জ্বলদর্চি

আমড়া /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬৭
আমড়া

ভাস্করব্রত পতি

'তিন অক্ষরে নাম শুনলে জিহ্বায় আসে জল, 
শেষের অক্ষর ছেড়ে দিলে হয় রসাল ফল'। 
ঢাকা এলাকার মানুষের মুখে এই ধাঁধা শোনা যায়। তেমনি বর্ধমান জেলা নিয়ে একটি জনপ্রিয় লোকছড়াতে এসেছে আমড়ার প্রসঙ্গ -- 'আম আমড়া কুঁজড়া ধান / এই তিন নিয়ে বর্ধমান'। আবার শোনা যায় -- 'আম আমড়া শিমুল / ফাগুনের জলে নির্মূল'। গ্রামবাংলার অতি পরিচিত এই আমড়া নিয়ে ধাঁধা ও লোকছড়ার পাশাপাশি প্রবাদেরও ছড়াছড়ি। প্রবাদে রয়েছে 'আমড়া কাঠের ঢেকি'। যদিও তা কখনও হয়না বাস্তবে। প্রবাদের আঙিনায় পাই -- 'কোথাকার কে / আমড়া ভাতে দে', 'সারাদিন বড়শি হাতে / সন্ধ্যা বেলায় আমড়া ভাতে', 'মানি তো শালগ্রাম / না মানি তো আমড়ার আঁটি' ইত্যাদি। কোনও কাজে ব্যর্থ হলে আমরা বলে থাকি, 'আমড়ার আঁটি চোষো'। 
গাছে ঝুলছে আমড়া ফল

অম্লপ্রিয় বাঙালির কাছে বেশ আগ্রহের ফল এই আমড়া। সুদূর পলিনেশিয়া থেকে আগত আমড়া একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল গ্রামবাংলায়। তাই একে 'বিলিতি ফল' বলে। আমের সাথে নামের মিল রয়েছে কিছুটা। কিন্তু জনপ্রিয়তায় এই দুটি ফল দুই ভিন্ন মেরুর। কথায় বলে -- 'আমড়ায় আর আমে / জামরুলে আর জামে'। লোকমুখে শোনা যায় -- 'আমড়াতলায় যদি আম পাই / তবে আমতলায় কেন যাই'। তেমনি বলতে শোনা যায় --  'আমড়া গাছে আম হয়না'। 

কেউ কেউ আমড়াকে আম্রাত, পীতনক, কপিচূড়া, আম্রাবর্ত, রসাঢ্য, কপিচূড়, অম্বরীয়, পীতন, বর্ষপাকী, ভৃঙ্গীফল, অম্বরাতক, তনুক্ষীর এবং অম্রবাটিক নামে অভিহিত করেছেন। তবে সংস্কৃতে আম্রাতক, হিন্দিতে অম্বাড়া, তামিলে মরিমঞ্চেতি, কন্নড়ে আমাতিকায়ি, মালয়লামে আম্বাঝাঙ্গা, তেলুগুতে কারাকায়া, টেরিমনোডী, ওড়িয়াতে আম্বড়া অর্থে আমড়াই বােঝায়। সিংহলীতে আম্বারাল্লা, কিউবাতে Ciruela, মেক্সিকোতে Jobo, নেপালীতে অমরা, কোস্টারিকাতে Gully Plum, ব্রাজিলে Cajá, Taperebá, Ambaló, পেরুতে Uvos এবং Mango Ciruelo বলা হয় আমড়াকে। এছাড়াও ইংরেজিতে বলে Wild Mango, Yellow Mombin, Hug Pulm, True Yellow Mombin, Golden Apple, Java Plum ইত্যাদি। তবে বিলিতি আমড়াকে বলে Otaheite apple। আমড়ার অপর নাম কপীতন। 'কপীনাং ইং লক্ষনীং তনোতি' অর্থাৎ কপিকূলের লক্ষ্মী বৃদ্ধি করে। আমড়া গাছের পাতা বানরদের খুব প্রিয় খাদ্য এবং পথ্য। বিশেষ করে বানর শিশুর জন্মের সময় আমড়া গাছের দিকে ছুটে যায় বানরী। এটি Anacardiaceae পরিবারের অন্তর্গত। ল্যাটিন পরিভাষায় আমড়াকে বলা হয় Spondias mangifera willd। আরও যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে, সেগুলি হল --
Spondias pinnaata Kurz
Spondias mombin
Spondias aurantiaca Schumach. & Thonn
Spondias dubia A. Rich
Spondias dulcis
Spondias graveolens Macfad
Spondias lutea L
Spondias oghigee G. Don
Spondias pseudomyrobalanus Tussac

চরক সূত্রস্থানের ২৭ অধ্যায়ে ১০১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে- 
'মধুরং বৃংহণং বলামাম্রাতং তর্পর্ণং গুরু। 
সস্নেহং বৃষ্যং বিষ্টম্ভ জীর্য্যতি'।
অর্থাৎ আমড়া যদি মিষ্টি হয়, তবে তা বৃংহণ, বলকর, গুরু, তর্পক, স্নিগ্ধ কিন্তু শ্লেষ্মাকারক আর বৃষ্য এবং বিষ্টম্ভের সঙ্গে জীর্ণ হয়। আবার সুশ্রুত সংহিতায় সূত্রস্থানের ৪৬ অধ্যায়ের ১৪২ সূত্রে উল্লেখ রয়েছে আমড়ার। এখানে অবশ্য আমড়া গাছের ছালের উপকারীতা ব্যক্ত করা হয়েছে। 

মোটামুটি এই গাছটি ২৫ - ৩০ ফুট লম্বা হয়। একটি ডাঁটায় সমান্তরালভাবে কয়েক জোড়া পাতা ও ডাঁটার আগায় একটি পাতা থাকে। ফল পাকলেই গাছের সব পাতা ঝরে যায়। আবারও মাঘ ফাল্গুন নাগাদ গাছে মুকুল হয়। ছোট আমড়ার ফলে আঁঠি বা বীজ নরম থাকে। একটু বড় হলে আঁঠি শক্ত হয়ে যায়। নরম বীজযুক্ত আমড়ার টক বা চাটনি বেশ উপাদেয়। কার্তিক অগ্রহায়ণে আমড়া পেকে যায়। থোকা থোকা অবস্থায় ঝুলতে থাকে। পাকা আমড়ার রঙ পাঁউশুটে হয় এবং আলাদা এক ধরনের গন্ধ হয়। আমড়া নাকি আঁটি সর্বস্ব। তাই বলা হয় -- 'হায়রে আমড়া / আঁটি আর চামড়া' কিংবা 'গায়ে নেই ছাল চামড়া / খুঁটে খায় কাঁচা আমড়া'। এই পাকা শুকনো আমড়া নুন মাখিয়ে চুষে চুষে খায় গ্রামের মানুষজন। আমড়া এমনই এক ফল, যা কচি কিংবা পাকা সবসময়ই খাওয়া যায়। তাই নিয়ে ছড়ায় পাই -- 'আমড়া চালতা তাল / আবালবৃদ্ধ ভাল'। অর্থাৎ এগুলি কচি অবস্থা থেকেই ভালো। 

আমড়া গাছের নামে অনেক গ্রামনামের সন্ধান পাওয়া যায় এই বঙ্গে। যেমন— আমড়াগাছিয়া, আমড়াতলিয়া, আমড়াতলা, আমড়াগোয়াল ইত্যাদি।
আমড়া + তলা > আমড়াতলা > আমড়াতলিয়া 
আমড়া + গােয়াল > আমড়াগােয়াল 
অর্থাৎ গােয়ালঘরের পাশে থাকা আমড়াগাছ যে এলাকার পরিচিতি জ্ঞাপক চিহ্ন। 

আমড়ার ব্যবহার রান্নাঘরে বেশি হলেও এর ভেষজগুণ বেশ রয়েছে। খসখসে চামড়া থাকলে, যৌন উত্তেজনা ছাড়াই শুক্র নির্গত হলে, খাবারে অরুচি হলে, গায়ে জ্বালা জ্বালা করলে, শরৎকালে পিত্তবমি হলে, অগ্নিমান্দ্য নিরসনে, শুক্র গাঢ় করতে, হাতে পায়ে হাজা হলে, রক্ত আমাশা হলে আমড়ার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন বৈদ্যকূল। মোটামুটি ১০০ গ্রাম আমড়ায় থাকে শর্করা ১৫ গ্রাম, প্রোটিন ১.১ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫৫ মিলিগ্রাম, আয়রন ৩.৯ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৮০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি ১০.২৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৯২ মিলিগ্রাম এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ ০.৬ মিলিগ্রাম।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments