জ্বলদর্চি

পাঠপ্রতিক্রিয়া: কাব্যগ্রন্থ -হৃদয়ে আঁকা কবিতা (কবি-ভবেশ মাহাত)/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

পাঠপ্রতিক্রিয়া: কাব্যগ্রন্থ -হৃদয়ে আঁকা কবিতা (কবি-ভবেশ মাহাত)

আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 


এ বড়ো সুখের সময় নয়।বড়ো যন্ত্রণার,বড়োই নিরুপায়তার। পাশাপাশি হয়তো সংশ্লিষ্ট হওয়ার,সংশুদ্ধ হওয়ারও।অযুত সমস্যাদীর্ণ সময়রেখা পাকে পাকে জড়িয়ে নাভিশ্বাস উঠিয়েছে আজ আমাদের,দেশ,কাল,সাহিত্য…সব জায়গাতেই আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। 
তরুণের চোখে স্বপ্ন নেই,সমাজ অন্দরে নৈতিকতা নেই,যাপন যোজনায় নিরাপত্তা নেই,চারিদিক জুড়ে শুধু হাহাকার আর হতাশা। এবং সেই আঁধারের গ্লানি আমাদের সবাইকে এমন গভীর ভাবে আক্রান্ত করে চলেছে প্রতিনিয়ত যে নান্দনিকতার মৃদুল স্পর্শটুকুও আমরা এড়িয়ে চলতে চাইছি সচেতনে। কবিতা পড়তে ভালো লাগছে না, গানে কোন আনন্দ অনুভব আসছে না, দিনের আলোর দাহপ্রদাহে সৃষ্টির মাহাত্ম্য খুঁজতে চাইছি না…
এক গভীর দুঃসময় যেন অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে  সবাইকে। শারীরিক অসুস্থতা যেভাবে মনকেও বিষন্ন করে তোলে প্রতিদিন; অনেকটা ঠিক তেমনই।অথচ এ আঁধার থেকে সঠিক মুক্তির পথও যে জানা নেই আমাদের।

 আমরা যারা কবিতা পড়তে ভালোবাসি আজও, প্রবলভাবে আশা নিয়ে বাঁচি, তারা ভীষণ ভাবে চাইছি এ কালো কেটে যাক,”If winter comes, can spring be far behind?”

এমন সব মনকেমনিয়া কথাবার্তা চলছিল কয়েকদিন আগেই জ্বলদর্চি পত্রিকার নববর্ষের বৈঠকী আড্ডার ঘরোয়া আসরে। অনেক গুণী মানুষ ছিলেন, প্রখ্যাত চিকিৎসক,কবি-লেখক, অধ্যাপক, শিক্ষক।সবার মুখে এবং কথায় কমবেশী ব্যাথার ছোঁওয়া,যুগযন্ন্রনা…। 
তবু তারমধ্যেও লক্ষ্য করছিলাম,একটি বাচ্চা তার শিশুসুলভ স্বাভাবিক চঞ্চলতায় কখনও হাসছে, কখনও আপনমনে কথা বলছে,কখনও বাবার কোলে উঠে বিষন্ন পরিবেশটি ক্ষণিকের জন্য হলেও আলো করে দিচ্ছে।ওর বাবা ওকে শান্ত করতে চাইলেও আমাদের অনেকেরই মনে হচ্ছিল,ও এমনই থাক, নিজস্ব হাসির আলো নিয়ে।

🍂
ad

সে কথা বলতে গিয়েই আলাপ হয় ওর বাবার সঙ্গে। শ্যামলা দোহারা চেহারা ,স্বভাববিনয়ী, উদ্ভাসিত চোখের এক তরুণ শিক্ষক;নাম ভবেশ মাহাতো।
কবিতা লেখেন, ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি কাব্য গ্রন্থ। সেই দিনও প্রকাশ পেল আরো দুইখানি। প্রথমটির নাম “হৃদয়ে আঁকা কবিতা”
দ্বিতীয়টি শিশুতোষ ছড়ার বই,”পাজির পাজামা”

গ্রন্থ সমালোচক নই,তৎসংক্রান্ত প্রথাগত শিক্ষাও নেই।তবু নিজে যেহেতু টুকটাক লিখি, কবিতা বা ছড়া সম্পর্কে আপনার মনোভাবটুকু জানাতেই তুলে নিলাম সদ্য উপহার পাওয়া বইদুটি।
প্রথমে বলি, কাব্যগ্রন্থের কথা।একটি ক্ষীণদেহী পুস্তিকা, সাদা ক্যানভাসের তলা জুড়ে এলোমেলো পাতার আঁকিবুঁকি,মাঝের বৃত্তে কালো রঙে আঁকা একখানি নারীমুখ। প্রচ্ছদ দেখেই বোঝা যায়,কাব্যটি প্রেমের কবিতার, যার উদ্দেশ্যে লেখা, তিনি কোন এক ‘তুমি’, অর্থাৎ হয়তো প্রিয়া বা দয়িতা।পাতা ওল্টাতেই দেখি,
উৎসর্গ পত্রে অগ্রজ প্রতিম কবির নাম,প্রকাশক শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক ত্রিপাঠি এবং জ্বলদর্চি।
সর্বমোট ত্রিশটি কবিতা ,সহজ কথায় সহজ ছন্দে গ্রথিত। আত্মকথনে কবি বলেছেন,

'তুমি' শব্দের মধ্যে যে পরম ব্রহ্মত্ব আছে তার অনুসন্ধান করাই জীবনের লক্ষ্য, এই শব্দ দিয়ে কবিতা রচনা করেননি, এমন কেউ নেই। কবির মতে তোমাকে নিয়ে আকাশ আঁকা যায়, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন চুরি করা যায় রোদ্দুরের থেকে হৃদয়ে এঁকেছি প্রেম, যা হয়ে উঠেছে কবিতা। তাই বইয়ের নাম রাখলাম 'হৃদে আঁকা কবিতা'। তোমাকে নিয়ে না ভেবেও দেখেছি কোনো না কোনো অছিল ভাবনার অতল গভীরে প্রবেশ করা যায়। এক অর্থে পাঠকও আমার সে প্রেমিকা। সুতরাং কবিতাগুলো পাঠকের ভালো লাগলে প্রেমের গভীরত বাড়বে নিশ্চিত। আসুন কবিতার কাছে নতজানু হই, বিশ্বাস ভেঙে গেলে স্বপ্নেরও অপমৃত্যু ঘটে।

 কবিতা গুলি পড়তে পড়তে তাদের অনায়াস চলন,মাটি ছুঁয়ে ভেসে থাকা ভাব সম্মিলনে আমরা মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। চাওয়া পাওয়ার বাইরে গিয়ে শ্বাশ্বত প্রেমের কাছে তাই তাঁর নতি,

‘ভালোবাসার আসল নকল করবো না আর চাষ
শুধুই ভালো বাসবো আমি তোমায় বারোমাস ‘

কিংবা,
‘ও মেয়ে তোর হাজার কথা রাখ
আমার সাথেই মুহুর্তকাল থাক’...দেহজ প্রেম পেরিয়ে তা অনন্ত যাত্রী হয়ে পড়ে।
এই রকম অজস্র মনি মুক্তা ছড়ানো আছে ছোট্ট বইটির পাতায় পাতায়।তবে শেষ করার আগে ‘অভিমান’কবিতাটি না পড়িয়ে পারছি না,

“সেদিন ঠিক কী কারনে জানিনা 
আকাশ ভেঙে পড়েছে রাস্তার উপর
 তুমি আর আমি হেঁটে চলেছি 
বৃষ্টির মোটা মোটা ফোঁটার মাঝখান দিয়ে, 
পথ হারিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে নতুন পথ 
তৈরি করে নিচ্ছে আমাদের বৃষ্টিমুখর বিকেল, একসময় রাত্রি নেমে আসে পৃথিবীর সমস্ত আয়োজনে, 
সেদিন পুরো আকাশ জুড়ে তারাদের অভিমান 
জমা হয়, মেঘেদের কাছে নালিশ জানায় 
আমাদের পথচলা বিষয়ে। 
আমরা চরৈবতির মন্ত্র জপতে জপতে
 চুম্বনের স্বাদ গ্রহণ করি।
এভাবেই পৃথিবীও একসময় অভিমানী হয়ে ওঠে।”

বড়ো সুন্দর, বড়োই সুন্দর অনুভবে ভরে ওঠে সমাজ, রাজনীতি, প্রকৃতির করার প্রদাহে তাপদগ্ধ হৃদয়।
এই পুস্তিকাটি যেন মলম,আরামের।স্নিগ্ধ আবেশের। আশা করছি,পাঠকপ্রিয় হবে বইটি, উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হোক লেখকের কলমের।

Post a Comment

0 Comments