বার্লিনের ডায়েরি
(৭৪ পর্ব /অন্তিম পর্ব )
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
অভিমানী আকাশের আজ মুখ ভার। হতচ্ছাড়া কালো মেঘের দল ঘুরে বেড়ায় একরাশ মন খারাপের বার্তা নিয়ে। সাত সকালে একমুঠো মিঠে রোদ্দুর মিষ্টি হেসে মুখ লুকিয়েছিল গহন মেঘের চওড়া দেওয়ালে। শীতের বার্লিনে সেই নভেম্বরের শুরুতে ওরা এসেছিল। হৈ হৈ করে কত নতুন দেশ , কত নতুন মানুষ , নতুন স্বপ্নের পৃথিবীতে ইতিহাস ভূগোলের মানচিত্রের পথ পরিক্রমা শেষে অবারিত প্রকৃতির অনুপমা সৌন্দর্যের মায়ায় কত নতুন অভিজ্ঞতায় ঝুলি পরিপূর্ণ করেছে। আজ 30th January ,শ্রীর বার্লিন সফর শেষদিন।রাত সাড়ে এগারটায় ফ্লাইট ইতিহারে দুবাই হয়ে ইন্ডিয়া ফিরবে। ঋষভ বলে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় এসে গেলো কিন্তু স্যাঁতসেঁতে বৃষ্টি ভেজা কাঁদুনে মেঘের আবহাওয়ায় কোনো পরিবর্তন নেই। ভাগ্যিস আজ ওয়েদার রিপোর্টে তুষারপাতের সম্ভাবনা নেই। তবে মাঝেমধ্যেই ভোরের আকাশে সূর্য ওঠা হলুদ রঙের দেখা পেয়ে অপরিসীম আনন্দে বেড়াতে বেরিয়েছি । আজ বিদায়ী বেলায় ক ' দিন ধরে আবছা মেঘে ঢাকা ছাই রঙা পাহাড়ের গায়ে মিশে থাকা শ্রীর মনের মতই বিষণ্ণ প্রকৃতি। ওর খেরোর খাতায় নিজের রোজনামচা লেখার সাথে ,ভ্রমনের ম্যাগাজিন ও গল্পের বই পড়া ছাড়া অন্যকাজে বড়ো আলসেমি। ঘরের কাজ ,প্যাকিং ইত্যাদি কখন হয়ে গিয়েছে। যতবেলা গড়ায় শ্রী আনমনা বসে থাকে বন্ধ কাঁচের জানলায়। রাস্তার ওপারে লম্বা চওড়া একই সাজের বাদামী রঙের বিল্ডিঙের মাথার ওপর দিয়ে ভেসে বেড়ানো এক মুঠো স্তদ্ধ ছাই রঙা আকাশ। মুটেদের মত হাঁপাতে হাঁপাতে ঘাড়ে বয়ে নিয়ে আসছে স্তরস্তর মেঘেদের অভিমানের কালোবোঝা।
আনমনে সময় পার হয়ে চলেছে শ্রীর। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এই বিশাল ঘরটির চার দেওয়ালের মাঝে অদ্রিজা কে একাকী ছেড়ে যাবার কথা ভাবলেই মনের মাঝে তুমুল এক ঝড় ওঠে। শ্রী ভাবছিল সে কেমন করে সম্ভব ? তবু ও সব খারাপ লাগা দূরে সরিয়ে রেখে বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতিতে নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে হাসি মুখে মানিয়ে নিতে। ব্যালকনিতে ছায়া পড়েছে আকাশের বুকে ভেসে থাকা ঝাঁকে ঝাঁকে নীড়ে ফেরা ক্লান্ত পাখির দল। 'বকের পাখায় আলোক' লুকিয়ে মৌন মধুর সাঁঝের আঁধার নেমে আসছে সদা কর্ম ব্যাস্ত প্রাণ চঞ্চল নাগরিক আকাশের শহুরে জীবনে। যত সময় গড়িয়ে চলেছে মন খারাপের উতল হাওয়ায় দিশেহারা মার মত মেয়েও । বার্লিনে চলার পথে।
সাঁঝ গড়িয়ে রাতের আঁধার , সারা শহর রোজকার মতই আলোকজ্জ্বল। শুধু তিতিরের ঘরের ভেতর অসময়ে আঁধার। কারো মুখে কথা নেই, দিস্তাদিস্তা মন খারাপের কালো মেঘ আকাশ টার মত সময় বয়ে নিয়ে আসছে। বার্লিন ছেড়ে যাবার আগে এতদিনের আনন্দ হাসি গানে কাটানো সময় টুকু কাছে যত এগিয়ে আসছে মন ততই পীড়িত। ফ্যাকাসে মুখ মলিন। দিশেহারা শ্রী যেন বাধ্য হয়ে ঘরের তরে ছুটে চলেছে। অথচ হৃদয়ের নিভৃতে আর একটি মন কিছুতেই চাইছে না বিদেশের ভূমিতে আত্মীয়বন্ধু বিবর্জিত হয়ে কঠিন অবস্থায় একাকী মেয়ে কে ছেড়ে যেতে।
এয়ারপোর্টে অদ্রিজা এসেছে সী অফ করতে। ওর ছলোছলো জল ভরা দুটি চোখ ভাষাহারা স্তব্ধ দীঘির মত-তাকিয়ে আছে মহা শূন্যতায়। ওর নির্বাক মনের ভাষা বলে ''যেতে নাহি দিব ,তবু যেতে দিতে হয় ''। শ্ৰীময়ীর চারদিকে হাহাকারের ধ্বনি এই মুহূর্তে ও রিক্ত শূন্য হত দরিদ্র --অসহায় এক মা। শরীর যেন তার পা দুটোকে নিয়ে মন ছেড়ে এগিয়ে চলেছে।
বার্লিন গেট।
আধঘন্টা ও লাগেনি অদ্রিজার ফ্ল্যাট থেকে বার্লিনের টেগেল এয়ার পোর্ট পৌঁছোতে। এবং ভেতরে পা দিয়ে মায়ের শুখনো তৃষিত চোখদুটো বিশাল চত্বরে খুঁজে চলেছে তিতির কেই। এবারে সে এক লহমায় সম্পূর্ণ অদৃশ্য। শ্রীর বিষন্ন মনে একটু ও ভালো লাগছেনা। নিস্তব্ধ সাঁঝের আকাশের আলো আঁধারিতে যেমন সারাদিনের পর ক্লান্ত পাখিরা কুলায় ফিরতে গিয়ে পথ ভুলে সারা আকাশ ঘুরে ক্লান্তি তে ভেঙে পরে, শ্রী ও যেন সেই মুহূর্তে তেমনি এক আপন নীড়ের পথে ডানা ভাঙা পাখি। সব পিতৃ মাতৃ হৃদয়েই হয়তো এমনই সংশয় এমনই দিশেহারা হয়ে করুণ রাগিনী নিরন্তর বেজে ওঠে মনোবীণায়। একান্ত স্নেহের ধন নিজের আত্মজ ,আত্মজা কে একাকী এমন ছেড়ে যাবার সময়।
🍂
ঋষভ নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে মন কে শক্ত রাখে , শ্রীর বড়ো জ্বালা। অসহায় অবাধ্য মন সে কোনো বারণ শোনে না। অদ্রিজার পোস্টডক শেষ হতে আর মাত্র কয়েকটা মাস। স্নেহ মায়ার বন্ধনে অবুঝ সুতোর ডোরে যদি ওকে এমন করে বেঁধে রেখে দূর্বল করে ফেলে তবে আগামী দিনে জীবনের বন্ধুর পথে প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে ? সাতপাঁচ অজস্র ভাবনার মাঝেই প্লেনে ওঠার আইনি ফর্মালিটি সারা হলে বোর্ডিংপাস নিয়ে এখন লাউঞ্জে আরো দেড়ঘন্টা অপেক্ষা।ওরা জানে বন্দরের বন্ধনকাল চিরতরে ছিন্ন হতে চলেছে আর কখনো এ দেশে আসা হবে না। নিজের দেশ চিরপরিচিত শহর কলকাতায় কতক্ষণে পৌঁছবে ? দূর থেকে শুনতে পাচ্ছে এক নিভৃত নিশ্চিত আনন্দময় জীবনের হাতছানি। দৈনন্দিন জীবনের ভেলা কোন প্রতিকূল স্রোতে উজান বেয়ে কোন অজানা সিন্ধুপাড়ের কুলে ভেসে যাবে তার খবর কেউ জানে না। এ দেশের জল মাটি নির্দ্দিষ্ট দিনের পর ভিসা ফুরোলে অদৃজাকে ও জানাবে তোমার আর এখানে থাকার অধিকার নেই। অকারণে সুগভীর এক ক্ষত থেকে চলে অবিরত রক্তক্ষরণ।
রানওয়ের ওপর আপন নির্দিষ্ট গতিতে প্লেন ছুটতে শুরু করেছে। তারপর এক ঝাঁকুনি দিয়ে তড়িৎ গতিতে মাটি ছেড়ে ওপরের দিকে আকাশের মেঘ গায়ে মেখে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে উঠে চলেছে শূন্য থেকে মহাশূন্যের দিকে। পৃথিবী খ্যাত নগরী তার ঐতিহ্য বাড়ি ঘর দালান কোঠা,ইউরোপের অসামান্য সুন্দর প্রকৃতির সাথে আঁধারে বিলীন হলো শিল্প সংস্কৃতি ভাস্কর্য্যে সমৃদ্ধময় মহানাগরিক জীবন। পরে রইলো এক আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীর প্রতিদিনের চাওয়া পাওয়া। বিন্দুর মত দূরে মিলিয়ে গিয়েছে বার্লিন। শ্রী সেদিকে তাকিয়ে ঋষভ কে বলে নীচে ফেলে এলাম বিস্তর ভালোলাগার সাথে " আমার প্রাণের গভীর গোপন মহা আপন " সেই পরম ধন। আল্পসের পর্বত মালা সমুদ্র নদী বন বনানী পার হয়ে উঁচু থেকে আরো উঁচুতে উড়ে বায়ু সমুদ্রে ভেসে চলেছে।
প্লেনে রাতের ডিনার এলো , খাবারে রুচি নেই সব বিস্বাদ লাগে। সহযাত্রীবৃন্দ নানা দেশের নানা ভাষার কত মানুষ ,তাদের মৃদু গুঞ্জন আলাপচারিতা কানে আসছে। টিভি তে দেশ বিদেশের কত রকম গান শোনা মুভি কার্টুন দেখে টাইম পাস ,শ্রীর কিছুতেই মন নেই । একরাশ গভীর অন্ধকারের দিকে উদভ্রান্তের মত চেয়ে স্থির নিশ্চল বসে থাকে। রাত অবশেষে যবনিকা টানলে ভোরের আকাশে নবীন সূর্য সোনালী রোদের চাদর গায়ে জড়িয়ে মাটির দিকে গভীর মোহে তাকিয়ে আছে। শ্রী আধো ঘুমে আধো জাগরণে চোখ মেলে চেয়ে দেখেছিল দীর্ঘ পাঁচ ,ছয় ঘন্টা আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে এসেছে দুবাইয়ের আকাশে। বেশ কয়েক দিন ধরে দেশে ফিরবো ভেবেই বেশ দো টানায় মন---এক মন যখন বার্লিন ছাড়ার কথা ভাবতেই পারছিল না আর এক মন তখন প্রবল উৎসাহে দেশের মাটিতে ফেরার জন্য ব্যাকুল।
দুবাই এয়ারপোর্টে ট্রানজিটে আড়াই ঘন্টা বিরতির পর ইতিহার প্লেন উড়ে যাবে কলকাতার আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। সব রকম ফর্মালিটি শেষে ধনীদেশের বিলাস বহুল এয়ার পোর্টের লাউঞ্জের নরম সোফায় গা ডুবিয়ে রাত জাগরণের ক্লান্তিতে চোখে তন্দ্রা নামে। শ্রী কোলে ডায়েরি খুলে বসেছিল ,আধো ঘুমের মাঝেই কানেএলো কলকাতা গামী ইতিহার প্লেনটি সাতঘন্টা লেট। চোখ থেকে ঘুম নিমেষে বিদায় নিয়েছে। ডায়েরির পাতা খুলে নিজেকে জাগিয়ে তুলেছিল ,এক নতুন পৃথিবীর মনমুগ্ধ কর বিস্ময়ের সান্নিধ্যে। বার্লিনে শেষের কটা দিনের অবিস্মরণীয় দৃশ্য ,কত টুকরো টুকরো স্মৃতি কত নতুন বন্ধু ,কত চরিত্র তাদের মূল্যবান গল্প রাশিতে স্মৃতির পাতা সুধায় ভরা ।
ভেনিস থেকে সেই রাতে বার্লিনে ফেরার পর বেশ কয়েক দিন কেটে গিয়েছিল। তিনমাস থাকার মেয়াদ প্রায় তখন শেষের পথে অদ্রিজার চরৈবেতী মনের খেয়ালে ,রোমের ইতিহাসের প্রাচীন পৃথিবী তার একে একে সমস্ত রহস্যের রুদ্ধ দ্বার খুলে দিয়েছিল। তারপর ভ্যাটিকান সিটি ও পম্পেইয়ের সমাধি নগর শ্ৰীময়ী ভাবে ,ওর হাঁ করে গিলে চলা গল্পবাজ মনের চোখের সামনে সে কী বিস্ময় ! এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতার পৃথিবী। গভীর অনুরাগে তাকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে যেন ধন্য হয়েছিল ওর চারদেওয়ালের ঘেরাটোপের এ মনুষ্য জীবন। নিত্য সঞ্চয়ের ঝুলি কে তিলে তিলে পূর্ণ করে তুলেছে অসীমের আনন্দ ধারায়। পৃথিবীর কত বিস্ময় ইতিহাসের বিবর্ন হলদে হয়ে যাওয়া মর্মরে পাতায় জীবন্ত হয়ে আছে।
তবু ও ঘরে ফেরার কথা ভাবলেই সব কিছু ভুলে গিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতির ছোঁয়া লাগে। দেশের মাটির জল বাতাস বায়ু কী এক অজ্ঞাত ভালো লাগায় ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যেখানে যত দূরেই যাও না কেন তার চিন্তা মনের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। চির চেনা জগতের বাইরে বহু সহস্র যোজন দূরে বসে থেকে এতদিন নতুন ঐতিহ্যময় ধনী পৃথিবীর আড়ম্বরের রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে ও ভোলে নি নিজের আজন্ম পরিচিত শহর কে। সুদূরের পিয়াসী মন অচেনা অজানার আকর্ষণে নতুন দিগন্ত ছোঁয়ার নেশায় বিভোর হয়ে পৃথিবীর কুহকের মোহজালে মুগ্ধ হয়েও নিজের ঘরের দাওয়ার স্নিগ্ধ আলোর কোণ টিকে কখোনো হয়তো ভুলতে পারেনা।
দুবাই এয়ার পোর্টে কত লোকজন হৈ চৈ কত মানুষের চলাচল ---শ্রী কে কিছুই স্পর্শ করছে না। একমনে ভেবে চলেছিল বার্লিনে থাকার সময় কেমন করে তিনটে মাস চোখের পলকে কেটে গেলো। ডায়েরির পাতা উল্টে ''বার্লিন''নিয়ে গল্প লেখার কথা মনের মধ্যে দ্রুত গতিতে অংকুরিত হয়েছিল । তারই প্রয়াসে প্রতিদিনের ছেঁড়া ছেঁড়া কাহিনী কে নেড়েচেড়ে চলছিল। আপাততঃ অদ্রিজা কে ছেড়ে এসে মনের মাঝে যে তোলপাড় অশান্তির ঝড় চলছিল তা এখন সময়ের ব্যবধানে যেন একটু প্রশমিত,হয়েছে । তার ওপর কলকাতা আর বেশী দূরে নেই এয়ারপোর্টের বিলাসময় সোফার আরামে ঘুম আসেনি বরং স্মৃতির জালে নিশ্চিন্তে আচ্ছন্ন হয়ে নোটবুকের সাদা পাতার ওপর কলম চালিয়ে চলেছে। এ প্রতীক্ষার সময় যেন শেষ হতে চায়না। একরাশ এলোমেলো চিন্তার সাথে ওর বন্ধ চোখের পাতায় বহুদিনপরে মনে পড়লো প্রথম স্নোফলের দিনের দৃশ্যটি। নাতিশীতোষ্ণ দেশের মানুষ শ্রী প্রাকৃতিক ঝড় ঝঞ্ঝা, প্রলয়,বৃষ্টি বাদল দেখে অভ্যস্ত। তুষার ঝরা ভোরের অনবদ্য ছবি শ্রীর চোখের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে রইলো! তুষারাবৃত নিশ্চল শহর শ্বেত শুভ্র শান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বার্লিন গেট।
অতীত স্মৃতি চারণে একাধিক ঘটনার রাশি মনের পাতায় বাঁধ ভাঙা বন্যার মত প্লাবিত হয়ে চলেছে। কলমকে উজানে ভাসিয়ে লেখার আবেগে তবু মন চলেছে নিজ নিকেতনে। তন্ময় হয়ে ডায়েরির পাতায় শ্রী, প্রাগের ব্রীজে হঠাৎদেখা অন্বেষণের মাঝে ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া নীলাঞ্জনার স্মৃতি ফিরে পেয়েছিল। বার্লিনের আর্বান গ্রীন হাউসে পুরোনো বন্ধু সেলিনা কে খুঁজে পাওয়া বা রোমের রাস্তায় নতুন বন্ধু সদালাপী মিষ্টার মল্লিক,এবং কোর্ডিলিয়া। ভেনিসে সাংবাদিক বেবর্ত,মিলানের আশিক ভাই পম্পেইএর সমাধি নগরীতে ইরিনা ,এড্রিকের মত আরো কত নাম কত মানুষ অজানা চরিত্র জড়িয়ে আছে ওর এই পথ চলার কাহিনী জুড়ে। তাদের হাসি কান্না ছোটছোট দুঃখ ব্যথা।চলার পথে ডায়েরির পাতায় যথাসাধ্য সাজিয়ে রেখেছিল শ্রী। উল্টে পাল্টে তাতেই গভীরে মনোনিবেশ করেছিল। সম্বিৎ ফিরলো ঋষভের ডাকে।
ও এতক্ষন দুবাই এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ শিল্প সজ্জা সাজগোজ আশেপাশের আনাচকানাচে ঘুরে এলো । কফি শপ থেকে আরো একবার বিস্তর দাম দিয়ে দু মগ এক্সপ্রেসো মিল্ক কফি তে ওরা গলা ভিজিয়ে এতক্ষন অপেক্ষার ক্লান্তি দূর করে চলা শুরুহলো। দুবাই থেকে প্লেন ছাড়ার আশ্বাস পেয়ে ঋষভ বলে আমার দেশ আর বেশী দূরে নেই ,এই তো ঘন্টা তিন চারেকের রাস্তা। ঘরে ফেরার পালায় ওর মনও চঞ্চল আনন্দে পাখা মেলে দিয়েছে ।
ইতিহার প্লেন টি শুধু রান ওয়েতে দৌড়োনোর পর গভীর আকাশের বুকে ডানা মেলে ওড়ার অপেক্ষায়। চেনা মাটির নিভৃত দেওয়াল ,মাটির উঠোন এক টুকরো সবুজে ঘেরা বাগানের প্রশান্তির সাথে চেনা অচেনা মানুষের ভালবাসায় ভরা মুখগুলোর আকর্ষণ শ্রী সমানে অনুভব করছিল । চির চেনা জগতের বাইরে বহু সহস্র যোজন দূরে বসে থেকেও এতদিন নতুন ঐতিহ্যময় ধনী পৃথিবীর আড়ম্বরের রাজ প্রাসাদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে ও নিজের দেশ, নিজের শহর নিজের আবাস ভূমি কে ভোলেনি শ্রী । মন ছুটে চলেছে সেই আদি অকৃত্রিম মাটির টানে। ও ভেসে চলেছে মেঘের পাহাড় ডিঙিয়ে মেঘের সমুদ্র, মেঘের স্বপ্ন পুরি ও পার হয়ে বেলা শেষের পশ্চিম আকাশের পথে। কলকাতায় পৌঁছতে সাঁঝের আঁধারের ছায়ায় রাত নামবে।
তবুও শ্রীর ভারাক্রান্ত কান্না ভেজা মন নিমেষে পৌঁছে যায় ফেলে আসা কাইজার স্ট্রীটের বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িটির চারতলার ফ্ল্যাটের নিভৃত কোণে। মনেমনে সস্নেহে আশীর্বাদের প্রশস্ত হাত টি রাখে অদৃশ্য তিতিরের মাথার ওপর। পরমেশ্বরের কাছে একান্ত নিবেদনে প্রার্থনা জানায় ভালোরেখো তুমি তাকে ,ওর কঠিন স্বপ্ন তুমি সফল করতে পাশে থেকো। নির্বিঘ্নে রেখো ওকে,জয় হোক তোমার । ভালোথাকুক তিতির আর ওর ভালোবাসার স্বপ্নের শহর বার্লিন।
0 Comments