জ্বলদর্চি

বিয়াত্রিচে /পুলক কান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

বিয়াত্রিচে 

পুলক কান্তি কর

আকাশে নক্ষত্র নীল, বাড়ী ফেরা ভালো/মনে মনে উঁকি দেয় রুদ্ধ যত পাপ/দূরে থাকো মোহ নিশা, আকাশ ঘুমাও/কী আছে ও আলো পাপে, ভরসা ভাসালো? পাহাড়ের উপর সিঙ্কোনা গাছের সারি। গাছের ফাঁক দিয়ে তারাদের মিটিমিটি জ্বলা দেখতে দেখতে মনে উঁকি দিলেন বোদেলেয়র। যে ‘নারী পাপের ফুল’ তার ঘ্রাণ কেন হয় আলেয়ার আলো?/শূন্য যায় মহাশূন্যে নিশুতি কোটরে/তার ছোঁয়া কেন এসে হৃদয় বাঁচালো?’ বড় হীন মনে হল নিজেকে। ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়ার সাথে বাঁদুরে টুপিকে লড়িয়ে দেওয়ার সময় পার হয়ে গেছে বহুক্ষণ। মোবাইলের কথা মনে হল হঠাৎ। ফ্লাইট মোডে দিয়ে রেখেছিলাম এই টিলাটায় ওঠার সময়। মিলি যদি ফোন করে থাকে, অনর্থক ঝগড়া। মিলির তো বোধ হয় এতক্ষণে দিল্লি পৌঁছে যাবার কথা! বলেছিল বটে ফ্লাইটের টাইমিংসটা। ভুলেই মেরে দিয়েছি। কাঁহাতক কথায় কথায় দায়িত্ববানের প্রমাণ দেওয়া যায়! আগে কি থোড়ি জানতাম ওর অফিসট্যুর পড়বে? আমার তো আগে থেকেই মংপুতে আসার টিকিট কাটা। সরকারি চাকরী টাকরী করিনা বলেই ত্যাগের প্রত্যাশাটা আমার দিকেই পড়ে জানি, তবু আজকাল আর আমল দিই না। মানুষের প্রত্যাশার অন্ত নেই। একটা মানলে দশটা সামনে এসে দাঁড়ায়। জোব্বাকে নিয়েই একটু সমস্যা। সারাদিন আয়ার ভরসাতেই থাকে। এ ক’দিন শ্যালিকা সিলির ঘাড়ে ওকে ভিড়িয়ে দিয়ে এসেছে মিলি। বুঝি, মিলি ভালো নেই, ভালো নেই সে আমার প্রত্যাশাপূরণের অসহায়তায়! কিন্তু আমিই বা কী করব!

  মোবাইলটা খুলে দেখলাম, একগাদা ফোন এসেছে, ভাগ্যিসটা মিলিরটা নেই! তবে কি পৌঁছায়নি এখনও দিল্লি? ফোন করে নেব? থাক, প্রত্যাশার নতুন ক্ষেত্র খুলে লাভ নেই। তুনুর ফোন এসেছে তিনবার। ও এতবার ফোন করেছে কেন? ওকে তো আমি রাত্রে শোওয়ার সময় ফোন করি! নরম নরম কথা কখনও সখনও বলি ইচ্ছে হলে। ও ফোনে মনে মনে ওর লেপের তলায় আসার আমন্ত্রণ জানায়, আমি হাসি। ধরা দিই না কথায়। তুনু কি ঈশ্বরী ছিল কখনও? কখনও কখনও কোনও নারীকে দেখে কেন ঈশ্বরী মনে হয়? আজ বিকেলের রবীন্দ্রভবনে দেখা মেয়েটি কি ঈশ্বরের প্রতিরূপ নয়? ‘ও চোখ অপাপ বিদ্ধা, দৃষ্টি নব মেঘ/সুদূরের দিশা আছে তৃষ্ণা ছাড়া চেনে/শরীর ছুঁয়েছে কেউ রেখেছ প্রমাণ/পাপ শুধু সমাজের নৈতিকতা মেনে? ’হা বোদেলেয়র! ’ঐ মেয়েটিও কি জেনে গেছে বিবিধ যন্ত্রণা? শরীরে বা মনে তার যাতনা কুসুম, কখনও কি ভাঙ্গে তাকে ভীত সঙ্গোপনে?’ ওই তো নীচে মদের দোকানে দাঁড়িয়ে ওর পুরুষ সঙ্গীটি সিগারেট খাচ্ছে। বরই নিশ্চিত। ‘এমন অপাপবিদ্ধা, নারী তুমি পরকীয়া জানো?/হু হু মন নদী হয়ে তারাকে লুকোয়/হৃদয়ে অজস্র স্রোত, কলুর বলদ/নারী তুমি নদীটির কতটুকু জানো?’ মেয়েটিকে তো দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। নিশ্চিত হোটেলেই আছে। এই লোকটি আকন্ঠ মদ্যপান করে নিশ্চয়ই আজ রাতে স্পর্শ করবে মেয়েটিকে, ‘ভেঙে দেবে রাতে জমা শীতের আমেজ।‘ কেমন ঈর্ষার মেঘ এসে ঘিরে ধরছে চারপাশে! আলাপ করে আসব ছেলেটির সাথে? যদি জানতে পারি কাল ওরা কোথায় কোথায় যাবে! তুনু আবার ফোন করে কেন? হ্যালো!

-কী ব্যাপার দীপেন দা, বিকেল থেকে কতবার ফোন করলাম, ফোন বন্ধ করে রেখেছেন কেন?

-দরকার আছে কোনও?

-না, না। এমনি করেছিলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল খুব।


🍂

-জানোই তো বেড়াতে এলে আমি ফোন বন্ধ রাখি। নিসর্গের সাথে মিশে থাকি যখন, কথা বলতে ইচ্ছে হয়না কারোর সাথে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুনু। বুঝতে পারি ওর একাকীত্ব। অল্প বয়স, স্বামীর সাথে বনিবনা হয় না বলে একা থাকে। চাকরী করে। আরেকটা বিয়ে করে নিলেই পারে। কয়েকবার বলেছিও এ কথা। ও বলে, ‘আমাকে আবার জলে কেন ফেলতে চাইছেন দীপেন’দা? আমি কি আপনার কাছে বোঝা হয়ে উঠেছি? ইচ্ছে না হলে আসবেন না।’ এসব কথার পর কথা চলে না। নিজের অপারগতার কাছে নতশির হই। বললাম, ‘তুনু, রাত্রে বরং ফোন করব। এখন রাখি?’

ফোন কেটে দিল তুনু। দেখলাম সিগারেটের ধোঁওয়া ছাড়তে ছাড়তে শান্তি চক বাজারের দিকে হাঁটা দিয়েছে লোকটি। পিছু নেব? নিজের হ্যাংলা স্বভাবের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিলাম মনে মনে। চুলোয় যাক বিয়াত্রিচে। আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ কেন আসতেন বারবার মংপুতে? সেও কী ঈশ্বরীর টানে? মৈত্রেয়ী দেবী তো তাঁর বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা। বহু বছরের ব্যবধান। তবু নিবিড় মানসিক বন্ধনের কথা তো স্বয়ং উল্লেখ করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। উনিশ শো আটত্রিশ থেকে চল্লিশ এই দু-বছরে চারবার মংপুতে এসেছেন কবি। তখন ওঁর বয়স ঊনআশি আশি। যুবতী মৈত্রেয়ীর মধ্যে কোনও ঈশ্বরীর রূপ না দেখলে কেন লিখবেন, ‘হে তরুণী তুমিই আমার ছুটির কর্ণধার/অলস হাওয়ায় বাইচো স্বপনতরী/নিয়ে যাবে কর্মনদীর পার’। যদিও লেখাটি  ‘লীলা’ কবিতায় আমূল বদলে দিয়েছিলেন। এই মংপুর কোনও এক অলস হাওয়ায় স্বপনতরী বাওয়ার স্বপ্ন কোনও তরুণীর চোখের চাওয়ায়! ‘কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায়, দোলে...রিংটোন আমার বেজে উঠল। মিলি। রুটিন ফোন। ঠিকঠাক পৌঁছনোর সংবাদটুকু আজকাল শুধু দেয় সে। এখন আর ওই গঞ্জনা করে না, ‘কই একবার ফোন করে খবর নাও না তো!’ আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে। বা হয়তো অভ্যাস হয়নি, জোর করে নিজেকে বিরত করার প্রয়াস করে সে। তবু আজ কেন অভিমান? ‘আমার খোঁজ না হয় নাই রাখো, ছেলেটার খোঁজখবরও কি নেওয়া যায় না?’

-যখন তখন ফোন করে খোঁজ নিলে সিলি ভাববে না কি ওর যত্নকে আমরা প্রশ্নযোগ্য করছি? 

-নিজের মতো সবাইকে এত কুচুটে ভেবো না দীপেন! ছেলে মেয়ের খবর নিলে কেউ খারাপ ভাবে না। সবসময় খালি কথার চালাকি!

আবার ঝগড়া! আজকাল ঝগড়া করার মতো শব্দের জোর আর আমার নেই! এসব বিষয় নিয়ে লড়তেও ইচ্ছে করে না। মিলি বুদ্ধিমতী মেয়ে! কেন বোঝে না এসবে আমি বিড়ম্বিত হই! নাকি আমায় বিড়ম্বিতই করতে চায়? আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল, ‘তোমার নিশ্চই আর কিছু বলার নেই?’

-খেয়েছ?

-আদিখ্যেতা করো না। ফোনটা কেটে দিলি মিলি। ‘এত ক্ষোভ, এত দ্রোহ, এত অভিমান/নীরবে সঞ্চিত হয় এত আয়োজন/ফিরে ফিরে যায় তারা কাগজে ভাসান/দগ্ধ হই, তবু ছুঁতে পারিনা তো মন!’ মনটা ভারী হয়ে গেল বড়! যে কষ্ট প্রতিমুহুর্তে মিলি অনুভব করে, ততটাই প্রতিঘাত ফিরিয়ে দেয় অবিরত। এক প্রগাঢ় সন্ধ্যায় ঈশ্বরীর রূপ ধরে সেও কি আসেনি? তখন কি কখনও মনে এসেছিল এমন নরক-গুমোট! অনন্ত নক্ষত্র জুড়ে কেন মনে হয়, ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই, শূন্য সসীম! বড় বড় শ্বাস নিই। ‘যে সব কথা প্রতিদিনের নয়, সে সব কথায় বাঁধবো নিজের তার। শূন্য গৃহে, শূন্য পুনর্বার!’ মন্দারকে ফোন করলে হয়। আমার প্রাক্তনীর স্বামী। আমার শব্দাবলীর সখা। ওর সাথে কথা বলে বুঝে নিই ‘কতটা শূন্যতা ছিল পুরোনো আকাশে, কতখানি হাওয়া দিল নতুন বাতাস, কতটা যন্ত্রনা আছে এখনও সজীব, শূন্যতা কতটা শুষে নেয় প্রতিভাস। ‘কী করছো মন্দার?’

-চা খেতে খেতে শব্দ সন্ধান করছি। তুমি কোথায়?

-মংপুতে!

-মংপুতে দীপেন চক্কোতি! শেষের কবিতা শুরু করেছো নাকি?

-শেষতো কবেই শুরু মিথোজীবিতার!

-মিথোজীবিতার শর্তই তো পারস্পারিক দীপেন। দেওয়া এবং নেওয়া! একপাক্ষিক দিয়ে যাওয়ার নাম পরজীবিতা। তুমি কৃপণ সেজেছ না কি কাঙাল - বুঝতে হবে তো নিজেকেই!

-তুমি এখন কী লিখছ, মন্দার?

-কী যে লিখেছি বুঝছি না এখনও। তবে গদ্য একখানা।

-বিষয়টা কী?

-একটা মানুষ, যে মানুষের সংবেদন তেমন বোঝে না। বরং বেশী করে বোঝে পশুদের মন। মানুষের সমাজে সে ঠোক্কর খায়। সবাই ভুল বোঝে...

-লোকটি বিবাহিত নাকি?

-এখনও এত দূর যাইনি, ইনফ্যাক্ট ভাবিওনি। কিন্তু তুমি একথা বলছ কেন? 

-কনফ্লিক্টটা তাহলে আরও প্রকট হত।

-ঠিক কথা। তাহলে বরং...। 

আরও কত কথা একমনে বলে গেল মন্দার। আর ভালো লাগছে না এত কথা। কিন্তু মন্দার এমন একটা চরিত্র ভাবলো কেন? সেও কি মনে মনে নির্জনতা চাইছে? কোনওভাবে কি ধরতে পারছে না অনুদীপার সংবেদন? লেখককে এভাবে বিচার না করাই ভালো। তবু...। মন্দারের চারপাশে এত চুপচাপ কেন? অনুদীপা কি ঘরে নেই? নাকি ‘থেমে গেছে ধীরে ধীরে যত বাচালতা। সন্ধে নামে মৌনতার ডালে আবডালে!’ রাত ন’টা হলো। জোব্বার একটা খবর নেওয়া দরকার।

  সকালে ঘুম ভেঙে গেল তাড়াতাড়ি। মংপুতে তেমন কোনও বড় শৃঙ্গ চোখে পড়ে না। তবু ভোরের সূর্য যখন গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ে দেয়ালে, ভারী চমৎকার লাগে। যে হোমষ্টেতে আছি, বেশ ভালো। পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন। বাড়ীওয়ালি নেপালী! পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেন। আমায় বললেন চটকপুর চলে যান। খুব ভালো ট্রেকিং। অন্যরকম লাগবে। ভোরের আলোয় গতরাতের গ্লানি নেই। সামনে মস্ত বড় এক চা বাগানে তৃতীয় দফার কুঁড়ি এসেছে। সুন্দর সুবাসিত চা খেতে খেতে ভাবলাম তুনুকে একবার ফোন করি। বড় অভিমান হয়েছে তার। রাতে ফোন ধরেনি। জানি আমি, ফোন ধরার ইচ্ছে ছিল তার ষোল আনা, তবু সে আমায় শিক্ষা দিতে চায়। তার অভিমানের ষোল আনা -পাইপয়সার হিসেব দিতে চায়! ‘আমি কি তেমন বান্দা! ধার ধারি কারও? ঘেরাটোপে রাখো যত, তত তুমি হারো।‘ রিং বাজছে কেউ ধরছে না। মিলিরও এত তাড়াতাড়ি ফোন আসবে না। ও সকাল সকাল উঠতে পারে না। হঠাৎ সকালে এত কথা বলার ইচ্ছে হলো কেন? কেন মোবাইলের কল লগ খুঁজে খুঁজে পছন্দ সই কাউকে ফোনে ছুঁতে মন চাইছে? সে কি কেবল এই নীরব সৌন্দর্য্যের তাল কেটে দিতে? বাড়ীউলি বললেন, থুপ্পা বানিয়েছি সকালে। খেয়ে নিন। আর বাজার থেকে একটু শুকনো কিছু কিনে নেবেন। নইলে সারা দুপুর খাবার জুটবে না।

-আপনি ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমার টুকটাক ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা আছে।

  পথে বেড়িয়ে পড়লাম। পথে নামলেই পথ চেনা হয়। জানা শোনা হয়। পথটি ভারী চমৎকার। চারিদিকে শুধু অর্কিড আর অর্কিড। চা বাগানও প্রচুর। রাস্তার দু-দিকে কত যে কুইনাইনের ফ্যাক্‌টরী ইয়ত্তা নেই। এত ফ্যাক্‌টরী দেখে মনে হয়, সত্যি সত্যি এককালে বাংলায় কত ম্যালেরিয়া হত। আজকাল কেমিক্যালি কুইনাইন তৈরী হয় বলে এইসব ফ্যাক্‌টরীর কদর কমেছে। বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে ঢুকলাম একটা অর্কিড বাগানে। দেখি অর্কিডের সাথে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার কালকের ‘বিয়াত্রিচে’। কিন্তু এত ক্লিষ্ট কেন? ও দুটি দীঘল চোখে এত কালি কী করে এল এই এক রাতে? ‘ঈশ্বরী কি রাতভর সয়েছে যন্ত্রনা? পাশ থেকে সরে গেছে ভালোবাসা হাত? কে দিয়েছে এত দাহ, দগ্ধ করে কে? কোনওদিন চেয়েছ কি নিজের সাক্ষাৎ?’ ওই তো ছেলেটি, একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে। এও এক আত্মরতি! যে এভাবে নিজের মধ্যে মগ্ন, সে কি কখনও বুঝতে পেরেছে, ‘সারারাত যে শরীরে সে রেখে গেছে নিজের সাক্ষর, সে শরীরে তিলমাত্র সে বেঁচে নেই! শুধু জেগে আছে রাত, ধর্ষকাম ক্ষণ, নাকি সব নিভে গেছে কেউ মরে নেই!’ এমন অমূলক ভাবনা কেন যে আসে! এক পা, এক পা করে এগিয়ে যাই অর্কিডের দিকে। এদিকটা আড়াল বেশী। ছেলেটি খেয়াল করবে না। নইলে আগে ওর সাথে আলাপ করাটাই শিষ্টতা - যা আমার একটুকুও ইচ্ছেকে সঙ্গ দিচ্ছে না আপাতত! কত কথা বলতে ইচ্ছে করছে বিয়াত্রিচে! সন্তর্পনে চোখ দুটোয় শীতল স্পর্শ দিতে ইচ্ছে করছে যে বড়ো! ক্যামেলিয়া পড়েছ তুমি? বড় আনাড়ী আমি, বেড়ালের মতো নিশ্চুপ হাঁটতে পারিনা। একটা টবে হোঁচট খেয়ে ধ্যান ভাঙালাম তার। চোখাচুখি হল। বলতে পারলাম না, এতটা শীতল কেন চপল বিষ্ময়? কেন শীত হয়ে আছে মনের অকথা? সংকোচে চোখ নামিয়ে নিল মেয়েটি। বেশীক্ষণ অপরিচিতা মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। ভান করা যায়না –  ওই অর্কিডটিই সবচেয়ে বেশীক্ষণ দেখার যোগ্য। আগ বাড়িয়ে বলতে পারিনা, ‘দিন না, আপনার মোবাইলটা দিয়ে এই অর্কিডের সাথে আপনার ছবি তুলে দিই!’ কিংবা ‘আমার একটা ফটো তুলে দেবেন?’ বড় সহজ পন্থা দুটো কথা বলার! কিন্তু আমার তো সহজ কথায় মন ভরে না। আমি তো গভীর চাই, গভীরতা চাই! ‘পিণাকেই তাল ঠুকি লাগাবো টঙ্কার! যদি ফিরে নাই দেখ, না দেখাই থাক। আমার চলার পথ আমার একার!’ বাগানটা এপাশ ওপাশ দেখতে থাকি। মাঝে মাঝে দু-একবার মুখোমুখিও হয়েছি মেয়েটির। কথা হয়নি। বরং ছেলেটি আগ বাড়ীয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?

-ভেবেছিলাম চটকপুর যাবো ট্রেক করে, তবে মনে হয় আজ আর হবে না। অনেকটা সময় কেটে গেল এই বাগানটায়।

-ভারী সুন্দর জায়গাটা। জীবনে এতটা অর্কিড দেখেনি একসাথে! আপনি কমলালেবুর বাগান দেখেছেন?

-হ্যাঁ।

-আমরা ভাবছিলাম ওদিকে রিয়াং নদীর পাশে যোগীঘাট যাবো। যাবেন আপনি? একা একা যেতে সাহস হয়না; বিশেষ করে সাথে মেয়ে নিয়ে।

-আমার যেতে আপত্তি নেই। ইনফ্যাক্ট চটকপুর না গেলে কোথাও গিয়ে আজকের মতো বেড়ানো তো যায়ই।

-ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভালো ভিউ পাওয়া যায়। নদীখানিও নাকি চমৎকার! আর নদীর ওপারে শীটংগ্রামে নাকি অনেক কমলাবাগান আছে!

মনটা হঠাৎ এই অযাচিত আমন্ত্রণে খুশী হয়ে উঠলো। আরও কিছুক্ষণ বিয়াত্রিচের সাথে থাকা যাবে। হয়তো বা ছোঁয়া যাবে ওর মনোভার! ছেলেটি বলল, ‘দাদা,আপনার নাম?’

বললাম। আর আপনার?

-সৌভিক। সৌভিক গুপ্তা!

-গুপ্ত না গুপ্তা?

-গুপ্তা। বাঙলায় জন্ম কর্ম হলেও আদতে আমরা ইউ-পির লোক। তবে উনি মানে আমার মিসেস বাঙালী।

-আপনারা ফিরবেন কবে?

-কাল। আপনি?

-ঠিক নেই। আরও দু-একদিন থাকতে পারি। শিলিগুড়ি থেকে আমার ফেরার টিকিট কাটা আরও পাঁচদিন পরে। দেখি, কী করি!

সামনে দেখলাম বিয়াত্রিচে একমনে সুদূর কোন দিকে শূন্য চোখে চেয়ে আছে। এ যেন নিজেকে ভেতর থেকে দেখার দৃষ্টি! এই দৃষ্টিতে আজ কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আমি বললাম, মিস্টার গুপ্তা, চাইলে আপনারা দুজনে নিশ্চিন্তে রিয়াং দেখে আসুন। পাহাড়ী লোকেরা খুব ভালো এবং নিরাপদ।

-আপনার আবার কী হল?

-আমি একটু আশেপাশে হেঁটে দেখি। আপনারা তো দেখছি গাড়ী ভাড়া করেছেন। এখানে এসে গাড়ী চড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে না। তবে আপনি বলেছেন, এজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ!

-আপনি তো আরও দু-তিনদিন আছেন! অন্যদিন গুলোয় হেঁটে বেড়াবেন না হয়! আজ চলুন আমাদের সাথে। বেশ আন্তরিক ছিল ভদ্রলোকের গলা। তবে আমারও না যাওয়ার গোঁ চেপে বসল মাথায়। বললাম ‘আপনারা নিশ্চিন্তে যান না। ভয়ের কিছু নেই। তাড়াতাড়ি যদি ফেরেন, কালকে যে দোকানটায় সিগারেট খাচ্ছিলেন ওখানে আসুন, দেখা হবে।‘

  ‘ক্রমাগত বেড়ে যায় মধ্যবর্তী ঋণ/ লীণ তাপে স্থানু থাকে গভীর কুহক।/ চলে যাও, কত গেছে ঈশ্বরী আদল/ঈশ্বরী মানুষ হয় দিন প্রতিদিন।‘ ফোন বাজলো। তুনুর মোবাইল থেকে কে কথা বলছে?

-আমি মুরারীপুকুর থানা থেকে বলছি।

পিঠের ভেতর হঠাৎ ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে গেল নীচের দিকে। সাহস করে বললাম, কী ব্যাপার?

-মোবাইল এ আপনার নাম দীপুদা বলে সেভ আছে, আপনার পুরো নাম কি?

-দীপেন্দু চক্রবর্তী।

-আপনি এই ভদ্রমহিলার কে হন?

-এত জেরা করছেন কেন? মোবাইলটা কি ওর হারিয়ে গেছে, আপনারা কি পেয়েছেন?

-না। আপনাকে যে প্রশ্ন করা হচ্ছে, তার উত্তর দিন। 

-বন্ধু।

-ওঃ। আপনি ইমিডিয়েট থানায় আসুন।

-আমি তো এই মুহুর্তে যেতে পারবো না স্যার। আমি গত এক সপ্তাহ ধরে মংপুতে এসেছি। ফিরতে আরও চার-পাঁচদিন লাগবে।

-আপনি কি মহিলার কোনও আত্মীয় স্বজনকে চেনেন? 

-কেন? আমাকে একটু বলবেন কি দয়া করে, কী হয়েছে তুনুর!

-উনি কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইডাল অ্যাটেম্পট করেছিলেন। পাশের ফ্ল্যাটের লোক দরজা ভেঙে নার্সিংহোমে দিয়েছে।

-তুনু বেঁচে আছে?

-কোমায় আছেন। চান্স কম বাঁচার। কাল রাতে আপনার ফোন এসেছিল দেখে আপনাকে ফোন করলাম। ওঁর বাড়ীর কারুর ফোন নাম্বার জানেন?

-নাম্বার তো জানি না। তবে যাদবপুরের দিকে ওঁর দাদা থাকেন। সম্ভবত ‘বাপি’ নাম। তুনু ‘বাপি’দা’ বলেই ডাকে। দেখুন ওই নামে কোনও নম্বর সেভ করা আছে কিনা?

  তুনুর মুখটা ভেবে শিউরে উঠলাম। ফোনে কথা বলিনি, এটাই কি আত্মহত্যার যথেষ্ট নিদান? নাকি অন্য কোনও দুঃখ ছিল আমার অচেনা? পুলিশে ছুঁলে আঠার ঘা। ভাগ্যিস মংপু এসেছিলাম! বড় ঘৃণা এল নিজের প্রতি। যে মেয়েটি আমার থেকে তার প্রতি শৈত্যের অনুমানে নিজেকে শীতল করে ফেলেছে এতখানি, যে আজ সংজ্ঞাহীন বেঁচে নিচ্ছে পরবর্তী আয়ু - আজ তার পাশে না থাকার জন্য কোথাও এক স্বস্তির নিশ্বাস উড়ে উড়ে মিশে যাচ্ছে সিঙ্কোনার ছালে। মাথার উপর চরম রোদ্দুর এসে যেন ধিক্কার দিল। অর্কিডের রামধনু যেন হঠাৎ করে কালো করে দিল আমার দৃশ্যপট। রাস্তার উপর একটা বাঁধানো মতো চাতালে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। সকাল থেকে মিলি ফোন করেনি। ফোনটা হাতড়ে কোনও রকমে ফোনটা লাগালাম। সর্বাঙ্গ কাঁপছে। সমস্ত অন্তর, হৃদয়ের অলিগলি, মন সবাই একসাথে কাঁপছে। একটা রিং হতে না হতেই থেমে গেল ফোন। মেসেজ ভেসে এল ‘মিটিং এ আছি। পরে কল করব।’ ভালোই হল। কীই বা বলতাম মিলিকে? এই শৈত্য ওর কোনওদিন কাটার নয়! জোব্বার জন্যই হয়তো সেপারেশন চাইবে না কোনওদিন। এভাবেই কেটে যাবে জীবনের বাকী কটা দিন। প্রতিদিন আরও বেশী করে মানবী হয়ে উঠবে, ঈশ্বরীর উৎসর্জন আর হবে না কখনও। কেমন আছ তুনু? কেমন আছ অনুদীপা? তোমরা সবাই কেন এমন উদাস চোখে সুদূরকে চেয়ে আছো? ‘কেন ছেড়ে দাও রোজ ঈশ্বরের বেশ? কেন জ্বালো মনে মনে মায়া ঘৃণা তৃষা? দূরে যায় যারা জ্বালে প্রতিদিন আলো। পূজারী জ্বালিয়ে ফেরে প্রতিদিন নিশা।‘ জানো তুনু, রবিঠাকুর মংপুতে বসে দুটো লাইন লিখেছিলেন, ‘তোমায় বেড়া দিতে গিয়ে আমায় দিলেম সীমা/তবু মনে রেখো/আমার মধ্যে আজো আছে চেনার অতীত কিছু!’ সেই চেনার অতীত যারা, তারা না তো আমার বশ, না তো আমার সাধা। আমি বয়ে চলি শুধু যার কেবল মন তারে বাঁধা আছে। যদি এবারের মতো বেঁচে ওঠো তুনু,নতুন জন্মে ‘তুমি’ হয়েই বাঁচো। ‘চেনার অতীত’ যদি অধরাই থাকে, থাক্‌। আমি নিজে যাবো ধরা দিতে চেষ্টা টুকু নিয়ে। 

                                            

Post a Comment

0 Comments