বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬৮
পারুল
ভাস্করব্রত পতি
'চম্পা পারুল যূথী টগর চামেলা।
আর সই সইতে নারি ফুল ঝামেলা॥
সাজায়ে বন ডালি
বসে রই বনমালী
যারে দিই এ ফুল সেই হানে হেলাফেলা॥
কে তুমি মায়ামৃগরতির সতিনি গো?
ফুল নিতে আসিলে এ বনে অবেলা॥
ফুলের সাথে প্রিয়ফুল মালীরে নিয়ো,
তুমিও একা সই, আমিও একেলা'॥
-- কাজী নজরুল ইসলাম
পারুল হল প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং গভীরতার প্রতীক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাধিক লেখায় মেলে পারুলের কথা। কবির প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের গানে উঠে এসেছে পারুলের কথা --
'ওরে বকুল, পারুল, ওরে শাল-পিয়ালের বন,
কোন্খানে আজ পাই
এমন মনের মতো ঠাঁই
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
দিয়ে আমার সকল মন॥
সারা গগনতলে
তুমুল রঙের কোলাহলে
মাতামাতির নেই যে বিরাম কোথাও অনুক্ষণ
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
দিয়ে আমার সকল মন॥
ওরে বকুল, পারুল, ওরে শাল-পিয়ালের বন,
আকাশ নিবিড় ক’রে
তোরা দাঁড়াস নে ভিড় ক’রে-
আমি চাই নে, চাই নে, চাই নে এমন
গন্ধরঙের বিপুল আয়োজন।
অকূল অবকাশে
যেথায় স্বপ্নকমল ভাসে
দে আমারে একটি এমন গগন জোড়া কোণ
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
বাংলাদেশের একমাত্র পারুল বৃক্ষ
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে পাই - "কনক কেতকী পারুল দুলালী"। এই পারুল আসলে সুবর্ণরেখার উপত্যকা এলাকার একটি ফুল। এটি অবশ্য পাটলী, পাটলা, অম্বুবাসী, অলিপ্রিয়া, অমোঘা, মধুদূতী, কৃষ্ণবৃন্তা, বসন্তদূতী, Trumpet নামেও পরিচিত। থেরবাদ বুদ্ধ মতে, কোথাও কোথাও এই গাছকে বোধীবৃক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৌদ্ধরা অনেক জায়গায় একে সরণকর এবং বিপাসি নামেও উল্লেখ করেছেন। সাধারণত পারুল দু ধরনের হয়। একটি লাল পারুল এবং অন্যটি ঘন্টা পারুল বা সাদা পারুল। এছাড়াও দেখা যায় রক্ত পারুল, পিত পারুল ও লতা পারুল। বাংলার সব জায়গায় মোটেও মেলেনা এই গাছ। অত্যন্ত বিরল এই পারুল গাছকে নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি আজিজুল হক কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম শফিকুর রহমান 'পারুলের সন্ধানে’ নামে একটি বইও লিখেছেন।
প্রায় ৪০ - ৫০ ফুট উঁচু এ গাছটি বিরল প্রজাতির গাছ হিসেবেই পরিচিত। এই গাছের পৃষ্ঠদেশ ধূসর কালচে ধরনের। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ। পাতার আয়তন ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি। শীতকালে গাছটির সব পাতা ঝরে যায়। এরপর এপ্রিল মাসে ফের ফুলে পাতায় ভরে ওঠে।
'বর্ষ তখনাে হয় নাই শেষ,
এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা।
বাতাস হয়েছে উতলা আকুল,
পথতরুশাখে ধরেছে মুকুল,
রাজার কাননে ফুটেছে বকুল
পারুল রজনীগন্ধা'।
-- কথা ও কাহিনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গন্ধহীন সাদা ফুলগুলি ১ ইঞ্চির মতো লম্বা। ফলগুলি বাঁকানো, ১০ ইঞ্চি মাপের হয়। লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠেও শোনা যায় এই পারুলের কথা --
'সাত ভাই চম্পা জাগরে জাগরে
ঘুম ঘুম থাকে না ঘুমেরই ঘোরে
একটি পারুল বোন আমি তোমার
আমি সকাল সাঁঝে শত কাজের মাঝে
তোমায় ডেকে ডেকে সারা
দাও সাড়া গো সাড়া
'বিগনােনিয়েসী' পরিবারভুক্ত পারুলগাছ উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় পরিচিত Stereospermum cheloniodes (পূর্বের নাম - Bignonia suaveolens Roxb) নামে। পারুলের অন্যান্য প্রজাতিগুলি হল --
Bignonia chelonoides L.f.
Bignonia gratissima K.D.Koenig ex DC.
Stereospermum chelonoides
Heterophragma chelonoides (L.f.) Dalzell & A.Gibson
Heterophragma suaveolens (Roxb.) Dalzell & A.Gibson
Hieranthes fragrans Raf.
Spathodea suaveolens (Roxb.) Benth. & Hook.f.
Stereospermum suaveolens (Roxb.) DC.
পারুল গাছের সংস্পর্ষে সৃষ্ট গ্রামনামগুলি হতে পারে --
পারুল + ডাঙ্গা > পারুলডাঙ্গা (শান্তিনিকেতন)
পারুল + ইয়া > পারুলিয়া
পারুল + বাড়ি > পারুলবাড়ি
পানি + পারুল > পানিপারুল
তবে কেউ হয়তাে পানি বা জলের ফোঁটা থেকে পানিপারুল হয়েছে বলতে পারেন। স্থানীয় মানুষের মত এমনই। তা কিন্তু নয়। পানি পদবীধারী সদগােপদের মেদিনীপুরে দেখা যায়। যাঁরা কৃষিজীবী সদগোপ বা সচ্চাষি। ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাইতির মতে, গােয়ালাদের যে শাখা কৃষিকর্মা হয়ে বিত্তবান হয়ে উঠেছেন, তাঁরা সদগোপ।
পুরুল > পারুল
পুর + উল > পুরুল
এখানে 'পুর' অর্থে নদীগর্ভ বা খাল, 'উল' অর্থে কদৰ্মভূমি বা কাদা জমি। এটি দ্রাবিড়ীয় শব্দ। অর্থাৎ নদীর ধারের কাদা জমি।
পানি + পুরুল > পানিপারুল
অতএব সব মিলিয়ে হল পানিদের নদীগর্ভের কর্মভূমি। বা বলা যায় পানি পদবিধারী সদগােপরা নদীগর্ভের বা খালের যে কর্দমাক্ত জমিতে চাষাবাদ করে তাই 'পানিপারুল'। ফলে এই গ্রামনামের পিছনেও উদ্ভিদ অনুষঙ্গ বিদ্যমান। পুরুল, পােরলদা, পারুলিয়া, পুরুলিয়া, পুরুনিয়া গ্রামনামগুলি এভাবেই সৃষ্ট। যাঁরা এখানে পুরুল গাছ বা দীর্ঘ পটোলিকা গাছ বা LUFFA AEGYTICA-র কারণে গ্রামনাম জন্ম নিয়েছে ভাববেন, তাদের ভুল হবে।
পাটলিক > পারুল
পারুল্যা > পারুলিয়া
এই পারুল গাছের মূল ডায়াবেটিস রোগের উপশম করে। এছাড়াও কার্বাঙ্কল, পাইলস, চুলকুনি, স্ক্যাবিস, আলসার রোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।
🍂
0 Comments