জ্বলদর্চি

আয়নার অপর পিঠ /বাপন দেব লাড়ু

আয়নার অপর পিঠ
বাপন দেব লাড়ু 

শ্রেয়া মুখার্জি ছোটবেলা থেকেই বুঝে গিয়েছিল, সে “সুন্দরী” নয়। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের মুখটা কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে যেত। না, আয়নাটা নয়, ধোঁয়াটা ছিল মনে—এক অদৃশ্য কুয়াশা, যা তার নিজস্ব আত্মচিন্তার ওপর ছায়া ফেলে রাখত।
তার ছোট বোন মেঘলা ছিল একেবারে উল্টো। চোখে-মুখে আলো, হাসিতে স্নিগ্ধতা, আর ত্বকে যেন সূর্যের আলোর ছোঁয়া। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষ থেমে তাকাত। শ্রেয়া একবার ঠাট্টা করে বলেছিল, “তুই না একদিন রাস্তায় জ্যাম তৈরি করবি।” মেঘলা হেসে বলেছিল, “তা হতেই পারে, রূপেরও তো দায় আছে!”
বাড়িতে পাত্র দেখা শুরু হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। বিয়ের জন্য যতজন পাত্র আসে, সবাই প্রথমে শ্রেয়ার কথা শুনেই আসে। কিন্তু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চোখ চলে যায় মেঘলার দিকে। কারও কারও পরিবার তো সরাসরি বলে দেয়, “ছোট মেয়েটার কথাও ভাবতে পারেন। আজকাল তো মেয়েদের সৌন্দর্যও একটা ফ্যাক্টর!”
প্রথমবার এমন হলে শ্রেয়া নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, “আরে, কাকতালীয় ব্যাপার।” দ্বিতীয়বার মাথা নিচু করে ছিল, আর তৃতীয়বার সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে ভেবেছিল—"আমার মধ্যে এমন কী নেই?"
শ্রেয়া ছিল মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। মনস্তত্ত্ব, আচরণবিজ্ঞান, আত্মপরিচয়ের স্তরগুলো সে বইয়ে পড়ে জানত, ক্লাসে আলোচনাও করত। কিন্তু নিজের জীবনে যখন সেইসব তত্ত্ব বাস্তব হয়ে দাঁড়াল, তখন সে কেমন যেন হারিয়ে গেল। আত্মপরিচয় ভেঙে পড়তে শুরু করল—“আমি কে?”
মানুষ যখন বারবার প্রত্যাখ্যান পায়, তখন তা শুধু দেহে নয়, মনে গেঁথে যায়। আত্মবিশ্বাস এক অদৃশ্য নকশার মতো, একবার ছিঁড়ে গেলে সেলাই করাও কঠিন।
একদিন রাতে মেঘলা তার পাশে এসে বলল,
“দিদি, তুমি খুব ভালো। বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা, দায়িত্বশীলা। আমি জানি তুমি একটা ভালো ছেলেকে পাবে।”
🍂
ad

শ্রেয়া হেসে বলল, “তুই কি জানিস, আমি আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে ভয় পাই এখন? মনে হয়, আমি একটা ভুল। সমাজের তৈরি সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে আমি ফেল করেছি।”
মেঘলা চুপ করে ছিল। তার চোখে অস্বস্তি।
তখন শ্রেয়া বুঝল, শুধু সে নয়—মেঘলাও এই তুলনামূলক পরিসরের শিকার। মেঘলাও চায় না সবকিছু কেবল তার মুখের জোরে নির্ধারিত হোক।
এক সন্ধ্যায় শ্রেয়া একা একা নিজের পুরনো ডায়েরি পড়ছিল। সেখানে একটা লাইন চোখে পড়ল—
“যে নিজেকে ভালোবাসে, তার কাছে পৃথিবীও একটু সুন্দর হয়ে ওঠে।”
সে ভাবল, এত বছর ধরে সে নিজের প্রতি কতটা কঠোর ছিল! সমাজের চোখে সৌন্দর্য একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা হলেও, সে কেন নিজেকে অন্যের চোখ দিয়েই দেখতে শিখেছে?
সে ঠিক করল, এবার থেকে নিজেকে নির্মাণ করবে নিজের চোখে।
পরের দিন সকাল থেকে শ্রেয়া নিজের পছন্দের কাজগুলোতে মন দিল—বই পড়া, লেখালেখি, স্থানীয় স্কুলে কাউন্সেলিং ক্লাস নেওয়া শুরু করল। শিশুদের মানসিক বিকাশ নিয়ে তার আগ্রহ ছিল বরাবর। তাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শ্রেয়া নিজেকে খুঁজে পেল নতুন করে।
ছোট এক ছাত্রী, নাম রিয়া, একদিন বলল, “দিদি, আপনি সবচেয়ে ভালো কথা বলেন। আমি বড় হয়ে আপনার মতো হতে চাই।”
শ্রেয়ার চোখে জল এসে গিয়েছিল। এতদিন পর কেউ তার মধ্যে "হওয়ার মতো কিছু" দেখতে পাচ্ছে।
বছরখানেক পর, যখন শ্রেয়া একটা NGO-র সঙ্গে কাজ শুরু করল, তার জীবন অনেকটাই বদলে গেছে। সে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আর দুঃখ অনুভব করে না। সে জানে, রূপের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। কিন্তু নিজের চোখে নিজেকে ভালোবাসা—এই সংজ্ঞাটাই সবচেয়ে জরুরি।

মেঘলা তখন নিজের মতো করে পড়াশোনা করছে, মডেলিং নয়, একজন চিত্রশিল্পী হতে চায়। দুই বোন এখন আর তুলনার খাঁচায় আবদ্ধ নয়, বরং একে অপরের হাত ধরে মুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

গল্পের শেষে শ্রেয়া ডায়েরির শেষ পাতায় লিখে রাখে—

“আমি আয়নায় তাকাই, আর দেখি, আমি আর শুধু রূপহীন এক মেয়ে নই। আমি একজন মানুষ, যার চোখে আলো আছে—যা সে নিজেই খুঁজে পেয়েছে।”

Post a Comment

1 Comments