জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক(শেষ গল্প)। বাসুদেব গুপ্ত/রোভোট যুদ্ধ ধুন্ধুমার/ পর্ব ৩

গল্প ধারাবাহিক(শেষ গল্প)। বাসুদেব গুপ্ত
রোভোট যুদ্ধ ধুন্ধুমার পর্ব ৩

আইটিউব চলছে। রঞ্জিতের এই অনেক দিনের অভ‍্যেস। আইটিউব চালিয়ে বিকাল বেলা আড্ডাগাড়ী চড়ে বেড়াতে বেরোন। কোথাও যেতে হয় না, ঘরে চেয়ারে বসেই ভারচুয়াল ট্যুর। রোবট রাজ‍্য শুরু হয় ২০২৫ সালে। তার পর প্রথম পরিবর্তন হয় ইউটিউবের নাম। 
কিছুদিন ধরে ইউটিউবটা হয়ে উঠছিল স্বাধীনচেতাদের আখড়া। তাই  রাজাধিরাজের নজর পড়ে সে দিকে। এই সর্বেসর্বা প্রথমে রাজা উপাধি নেন, তারপর সেটা বদলে নাম নেন রাজাধিরাজ। নাম বদলানো একটা শখ ছিল তাঁর। রাস্তার নাম, শহরের নাম, প্রদেশের নাম আইনের নাম, সরকারী দপ্তরের নাম উনি হরবখত বদলাতেন। খারাপ লোক বলত নিজের বাপের নাম ছাড়া তিনি সবই পালটে দেবেন একদিন। 

তিনিই নাম বদলে দেন আই টিউব। আই মানে আমি, নেতা, সরকার, অথরিটি। তিনি বলে দেন যা ভিডিও দরকার আমাদের সেল থেকেই করে দেবো। এলগরিদম সবার দরকার মত ভিডিও বানাবে আর আপলোড করবে। তাই নাম হল আইটিউব। 

আইটিউব ছাড়া এখন আর কিছু মিডিয়াই  নেই, সব বন্ধ হয়ে গেছে একে একে। রঞ্জিত সেখানেই মন দিয়ে নানা রকম খবর শুনছিলেন ভারচুয়ালি কায়রোর এক চায়ের আড্ডায় বসে। সেখানে অনেকে আসেন। বড় বড় কবি লেখক সাংবাদিক। যাঁদের ক্নিয়ারেন্স আছে সত্যা সরকারের। সবই স্ক্রীনের খেলা। তাঁদের ঘরের দেওয়ালে প্রোজেকশান হয় কায়রোর চাএর আড্ডার। 

চাএর আড্ডাতেই প্রথম শোনা গেল কিছু মানুষ নাকি ভোট বয়কট করবে। মানুষ বয়কট করলেই বা কি, নিউম্যানরা তো ভোট দেবে।  হিউম্যানরা নিজেদের সংরক্ষিত প্রজাতি বলে ঘোষণা করছে নির্বাচনের ছ মাস আগে। তাতে ঠিক করা হয়েছিল নিউম্যানের সংখ‍্যা কখনই ২৫% এর বেশি হবে না। কিন্তু মানুষ যদি ভোট বয়কট করে তাহলে তো নিউম্যানরাই জিতে যাবে। এইখানেতেই ধন্দ। নিউম্যানরা নাকি ঘুষ দিয়ে মানুষগুলোকে ভোট বয়কট করাচ্ছে। আর তাদের সাহায্য করছে রোবটরা, এই আশায় যে তারা তাড়াতাড়ি প্লাটিনাম কার্ড পেয়ে নিউম্যান হয়ে যাবে। মানুষ পারে বটে, ঘুষ নিয়ে নিজেরই সর্বনাশ করে বাধছে না। এই গুজব জোর ঘুরছে বিভিন্ন ফ্লোটিয়ামার গ্রুপে।

খটকা লাগল একটা। কোন হিসেবেই আসে না হিউম্যানরা  কেন ভোট বয়কট করতে যাবে? একটা ঘোঁট পাকাবার চেষ্টার গন্ধ পান। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী তিনি, তাঁর দেশে, রাজ্যে এমন ঘোঁট শুরু হয়ে যেত প্রতিবার ভোটের আগে। দাঙ্গা, গোয়েন্দাদের হানা, মোবাইল ফোনে দিবারাত্র প্রচার, মানুষ বুঝতেই পারত না সত্যি কি হচ্ছে।  স্ক্রিপ্ট চেনা চেনা লাগছে। বাগেশ্বরের হাতের কাজ নয় তো?

চারদিকে ভোটের বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ। কাগজ ছাপা বিলবোর্ড এসব কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। সব বিজ্ঞাপন এলনগ্লাস থেকে ডাইরেক্ট রেটিনায় ফোকাস করে। এক মিনিট পরে পরে বিজ্ঞাপন। সত্যাকে ভোট দিন। হিউম্যান আর নিউম্যান, সবার উন্নতি সত্যা চান   । মানুষের স্বার্থ কে দেখে? ভোট দিন কুংফু কে । বিজ্ঞাপন দেখে দেখে, হাজার হাজার মানুষের চোখ খারাপ। নিউম্যান বা রোবটদের চোখ খারাপ হয় না, হলে স্পেয়ার পারটস লাগিয়ে নিলেই হল। হিউম্যানদের আই ট্রান্সপ্ল্যান্টের গবেষণা এখনো চলছে। কিছুদিন হলো হিউম্যানদের দরকারি গবেষণায় ফান্ড কেটে দিচ্ছেন সত্যার পরিচালক বা সেক্রেটারীরা। প্রথমেই বন্ধ হয়েছিল আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা। নিউম্যানদের কিচ্ছু যায় আসে না আবহাওয়ার পরিবর্তনে। 
🍂
ad

আর সাতদিন বাকি ভোটের। আজকের দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজ আছে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট। সত্যা বনাম কুংফু। সন্ধে সাতটায় ডিবেট। এখনকার পৃথিবীর রাজধানী গাজা যার নতুন নাম হয়েছে ট্রাম্পিয়া। । সেখানে সব লোককে বার করে দেওয়ার পরে, এত ডেভলপমেন্ট হয়েছে যে চেনাই যায় না কুড়ি বছর আগে রাস্তায় রাস্তায় ছিল শুধু ভেঙ্গে পড়া বাড়ী আর ছিন্ন ভিন্ন মানুষের শব। এখন সেখানে তৈরী হয়েছে ট্রাম্পটিজ রিভিয়েরা। হাজার হাজার স্কাই স্ক্রেপার ঘিরে রয়েছে সমুদ্রতট, শহরের ভিতর অপরূপ সুন্দর করে সাজানো, বিশাল বিশাল   ফ্লোট অ্যান্ড ফ্লাই উড়ুক্কু বিলাস পোত ভাসছে, নীল জলে থেকে নীল হাওয়ায়। সাংহাই থেকে স্থপতিরা এসে বানিয়েছে দশ তলা শহর। চোখ ঝলসে যায়। আর তার ঠিক মাঝখানে রয়েছে টাউনহল মাস্কিলিকা, ধবধবে সাদা একটা বিরাট রাজ হাঁস যেন ডানা মেলে উড়ানের জন্য ছটফট করছে। এর কাছে ওয়াশিংটনের পুরানো ক্যাপিটল নেহাত ম্রিয়মাণ লাগে। এই টাউনহলে ডিবেট হবে আর সারা পৃথিবীর সব নাগরিক তা দেখবে আইটিউবে। উত্তেজনায় টান টান সারা পৃথিবী।

 রোবট কুকিং খুব জনপ্রিয় হলেও এখনো অনলাইন ফুড ডেলিভারি চালু আছে। কিছু আসে ড্রোনে কিছু ডাইরেক্ট ডেলিভারি অনলাইনে, রেসিপি ডাউনলোড করে রোবোকুকে রান্না হয়। সকাল থেকে মেসেজ আসছে, ফেক মাটন কাটলেট, চিয়াসিডের পুরী আর উত্তরাঞ্চলের চা বাগানের চা উইথ অ্যা ড্যাশ অফ হোলি ওয়াটার। ভোটের দিন, খ্যাঁটের দিন, তাড়াতাড়ি অরডার দিন।  সঙ্গে ক্লিক করুন জে ফর আইব্রেন ডি ফর স্যাপিয়েন্স । ওপিনিয়ন পোল। এখনো চলছে।

প্রতি ভোটেই এরকম ডিবেট হয়। দশজন হিউম্যান নানারকম প্রশ্ন করবে আর উত্তরের ওপর রেটিং দেওয়া হবে। এবারে ঠিক হয়েছে তিনজন হিউম্যান আর তিনজন নিউম্যান মিলে ডিবেটটা হবে। রোবটদের কোন প্রশ্ন করার অধিকার নেই, তাদের ভোট দেওয়ারও অধিকার নেই। 

রঞ্জিতের মনে পড়ে যাচ্ছিল সিএনএন আর এবিসিতে দেখা অনেক স্মরণীয় ও বিস্মরণীয় ডিবেটের কথা। বয়স হয়েছে, কিন্তু তর্ক পেলে এখনো স্নায়ুগুলো তাজা হয়ে যায়, একেই বলে বেংগল জিন। 
 
শুরুটা মোটেই ভাল হল না। 
প্রথমেই শোনা গেল রোবটরা টাউন হল ঘিরে ফেলেছে, সেখানেই আজ ডিবেট হবার কথা। ওদের দাবী, ওদেরও প্রশ্ন করতে দিতে হবে। টিম আইব্রেন সোজা জানিয়ে দিয়েছে, রোবটদের ভোটাধিকারই নেই, ওদের আবার প্রতিবাদ কি? ওদের প্রতিবাদ করার কোন অধিকারই নেই। বেশি গোলমাল করলে ওদের ওয়াইফাই বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদিও স্যাপিয়েন্সদের  হাতে আছে সব কারখানাগুলো, যাবতীয় নেটওয়ার্ক চলে আইব্রেনএর খেয়ালখুশিতে। এই ভাগটা দশবছর ধরে ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছে। যদিও রোবটদের ওয়াই ফাই বন্ধ হয়ে গেলে যে সব কাজ বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা সবাই জানে, কাজেই এটা আসলে ফাঁকা আওয়াজ। টিম স্যাপিয়েন্স  ওদের আলোচনায় ডেকেছে, ছটার সময়, ওদের ভোটাধিকার দেওয়া যায় কি না তাই নিয়ে জরুরী মিটিং হবে তার পর ওরা ডিবেটে যাবে।

রঞ্জিত খুব মন দিয়ে আইটিউবে লাইভ দেখছিল হঠাত পাশে একটা ছায়া দেখে ঘুরে দাঁড়াল। জিভস। 
আরো চমকে ওঠেন দেখে, তার সঙ্গে এক ঝকঝকে কালো তরুণী। রোবট বেশির ভাগ সাদা হয় এখনো, বর্ণ বৈষম্য খুবই চালু এ ব্যাপারে। কালো রঙ রোবট নাকি আইডেন্টিফাই করা মুশকিল হয় এরকম যুক্তি আছে, কিন্তু রোবট কারখানাগুলো সবই এলন মাস্কের বংশধরেরা চালায়। তাদের এব্যাপারে দুর্নাম তো আছেই। কিন্তু রোবটের মাথায় যে একটা ছোট্ট এল ই ডি থাকে, যেটা দেখে বোঝা যায়, টিভি বা অন্য যন্ত্রের মত পাওয়ার অন আছে, এই তরুণীটির মাথায় সেই এল ই ডিটাতো নেই। তাহলে?

জিভস লাজুক মুখ করে এগিয়ে আসে, রোবটদের লাজুক মুখ বেশি দেখা যায় না, একটু অবাক লাগলো রঞ্জিতের। 
=স্যার মিট মাই ফ্রেন্ড আলিয়ানা। আলিয়ানা মিট মাই ক্লায়েন্ট মি মল্লিক।
আলিয়ানা, মানে… 
আলিয়ানা হাসি মুখে এগিয়ে এসে হ্যান্ড শেক করে রঞ্জিতের। 
-আমি হিউম্যান, রোবট নই। কিন্তু অনেক রোবট আমার বন্ধু। জিভস একটু স্পেশাল ফ্রেন্ড। 
ব্যাপারটা ধরতে একটু সময় লাগে রঞ্জিতের। 

কানাঘুষোয় এই ব্যাপারটা নিয়ে ফ্লোটিয়ামাতে ঘুরতে ঘুরতে অনেক লোকের মুখে শুনেছেন রঞ্জিত। রোবট আর হিউম্যানদের মধ্যে সম্পর্ক। শুনে তিনি হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন এত দিন। হিউম্যানরা মানে হিউম্যান আর রোবটরা… মানে রোবট। অবশ্য রোবট আর হিউম্যান দেখতে এখন একরকম। বলতে কি রোবটদের অনেক সুন্দর দেখতে কারণ তাদের মুখ চোখ ছাঁচে তৈরী হয়, যেমন কুমোরটুলিতে তৈরি দেব দেবীর মুখ সর্বদা সুন্দর হত, রোবটরাও যেমন সুন্দর তেমনি তাদের সুঠাম শরীর। আসল তফাৎ ভিতরে, হিউম্যানদের শরীর হাড় মাংস পেশী দিয়ে তৈরী, রোবটদের শরীর সারকিট, চিপস গিয়ার, মোটর, সেন্সর। যদিও কিছু বায়োলজিকাল পারটস এখন তৈরী হচ্ছে, যাতে রোবটদের নড়া চড়া অনেক সুচারু হয়েছে, আড়ষ্টতা গেছে, তবু…

আলিয়ানা মেয়েটি হাসিখুশি, সে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল রঞ্জিতের মুখে নানা ভাবের খেলা। হাসিতে লুটিয়ে পড়ে সে বলে, 
= না না আঙ্কল, আমি সত্যিই হিউম্যান। আর জিভস আমার বয় ফ্রেন্ড। সত্যি, বিশ্বাস করুন। 
রঞ্জিত আঙ্কল শুনে একটু আশ্বস্ত হন, রোবটরা সবসময় স্যার বলে। কিন্তু ব্যাপারটা তাঁর মাথায় ঢোকে না, সেই বিভ্রান্তি কোনমতে চেপে তিনি বলেন, 
= গ্ল্যাড টু মিট ইউ, কিন্তু জিভস যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে তাতো জানতাম না। তো বলো কি ব্যাপার। হঠাত আসা? তুমি তো জিভসের আইডি দিয়েই ঢুকে পড়েছো বুঝতে পারছি, এবং সেটা কিন্তু বেআইনি। 
এবার আলিয়ানার হাসি বন্ধ হয়। সে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পাশে বসে আস্তে আস্তে বলে, 
=আপনার কাছে একটা সাহায্যের জন্য এসেছি, আপনি ছাড়া কেউ করতে পারবেন না। আমি আপনার এখানে শেল্টার চাই। 
-শেল্টার? রঞ্জিত প্রায় চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠতে উঠতে আবার বসে পড়েন। 

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments