ম্যাপেল পাতায় রবি
কমলিকা ভট্টাচার্য
ছেলের পুরোনো সার্টিফিকেট খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ কলির চোখে পড়ে এক শুকনো ম্যাপেল পাতা—পাতার গায়ে সাঁটা হলুদ কাগজে লেখা একটি চরণ।
কলি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। স্মৃতির দরজা খুলে যায় নিঃশব্দে। ফিরে যায় সেই সুদূর বিদেশি শহরে, যেখানে তার জীবনের এক নীরব অধ্যায় রচিত হয়েছিল।
প্রবাসে কলির দিন শুরু হতো ভোরে—ছেলেদের স্কুল, নিজের কলেজ, সংসারের দায়িত্ব সামলে বিকেলে একটু নিঃশ্বাস নেবার আশায় সে যেত কাছের পার্কে, এক ম্যাপেল গাছের ছায়ায়।
সেদিনও সে বসেছিল সেখানে। ছেলেরা খেলায় মগ্ন। হঠাৎ ভেসে এলো গান— “পুরানো সেই দিনের কথা, ভুলবি কি রে হায়…”
চমকে ওঠে কলি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে এক বৃদ্ধ ইংরেজ ভদ্রলোক বেঞ্চে বসে আপনমনে গাইছেন। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ—অলীক, অথচ গভীর বাস্তব।
পরদিনও যায় কলি। এবার ভদ্রলোক গাইছেন— “দিবস রজনী আমি যেন তার আশায় আশায় থাকি…”
সেই সুরে গলে যেতে থাকে প্রবাসের ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতা আর এক অপার্থিব শান্তি।
একদিন সাহস করে কলি আলাপ করে তাঁর সঙ্গে। নাম হ্যারি ম্যাথিউ। একসময় কেমব্রিজের পিয়ানো শিক্ষক ছিলেন। প্রেমে পড়েছিলেন এক বাঙালি ছাত্রীর—নাম সরোজা। সে-ই শিখিয়েছিল তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
হ্যারি বলেন, “তোমাদের ভাষা বুঝি না, কিন্তু এই গানগুলোয় আমার ভালোবাসার গন্ধ পাই। সরোজা তো চলে গেছে, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে গেছে।”
কলি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কোন গানটা সবচেয়ে ভালোবাসেন?”
হ্যারি মৃদু হেসে বলেন— “আমারও পরানো যাহা চায়, তুমি তাই গো…”
এরপর গানের বন্ধনে গড়ে ওঠে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব।
প্রতিদিন তারা একসঙ্গে বসে গান করে। কলি শেখে পিয়ানো, হ্যারি শেখে বাংলা উচ্চারণ।
প্রায়ই হ্যারি একটি গান গেয়ে ওঠেন— “অনেক দিনের আমার যে গান, আমার কাছে ফিরে আসে
তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন্ বাতাসে…”
এক বিকেলে তারা গাইছিল— “ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে,
আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে…”
কলির গলা কেঁপে ওঠে। হ্যারি চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন তার দিকে।
কলি বলে, “এই গানটা আগেও অনেকবার গেয়েছি। কিন্তু তখন বুঝিনি এর গভীরতা।”
হ্যারি জিজ্ঞেস করেন, “এখন?”
কলির মুখে নীরব হাসি। চোখে জল।
এক সন্ধ্যায় হ্যারি বলেন, “আজ তোমার জন্য একটা গান এনেছি। গানে গানে ভরিয়ে দেব তোমার হৃদয়।”
পিয়ানোয় ভেসে ওঠে সুর— “তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া...”
কলির চোখে ভেসে ওঠে কৈশোর, প্রেম, যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা এক ভালোবাসা। হ্যারির চোখেও জ্বলে ওঠে সেই আবেগ।
সে গেয়ে ওঠে— “সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে...
ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়…”
কলি গায়— “ভালোবাসি, ভালোবাসি…”
ফিরে যাওয়ার দিন এসে যায়। কলি বিদায় জানাতে যায়। হ্যারি ধীরে বলেন, “Can I kiss you?”
কলি মাথা নিচু করে। হ্যারি কপালে চুমু খায়।
তারপর এগিয়ে দেন এক খাম। “ভারতে ফিরে পড়বে, এখন নয়।”
আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী। কলির বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। খামটা খুলে পায় সেই ম্যাপেল পাতা, আর হলুদ কাগজে লেখা— “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম…”
তার বুক কেঁপে ওঠে। মনে পড়ে সেই গান— “তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে…”
সে পাতাটা ঠোঁটে ছুঁয়ে গাইতে থাকে— “কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।”
তার গান ভেসে চলে খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে—মিশে যায় হ্যারির পিয়ানোর সুরে, অদৃশ্য এক ধ্বনির সঙ্গে—
“কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে,
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে…”
রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন—
কলির হৃদয়ে, হ্যারির সুরে, আর সেই ম্যাপেল পাতায়।
একটি গান, একটি পাতা, একটি হৃদয়বন্ধন—এই ছিল কলির “ম্যাপেল পাতায় রবি”।
🍂
1 Comments
খুব সুন্দর!! রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে যথাযথ।
ReplyDelete