জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /মেমারি গেম। পর্ব ৫


গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
মেমারি গেম।  পর্ব ৫

সব নিয়মমতই চলছিল। এক এক করে রোগীদের বেড ঠিকঠাক করে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল। ওটি-গুলি পরিষ্কার করে বন্ধ করা হল, বড় বড় ডাক্তাররা সমস্ত ওয়ার্ডে তাদের রাউন্ড শেষ করলেন, এক একটি ফ্লোরের ইনচার্জ তাদের ফর্ম, খাতা ফিল আপ করা হয়ে গেল। নন্দিনী, নাগমণি আর পুনিয়াম্মা তিন নার্স আরো একটি রাতের নতুন ইভেন্টের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কারণ বেশিরভাগ ইভেন্টগুলি ঘটার সময় রাত 1 টার পরে। তারপর 3 টার মধ্যে তাদের আত্মীয়দের কল করার জন্য ফোনলাইন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

মহিমা এবং সুশান্তর জন্য এমন কোনও ভয়ের ব্যাপার ছিল না। তাঁদের শরীর এতদিনে প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। ডিসচার্জ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু তাঁরা কোথায় যাবেন সেটাই তো জানা নেই। হাসপাতালের আইসিইউ বা এইচ টি ইউ এমনভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা যায় না, তাই দু-একদিনের মধ্যে কিছু একটা হতেই হবে। 

🍂
ad

সুশান্তর ঘুম আসে নি। অনেকক্ষণ জেগে জেগে জেগে অতীতকে স্মরণ করার জন্য জোর চেষ্টা চলছিল। অতীতকে মনে হচ্ছিল ঘন কুয়াশায় ঢাকা এক নির্জন রাস্তা। আর সেই রাস্তায় সুশান্ত একলা একটা গাড়ি চালাচ্ছেন। রাস্তার ধারের গাছপালা, কুঁড়েঘর আর দোকানপাট দেখে মনে হচ্ছিল যেন ভুতুড়ে শহর, কোথাও একটা মুখও বেরিয়ে আসছে না। 
মহিমার চোখেও ঘুম নেই। চিন্তার স্রোত বয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোথাও পৌঁছচ্ছে না। আজই হাসপাতালে প্রায় নোটিশ দিয়েছে, দু-একদিনের মধ্যে তাদের সরকারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যাবে। সেখানে যত আজে বাজে লোকের বাস, সেখানে গিয়ে কি করে থাকবেন। 
 
এই অপ্রাকৃত সময়ে, আইসিইউর আবছা অন্ধকারে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ হলো। মহিমা সুশান্ত নন্দিনী এবং সবাই শুনলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কিন্তু অনুমান করতে পারল না এটি কী। বাইরে কি টায়ার ফাটলো? কিন্তু এখন শীতকাল এবং বেশ ঠান্ডা। সাধারণত গরমকালেই টায়ার বেশি ফাটে। নন্দিনী এসে চারপাশে চেক করে তার স্টেশনে ফিরে গেল। সুশান্ত আর মহিমার চোখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি মহিমা চোখ বন্ধ করলেন আর সুশান্ত মহিমাএর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সিলিং দেখতে থাকলেন। ঠিক তখন আরও একটি প্লপ আওয়াজ হল আর ঘরের কোণ থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করল। নন্দিনী সিট থেকে ছিটকে উঠে ও মাই লরড বলে তত্ক্ষণাৎ মেন্টেনান্সকে কল করল, কিন্তু ওদিক থেকে কেউ তুলল না। নন্দিনী ফোন রেখে ছুটে গেল মেডিকের ঘরে । দুজন জুনিয়র ডাক্তার সর্বদা সেখানে থাকেন, কিন্তু আজকেই তারা ছুটি নিয়ে গেছেন নিউ ইয়ার পার্টি এটেন্ড করতে। নিউ ইয়ার পার্টি একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে গেছে এখন। নন্দিনী একবার ফায়ার ফায়ার বলে চেঁচিয়ে উঠেই আবার থেমে গেল পেশেন্টরা আতঙ্কিত হবে ভেবে চুপ করে গেল। 

এসব থেকে হঠাৎ কি যে হল, সুশান্ত উঠে বসলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল ফায়ার ব্রিগেডের ফোন নম্বর। সুশান্ত চিৎকার করে উঠল, 
=দিদি দিদি, ১০১ ডায়াল করুন এখনই, ফায়ার অ্যালার্ম কোথায়?

যথারীতি এখানে কোনও ফায়ার অ্যালার্মই ছিল না। ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ধীরে ধীরে ঘরটি ভরে যাচ্ছিল। ভেন্টিলেটরগুলির মধ্যে ছোট ছোট আগুনের জিভ লাফিয়ে উঠল একের পর এক। 

 নন্দিনী ১০১ নম্বরে ফোন করই এবার রিসেপশনে ফোন লাগালো, প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বলল, 
=আগুন, আগুন, দয়া করে কিছু লোককে পাঠিয়ে এক্ষুণি আইসিইউ খালি করে দিন। 

মহিমাও এবারে উঠে বসে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। চারদিকে কী হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তাঁর। ধোঁয়ায় তার চোখ জ্বলতে শুরু করল আর একটা বুকচাপা আতংক এসে মাথায় জোরে আঘাত করল। প্রবল ভয় পেয়ে তিনি প্রার্থনা করতে এবং কীর্তন গাইতে শুরু করলেন। গাইতে গাইতে খেয়াল হল, প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি সুর পরিষ্কার মনে পড়ছে। গান গাইতে গাইতে কোথা থেকে যেন গাঁদা ফুলের গন্ধ ভেসে এল, এবং মহিমা নিজের অজান্তে গলায় হাত দিয়ে খুঁজতে লাগলেন হারিয়ে যাওয়া গাঁদা ফুলের মালা। 

সুশান্ত আগুন দেখে আর তার ওপর এই অদ্ভুত ভক্তি গীতি শুনে কেমন যেন খেপে উঠলেন হঠাৎ। মহিমার দিকে তাকিয়ে চীৎকার করে বললেন, চুপ করুন, চুপ করুন পুড়ে মরতে না চাইলে পালান এক্ষুনি, গান গেয়ে সতীদাহ যেতে যান নাকি?
মহিমা এই শুনে আরো জোরে জোরে গান গাইতে শুরু করলেন। গান মানে একটাই লাইন শুধু জপ করে যাচ্ছেন, পরমেশ্বরের কাছে, যার সহজ মানে হল আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। 
চারপাশটা বেশ গরম লাগছে, যদিও এখনও আগুন দূরে জানলার কাছেই ঘোরাফেরা করছে। সুশান্ত এবার বিছানা থেকে উঠে দৌড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু মনিটর ও আইভি টিউবের সঙ্গে জুড়ে থাকা তাঁর হাত। সেগুলো সরিয়ে না দিয়ে উঠে যাওয়া একবারে অসম্ভব।
 
অন্য রোগীরা, যাঁরা কোমায় ছিলেন না বা অ্যানাস্থেসিয়া থেকে সেরে উঠেননি, এবার তাঁরাও ঘুম থেকে উঠে চিৎকার শুরু করেন। আগুন আসতে আসতে ছড়াতে শুরু করেছে, ফলস সিলিংএর টালিগুলোতে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। সবচেয়ে সমস্যা ধোঁয়া। ধোঁয়ার শরীর একটা জিনের মতো বাড়ছিল, ঘর ক্রমেই গরম থেকে আরো গরম, এরই মাঝে একটি ভেন্টিলেটর আগুনের শিখা ধরে নিতেই বিকট শব্দে ভেঙে পড়ল। 

হাসপাতালের উদ্ধারকর্মীরা যখন আইসিইউ খালি করতে এলেন, ততক্ষণে কোমায় থাকা দুই রোগী মারা গেছেন। অন্যরা আতঙ্কে পাগলের মত চিৎকার করছিল। মহিমার শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল, তাঁর গলা ধরে আসছিল, তিনি আর প্রার্থনা করতে পারছিলেন না। সুশান্ত শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে যতটা সম্ভব ধীরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আর পারলেন না প্রচন্ড এক দমকা কাশি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুশান্তর ফুসফুসে। তিনি কাশতে শুরু করলেন, মনে হচ্ছিল সে কাশি বুকটা পুরো ফাটিয়েই তবে থামবে। 

আইসিইউ খালি করতে আধ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। কিছু লোক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে এদিক ওদিক গ্যাস ছড়াতে গেলে তাতে ধোঁয়াই আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। এর মধ্যে তাজা বাতাস ঢোকার জন্যে সিকিউরিটির একজন চেয়ার দিয়ে মেরে মেরে জানালার কাচ ভেঙেছে। তাতে সুবিধে হয়েছে ধোঁয়া বেরোবার ও অক্সিজেন আসার। কিন্তু অক্সিজেন আসাতে আগুনও উৎসাহ পেয়ে গেলে। দুটি বেডে আগুন লেগে গেল। ভাগ্যবশত তার ঠিক আগে সেগুলি খালি করা হয়েছিল। একজন উদ্ধারকারী ধোঁয়ার মধ্যে ঢুকে কাঁধে করে রোগীদের তুলে আনছিলেন, তিনি এবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। অবশ্যই হাসপাতালের বেশির ভাগ ফ্লোরে ফায়ার অ্যালার্ম বা স্প্রিংকলার বলতে কিছুই ছিল না, সবই ছিল প্রাগৈতিহাসিক। আগুন নেভানোটাও বেশিটা হাতে হাতে শুরু হল যতক্ষণ না দমকল কর্মীরা এসে হাজির হলেন। তাঁরা এসে জল কোথায় পাবেন তাই নিয়ে দিশাহারা হলেন। কোথায় জল দিয়ে নেভাবেন, তাতে রোগীদের কি হবে এসব বলার মত কোন ব্যক্তিকে খুঁজেই পাওয়া গেল না, তাঁরা তখন নিউ ইয়ার পারটিতে মনের আনন্দে ভুঁড়ি দুলিয়ে, মাথায় একহাতে সেক্স অন দি বিচ কক্টেলের গ্লাস মাথায় নিয়ে নাচতে ব্যস্ত ছিলেন। 

উদ্ধার হওয়া আরও অনেক রোগীর সঙ্গে হাসপাতালের অফিস সেকশনে পাশাপাশি বসেছিলেন মহিমা আর সুশান্ত। নানা রকম কথা বলছে চার পাশের লোকজন। কেউ বলছেন, আইসিইউ থেকে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ায় এবং তাদের উদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সাধারণ ওয়ার্ডে ৯০ জন রোগী মারা গেছেন। সবাই শূন্য দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। এরই মধ্যে কোথা থেকে নন্দিনী দৌড়ে এলো, তার পাট করা নার্সের পোষাক, কালো, ছাই ও কাদায় ভর্তি, মুখে সেই ছাই আর কাদা লেগে অদ্ভুত লাগছে। নন্দিনীর কনুইএর একপাশটা কিছুটা ঝলসে গেছে। একটা মলম লাগিয়ে নন্দিনী নির্বিকারভাবে এক এক করে সব রোগীদের হিসেব নিয়ে খাতায় নোট করে চলল, ও সঙ্গে থাকা একটা এমারজেন্সী ওষুধের বাক্স থেকে যাকে সম্ভব তাকে তাদের লাইফ সেভিং ওষুধ খাওয়াতে ব্যস্ত। চারদিকে গুন গুন করে নানা রকম গোঙ্গানীর আওয়াজ, তার মধ্যে নন্দিনী ও তার আরো কজন সহকর্মী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সুশান্ত সেদিকে একবার দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন, এই মেয়েগুলো গাধা না দেবদূত। 
 
সব এলোমেলো, বেডগুলো পুড়ে গেছে বা দমকলের হোস পাইপের জলে ভিজে ঢোল। করিডরে সারি সারি ম্যাট্রেস পাশাপাশি পেতে একটা বিরাট বিছানা করা হয়েছে। তার ওপর উদ্ধার হওয়া রোগীরা শুয়ে। বেশির ভাগের অবস্থাই কাহিল, কাতরাচ্ছে, গোঙাচ্ছে, মোটামুটি একটা মিনি নরক, যার মধ্যে ঘুরে যাচ্ছে দেবদূতের মত নন্দিনী ও তার সঙ্গী নার্সেরা। 
মহিমা এবং সুশান্ত এখনো পাশাপাশি, অফিসিয়ালি বলতে গেলে তাঁরা একই বিছানায়। 
নাগমণি দুজনের ভাইটাল প্যারামিটারগুলি পরীক্ষা করতে এল, নিয়মিত ওষুধগুলি যেটা মুখে দেওয়া যায় সেগুলো খাওয়ালো। জানালো আই ভি গুলো আনার ব্যবস্থা করছে। প্রথম যারা অক্সিজেন ছাড়া থাকতে পারবে না তাদের দেখা হচ্ছে, তারপরই এঁদের ব্যবস্থা হবে।

দুজনেরই খুব খিদে পেয়েছে। এত বিপদ ও আতঙ্কের মধ্যেও শারীরবৃত্ত তার কাজ করে যায়। কিন্তু সাহস করে নন্দিনীকে সেকথা বলার আগেই নন্দিনী আবার দৌড়ে কোথায় চলে গেল। এখন খাবার ব্যবস্থা করবে কি করে সেটাও একটা প্রশ্ন। 

এদিকে ধীরে ধীরে কখন যে দুজন প্রায় কাছে চলে এসেছেন আর দুজনের হাত দুজনকে ছুঁয়েছে সেটা কেউ জানে না। একটি হাত আর একটি হাতকে খুব আলতো করে ছোঁয় , অজান্তেই ধরে থাকে ও ধরে রাখে, যেন দুই বিধ্বস্ত মানুষ একে অপরকে আশ্বস্ত করছে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এমন সময়ে ঈশ্বর নয়, ডাক্তার ও নার্সরাই আশার প্রতীক হয়ে ওঠেন এবং তারা নির্ঘুম রক্তবর্ণ চোখে দেখতে থাকলেন কীভাবে নন্দিনী এবং অন্য একজন জুনিয়র ডাক্তার এক রোগী থেকে আরেক রোগী ছুটে যাচ্ছেন। একেই হয়ত সেবা বলে। মহিমা ভাবলেন, ভেবে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে এল।

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

1 Comments