জ্বলদর্চি

করুণাময়ী ভূত / সুদেব কুমার ঘোষ

করুণাময়ী ভূত 
                                      
সুদেব কুমার ঘোষ

আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। দাদা ক্লাস টেনে পড়ে। আমরা দুজনে একসাথে পড়তে বসতাম। গ্রামে তখনও ইলেকট্রিক আলো আসেনি। হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে হত। আজকের মতো টিউশনির রেওয়াজ এত ছিল না। নিজেদেরই পড়তে হত। আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বাবা মা কাকা কাকিমা ঠাকুমা।ছোট ছেলে বলতে আমরা দুজন।বাইরে সদর বারান্দায় তাসের আসর বসত। পাড়ার আরো তিন চারজন তাস খেলতে আসত। আমরা স্কুলথেকে এসে খেলার মাঠে যেতাম। সন্ধ্যার আগে ঘরে ঢুকতে হত। টিফিন করে পড়তে বসতাম। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়টা ছিল বর্ষাকাল।আমরা পড়তে বসেছি। হটাৎ করে মেঘ করে বৃষ্টি এল। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি। তার আগে মৌসুমী বায়ু সারা দেশে এসে গেছে। বৃষ্টির সাথে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। আমরা ঘরের সামনে বারান্দায় পড়তে বসেছি। সামনেটা ঘেরা ছিল যাতে বৃষ্টির ঝাপটা আসতে না পারে। ওদিকে চা খেয়ে তাসের আসরে সব বসে গেছে। শুকনো মাটির উপর বৃষ্টি পড়েছে। মাটির সোঁদা গন্ধ উঠছে। আমরা বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।তারপর মেঘের গর্জন।
দাদা বলল "মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের সাথে সম্পর্ক আছে জানিস?"
আমি বললাম " কী সম্পর্ক?"
দাদা বলল "ব্যাটারি দেখেছিস তো?" 
আমি বললাম " হ্যাঁ।"
দাদা বলল "ব্যাটারির মাথার দিকটা মানে যেদিকে লাল রঙের কভার থাকে এবং  পিতলের ছোট্ট একটি টুপির মত ঢাকনা থাকে সেই দিকটি ধনাত্বক দিক। নীচের দিকটি হল ঋণাত্বক দিক। দুই প্রান্তে তামার তার যোগ করে অপর দুই প্রান্ত স্পর্শ করালে পড় পড় শব্দ হয়। আমাদের রেডিও এর ক্ষেত্রেও এটা হয়। আকাশের মেঘ বিরাট আকৃতির। দুই বিশাল মেঘখন্ড ধাক্কা লাগলেই বিশাল শব্দ হয় এবং আলো জ্বলে উঠে। এই আলো হল বিদ্যুৎ। আলোর গতিবেগ শব্দের গতিবেগের থেকে বেশী। তাই আলো আমাদের চোখে আগে দেখা যায় আর শব্দ পরে আমাদের কানে শোনা যায়। এই আকাশের বিদ্যুৎ আর আমাদের ঘরের বিদ্যুৎ একই। এটা কে প্রমাণ করেছিল বল দেখি ?"
আমি বললাম " বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।"
দাদা শুধাল "তুই জানলি কীকরে ?"
আমি বললাম "এ নিয়ে আমাদের বাংলা বই এ একটি গল্প আছে। এক বৃষ্টির দিনে ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়ি ওড়াছিলেন। উদ্যেশ্য আকাশের বিদ্যুৎ এবং ঘরে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ এক কি - না তা পরীক্ষা করা। এক বুড়ি এই  দৃশ্য দেখে থানায় খবর দিয়েছিল। থানা থেকে পুলিশ এসে বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে দেখে অভিভূত।
🍂
ad

 বলার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে এক বিরাট এলাকা জুড়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। পরক্ষনেই জোরে শব্দ চারিদিক মুখরিত করে দিল। বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল গাছগুলি যেন বৃষ্টিতে বহুক্ষণ ধরে স্নান করেই যাচ্ছে।সেই জল আবার নীচের গাছগুলি পাচ্ছে। যেন উপরের গাছগুলি জলপান করে নীচের গাছগুলিকে জল  দিচ্ছে। দুচারটে পোকা হ্যারিকেনের চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাটিতে ওদের বাসায় জল ঢুকেছে।নিরাপদ আশ্রয়ে আলোর চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কিন্তু নিরাপদ কোথায় ! টিকটিকিরা ওদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কখন ঘায়েল করা যাবে। ওদিকে তাসের আড্ডা জমে উঠেছে। মা ঠাকুমা কাকিমা আর পিসিমা রান্নাঘরের ভিতরে বসে জমিয়ে গল্প করছে। পিসিমার বিয়ে হয়েছে বর্ধমান জেলায়।দুদিন আগে এসেছে। বাপের বাড়ি বেড়াতে। ওদিকে বারান্দায় তাস খেলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কে ভুল করেছে কে ঠিক করেছ তারই তর্ক -  বিতর্ক চলছে। বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমেছে। দাদা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হটাৎ দাদা বলল "নবু চল ,উঠোমাছ ধরতে যাব। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি। কই মাগুর সিঙ্গি এসব মাছ উঠবে।"
আমি বললাম "বাবা জানতে পারলে বকবে।"
দাদা বলল "বাবা জানতে পারবেনা। তুই চুপি চুপি  ঘর থেকে টর্চ লাইটা বের করে নিয়ে আয়। আলোটা যেমন জ্বলছে এখানে জ্বলুক। তাহলে সবাই ভাববে আমরা এখানে আছি। পড়ছি। কেউ সন্দেহ করবেনা।তুই বরং আর একটা কাজ কর। লণ্ঠনটা জ্বেলে নিয়ে চল।"
আমি তার কথামত কাজগুলি করে গেলাম। দুজনে দুটি তালপাতার পেখে নিলাম। চুপি চুপি সকলের দৃষ্টির অগোচরে মৎস আহরণের উদ্যেশ্যে গমন করলাম। গোয়েন্দাদের মতো এমনভাবে কাজগুলি করে গেলাম কেউ জানতেই পারল না।
এরকম দুঃসাহসিক কাজ দাদার অনেক আছে। গাছে উঠে তাল কাটা,অমাবশ্যার অন্ধকার রাতে শ্মশান থেকে পাতা নিয়ে আসা। আরো কতকী। কাজেই দাদার উপর ভরসা আছে।
বৃষ্টি তখনও ঝিমঝিম করে পড়ছে। নালা দিয়ে জলের স্রোত বইছে। তার কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে।জমির কিনারে কিনারে ভেক সকল আনন্দে চীৎকার শুরু করে দিয়েছে। দু একটা ভেক ডাঙায় উঠে এসেছে শিকার ধরার জন্য। লম্বা জীভ বাড়িয়ে রেখেছে। শিকার জিবের উপর পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে জিবটা মুখের ভিতরে টেনে নেবে।
মরা মাটিতে জল পড়েছে। মাটি গলে গিয়ে দইয়ের মতো হয়ে গেছে। বাড়ির সীমানার পরেই খামার। তার পরেই আমাদের ডোবা। তার চারপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ। খামারের পাশে আছে ঘাট। বৃষ্টির জল তখনও গড়িয়ে যাচ্ছে। দাদা আমাদের ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে দেখল কোনো মাছ উঠছেনা। বৃষ্টির সময় কেবল জিওল মাছই উঠে। অন্য মাছ সাধারণত উঠেনা।আমাদের পুকুরে কেবল পোনা মাছ বেশী। জিওল মাছ নেই বললেই চলে। দাদা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল "চল আমাদের ডোবায় কোনো মাছ উঠেনি। ঘোষাল দের পুকুরে যাব চল।"
আমি বললাম "তাই চল।"
প্রথম বর্ষার বৃষ্টি বেশ ভালো লাগছে। টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে ঘুরতে বেশ মজা হচ্ছে। আবার ভয় ও পাচ্ছে। চারিদিক অন্ধকার আর নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় প্রকৃতিকে নিমেষের মধ্যে দেখার সুযোগ ঘটছে। গা ছম ছম করছে।সাপখোপের ভয়। ভুতের ভয়। দাদা মাঝে মধ্যে খোঁজ  - খবর নিচ্ছে। পিছলে যাতে পড়ে না যায় তার জন্য সাবধানতার সতর্ক বাণী শোনাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা ঘোষাল পুকুরের পাড়ে এসে গেছি। আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে রাস্তা। তারপর ঘোষালদের বাড়ি। পুকুরের উত্তর পাড়ে । উত্তর - পূর্ব কোণে ছোট ঘরে থাকে এক বুড়ি। আমি ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি। কিন্তু তার সমন্ধে বিশদ কিছু জানিনা। শুনেছি বুড়ি বাল্য বিধবা। তবে খুব কষ্ট করে দিনাতিপাত করে। ছোট কুঁড়ে ঘর। ছোট্ট ঘুলঘুলির মধ্য দিয়ে লণ্ঠনের আলোর ঝাপসা আভা দেখা যাচ্ছে। ঘোষালদের বড় ঘর। তাদের ঘর থেকেও আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ঘরের বাহিরে কেউ বের হয়নি। আমরা কেবল দুজন নিস্তব্ধ পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরের এক প্রান্তে বাঁধানো ঘাট। এই ঘাট মূলত ঘোষালরাই ব্যবহার করে। ঘাটের কিছুদূরে এক মাঝারি সাইজের আমগাছ। পাকলে খুব মিষ্টি। পুকুরের পূর্বপাড়ে এক প্রকান্ড আমড়া গাছ। পাতা বিহীন। ছোটো ছোটো আমড়া ধরেছে। পুকুরের চারপাড়ে আর কোনো বসতি নেই। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে দু - একটা  গাছ শূন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর আছে কিছু ঝোপ জঙ্গল।
দাদা বাঁধানো ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ডাঙ্গার জলের স্রোত যেখানে পুকুরের জলের সাথে মিশেছে ঠিক সেখানে দাদার দৃষ্টি নিবদ্ধ। কারণ সেখান থেকেই মাছ উঠে আসবে। দৃষ্টি না ঘুরিয়েই কিছুক্ষণ পরেই দাদা বাঁ হাতের ঈশারায় আমাকে ডেকে নিল। বসে পড়ে খপ করে একটি মাছ ধরে আমার হাতের খালুই এ রেখে দিল। তারপর আরো একটা। আরো একটা। এভাবে বেশ কয়েকটা মাছ শিকার করে উঠে দাঁড়াল। একবার খালুই এর দিকে তাকাল। সিঙ্গী , মাগুর কই। পাশে ঝোপ থেকে ডাল ভেঙ্গে খালুই এর মুখে গুজে দিল যাতে মাছ লাফাতে না পারে।
দাদা এবার বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত। আমাকে বলল "চল, বাড়ি চল। খালুইটা আমাকে দে।"
দাদা যাবার জন্য যেই পা বাড়িয়েছে অমনি আমড়া গাছ থেকে লাফ দিয়ে কে যেন দাদার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল " মাঁছগুলো দেঁ।"
দুজনেই ভয়ে কাঠ। আমার তো মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা। দাদা যে এত সাহসী, সেও যেন পুত্তলি বৎ।উনি মানে ভূত বাবাজি আমাদের চারপাশে ঘুরতে লাগল এবং নাকি সুরে বলতে লাগল "মাঁছগুলো দেঁ , নাঁহলে দুঁজনকে খাঁবো।" 
দাদা খালুইটিকে পেটের উপর চেপে ধরে আছে।আমার মুখে তো রা নেই। মনে মনে ভাবছি সব পণ্ড হয়ে গেল। দুজনে প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারব কি না জানিনা। আমাদের গ্রাম্য দেবতা কাশীনাথ। শিব ঠাকুরের নাম। তাকেই ডাকছি আর রাম নাম করছি।উনি কয়েক ফের ঘুরে হঠাৎ দাদার হাত থেকে খালুইটা কেড়ে নেবার জন্য যেই হাত বাড়িয়েছে অমনি লাল শাড়ি পরা একজন তার হাতটা মুড়ে ধরল। বলল "বুড়ো , এইবেলা ভাগ। নইলে তোর ওই হাড় জিরজিরে ঠ্যাং আমি ভেঙে দেব। এরা আমার নাতি। ওর হাতটা ছাড়।"
আমি যেন আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এতো ঘোষাল ঠাকুমা। কবে মারা গেছে।আমাদের দুজনকে খুবই ভালোবাসত। পাশাপাশি ঘর। ঘোষালদের ঘর গেলেই আমাকে কোলে তুলে নিত। কত আদর করত। আমি কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলাম। দাদার চোখের ঈশারায় আমি মুখ বন্ধ করে দিলাম।
ইতিমধ্যে বুড়ো ভূত কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল টের পাওয়া গেলনা। ঘোষাল ঠাকুমা আমাদের বলল "তোরা কোন সাহসে এত অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়েছিস ? তোদের ঘরের লোকগুলোকেও বলিহারি। চল আমার সাথে। তোদেরকে এগিয়ে দিই।একথা ঘরে কাউকে বলবিনা।"
ঘোষাল ঠাকুমা আগে আগে যাচ্ছে।আমি দাদার হাত ধরে যাচ্ছি। ঠিক আমাদের দরজার সামনে এসে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। তখনও আমাদের শরীর থেকে ভীতি কাটেনি। সদর বারান্দা থেকে তাসের আসর থেকে বাবার আওয়াজ ভেসে আসছে "মল্লিক তোমার গোলাম ধরলাম।"ওদিকে বৃষ্টির শীতল হাওয়ায় মা কাকিমা ঠাকুমার গল্প জমে উঠেছে। আমরা যে  ইহজগতের দুটি প্রাণী পরজগতের দু - দুটি প্রাণীর সাথে সাক্ষাৎ করে এলাম সংসারে কেউ জানতেও পারল না। খালুইটি রান্না ঘরের দুয়ারে টাঙিয়ে যেমন পড়তে বসেছিলাম তেমনি পড়তে বসে গেলাম।আকাশ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। খাঁচায় টিয়া পাখিটি চুপটি করে বসে আছে। বারান্দার এক কোণে আমাদের পোষা কুকুরটি কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। বিড়ালটি আমাদের দেখে লেজ তুলে একবার "ম্যাও" করে ডাক দিল। তারপর কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল জানিনা। দাদা অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। আমি জোরে জোরে ইংরেজির এক কবিতা মুখস্থ করছি।যেন আমরা কোথাও যাইনি এবং বাহ্যিক কোনো প্রভাব আমাদের উপর ঘটেনি।

Post a Comment

1 Comments

  1. কমলিকা ভট্টাচার্যMay 30, 2025

    Love it, আষাঢ় মাস একটু আগেই এলো।

    ReplyDelete