এলাম অর্ক ম্যাগাজিনটা নিয়ে পলাশের লেখা পড়াতে।এমন নিষ্ঠুর মেয়েছেলে তুই।ফস করে বললি ভালো হয়নি আর শুনেই ম্যাগাজিন ছিঁড়ে কুটে শান্তিনিকেতনে ওর জ্যাঠার বাড়ি চলে গেল।
আপদ গেল তবে তোর তো প্রেম কবিতা কিছুই হবে না। ফের মেয়েছেলে শব্দটা উচ্চারণ করেছিস কী গামছা দিয়ে এই বেঞ্চে বেঁধে বিছুটি না বিছুটি তো পাওয়া যাবে না হাত পা বেঁধে কাতুকুতু দেবো এই আলু শোওওওন। রুটি চা-পাতি বোরোলিন এইসব কিনে ফিরছিল আলু; হাঁক শুনে দাঁড়িয়ে গেল। দুটো গামছা আর কলিকে নিয়ে নীচে আয় তো। দীনবন্ধু হস্টেলের খুব বাড় বেড়েছে।আসছি দাঁড়া।
হুজ্জোতের গন্ধ পেয়েই সে পাউরুটি রেখে খালি হাত হয়ে আসতে দৌড় দিল।
হাতজোড় করে আনন্দ বলতে লাগলো মাফ দে! মাফ দে, মা রে! বিশ্বেস কর জগজ্জননী মহামায়া দেবী ছাড়া এরপর থেকে মেয়েদের আর কিচ্ছুটি বলবো নাকো তবে ইয়ে পাষাণী সব।গামছা দিয়ে আর বাঁধিস নে মা। তোদের পায়ে এমনিতেই আমরা বাঁধা পড়ে আছি।
আর শোন মা কালীর দিব্যি ওই গামছার কথাই বলতে এসেছিলাম। কথায় কথায় অসভ্যের মতন কিরে কাটবি না আর বানিয়ে বলবি না আনন্দ।মাইরি না ইয়ে বিশ্বাস কর।কাল ও জ্যাঠার বাড়ি থেকে ফিরে প্রাকটিক্যাল ক্লাস করে চান টান করে হ্যারিসন নিয়ে বসল আর পাশের রুমে পেনো সরকার ক্যাসেট বাজানো আরম্ভ করল। মান্না দে যেই কিনা হায় রে হৃদয় চেয়েছি তোমার মতন হৃদয়হীনার কাছে বলেছে অমনি পলাশ ভেউ ভেউ।
সত্যি? ছুঁয়ে বলছি তোকে।ওর অবস্থা দেখে এত কষ্ট হচ্ছিল।কী করলি তখন? কী আর করব,
গামছাখানা এগিয়ে দিলাম।আর ঠিক করে ফেললাম যাই করিস তোরা বুক ঠুকে হস্টেলে ঢুকে একবার তোকে জানানো দরকার।
🍂
ইতিমধ্যে গামছা নিয়ে আলু কলির সঙ্গে নেমে আসছে। নিচে থেকে তিন তলার সিঁড়িতে ওদের দেখতে পেয়ে ঝিনি বলল আচ্ছা তোর গামছা মাহাত্ম্য নিয়ে তুই যা এখন।যাব? আশা দিচ্ছিস তালে? কিছুই দিচ্ছি না। আপাতত লম্বা দে।
ঠিক বলেছিস। লেডিস হস্টেলের মেয়েগুনো না ইয়ে দেবীরা একসাথে হলেই কী যে ভাবে নিজেদের।হেভি মুরগি করে । চললাম। কিন্তু দাঁড়া দাঁড়া বলে দু তিনটে করে সিঁড়ি টপকে ওরাও এসে ধরল আনন্দকে। শোন বাবা সচ্চিদানন্দ! কিচ্ছু বলবো না আমরা।জানিস না দুত অবধ্য। তুই আবার আদ্দেক মানে ভগ্নদুত আর কি।তা বল কেমন চলছে দিনকাল। কী করছিস ইদানিং। ভ্যারেণ্ডাই ভাজছিলাম।এখন ভাবছি অল্প তেলে বেশ পেঁয়াজ কলি আর আলু কুচিয়ে ভাজব। তা তোদের খবর কী?
রাঁধতে শিখেছিস তালে? এই যে শুনি বাড়ি থেকে আসার সময় মাসিমা এখনও জুতোর ফিতে বেঁধে দেয় ?"এই যে শুনি তোদের বাড়ি/কেউ নাকি রাখে না দাড়ি"? বলে হেসে হাত নেড়ে আনন্দ চলে গেল।
আনন্দটা কেমন ওপরচালাকি দেখিয়ে স্লিপ করে বেরিয়ে গেল বল? জুৎমতো ধরার আগেই ফসকে গেল দেখে বেজার হয়ে পড়ল দুজন। কায়দা করে আবার আমাদেরকেই ভাজবে বলে গেল। সবাই স্যায়না হয়ে উঠলে চলে কিভাবে? তোম্বা মুখ করে আলু বলল।তা বক্তব্য কী চ্যালার?
ফিরেছে ওর গুরুদেব? ফিরেছে।সেই পলাশের কবিতা নিয়েই ধানাই পানাই। তোরা দেরি করলি বলেই তো পিছলে গেল।চা খাই চল। মুড়ি মাখছি আমি। আলু চা বসা।
ছিটকিনি লাগিয়ে বোস নয়তো পর্ণাটা এসে একাই সব সাবাড় করবে। হ্যাঁ সেদিন আমার হরলিক্সের আদ্দেক বয়াম উড়িয়ে দিল খালি খালিই।আলুর চা হতে না হতেই অবশ্য দরজায় ঠকঠক আর অচেনা গলায় ভিজিটর স্রোতস্বিনী ,শুনেই ভুরু কুঁচকে গেল সবার। যেই আসুক আমি নামব এবার। একদিনে তোর কতজন ভিজিটর রে মিচকে হতভাগা বলতে বলতে কলি দরজা খুলেই পিছিয়ে এল।
আর তার সঙ্গেই ঢাউস একখানা ব্যাগ পিঠে করে ঋতু ঢুকে এল দেখে লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো ঝিনি। ছাড় ছাড় পড়ে মরব যে সবসুদ্ধু।কাবলিওলার মতো ঝোলার সাইজ।এত কী এনেছিস রে? দেখাচ্ছি দাঁড়া।হাতপা ধুয়ে আসি আগে।
রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হয়ে অবধি ঋতু দিন পনেরো বাদে বাদে ঝিনির কাছে ঘুরে যায়।ব্যাগ থেকে কতবেল, পেয়ারা বার করে রাখল ঋতু। মা ওর হাতে আমসত্ত্ব আর গাছের সফেদা পাঠিয়েছে মা। কাকিমা অর্থাৎ ঋতুর মা ঘুগনি বানিয়ে দিয়েছে।আজ ঘুগনি দিয়ে ভাত খাব। কতদিন ভালো কিছু খাইনি।
তাই বলে ঘুগনি দিয়ে ভাত? আমি মৌরলা মাছের ঝাল আর ঘ্যাঁটকোল বাটা এনেছি।ভাত চড়িয়ে দিচ্ছি। ঘুগনিটা এমনিই খা তোরা। উহু ভাত দিয়ে ভাত দিয়ে। কোনো কালে শুনিনি ভাত দিয়ে ঘুগনি খায়।বাঙাল কোথাকারে।
আমি ঘটি, ঝিনি বাঙাল আর আলু ত্রিপুরেশ্বরী;কলি বলল, কিন্তু আমাদের জিভ স্বাদু কোনো তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া ভুলে গেছে।লেডিস হস্টেলে থাকো না কিছুদিন। দেখবে তোমার জিভেও সব কিছু ওই এক স্বাদে লীন হয়ে যাবে।তখন তুমিও ঘুগনি দিয়ে ভাত,ম্যাগি দিয়ে পাউরুটি সব খাওয়া শিখে যাবে।কলি আর আলু ঘুগনি আর মাছের ঝাল নিল।গাল চুলকোবে বলে ঘ্যাঁটকোল খাওয়ার অবশ্য সাহস করল না। এতেই জমে যাবে।
ভাত খেয়ে ছাদে এল দুজন অনেক রাতে। গুরগুর করছে আকাশ। রাতের কলকাতা ভারি অন্যরকম রে। হুঁ...মেঘ করলে আরও।
গহন ঘন ছাইল ... ঋতু গলা ছেড়ে গাইছিল।ঝিনির হিংসে হলো ওর ফুরফুরে নীল গানের জীবনকে। যদিও ঋতুটা নিজেই সবসময়ই বিষন্ন হয়ে থাকে।বোন ফরসা বলে কাকিমা ঋতুকে কথা শোনায়। কিন্তু ভালবাসা আর আদর ওর টানটান ত্বকে চকচক করে সে দেখেছে।তুই এলেই হস্টেলটা বাড়ি বাড়ি হয়ে যায় রে।
সে তো নয় হলো তবে তোর মুখখানা অমন
শুকনো দেখায় কেন ঝিনি? হাইলি সাসপিসাস কিন্তু।
ইচ্ছানদীর ধারের আমাদের সেই হাসিখুশি ঝিনি গেল কই? কলকেতা শহরের বোম্বাচাক লাগলেও আ্যদ্দিনে তা তো ছাড়ান কাটান করে ছিলি মোটমাট।
বাড়িতে সবার জ্বরজারিতে কিছুদিন গানের ক্লাস আর তোর এখানে পারলাম না। মাসখানেক আগেও এলাম যেদিন কত ক্যালোরব্যালোর কচ্ছিলি।"
...কাল খুশির তুফান উড়িয়ে আজ উদাস কেন...
সহেলি আজ উদাস কেন"রবি ঠাকুর থেকে ঋতু আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান ধরে দেয়।কী হয়েছে রে? ঋতু গান থামিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলে আমার আবার হবে কী?আনমনে উত্তর দেয় সে।
হুঁকোর ক্লাসের ওই কাণ্ডের পর থেকে পলাশের উড়ো কথা আনন্দের আজকে হস্টেল অব্দি উজিয়ে আসা সত্ত্বেও ছেলেটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।কলেজের ছেলে একই ব্যাচের এবং সামান্য চ্যাপ্টা হলেও কমলা লেবুর এই গ্ৰহ ঘুরছেও গোল গোল।কাজেই থিয়োরি, প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়াও কলেজের ক্যান্টিন,বুকস্টোর, ঝন্টুর রোল দোকান যে কোনো জায়গায় মুখোমুখি পড়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি থাকলেও পলাশকে পাওয়া যাচ্ছিল না।
0 Comments