মার্কেজের খোঁজে
(সপ্তম পর্ব)
মলয় সরকার
এই প্লাজার নাম বলিভার প্লাজা হয়েছে সেই বিখ্যাত বীর সাইমন বলিভারের নামে। তাঁর এক ঘোড়ায় চড়া মূর্তি রয়েছে প্লাজার মাঝখানে। ১৮২১ সালে তিনিই যখন এখানে প্রথম প্রেসিডেন্ট হন তখন Paula Santander হন ভাইস প্রেসিডেন্ট আর তাঁর নামেও একটি পার্ক আছে বোগোটাতে, যার কথা পরে বলব।
এখানে দেখি সন্ধ্যা শুরু হতেই এসে গেছে নাচ গানের দল। এখানকার অনেক প্লাজাতেই এরকম নাচ গান হয়েই থাকে। অনেক মানুষ ভীড় জমিয়েছেন এখানে। অনেক গাছপালায় ঘেরা পার্কটি কিন্তু এত লোকজনের আসা-যাওয়া সত্বেও মোটেই অপরিচ্ছন্ন নয়।এটি ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। এর চারপাশে রয়েছে বাঁধানো রাস্তা সু-উচ্চ প্রাসাদোপম ঐতিহাসিক বাড়ি, ও Palace of Inquisition (Museo Histórico de Cartagena de Indias) এবং Gold Museum সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত যেগুলি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এবং রবিবারেও থাকে একটু কম সময়ের জন্য। এদের কথা বলছি পরে।
আমি স্থানীয় একটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললাম, ওদের সাহিত্যিকদের বা বিশেষ করে মার্কেজের ব্যাপারে। লোকটি খুব শিক্ষিত বলে মনে হয় নি, তবু দেখলাম, আমার মুখে মার্কেজের কথা শুনে আশ্চর্য হল। ওদের দেশের সাহিত্যিককে জানি বলে গর্বিতও হল বুঝলাম। সে বলল, সে দোকানে কাজ করে।সে লাইব্রেরীতে যায়, অল্পস্বল্প বই পড়ে। সেখানে ওঁর কথা শুনেছে। বই দেখেছে, তবে পড়ে নি।
ক্লক টাওয়ার বা Monnumento Torre Del Reloj শহরে ঢোকার প্রধান দরজা
এই পর্যন্ত এসে যদি সাইমন বলিভারের কথা না জানি বা বলি, খুবই অন্যায় হবে।
সাইমন বলিভার( ১৭৮৩-১৮৩০) ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার এক বিখ্যাত বীর বা নেতা, যিনি উদবুদ্ধ হয়েছিলেন ফরাসী বিপ্লব এবং নেপোলিয়নের বীরত্ব দেখে। তাঁকে দক্ষিণ আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বলে মানা হয়। কারণ তিনি স্পেনীয় অধীনতা থেকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন প্রথমে ভেনেজুয়েলাকে(১৮১৩ সালে) এবং পরে পরে বলিভিয়া, কলম্বিয়া (পানামা সহ) ,ইকুয়েডর পেরু, ইত্যাদি।এজন্য তাঁকে নাম দেওয়া হয়েছিল, “El Libertador” (The Liberator)।তিনি দু’শোর বেশি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন স্পেনীয়দের বিরূদ্ধে।এই বলিভারের নামেই হয়েছে বর্তমান বলিভিয়ার নাম , যার আগে নাম ছিল Upper Peru ।
🍂
এখানে আসার পরেই তিনতলার বারান্দা দিয়ে নীচের শহরের পরিচয় নিতে গিয়ে দেখি, নীচে হেঁটে যাচ্ছে ঠেলা গাড়ি নিয়ে একটি লোক খালি গায়ে আর হাঁকতে হাঁকতে ।ঠেলা গাড়িতে রয়েছে ভাঙ্গা ফুটো জিনিসপত্র।অর্থাৎ ও ভাঙ্গা জিনিসপত্র কিনবে, এই আর কি! দেখে নিজের দেশের কথা মনে এল।আর ভাবলাম, এরাও তো আমাদের মতই অর্থনীতিতে দুর্বল আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যেই পড়ে।
আমাদের আজ ফিরতে সন্ধ্যা হল। আগামীকালের ব্যবস্থা হল, একটা টুর পার্টি , এজেন্সিয়া টুর এর সাথে কার্তাহেনা ও স্থানীয় দ্রষ্টব্য দেখা। তবে এই শহর , অর্থাৎ, কার্তাহেনার যেটুকু অংশ পাঁচিল ঘেরা বা UNESCO Heritage বলে খ্যাত , সেই পুরানো শহর কিন্তু খুবই ছোট, এবং তার মধ্যে যেটুকু জায়গায় বিশেষ দ্রষ্টব্য গুলো আছে, সেগুলো পায়ে হেঁটে দেখাই যায় এবং পায়ে হেঁটে দেখাই ভাল। যদিও রাস্তায় গাড়ির অভাব নেই, তারাও ঘোরানোর জন্য মুখিয়ে আছে, নানা কোম্পানীর বা প্রাইভেট গাড়িও ঘুরছে। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, এই সমস্ত গাড়িগুলোর অনেকগুলোর কোম্পানীই জাল। ফলে বিশ্বাস করে ঠকতেই হতে পারে। তাই আমরা এখানে বা কোথাও যেতে হলে উবের বা ক্যাবিফাই ধরণের এপ যুক্ত গাড়িই নিয়েছি। রাস্তার গাড়ি কোথাও নিই নি।
যাই হোক, আজ সারাদিন বার বার টুর কোম্পানী মেসেজ, ফোন করে পরের দিনের ‘টুর’এর ব্যাপারে পাকা করে রাখল।
আমাদের যে থাকার জায়গা বা এ আর বি এন বি, তাতে স্বাধীনতা অনেক বেশি থাকে হোটেলের থেকে। ছেলেটি, যে বসে থাকে এর রিসেপশনে, মোবাইলে মগ্ন হয়ে , সেই জোনাথন কিংবা লেইদারও খুব ভাল। কোন জিনিস প্রয়োজন হলে তাকে ফোন করলেই, সঙ্গে সঙ্গে হাজির।এখানে নীচে সিঁড়ির মুখেই এটার গেট।সেটা সব সময়েই বন্ধ, একেবারেই তালা চাবি দিয়ে। বাইরের লোক ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারবে না।সেদিন বসে ছিল লেইদার আর আজ বসে আছে জোনাথন। আসলে এদের সময় বিশেষে ডিউটি বদলায়।
একদিন আমরা খাবার অর্ডার দিয়েছি আমাদের ‘জোমাটো’র বদলে এখানকার ‘র্যাপি’কে দিয়ে। তাদের লোক নীচে এসে দাঁড়িয়ে আছে, তবু উপরে উঠতে পারছে না, -তালা বন্ধ। শেষে অনেক করে বলাতে, চাবি খুলিয়ে তাকে আনা গেল।
পরদিন সকালে, আমাদের জড়ো হওয়ার কথা এখানকার ক্লক টাওয়ারে। এই ক্লক টাওয়ার যাকে বলা হয়, তার আসল নাম MONUMENTO TORRE DEL RELOJ । এটি একটি চার্চের ঢঙ্গে তৈরী গেট, যা ১৭০৪-৩৮ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। এই গেটের উপরে একটা বেশ বড় ঘড়ি লাগানো আছে যার জন্য এটির নাম ক্লক টাওয়ার। এটিই আসলে ছিল সেই স্প্যানিশ শাসনের যুগে দেওয়াল ঘেরা শহরের প্রধান দরজা বা বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান পথ। এর সামনে ছিল এক ওঠানো নামানো করার মত সেতু, যা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বাঁচানোর কাজে ব্যবহার হত।এর রঙ সোনালীই প্রধানতঃ, তাতে কিছু সাদার মিশ্রণ আছে। বারুখ ধরণের এই গেটের দরজার মাথাটা আর্চের মত।এটা তৈরী করেছিলেন,স্প্যানিশ মিলিটারী ইঞ্জিনীয়ার Juan de Herrera y Sotomayor যিনি আবার কার্তাহেনা একাডেমিরও প্রতিষ্ঠাতা।
আমরা আমাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে সামনেই একটা দোকানে খুব ভিড় দেখে ঢুকলাম, কিছু খাবার নিতে। ওরা তো আমাদের কথা কিছুই বোঝে না। শেষে একটি মেয়েকে এগিয়ে দিল। সেই সুন্দরী হাসতে হাসতে বলল, বুঝেছি। কিছু স্প্যানিশ খাবারই বললাম দিতে শুধু শুয়োর গরু বাদে। বলল, ঠিক আছে , চিকেন আর ডিম দিয়ে বানিয়ে দিচ্ছি। সুন্দরীর দেওয়া খাবার , ওয়াফেল নিয়ে এগোলাম মিটিং পয়েন্টের দিকে। ভালই করেছিল খাবারগুলো। বেশ মনে রাখার মত স্বাদ।
আমাদের বেড়াতে যাওয়ার বাস
স্প্যানিশ ঢঙ্গে তৈরী এই জায়গাটি আজ বহু জনের ক্ষেত্রে মিলিত হওয়ার বিশেষ ক্ষেত্র বা ‘মিটিং পয়েন্ট’ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই গেটটা যে খুব বিশাল বড় তা নয়, তবে সুন্দর তো বটেই। আর চার্চের মত যে চূড়া, তার দেওয়ালে লাগানো রয়েছে একটা ঘড়ি ,যা সময় দিচ্ছে আজও। গেটের বাইরের দিকে অনেকটা বাঁধানো চাতাল। তার সামনে দিয়ে চলেছে প্রধান রাস্তাগুলো। এ ছাড়া এটা এখানে একটা ছোট খাট এস্প্ল্যানেডই।
আর ভিতরের দিকে রয়েছে আর এক উন্মুক্ত বেশ বড় চাতাল। এই চাতালে রয়েছে এক বিরাট ব্রোঞ্জ মূর্তি, এক ভদ্রমহিলার , নাম Catalina , যিনি , স্প্যানিশরা এখানে আসার সময় স্প্যানিশ যোদ্ধা Pedro de Heredia র কাছে স্থানীয় ভাষার দোভাষী হিসাবে কাজ করেছিলেন।
ক্রমশঃ
0 Comments