স্মৃতির পটে || প্রথম পর্ব
সুদেব কুমার ঘোষ
Memory speaks manythings
But writer writes somethings
যত বয়স বাড়ছে ছোটো বেলাকার স্মৃতিগুলি মাঝে মধ্যেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিন্তু সেই স্মৃতিগুলি লেখা খুবই মুশকিল। আর লিখলেই সেগুলি লোকে পড়বে কেন ? আমি তো তেমন গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি নই। কোনো অবদানও সমাজে নেই। সামান্য অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। মনীষী বা লেখক বা খেলোয়াড় বা সিনেমা আর্টিস্টরা জীবনী লিখলে তাঁদের লেখা সকলেই পড়ার আগ্রহ দেখাবে। আমাকে কেউ চেনে না জানে না । এমনকি পাড়ার লোকজনও সবাই চেনে কি - না সন্দেহ আছে। তবে স্মৃতি কথা বেশ মধুর। অনেকেই একে আবার বেদনাদায়ক হিসাবে গণ্য করেন। আমার তো কখনোই তা মনে হয়নি। বাল্য স্মৃতি মনে পড়লে আমার তো বেশ ভালই লাগে। দেখা যাক কতটা লিখতে পারি।
তবে স্মৃতি কথা যদি সম্পাদক মহাশয়ের মনোনীত হয় তাহলে পদার্থের মতো পত্রিকাতে লেখাটি একটা স্থান দখল তো করতে পারবে।
আমার জন্ম হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার গোঘাট ব্লকের নকুণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের কোটা গ্রামে। পশ্চিম মেদিনপুরের লাগোয়া। গ্রামের দক্ষিণ দিকে বহে গেছে তারাজুলি খাল। তারপর শুরু হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। গোঘাট ব্লকটি দু ভাগে বিভক্ত। গোঘাট ১ যার ব্লক অফিস গোঘাটে। গোঘাট ২ যার ব্লক অফিস কামারপুকুর। আমার গ্রামটি গোঘাট ১ এর অন্তর্গত। গ্রামটি আরামবাগ থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দক্ষিণ – পশ্চিম কোণে।
একেবারে জন্মের সময় তো আমার বলার কথা নয়। মা ঠাকুমা অন্যান্য আত্মীয় – স্বজনদের কাছ থেকে যেটুকু শোনা সেটুকু বলা যেতে পারে। জন্মের সময় অনেকের এমন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তা থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। জন্মের সময় পীযুষ নির্ঝর হয়ে শান্ত হয়ে মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর কোলে - পিঠে - হেসে – খেলে মানুষ হয়েছি। বদমাশ ডানপিটে এসব শব্দ আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। অন্ততঃ শোনা যায়নি। জন্মদাত্রীকে মা বলতাম। তার সাথে সাথে ঠাকুমাকেও মা বলতাম। তার কারণ বাবা – কাকা ঠাকুমাকে মা বলতেন। তাঁদের শুনে আমরা ভাই – বোনেরাও মা বলতাম।
চার বছর বয়সে শচীনন্দন চক্রবর্তী মহাশয়ের পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে দু বছর পড়েছিলাম। সেখানকার স্মৃতি বেশ ভালোয় মনে পড়ে। সরস্বতী পূজার সময় খড়ি পেনসিল দিয়ে হাতে খড়ি শুরু করে পাঠ আরম্ভ হয়।প্রথমে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রথম ভাগ দিয়ে পাঠ শুরু হত। এই পাঠ শেষ হলে শুরু হত দ্বিতীয় ভাগ। দুটি ভাগ শেষ হতে প্রায় দু বছর সময় লাগত। তারপর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হত। পাঠশালায় দু বছর পড়লে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হবার পর প্রথম শ্রেণীতে না পড়ে সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রমোশন পাওয়া যেত। প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ শেষ করে বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে বানান ও রিডিং পড়ার সমস্যা হতনা। পাঠশালায় একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে সরস্বতী পূজার সময় খিচুড়ি রান্নার খরচ যোগানোর জন্য গ্রামের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে হত। এজন্য স্যারই গান বেঁধে দিয়েছিলেন। দুটি দলে গানটি গাওয়া হত। গানটি নীচে দেওয়া হল।
প্রথম দলৎ--- আমরা শিশু করেছি মনে
পঞ্চমীতে পুজব মোরা মায়ের চরনে।
দ্বিতীয় দল--- সরস্বতী পূজা করলে কী হবে ?
লক্ষী পূজা করলে যে ভাই বহু ধন পাবে।
প্রথম দল--- লক্ষী পূজা করার সময় এখন নয়
সরস্বতী পূজা করে বিদ্যা শিখতে হয়।
দ্বিতীয় দল--- পূজার সময় বিল্বপত্র তুলতে হয়
বিল্বপত্র তুলতে গেলে কণ্ট সইতে হয়।
প্রথম দল --- কন্টক্ষেতে ভয়টি করোনা
কন্টক্ষেতে কষ্ট করে বিল্বপত্র তুলতে হয়।
দ্বিতীয় দল --- পূজার সময় অনেক কষ্ট হয়
পুষ্পাঞ্জলির জন্য যে ভাই উপোস থাকতে হয়।
প্রথম দল --- বিদ্যার জন্যই মোরা পূজা করে থাকি
উপোস করে মায়ের কাছে আশীর্বাদ মাগি।
দিতিয় দল ---কলিকালে বিদ্যা শিখে অভিযোগ আছে
বাপকে তুচ্ছ করি ছেলে কর্তা সেজেছে ।
প্রথম দল --- ঝগড়া করে সময় নস্ট করোনা
ভিক্ষা নিয়ে অন্য বাড়ি চলে চলনা।
সমবেত কণ্ঠে ---
দাও গো ভিক্ষা দাও গো ভিক্ষা মাগি বারে বারে
ভিক্ষা নিয়ে আমরা যাব অন্য বাড়ির দ্বারে।
শচীনন্দন আশা করে চাল আলু টাকা
পূজার দিনে মায়ের সামনে সবার ঢাই থাকা।।
যারা দ্বিতীয় ভাগ পড়ছে অর্থাৎ দ্বিতীয় বছরের ছাত্ররা এই ভিক্ষা করার সুযোগ পেত। তখনকার দিনে এখনকার মতো ব্যাগের ছড়াছড়ি ছিলনা। গামছাকে দু ভাঁজ করে দুদিকে গিঁট বেঁধে ব্যাগের মতো তৈরী করতাম। এটিও গুরুমহাশয়ের কাছেই শিখা। বলতে গেলে শচীনন্দন চক্রবর্তী মহাশয় আমাদের প্রথম জ্ঞানের আলো ফুটিয়েছেন। আজ তিনি নেই। কিন্তু আমরা তাঁর কাছে চিরঋণী।
1 Comments
সবার ছোটবেলার গল্পই আলাদা আলাদা সুন্দর গল্প ,লিখুন ,সঙ্গে আছি।
ReplyDeleteনমস্কার