১৮২ তম ছোটোবেলা সংখ্যা
সম্পাদকীয়,
খেলা আর পড়ার মধ্যে বিরোধ সেই সত্য যুগ থেকেই। বড়োরা বলে পড়, আর মন চায় খেলতে। এই নিয়ে দারুণ ছড়া লিখেছে তোমাদের বন্ধু সঞ্চিতা। ছবিতে সুশোভন আঙ্কেল তোমাদের দুই বন্ধুর কান্ড দেখিয়েছে। গরমে কি মজার তাই না! শ্রীপর্ণার আঁকা কেমন লাগলো জানিও। লিখে জানিও। মানসী পিসি বিলু দাদুর গল্প বলেছেন। বিলু দাদু কে? জানতে হলে পড়তে হবে। অসীম জ্যেঠুর চিঠি প্রতিবারের মতো অসাধারণ। না আর কিছু নেই এবারের পত্রিকায়। ছোট হলে পড়তে কম সময় লাগবে। আর পড়েই লিখে পাঠাও কেমন লাগল। তোমাদের লেখার অপেক্ষায় থাকব। আশা করব তোমাদের পত্রিকা তোমাদের লেখায় আঁকায় ভরে উঠবে প্রতিবারের মতো। শুভ রাম নবমী। - মৌসুমী ঘোষ।
খোকন স্বপ্ন
সঞ্চিতা ঘোষ
ওই যে দূরে থাকা ছেলেটি
পছন্দ করে ক্রিকেট খেলাটি।
তার স্বপ্ন সে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হবে,
কিন্তু মা বলে তুই পাশ করবি কবে?
প্রতি বছর সে অঙ্কে পায় স্বল্প
সমাজ বলে প্রতিভা তার অল্প।
অঙ্কে একশো পাওয়া ছেলেটি
পারে না খেলতে ক্রিকেট,
কিন্তু সমাজের চোখে
সে হয়ে যায় দি গ্রেট।
অঙ্ক করে হওয়া যায় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার,
ক্রিকেট খেলে হোক না খোকন ক্রিকেটার।
সঞ্চিতা ঘোষ
নবম শ্রেণি, কেশপুর গালর্স হাই স্কুল
পশ্চিম মেদিনীপুর
শ্রীপর্ণা ঘোষ
একাদশ শ্রেণি, পি এম শ্রী জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর
বিলুদাদুর বাঘ দর্শন
মানসী গাঙ্গুলী
অনেকদিন বিলুদাদুর দেখা নেই, কোনো খবরও নেই। লাল্টু, গুল্টু হাঁপিয়ে উঠছে। দাদুকে ব্যস্ত করে তুলছে খোঁজ নেবার জন্য যদিও দাদু নিজেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফোনেও বিলুদাদুকে পাওয়া যায় না। এরকম মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যান তিনি। আসলে তাঁর তো কোনও পিছটান নেই, তাই মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু লাল্টু গুল্টুর দাদু বলাইবাবু পাড়া সম্পর্কিত এই ভাইটিকে যৎপরোনাস্তি স্নেহ করেন, এমনকি আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি। ঠাকুমাও ঠাকুরপো বলে অস্থির। তা সবাই যখন তাঁকে নিয়ে চিন্তামগ্ন তখনই একদিন এল বিলুদাদুর ফোন। দাদু তো ফোনেই তাঁকে যথেচ্ছ বকাবকি শুরু করে দিলেন। ও প্রান্তে বিলুদাদুর অট্টহাসির আওয়াজটুকু কানে এল দাদুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাল্টু বিল্টুর কানে। "আরে দাদা, তোমার কাছে যাই আগে, তখন না হয় বকাবকি কোরো। আমি কি এখানে ছিলাম নাকি? কত কান্ড ঘটে গেল এর মধ্যে। বেঁচে ফিরেছি এই কত না।" বলাইবাবু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না, কেঁদে ফেলেন। "এতদিন কত চিন্তা করে করে মাথা খারাপ হবার জোগাড়, তাতে আর তোমার কী?" দাদু আবেগবিহ্বল হয়ে পড়ায় বিলুদাদু কথা দিলেন দু'দিন পর শনিবার তিনি আসবেন। ফোন রেখে দাদুর হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। ঠাকুমা ছুটে এলেন। দাদুর শুরু হল বাজারের ফিরিস্তি। রাতটা পার হলেই ছুটবেন বাজারে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। অনেকদিন পর বাড়িতে যেন আবার প্রাণ ফিরে এল। লাল্টু গুল্টুও খুব খুশি। বিকেলে খেলতে গিয়ে বন্ধুদের সে খবর তাদের দেওয়া হয়ে গেল। তারাও যে গল্প শুনতে ভিড় করে ওদের বাড়িতে। বিলুদাদু এবার এসে বেড়ানোর গল্প বলবেন। বেড়াতে গিয়েও নাকি কত কী ঘটেছে, সেইসব গল্প।
বিলুদাদু এলে কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুরদম দিয়ে জলখাবারের পর্ব মিটলে শুরু হল গল্পের আসর। "আমাদের এবারের গন্তব্য ছিল অমরকন্টক। আর সেটাকে কেন্দ্র করেই আশপাশের কিছু অঞ্চল জুড়ে নেওয়া হয়েছিল। গ্রুপে আমিই বয়োজ্যেষ্ঠ", বিলুদাদু শুরু করলেন। তাঁকে ঘিরে বসে আছে লাল্টু, গুল্টু, তিন্নি, পকাই, সোনা, পদ্মা। সবাই নিবিষ্টমনে বিলুূদাদুর মুখের দিয়ে তাকিয়ে গল্প শুনতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে "বয়োজ্যেষ্ঠ মানে কী দাদু?" ছোট গুল্টু জিজ্ঞেস করে ওঠে। "গল্প শুরু হতে না হতেই, চুপ কর না ভাই। বিলুদাদুকে শুরু করতে দে না", লাল্টু খিঁচিয়ে ওঠে গুল্টুর ওপর। "আহা, আহা! ওকে বকছো কেন দাদুভাই? আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি গুল্টুবাবু। বয়োজ্যেষ্ঠ মানে বয়সে সবার বড়।"
🍂
বিলুদাদু আবার শুরু করলেন। "তো অমরকন্টক হল মধ্যপ্রদেশের একটি পুরনো শহর। মন্দিরময় এই শহরটিকে 'তীর্থরাজ' বলা হয়। নর্মদা ও শোন এই দুটি নদীর উৎপত্তিস্থল হল এই অমরকন্টক। আমরা ৬ জন মিলে গিয়েছিলাম এবার। ওরা সবাই আমাকে 'মেজদা' বলেই ডাকে। আমি যে বাড়ির মেজো ছেলে, তা ওরা কীভাবে যেন জেনে গেছে। আমার কথা থেকেও হতে পারে। ওরা আমার অনেক ছোট, মানসিকতাও মেলে না, তবু কীভাবে যেন ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমার। ওরা সবাই সংসারী, আমার মত বাউন্ডুলে নয়। খুব উৎসাহে ওরা মন্দির দেখে বেড়ালো ক'দিন। আমিও ওদের সঙ্গে দেখেছি, ভালই লেগেছে। ওরা পুজো দিয়েছে সব জায়গায়, আমি আর দিইনি কোথাও। কার জন্যই বা দেবো? যাইহোক, একদিন নৌকা ভাড়া করে নর্মদা নদীতে ঘুরলাম আমরা। নদী খুব গভীর। দু'দিকে উঁচু উঁচু মার্বেলের পাহাড়। সকালের রোদে সে মার্বেল একেবারে ঝকঝক করছে, আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন। মাঝি বলল নদীতে নাকি প্রচুর কুমীর আছে, তাই নৌকা থেকে ঝুঁকে কেউ যেন জলে হাত না দেয়। একবার একজন নৌকা থেকে জলে হাত দিয়েছিল আর সঙ্গে সঙ্গে কুমীরে তার হাতটা কব্জি থেকে কেটে নিয়ে চলে যায়। আরেকটু হলে হাত ধরে টেনে জলে নামিয়ে তাকে খেয়ে ফেলত।" "ওরে বাবা, বল কী দাদু," তিন্নি বলে ওঠে। "হ্যাঁ দিদিভাই ঐ নদীতে গিজগিজ করছে কুমীর। তো মাঝির ওই কথা শুনে আমরাও যে একটু ঘাবড়ে যাইনি তা নয়। সবাই সামলেসুমলে বসলাম নৌকায়। এরপর একদিন গেলাম কানহার জঙ্গলে। তখনও সূর্য ওঠেনি, আকাশ কেবল লাল হয়ে উঠেছে। আমরা একটা মারুতি জিপসিতে চেপে সাফারিতে গেলাম। এক বাঘ বাবাজি গাছের তলায় কেবল ঘুম ভেঙে আমাদের দেখে আড়মোড়া ভাঙ্গল। খোলা জিপে বসে ভয়ই লাগছিল। ঝাঁপ দেবে নাকি রে? সেদিন অনেক জন্তু-জানোয়ার দেখে আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম। হোটেলটা বেশি দূরে নয়। অল্পবয়সী ছেলেছোকরা সব গল্পগুজব শুরু করছে। আড্ডায় প্রথমে যোগদান করলেও তারা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো, আমি বললাম, 'কাছেই আমার এক বন্ধুর বাড়ি, হাঁটা পথ, আমি যাই ওদের সঙ্গে দেখা করে আসি। যদি ফিরতে না দেয় তো রাতটা ওখানেই থেকে যাবো। আমাকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।' ওরা বলল, 'আমরা পৌঁছে দিয়ে আসবো?' আমি বললাম, 'আরে না না, কতবার গেছি আমি বন্ধুর বাড়ি। ও তোমরা চিন্তা কোরো না, কাল এখান থেকে বেরোনোর আগে আমি ঠিক চলে আসব।' এই বলে আমি বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। অনেকদিনের বাসিন্দা। আমাকে একবার মায়ের বাতের ব্যথার তেল জোগাড় করে দিয়েছিল, যা মালিশ করে মা খুব উপকার পেয়েছিল। ভাবলাম অল্প রাস্তা হেঁটেই চলে যাই, একটু হাঁটাও হয়ে যাবে। ভেবে বেরিয়ে পড়লাম। খানিক এগিয়ে পথে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম পথ প্রায় ৪ কিলোমিটার। তাকেই জিজ্ঞেস করলাম কোনও শর্টকাট পথ আছে কিনা। সে বলল, 'আছে, সে পথ প্রায় অর্ধেক, তবে তা মাঠের ওপর দিয়ে। পথে আলো নেই।' তবে শুক্লপক্ষের রাত, অন্ধকারটাও তত ঘন নয়। চললাম এগিয়ে শর্টকাট পথ ধরে। বেশ খানিকটা পথ এগিয়েছি হঠাৎ মেঘ ডাকতে শুরু করল, সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। পা চালালাম। কিন্তু অর্ধেক পথও পৌঁছাইনি হঠাৎ খুব জোর বৃষ্টি এল। পথে দাঁড়াবার কোথাও জায়গা নেই। আকাশ ঘনঘোর অন্ধকার, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলোয় দেখে নিতে নিতে এগিয়ে চললাম। হঠাৎ পড়লাম এক জলাশয়ে। পড়ে গিয়ে সে একেবারে হাবুডুবু। কনকনে ঠান্ডা জল। আচমকা পড়ে ডুবেই খানিকটা নিচে চলে গেলাম। ভাগ্যি সাঁতার জানতাম, তাই নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে পারলাম। আবার বিদ্যুতের এক ঝলকানিতে দেখলাম বৃহৎ কোনো জলাশয় নয়, পড়েছি আমি এক বিশাল ইঁদারায়। এই ইঁদারার পাড়টি উচু নয়, মাটির লেবেলে। আর তাই আমি পড়ে গেলাম. জলের মধ্যে। এদিকে ইঁদারার জল, ওপর থেকে বৃষ্টির জল ঝমঝম করে, সে এক নিদারুণ অবস্থা। চোখ খুলে তাকাতে পারছি না। কীভাবে ইঁদারা থেকে বেরিয়ে উপরে উঠবো, তাই ভাবছি কেবল। হঠাৎ ঝপাং করে ভারী জিনিস পড়ার আওয়াজ আর সঙ্গে ইঁদারার জল ছিটকে উঠল। ইঁদারাটা বেশ বড়। খানিক বাদে বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখি আমার উল্টোদিকে জলের মধ্যে একটা বাঘ হাবুডুবু খাচ্ছে।"
. "উফ্ বিলু! সামলে সামলে। যদি করি গল্প কেন করি অল্প।"
"এইতো নয় দাদা, তুমি আমায় মোটে বিশ্বাস করো না। ঠিক আছে, আজ গল্প এই পর্যন্তই। এই আমি উঠলাম।” লাল্টু হৈ হৈ করে উঠলো। "না না বিলুদাদু, তুমি দাদুর কথা শুনো না, দাদু তোমায় খেপাচ্ছে। তুমি বলো।" বিলুদাদু খানিক গুম হয়ে বসে থাকলো। সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। পদ্মা, তিন্নি, গুল্টু, সোনা, পকাই সবাই 'বলো বলো' করে অস্থির করে তুলল। লাল্টুর দাদু বলাইবাবু বললেন, "আচ্ছা বাবা, আমি আর কিছু বলছি না, বিলু যত খুশি গুল মারুক।" বিলুদাদু কপট রাগের ছলেও হেসে ফেললেন। আবার গল্প শুরু হল।
. তো বাঘটা হাবুডুবু খেতে খেতে সামলে নিয়েছে। বাঘ তো সাঁতার কাটতেই পারে কিন্তু বেকায়দায় পড়ে গিয়ে বাঘ বাবাজি একটু হিমশিম খেয়ে পড়েছিল। সামলে নিয়ে জলের ওপর ভেসে উঠে এবার তার নজর পড়ল আমার দিকে। একবার চোখ পিটপিট করে নিল ঠিক দেখছে কিনা আর কী। আমার তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা। কিন্তু সত্যি, জানো দাদা, বাঘ বোধহয় বুঝতে পারল যে সে আর আমি একই বিপদে পড়েছি। দু'জনেই আমরা ইঁদারা থেকে উঠবার চেষ্টা করে যাচ্ছি অথচ বেকায়দা হয়ে যাচ্ছে, তাই ও আমার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ বলে মনে হল আমার। ইতিমধ্যে বৃষ্টি একটু কমেছে। বাঘ বাবাজি সাঁতরাতে সাঁতরাতে আমার বেশ কাছাকাছি চলে এলেও কিচ্ছু করলো না আমায়। অতো কাছে এসে যাওয়ায় বাঘের গায়ের তীব্র গন্ধ পাচ্ছি তখন, যতটা পারছি নাক টিপে থাকছি। ভয়েতে চোখ বুজে থাকছি, এদিকে মুখ বন্ধ। এভাবে কতক্ষণ পারা যায়! জলে ভেসে থাকতে থাকতে শরীর অবশ হয়ে আসছে। খানিকবাদে বাঘটা হাঁচোড়পাঁচোড় করতে করতে কীভাবে যেন ইঁদারা থেকে বেরিয়ে যেতে পারল, আমি পারলাম না। বাইরে বেরিয়ে পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাল। মনে হল, নিজে সে বেরিয়ে গেল কিন্তু আমি পড়ে রইলাম, তাই ওর খারাপ লাগল বোধহয়। বাঘটা বেরিয়ে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি তো পেলাম অবশ্যই, যদিও এই ইঁদারার মধ্যে দু'জনই পড়ে যাওয়ায় বাঘটাকেও তখন বড় আপন মনে হচ্ছিল। এভাবে একা একা পড়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল এবার বোধহয় তলিয়ে যাবো, আর পারছি না। এমন সময় মনে হলো ক্ষীণ কন্ঠে দু'জন মানুষের গলার আওয়াজ। আমি 'হেল্প হেল্প' করে চেঁচাতে লাগলাম যদিও গলা দিয়ে আমার আওয়াজ বেরোতে চাইছে না তখন। অতক্ষণ কনকনে ঠান্ডা ইঁদারার জলে আর বৃষ্টির জলে আমার গলার অবস্থা তখন খারাপ হয়ে গেছে। হঠাৎ দূরে আলোর ক্ষীণ রেখা দেখতে পেয়ে আশাবাদী হই। সাইকেলের ডায়নামোর আলোয় রাস্তা বেশ আলোময়। দু'জনের গলার আওয়াজ তখন একটু জোরে। তার মানে সাইকেলে দু'জন আসছে। আমি ভাঙ্গা গলায় প্রানপণে 'হেল্প হেল্প' করতে থাকি। দুই পথচারী সাইকেলের আলো ঘুরিয়ে চারিদিক দেখতে লাগলো। সেই আলো আমার গায়ে পড়তে তারা এগিয়ে এলো ইঁদারার কাছে। একজন হাত বাড়ালো, কিন্তু আমি তার নাগাল পেলাম না। দু'জনে পরামর্শ করে একজন রইলো আমার কাছে, আরেকজন সাইকেল নিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল। পাঁচ-সাত মিনিট পর তার সঙ্গে আরো ৫-৬ জন মানুষ এলো, সঙ্গে মোটা দড়ি। তারা দড়ি ফেলে দিল জলে আমার ধরার জন্য। আমার তখন আর ক্ষমতা ছিল না যে শক্ত করে দড়িটা ধরবো। কিন্তু তখন আমি মরিয়া। তাই সেই দড়িকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। পাড়ের ওপরের মানুষরা আমাকে টেনে ইঁদারার বাইরে বার করল। আমি ধড়াস করে মাটিতে পড়লাম। তারাই কোথা থেকে যেন একটা ভ্যানরিক্সা নিয়ে হাজির করে আমায় তুলে লোকালয়ে নিয়ে এসে সুস্থ করে তুলল, তারপর বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে দিল। বন্ধু তো সব শুনে আমাকে আর ছাড়তে চায় না। তুই এক সপ্তাহ এখানে থেকে সুস্থ হবি, তবে যাবি। সেই মুহূর্তে তর্কাতর্কি করি না আমি কিন্তু জানি যেতে আমাকে হবেই।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
জ্বলদর্চি ছোটবেলা ১৭৯ পড়ে অসীম হালদার যা লিখলেন।
শীতের পরশ গায়ে মেখে নিতে গিয়ে সবচাইতে আগে যেটা মনে পড়ে তা হলো পিঠেপুলি আর খেজুর রস। ছোট ভগ্নিপতী, সঞ্জয় কবে খেজুর রস খাইয়েছিল ভুলে গেছি। তাও অন্ততঃ বছর সাত আটেরও বেশি বই কম হলো না। ওরে বাপরে, প্রায় তিন গ্লাস উদরস্থ করেছিলাম মনে হয়। ও বলছিল, দাদা খেয়ে নিন, কিচ্ছু হবে না। দারুণ উপকার। ব্যস, খেয়ে নিলাম আর কী! আমলকির গানের থেকেও যেন এইসব বেশি চোখে ভাসে। জ্বলদর্চি এবার ছোটদের জন্য সাজিয়ে এনেছে শীতকালীন তত্ত্ব। সেই ফাঁকে দু চারকথা আমারও বলা হয়ে গেল তাই। মৌসুমীদির ডালি থেকে বেরোলো কিছু অসাধারণ সৃজনশীল কাজ। সে সম্বন্ধে আমার অনুভূতি।
'শঙ্করী সেলুনে মামা' - শতদ্রু মজুমদারের লেখা দিয়ে শুরু করছি। মামা সিরিজের এই গল্প পাত পেড়ে চেটেপুটে খেতে হয় বাচ্চা থেকে বুড়োদের। হাত সাফাই তো হলোই। শেষে নিজের চুলটাও কাটানো হলো না। এখানেই হাসি থামল না। শেষ লাইনেও দমফাটা হাসির কথা। "তার মানে আমার মা'র কাছ থেকেই চাইবে।" এই হাস্যরস আর কোথায় পাবো! গত ১২ই জানুয়ারী যখন ফরাসী মিউজিয়ামে তাঁর "অথ মামা বিচিত্রা" বইটা বেরোলো। যত দেখি এমন মানুষদের, একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি।
'ভুতুড়ে মাছ' - গল্পটি লিখেছে দ্বিতীয় শ্রেণীর আরিয়া মুখার্জী। এটাই বড় কথা। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি, কচি হাতে কাঠ পেন্সিল দিয়ে সে লিখছে, গোটা গোটা হরফে, লাইনটানা খাতার পাতায়। লিখতে গিয়ে ভুল হচ্ছে, তাই রবার দিয়ে মুছে নিয়ে সে আবার লিখছে। মুছতে গিয়ে খাতার পাতা বেঁকে যাচ্ছে, হয়তো খুলেও আসছে। তবু লিখে চলেছে আপন মনে 'ভুতুড়ে মাছ'। না, এতে আমাদের ভয় হয়নি ঠিকই। কিন্তু সে অনেক কিশোর গল্পলেখকদের ভয় পাইয়ে দিতে পারে বড় হয়ে। ও বড় হয়ে পরিচিত হোক লেখার গুণে, সেটাই কামনা।
'আছেন তিনি আছেন' - লিখেছেন নয়ন বসু। অনেকটা অণুগল্পের মতো। রংয়ের জাদু এমনই যে আসল নকল বোঝার উপায় থাকেনা। পেশা, রাজনীতি মানুষের প্রকৃত রূপকে বদলে দেয়। হয়তো সেটাই করণীয় হয়ে পড়ে টিঁকে থাকতে। পেছন ধাওয়া করে মিডিয়া, একটা সাক্ষাৎকার নেবার জন্য। আসলে এটাও তো একটা লড়াই। নিজের সাথে নিজের। আমি জানি আমি কী এবং কেমন। কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ না করার জন্য যদি নিজের চাহিদা পূরণ হয়, তাতে আশ্চর্যের কীই বা থাকতে পারে! এমন অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে থাকে সমাজের বুকে। আমরা যত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে চলেছি, তত ভুলে যাচ্ছি নিজেকে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে। মূল্যবোধ নিয়ে এখন আর কেউই ভাবতে রাজী নই। এ গল্প তেমনই একটি উদাহরণ মাত্র। তবে সেলফি না তোলার ঘটনাটা একটি দারুণ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করেছে এই গল্পে।
'বালক বিবেকানন্দের কীর্তি' - তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে যেকোন লেখাই আবালবৃদ্ধবনিতা, সবার কাছেই সমাদৃত। সাপের কাহিনী, সাধুকে শাড়ি দেবার কাহিনী, ভূতের ভয়ে এতটুকু ভীত না হওয়া এমন ছেলেটি আমাদের দেশের গর্ব হয়ে থেকে যাবে অনাদিকাল। পওহারী বাবা, সোনার নেউল ইত্যাদি আরও অনেক কাহিনীতে সমৃদ্ধ ছোট ছোট গল্পগুলো আমাদের কাছে নীতি, আদর্শের। শিশু বয়স থেকে যত আমরা তাঁর সম্বন্ধে পাঠ করাতে পারবো আমাদের প্রজন্মকে, তত তাদের মধ্যে শুদ্ধ চেতনা তৈরী হতে পারবে। আমরা এখন যে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেখানে দাঁড়িয়ে এমন মহাপুরুষের বাণী, নীতি, আদৰ্শ, গল্পকথা চর্চা খুব প্রয়োজন। এতে সমাজেরই উপকার।
'তোমার কাছে ফেরা' - আরণ্যক বসু।
ফিরে আসার কথায় একটা বাড়তি আনন্দ থাকে। না, বলে বোঝানো যায়না। সম্পূর্ণ অনুভূতির। যেখানেই যাই না কেন, দিনের শেষে রাত নিঝুম হলে মবে হয় কখন বাড়ি যাবো। পা ছড়িয়ে বসে থাকবো, কথা বলবো নিজের মানুষদের সাথে। এই স্বাধীনতা কেবল নিজের বাড়িতেই পাওয়া যায়। হোক না সে কোন কাঁচা বাঁশের তৈরী, হোক না মাটির মেঝে, তবু তা তো নিজেরই বাড়ি। সব সুখের ঠিকানা নিজের একটা বাড়িতে।
সেই বাড়ি ছেড়ে আমাদের বাস্তবে নেমে আসতে হয়। বুঝতে হয় আগত পরিবেশকে। সে এক এমন জগৎ যেখানে নিজেকে ঢেকে রেখে নাটক করতে হয়, সেসব কথা মুখে বলা যায়না। সেই সুখ তাই লোকদেখানো ছাড়া আর কী! নিজের ঘরে একদিন ফিরতে হয়ই। কিন্তু সেখানে তখন মাকে কোথায় পাই! মায়ের চিরুনিতে লেগে থাকা চুল মাকে স্মরণ করায়। তুলসীমঞ্চে ধূপ দীপ জ্বলেনা, তাঁর ব্যবহারের আয়না কবেই গেছে ভেঙ্গে। আসলে কবি ফিরতে চাইছেন তাঁর সেই ছোটবেলার জীবনে। মা ছাড়া ছবিটাই পাল্টে গেছে। তবু যেন কবির আগমনে তাঁর মাধ্যমে আশেপাশের পরিবেশ পুরানো স্মৃতিতে ডুব দিতে চায়, তাকে কাছে পেতে চায়। অসাধারণ একখানি কবিতা। মনে হয় যেন ছোটদের পাশে আমরাও এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হলাম না।
'শীত বুড়িটা' - রাজর্ষি মণ্ডল
হিমেল হাওয়া, ছাতিম ফুল, হলুদ গাঁদা, সোনালী ধান আর মিঠে রোদ - সবটাই তো শীতকালের সম্পদ। বুড়ি হোক, ক্ষতি নেই। কিন্তু তাঁর সম্পদের ডালি সেজে বাগান উপচে পড়ে সবুজ সব্জি, গাঁদা আর সোনালী ধানের রাশিতে। এইসময় রোদ বড়ো মিঠে লাগে। এই কবিতাটা এক ধাক্কায় নিয়ে গেল সেই ভাড়াবাড়ির বারান্দায়, যেখানে দুপুরবেলা রোদ আসতো। রোদের দিকে পিঠ দিয়ে সবাই খেতে বসতাম। খাওয়া শেষ হলেও রোদ পোহাতাম বসে। গল্প হতো কতরকমের। আর থেকে থেকেই বলে উঠতাম, কী ঠাণ্ডা পড়েছে গো! এই কথা বলতে বলতেই মাঝেমধ্যে হিমেল হাওয়া বয়ে যেত আর শুকিয়ে যাওয়া এঁটো হাত ধুতে যেতাম। মা ঠাকুমারা বাসী থালাবাসন ধুতে গিয়ে কেঁপে উঠতো। শীতবুড়ি তো আর যে সে বুড়ি নয়, হাড়ে হাড়ে টের পেতাম সবাই। তারপর জবুথবু হয়ে বিছানায় লেপের মধ্যে। কত কিছুই মনে এসে গেল শীতবুড়িটার জন্য।
'উবুদশ' - চন্দ্রনাথ শেঠ
কবির এই রচনার তারিফ না করে পারিনা। ফুল, কুঁড়ি সমৃদ্ধ ফুলের বাগান এবং আকাশভরা তারা, চাঁদ কত সুন্দর করে কচি মনের সাথে একাত্ম হয়ে উঠেছে তাঁর অসাধারণ লেখনীতে। হিমেল সন্ধ্যার এই অপরূপ সৌন্দর্য্য একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। শৈশবের নিষ্পাপ শিশুদের খেলাধুলার নামকরণের মধ্য দিয়ে কবিতাটি সজীব হয়ে উঠেছে। কবির প্রতি নমন জানাতেই হয়।
ঋপণ আচার্যের ছবিটা দেখে একনিমেষে কম করে চল্লিশটা বছর কমে যায়। মনে পড়ে, হ্যাঁ এই তো কদিন আগেই তো একটা চালতাগাছ বা শিরিষ গাছে উঠে বসতাম। আর তারপর সেই লাইনের ধারের পুকুরটায় ঝাঁপ দিতাম। তখন অবশ্য গরমকাল। কিন্তু ঐ ধানের ক্ষেতটা তো আমার ভীষণ চেনা। আল ধরে হেঁটে যাওয়া, গরু বাছুর নিয়ে জ্যেঠুর সাথে আবাদে ঘুরে বেড়ানো, ধানের বীজ পুঁতে দেওয়া দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যেত। আর দূর থেকে বড়োমা ডাক পাড়তো, "ও বাপি খাইতে আয় জ্যেঠুরে লইয়া। ভাত ঠাণ্ডা হইয়া যায়।" ছোট্ট অভিরূপের ছবিটাও সেই গ্রামের ঐতিহ্যকে যেন বহন করছে। নস্টালজিক এই ছবি মনকে খুব নাড়া দেয়। এই পরিবেশের একেবারে বিপরীতের ছবি একাদশ শ্রেণীর সৌমী মণ্ডলের তুলির ছোঁয়ায়। একটি মেয়ে বা নারী কতটা অসহায়, নিরাপদহীন, তা যেন আবার ফুটে উঠেছে! সমাজের অবক্ষয় বোধহয় এভাবেই শুরু হয়। কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কতদিন সমাজকে চলতে হবে জানা নেই। কিন্তু তার জন্য যে প্রতিবাদ, তাও যেন তাদের টলাতে পারছেনা! এ এক চরম বিপর্যয় বটে।
জ্বলদর্চি - ছোটোবেলার সংখ্যাগুলো একটা সময়ে খুব অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল আমাদের সবার কাছে, যখন আমরা ঘরবন্দী ছিলাম। সম্পাদক মৌসুমী ঘোষ খুব যত্নসহকারে তাঁর সাধের প্রয়াসটি ধরে রেখেছেন এখনও, কারণ তিনি কিশোর মনকে নিয়ে রীতিমতো পড়াশুনো করেছেন, তাদের ভালো লাগার বিষয়টি লালিত করেছেন নিজস্ব গুণের দ্বারা। আমি সৌভাগ্যবান একজন, যে এই সৃজনকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি, দু চার কথা বলার জায়গা পেয়েছি। বহুদিন পর তা নিয়ে লেখার সময় পেলাম। তোমাদের মাঝে নিজেকে মিলিয়ে দেবার এই সৌভাগ্য স্মৃতিতে রয়ে যাবে। ছোটোরা, তোমাদের সবার প্রতি আমার অকৃপণ ভালবাসা ও আশীর্বাদ। আর বড়োদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
0 Comments