মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫৪
আভা মাইতি (স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, খেজুরী)
ভাস্করব্রত পতি
১৩৩০ সালের ৯ ই বৈশাখ। ১৯২৩ এর ২২ এপ্রিল। দিনটা ছিল রবিবার। নন্দীগ্রামের কালীচরণপুর গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আভা মাইতি। কিন্তু আদপে তাঁর নাম ছিল নন্দরাণী। ঠাকুর্দা বিশ্বনাথ মাইতি তাঁর আদরের নাতনির নাম রেখেছিলেন এটাই। বাবা ছিলেন বিখ্যাত গান্ধীবাদী কংগ্রেস নেতা নিকুঞ্জবিহারী মাইতি। আর মা অহল্যাদেবী। তিনিও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁদের তিন কন্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় আভা মাইতি। যিনি রাজনৈতিক কৃতিত্ব এবং সামাজিক অবদানের জন্য সকলের কাছে হয়ে উঠেছিলেন 'অগ্নীকন্যা'।
জহরলাল নেহেরুর সাথে আভা মাইতি
নিকুঞ্জবিহারী মাইতি। একজন আদর্শ স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং শিক্ষাব্রতী। স্বাধীনতার পর তিনি ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। একসময় নন্দীগ্রামের ব্রজমোহন তিয়াড়ী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বেতন ছিল মাসিক ১০০ টাকা। পরবর্তীতে ঐ চাকরি ছেড়ে মাত্র ৫০ টাকা বেতনে খেজুরীর কলাগেছিয়া জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। অবশেষে এই চাকরিও ছেড়ে দিয়ে সর্বসময়ের কংগ্রেস কর্মী হিসেবে নিঃস্বার্থ স্বদেশসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এহেন ব্যক্তির কন্যা আভা মাইতি। স্বাভাবিকভাবেই পিতার কর্মতৎপরতা এবং গুণগত মান কন্যার ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছে। ১৯৪২ এর ১৬ অক্টোবর দুর্গোৎসবের সপ্তমী তিথিতে ঘটে যাওয়া চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিল বিধ্বংসী ঘূর্ণীঝড় ও প্রলঙ্করী বন্যার মাধ্যমে। সেসময় জেলায় মানুষের মৃত্যু হয় ১৪,৪৪৩ জন। এছাড়াও গবাদি পশু ১,৮৮,০০০ টি, গৃহধ্বংস ৫,২৭,০০০ টি, গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৬০০ টি। সেই দুর্বিপাকে পড়া জেলাবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অকুতোভয় আভা মাইতি। এরপর মন্ত্রী হয়েও বিপদে পড়া মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বারংবার।
দাঁতন ভট্টর কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে আভা মাইতি
আভার বাল্যশিক্ষা গ্রামের পাঠশালায়। নিকুঞ্জবিহারী মাইতি ডায়মন্ডহারবারের কাছে ফতেপুরে শ্রীনাথ ইন্সটিটিউশনে প্রধান শিক্ষক থাকার সময় ১৯৩৮ সালে সপ্তম শ্রেণিতে মেয়ে আভাকে ভর্তি করলেন কলকাতার বেথুন স্কুলে। ১৯৪০ সালে প্রাইভেটে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর প্রাইভেটে ১৯৪২ এ পাশ করেন আই এ। এরপর ১৯৪৪ এ বেথুন উইমেন কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন আভা। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইন কলেজে ভর্তি হয়ে এলএল.বি. পাশ করলেন ১৯৪৭ এ। এরপর সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর অনুপ্রবেশ।
যদিও তাঁর রাজনীতিতে পদার্পণ ঘটে মাত্র নয় বছর বয়সে। সেটা ছিল ১৯৩২ সালের কোনও একদিন। সেসময় খেজুরি থানার মৌহাটি গ্রামে মেদিনীপুর জেলার প্রবীণতম গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী শশীভূষণ ভৌমিকের বাড়িতে অনুষ্ঠিত মহিলা শিক্ষা শিবিরে যোগদান করেছিলেন তিনি। সেই শিবিরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় গান্ধীবাদী নেতা প্রফুল্লচন্দ্র সেন, পঞ্চানন বসু, নিবারণ দাশগুপ্ত, বিজয়কুমার ভট্টাচার্য এবং স্বামী পুরুষোত্তমানন্দ অবধূতদের সঙ্গে।
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ বিক্ষোভে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একত্রিত করে মিটিং মিছিল পিকেটিং করে বহু বিদ্যালয় অচল করে দেন। এদিকে তখন বিনা বিচারে কারাগারে বন্দী নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি। অকুতোভয় মহিলা কিন্তু পিছু হটেননি। নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত (১৯৯৬) কংগ্রেস বিধায়ক দেবীশংকর পণ্ডা তাঁর 'সূর্যাস্তের স্মৃতি' নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, 'আভা মাইতিকে প্রথম দেখি ১৯৬২ সালে। তখন আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্র। ভারত-চিন যুদ্ধ চলছে। । উনি এসেছেন আমাদের নন্দীগ্রামের স্কুল মাঠে। সভা করে প্রতিরক্ষা দপ্তরের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে। মন্ত্রী হিসেবে যে মহিলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন তাঁকে কোনোমতে সুন্দরী বলা যায় না। কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন কিছু ছিল যা (বোধ করি তখন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি) মানুষের স্বাভাবিক সম্ভ্রম আদায় করে নেয়'!
বাবা এবং মা -- নিকুঞ্জবিহারী মাইতি ও অহল্যাদেবী
আভা মাইতি পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির মহিলা শাখার সম্পাদিকা পদে নিযুক্ত হন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত। এই দশ বছর তাঁর নিরলস এবং অবিশ্রান্ত সেবা, কর্মদক্ষতা, বিচক্ষণতা ও কর্তব্যপরায়ণতা পর্যবেক্ষণ করেছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। ১৯৫৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ খাদি কেন্দ্রের যুগ্ম সম্পাদক হন। ১৯৬০ সালে মেদিনীপুর কংগ্রেস কমিটির সভাপতি এবং ১৯৬০-১৯৬২ তে সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬০-১৯৬২ সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হওয়ার পাশাপাশি 'সত্যাগ্রহ' পত্রিকার সম্পাদক এবং 'যুগের ডাক' এর সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে কলকাতার পি ১৪, দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট থেকে এই 'সত্যাগ্রহ' সাপ্তাহিক পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন তিনি। এটি ফুলস্কেপ ৮ পৃষ্ঠার কাগজ ছিল তখন। দাম ছিল ছয় পয়সা। আর প্রকাশক ছিলেন বিধায়ক প্রবীরচন্দ্র জানা।
তাঁর কর্মতৎপরতা এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতার ওপর ভরসা করে কংগ্রেস নেতৃত্ব বিধানসভা আসনে প্রার্থী করে আভা মাইতিকে। ১৯৫২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে খেজুরী ভগবানপুর কেন্দ্র থেকে সংযুক্ত সংরক্ষিত ও সাধারণ আসনে কৌস্তভকান্তি করণের সঙ্গে কংগ্রেস প্রার্থীরূপে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তিনি। সেসময় তিনি তাঁর বক্তব্য দেওয়ার কারিকুরি এবং প্রাঞ্জল ভাষনের মাধ্যমে বিধানচন্দ্র রায়ের নজর কেড়ে নেন। তবে ১৯৫৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভগবানপুর কেন্দ্রে পিএসপি প্রার্থী বসন্তকুমার পণ্ডার কাছে পরাজিত হন।
এরপর রাজ্যসভার (১৯৬০ - ১৯৬২) সাংসদ হন তিনি। তবে আবারও ভগবানপুর কেন্দ্রে দুবার বিধায়ক হন ১৯৬২ - ১৯৬৯ সালের মেয়াদকালে। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে ভগবানপুর বিধানসভা কেন্দ্রে পিএসপি প্রার্থী বসন্তকুমার দাসকে ৩৬ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হন। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভায় তিনি স্থান পান। তাঁকে উদ্বাস্তু কল্যান পুনর্বাসন ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের (নির্বাচন এবং সংবিধান) ভারপ্রাপ্ত পূর্ণমন্ত্রী করা হয়। ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে আবারও এই ভগবানপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বাংলা কংগ্রেস প্রার্থী বনবিহারী মাইতিকে পরাজিত করে বিজয়ী হন আভা মাইতি। আসলে তাঁর নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতা এবং পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল। ১৯৭৭ - ১৯৮০ পর্যন্ত পাঁশকুড়া লোকসভার সাংসদ হয়েছেন। সেসময় মোরারজী দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বে ভারত সরকারের শিল্প দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয় তাঁকে।
১৯৫৯ সালে নাগপুর কংগ্রেসে ইন্দিরা গান্ধী সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। একই সাথে আভা মাইতি নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদিকা পদে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু। আভা মাইতির পদটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ক্ষমতাযুক্ত। এরপর বেঙ্গালুরু কংগ্রেসে ১৯৬০ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। কিন্তু তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে পুনঃবহাল থাকেন। হয়ে ওঠেন ভারতের একজন অন্যতম পদমর্যাদার নেত্রী।
১৯৭১ সালে কানাডার ফেডারেশন অফ প্রোফেশনাল উইমেন এর দ্বাদশ কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন এই মহিলা নেতৃ। গিয়েছেন আরও বহু দেশে। ১৯৬০ নাগাদ উদ্ভুত উদ্বাস্তু সমস্যার মোকাবিলায় তিনি ছিলেন অগ্রণী পথিক। তিনি ছিলেন বাজকুল মিলনী মহাবিদ্যালয়ের (১৯৬৪) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। নরঘাট (মাতঙ্গিনী সেতু) সেতু নির্মানেও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। দাঁতন ভট্টর কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও তাঁর নাম উচ্চারিত হয়।
নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত (১৯৯৬) কংগ্রেস বিধায়ক দেবীশংকর পণ্ডার 'সূর্যাস্তের স্মৃতি' নিবন্ধ থেকে- 'আভা মাইতিকে প্রথম দেখি ১৯৬২ সালে। তখন আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্র। ভারত-চিন যুদ্ধ চলছে। উনি এসেছেন আমাদের নন্দীগ্রামের স্কুল মাঠে। সভা করে প্রতিরক্ষা দপ্তরের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে। মন্ত্রী হিসেবে যে মহিলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন তাঁকে কোনোমতে সুন্দরী বলা যায় না। কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন কিছু ছিল যা (বোধ করি তখন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি) মানুষের স্বাভাবিক সম্ভ্রম আদায় করে নেয়'!
পশ্চিমবঙ্গ খাদি কেন্দ্রের (১৯৫৮) যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। এই পদে থেকে তিনি খাদিশিল্পের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। মেদিনীপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাস সমিতি, বঙ্গীয় মাহিষ্য সমিতি এবং মেদিনীপুর সম্মিলনীর (১৯৯৩-১৯৯৪) সভাপতি ছিলেন। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ১৪০১ এর ১৭ ই আষাঢ় (২ জুলাই ১৯৯৪) তাঁর মৃত্যু হয়। ঈশ্বরচন্দ্র প্রামানিক লিখেছেন, 'বহু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ভোগ্যপণ্য সমস্যা সমাধানে যে কনজিউমার অ্যাকশন ফোরাম গঠিত হয় আভাদেবী ছিলেন তার চেয়ারম্যান। এছাড়া উইমেন্স কো অর্ডিনেটিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। অনূঢ়া থেকে আজীবন বাংলা এবং ভারতের সেবা করে গেছেন তিনি। কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও তাঁর প্রিয় মেদিনীপুর জেলাকে দু'হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন আজীবন। তাই জীবন সায়াহ্নে অসমাপ্ত মেদিনীপুর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং মৃতপ্রায় মেদিনীপুর সম্মিলনীর পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রচুর শ্রম ও সময় দিতে হয়েছিল'।
🍂
0 Comments