রবীন্দ্রনাথের গল্প আর সত্যজিতের সিনেমা – এক সার্থক যুগলবন্দি
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
জানালা দিয়ে মাঠে ঘাসের ছবি তুলে ইতিহাস তৈরি হয়েছিল প্রায় দুশো বছর আগে। বলত, হেলিয়োগ্রাফি। তখন ফিল্ম আসেনি, ধাতব বা কাঁচের প্লেটে ছবি। এর দেড় দশকের মধ্যেই ভারতে প্রথম ছবি তোলা হয় কলকাতায়। ১৮৮৮ সালে ইংলন্ডে প্রথম চলমান ছবি তোলা সম্ভব হয়। এর সাত বছর পর লুমিয়েরে ব্রাদার্স পর্দায় চলমান সাদা-কালো ছবি প্রোজেক্ট করে দেখানো থেকে সিনেমার শুরু বলে ধরা হয়। অবশ্য তখন শব্দ যোগ হয়নি। ভারতে দাদাসাহেব ফালকে রাজা হরিশচন্দ্র ছবি তৈরি করে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ১৯১৩ সালে। ১৯২৭-এ শব্দ যোগ হল ছবিতে এবং এর চার বছর পরেই তাও ভারতে সম্ভব হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ
ভারতীয় চলচ্চিত্রে আমূল পরিবর্তন আসে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে পথের পাঁচালী ছবির মাধ্যমে। এক লাফে সাবালক হয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সমকক্ষ হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনীর মাধ্যমে। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ কবিতা গান নাটক গল্প ছোটগল্প উপন্যাস প্রবন্ধ ভ্রমণ আত্মকথা ছবি আঁকা সবেতেই একটা নব রূপ দিয়েছেন যা পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিল। সাহিত্যে ভাষা গড়েছেন আবার ভেঙেছেন বারবার। প্রতিটি বিভাগে ভাষা সৃষ্টি ও ব্যবহার ভিন্ন। সত্যজিতের প্রধান শিল্পক্ষেত্র চলচ্চিত্রের বাইরে ছবি আঁকা, ক্যালিগ্রাফি, বিভিন্ন স্বাদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, বক্তৃতামালা, ফটোগ্রাফার এবং আরও অনেক কিছু। সত্যজিতের ক্ষেত্রে শুধু চলচ্চিত্র বললে সবটা বলা হয় না বরং বলা ভাল ফিল্ম ইন টোটালিটি। তিনি শুধু পরিচালকই নন, একাধারে চিত্রনাট্য, সঙ্গীতস্রষ্টা। চলচ্চিত্রেও সত্যজিৎ ছবির জন্য এক নতুন ভাষা সৃষ্টি করেন এবং সেই ভাষা ক্রমে বদলে যায় ছবির বিষয়ের সাথে। সাহিত্যে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ আর চলচ্চিত্রে অস্কার পান সত্যজিৎ সারা জীবনের চলচ্চিত্র নির্মাণের কৃতিত্বের স্বীকার।
🍂
রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও সাহিত্যকে তিনটে পর্যায় ভাগ করা যায়, পঁচিশ বছর, পঞ্চাশ বছর আর তার পরের সময় যখন থেকে মুক্তহস্তে সমাজের কাটাছেঁড়া করছেন। সত্যজিতের প্রথম দিকের চলচ্চিত্রের ভাষায় ছিল সমাজের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিক। এর শুরু ১৯৫৫-য় ‘পথের পাঁচালি’ দিয়ে এবং শেষ ১৯৬৭তে ‘চিড়িয়াখানা’-য়। এরপরেই তিনি ভাষা বদলে সমাজের অন্দরে ঢুকে বিশ্লেষণে তাঁর শিল্পমাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছেন। প্রথম হাতেখড়ি ‘গুগাবাবা’ এবং তারপরে একের পর এক ছবিতে নিজের জিনকেই কাটাছেঁড়া করলেন, তৈরি হল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘অশনি সঙ্কেত’। ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে তিনি সরাসরি ঘুমন্ত দর্শককে চাবুক মেরে জাগিয়ে তোলেন। সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। টাকার লোভে মধ্যবিত্ত ঘরের মা-বোনকে বৃহৎ পুঁজিপতির অঙ্কশায়িনী করে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না এই ভয়াবহ সত্য উচ্চারিত হল। নারী ও মাতৃজাতির প্রতি মধ্যবিত্তের ভক্তির পেছনে খেলা করে নারীমাংস-ব্যবসাকে আড়াল করার একটা আত্মপ্রতারণা। সিনেমা হল থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন সত্যজিৎ এবার আমাদের দেখে ফেলেছেন পুরোপুরি। এই দেখা ‘নায়ক’ ছবিতেও আছে, এবং চলেছে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ এবং ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এও। ‘গুগাবাবা’র মত আপাত নিরীহ গল্পের দ্বিতীয় ভাগে ‘হীরক রাজার দেশে’-য় ভাষায় এসে গেল খুল্লমখুল্লা রাজনীতি, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এরপর আর লুকোছাপা নয়, বিপ্লবী রাজনীতিবিদদের মুখোশ খুলতে আশ্রয় নিতে হল রবীন্দ্রনাথের, সৃষ্টি হল ‘ঘরে বাইরে’। তার আগেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। বুঝে গেছেন, সময় অল্প, বলতে হবে এবার নিজের গল্প। না, আত্মজৈবনিক গল্প নয়, সমাজ সম্পর্কে এতদিনের যত অভিজ্ঞতা তা প্রকাশ করার সময় এসেছে। দর্শক এখন সিনেমা দেখায় শিক্ষিত। এইখানেই তাঁর শেষ মোড়। সমাজের ভাষা তাঁর ছবিতে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানী-রাজনীতিজীবী-মানবসেবী-ভদ্রসমাজের চোখের সামনে রাখলেন আয়না। একসময় ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়া লোক যিনি অরণ্যে ঘুরে ঘুরে দিনরাতের গল্প বলেছেন, তিনি এখন ঘরে বসে বাইরের সমাজের গল্প বলতে শুরু করলেন। এবার আর বিশ্লেষণ নয়, সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কোথায় আমরা আছি, কী ভাবছি আর কী ভাবা উচিৎ, কী করছি আর কী করা কর্তব্য। মনোমোহন মিত্রকে মনে আছে? সেই-ই যেন শেষ তিনটে ছবিতে ঘোরাফেরা করছে। মনের মধ্যে জমা বিদ্রোহ যেন ক্রোধকম্পিত হয়ে উঠছে। তার প্রথম প্রকাশ ‘গণশত্রু’। প্রবল জনপ্রিয় মন্দিরে দূষিত পুকুরের জলকে চরণামৃত বানিয়ে অন্ধভক্তদের চিটিং করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা ডাক্তারের সাথে বিবাদে জড়ালেন জনপ্রতিনিধি। কী করুণ অবস্থা এই ধর্মীয়সংস্কারে ডুবে যাওয়া লোকজন যাদের বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে আর তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে এই জনপ্রতিনিধিরা। এর পরের দুটো ছবি সত্যজিতেরই লেখা। সুবিধেবাদী, অসৎ মধ্যবিত্তের অর্থলোভের ভয়ঙ্কর ছবি ‘শাখা-প্রশাখা’ যেখানে শিশুও জেনে যাচ্ছে দু-নম্বরি কথাটা। অসদাচরণ অহঙ্কার এবং ধর্মের চেয়ে বড় উচ্চবিত্ত হওয়ার বাসনা, কথার চাবুকে নীতিহীন সমাজকে জর্জরিত করেছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তান যখন মমতামাখানো আবেগে ‘বাবা’ বলে ডাকে সেখানেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় মানবিকবোধ। প্রশ্ন জাগে, তাহলে আসলে কারা মস্তিষ্কবিকৃত? ‘আগন্তুক’ ছবিতে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা, বিস্ময়বোধ, নানা জায়গা ও প্রাচীন সভ্যতার মত নানা অজানাকে জানার আগ্রহ মনোমোহনের এসব তো আমরা সত্যজিতের জীবনেই দেখি। আড্ডার মধ্যেই গল্পচ্ছলে চিনিয়ে দেন মানুষের প্রতি প্রতিষ্ঠিত অবিশ্বাস মানুষের পরম শত্রু। আর এই অবিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখাই রাজনীতির মূলধন। স্যাটায়ারিক ভঙ্গিতে বলেন, দুর্নীতির আশ্রয় যে নেয় না, মুদ্রাদোষ যার নেই, সে কি এই গ্রহের জীব? মেকি সভ্যতার চেয়ে আদিম সভ্যতাই শ্রেয়- এটাই সত্যজিতের শেষ কথা।
রবীন্দ্রনাথ + সত্যজিৎ
বিশ শতকের সত্যজিতের চলচ্চিত্র জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উনিশ-বিশ শতকের রবীন্দ্রনাথের গল্প চলচ্চিত্রায়ণ করা। ভাষার জাদু খেলিয়ে তৈরি গল্পকে চলমান ছবিতে রূপান্তর বা বলা ভাল ভাষান্তর এবং তা সত্যজিতের নিজের ভাষায় একটা বিস্ময়। রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস নিয়ে সত্যজিৎ ছবি তৈরি করেন তখন এই দুই মহান শিল্পীর আবেগের মিশ্রণ যুগলবন্দি রূপে নিজ সত্তায় আমাদের কাছে ধরা দেয়। সেই ধরা দেওয়াটাও আবার দর্শকদের মধ্যে স্বতন্ত্র যেমন সেই গল্প পাঠে হয়। তবু গল্পের সাথে পাঠকের আবেগের অনেক মিল থাকতেও পারে, থাকেও কিন্তু সেই গল্প নিয়ে সত্যজিৎ যেভাবে তাঁর শিল্প মাধ্যমে গল্প বলেন তার সাথে মিল থাকাটা ব্যক্তি-নিরপেক্ষ নয়। তার অনেকগুলো কারণ আছে সেটা পরে আলোচনায় আসছি। আমি প্রথমে সত্যজিতের একটা ছবি নিয়ে আমার নিজস্ব মনের ভাবনার কথা বলব। আসলে এটা একটা ছবি হলেও এর মধ্যে রয়েছে তিনটে গল্প যেন দুই মলাটের ভেতর তিনটে গল্প বলছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে সত্যজিতের এই বিনম্র সম্মান তাঁর নিজ শিল্পের মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছিল সারা পৃথিবীতে। অবশ্য ছবির দৈর্ঘ্যের বিচারে মাত্র দুটো ছবিই বিদেশের রূপোলী পর্দায় ছাড়পত্র পায়। সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের এমন তিনটে ছোটগল্প নির্বাচন করেছেন যেখানে তিনটেরই মূখ্য চরিত্র নারী, তিনটে ভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট আর সবার ওপরে তিনটে পৃথক মানসিক ঘরানার যা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দাবী করে। ‘তিন কন্যা’ নামে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় এই ছবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটে ছোটগল্পের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি, সেগুলো হল পোস্টমাস্টার, সমাপ্তি ও মণিহারা।
শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প লেখা শুরু করেন এবং দ্বিতীয় গল্প হচ্ছে পোস্টমাস্টার। হিতবাদী পত্রিকায় ১২৯৮তে মুদ্রিত। পোস্টমাস্টার গল্প থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য কারণ গল্পে বাক্যালাপ অত্যন্ত সীমিত। কলকাতার ছেলে পোস্টমাস্টারের চাকরি পেয়ে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম উলাপুরে এসেছে কাজ আরম্ভ করতে। সেই পোস্ট অফিসে একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা রতন পোস্টমাস্টারের কাজকর্ম করে দেয়। গল্প এগিয়ে চলে লেখকের নানা কল্পনার জগতে। গ্রামের কথা, রতনের সাথে নিরুপায় হয়ে শহুরে পোস্টমাস্টারের আলাপ জমানোর কথা, সময় কাটানো এবং কিছুটা করুণাবশত রতনকে লেখাপড়া শেখানো ইত্যাদি। ভাষার জাল বিছিয়েছেন দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ, “...নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।” লক্ষ্য করার মত যে রবীন্দ্রনাথ পোস্টমাস্টারকে পথিক বলছেন। ভাষার জাদু এবং গল্প রচনার পারদর্শিতায় দুই অচেনা অসম বয়সী ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের মানুষের ক্ষণিক মিলন ও বিচ্ছেদের কাহিনী এক অপূর্ব মাত্রায় উন্নীত। সিনেমায় সত্যজিৎ শহুরে পোস্টমাস্টারকে গ্রাম্য পরিবেশে এনে প্রথমেই, যেরকম সবাই হয়, সন্দেহ বাতিক দেখিয়েছেন, স্নানে যাবার আগে খুব স্বাভাবিকভাবে রতনের সামনে মানিব্যাগ কোটের পকেট থেকে বের করে লুকিয়ে বাক্সে রেখে তালা দেন। দশ-বারো বছরের রতনের নতুন বাবুর দিকে তেড়ছা চোখে তাকিয়ে তাকে বোঝার চেষ্টা এই অভিনয়টাও অনবদ্য। আবার স্নেহ পেয়ে তার মানসিক পরিবর্তন এত ন্যাচারাল মনেই হয় না অভিনয়। পরিচালকের মুনশিয়ানা এখানেই। গল্পে নেই অথচ এক মস্তিষ্ক বিকৃত লোককে উপস্থিত করে গ্রাম্য পরিবেশে শহুরে লোকের নার্ভের টেস্ট অভিনব সেইসাথে স্থানীয় প্রবীণদের গানের আসর। এই দুটোই পোস্টমাস্টারের স্নায়ুতে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে। শহুরে ভদ্রলোক অতিথিদের ক্ষণিকের স্নেহ অনাথ অবহেলিত রতনদের ভালবাসাকে আঘাত করে, অতিথি বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায়। এই বোধ যখন রতনদের আসে তখন তারা অভিমানভরে শুধুমাত্র অবজ্ঞাই করতে পারে আর সেটাই সত্যজিতের ছবির শেষ দৃশ্যে ফুটে উঠেছে।
সমাপ্তি গল্পটা হালকা মেজাজের এবং হাসি-মজার কিন্তু নারীর মানসিক চাওয়া-পাওয়ার একটা কষ্ট আছে। সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত। বাপের আদরে উচ্ছন্নে যাওয়া এক গেছোমেয়ের মেয়ের নাম মৃন্ময়ী। ঘন বর্ষার শেষে এক মেঘমুক্ত আকাশের দিনে অপূর্বকৃষ্ণ বি. এ. পাশ করে কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরছেন। নদীর ঘাটে নৌকো থেকে নামলেন এবং সাথে সাথে কাদায় পিছলে পড়লেন। তখনই কোথা থেকে হাসির ফোয়ারা উঠল। অপূর্ব চিনতে পারল মেয়েটিকে, মৃন্ময়ী। হাস্যরস দিয়ে এই কাহিনী শুরু এবং আগাগোড়া লেখক সেই রসটিকে নীরস হতে দেন নি। গল্পের রসের শেষটুকু রবীন্দ্রনাথ শেষ প্যারাগ্রাফে ঢেলে দিয়েছেন – “হঠাৎ বলয়নিক্কণশব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মত আসিয়া পড়িয়া অবিরল অশ্রুজলসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময় প্রকাশের অবসর দিল না।”
এমন একটা মিষ্টি রসসিক্ত প্রেমের গল্পের চিত্রনাট্য হাত খুলে তৈরি করেছেন সত্যজিৎ রায়। পরিচালক হিসেবে যে স্বাধীনতার কথা তিনি মানতেন তা এখানেও বজায় রেখেছেন। গল্পের প্লট ছায়াছবির প্রয়োজন অনুসারে বদলে দিয়ে তিনি অন্যভাবে একটা গল্প বলেছেন। সমাপ্তি ছবির লোকেশন গল্পের মত। চিত্রনাট্যে কয়েকটা কথা দৃশ্য যোগ হয়। ছবিতে মৃন্ময়ীকে পাগলী বলে ডাকা হয় তার ওই গেছো স্বভাবের জন্যে। প্রকৃতির মতই মৃন্ময়ীর মুক্তির প্রতীক দোলনা এবং কঠিন সময়ে সেখানে মানসিক আশ্রয়ও পায়। গল্পে যেভাবে ভাষায় প্রকৃতির দুরন্তপনার সাথে মৃন্ময়ীকে দেখানো হয়েছে ছবিতে সেটা বোঝানোর জন্যে একটা প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে – কাঠবিড়ালি, যে সদাচঞ্চল। কিন্তু প্রতীক হয়ে উঠেছে ছবিরই এক চরিত্র, তাকে আর প্রতীক বলা যাবে না। ছবির শেষে যখন পাগলী গেছো থেকে যুবতী হয় তখন সেই কাঠবিড়ালির মৃত্যু হয় এবং তাকে মাটিতে পুঁতে নয় পুড়িয়ে দেবার আদেশ দেয় তার একসময়ের খেলার সাথীকে। রবীন্দ্রনাথ গল্পের শেষে চুম্বনের মনোরম দৃশ্য লিখলেও ভারতীয় সংস্কৃতি মেনে ছবিতে তা সচেষ্টভাবে প্রতিহত করা হয়েছে ট্র্যাডিশনাল দরজা বন্ধ করে প্রাইভেসি বজায় রেখে। অপূর্ব ও মৃন্ময়ী দুজনেরই বিবাহের পরে নিজ নিজ মানসিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি অদ্ভূত কৌশলে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছবিতে চোখের ভাষা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা জায়গায়।
ভারতী পত্রিকার নভেম্বর ১৮৯৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘মণিহারা’। কলকাতায় পূর্বপুরুষের ব্যবসার উত্তরাধিকারী ফণিভূষণ তাঁর সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী মণিমালিকাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। স্বামীটি ছিলেন নব্যসভ্যতার আদলে আদর্শ যিনি স্ত্রীর ওপর কোনোরকম প্রভূত্ব তো খাটায়ই না এমনকি ভালোবাসা নিবেদনেও জোর করেন না। তারা ছিলেন নিঃসন্তান। মণিমালিকার ছিল গয়নার প্রতি প্রবল আসক্তি। এই আসক্তি এমন পর্যায় চলে যায় যে স্বামীর ব্যবসা মন্দ হলে মণিমালা, পাছে স্বামী গয়না দাবি করে তাই তার গয়না নিয়ে পরিচিত লোকের সাথে পালিয়ে যায়। গল্পে ঘটনার ঘনঘটা ও চমক কিন্তু কথোপকথন কম। গল্পের সারমর্ম ও মূল উপাদান অপরিবর্তিত রেখে সত্যজিৎ ঢেলে সাজিয়েছেন চিত্রনাট্য। এই ছবিতে যেটা সবার আগে আকর্ষণ করে তা আবহ ও সংগীত। শুরুতেই গা ছমছমে আবহ এবং তারপর আবহে ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘বাজে করুণ সুরে’ গানের রেশ সারা ছবিটায় সুতোর কাজ করেছে। গানের শেষ দুটো পঙক্তি ‘তেমনি চিত্ত উদাসী রে / নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে’ – এটাই যেন পুরো ছবিটার মূল কথা। পুরো গানটা রুমা গুহঠাকুরতার গলায় সুন্দর মানিয়েছে চিত্রায়নে। পরিচালক মোক্ষম ভয়ের দৃশ্য তৈরি করেছেন শেষে গয়না পরা কঙ্কালের আগমন ও ফণিভূষনের হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া দেখিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় গল্পের চলচ্চিত্রায়ন করেছেন সত্যজিৎ নায়িকার নাম মিলিয়ে ‘চারুলতা’ ১৯৬৪ সালে। উনিশ শতকের বাংলার অবস্থাপন্ন বাড়ির ঘরের সন্তানহীন উচ্চবিত্ত স্ত্রী ঘরে-বাইরে সর্বসুখস্বাচ্ছন্দের মধ্যে থেকেও স্বামীসঙ্গ না পেয়ে কতটা একা ও নিঃসঙ্গ সেই গল্প নিয়েই তৈরি এই ছবি সত্যজিতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি বলে স্বীকৃত। নিঃসঙ্গতাকে অভ্যেস করে নিয়েও সেই একাকীত্বের মধ্যে আগত দেওর অমলের সাথে খোলা মনে মেলামেশা থেকে মানসিক দুর্বলতা তৈরি হয় যার পরিণতি সাময়িক প্রেমের আবেগ। অমলের অধরা প্রেম চারুর সমস্ত সত্তাকে আলোড়িত করেছিল। নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে গিয়ে একসময় অনেকটা চ্যালেঞ্জের মত নিয়ে চারুর লেখা এক নামকরা পত্রিকায় প্রকাশ হয়। রবীন্দ্রনাথ চারুর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন, “আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পদার্থ তুমিই ফুটাইয়াছ”। ছবিতে এখানে একাধিক ঘটনা পরপর কয়েকটা দৃশ্যে ঘটিয়ে সত্যজিৎ বোঝাতে চেয়েছেন চারুর লেখা তার অমলের প্রতি পরাভূত প্রেমকেই প্রকট করেছে। অমলের প্রশংসা বাক্য চারুর পুঞ্জিভূত আবেগকে উচ্ছ্বসিত করে অমলের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেসে গেছে।
ঘরে বাইরে উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ মূলত সমাজের তিনটে দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন – জাতীয়তাবাদ, নারীর বন্ধন-মুক্তি এবং বহমান ও আধুনিকের মধ্যে চিরকালীন দ্বন্দ্ব। সত্যজিৎ সমনামে এই উপন্যাস চলচিত্রায়ণ করেন ১৯৮৪ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলন মোহনদাস গান্ধীর নেতৃত্বে গড়ে উঠলে অহিংস আন্দোলনের সাথে বাংলায় সহিংস আন্দোলনও শুরু হয়। তার প্রেক্ষিতে সমাজে গভীর প্রভাব পড়ে। উচ্চবিত্ত ঘরের প্রায় পর্দানশীন গৃহবধূ ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের লোকের কথার চাতুরিতে মুগ্ধ হয়ে যায়। এখানেও সেই একাকীত্বের নিঃসঙ্গতা বিমলাকে সন্দীপের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। অবশেষে সন্দীপের হঠকারিতার পর বিমলা তার ভুল বুঝতে পারে। এক সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে তৎকালীন কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কীভাবে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে বিপথে চালনা করেছিল তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখনীতে এবং সত্যজিৎ তাঁর ছবির ভাষায় চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায় এই দুই মহান শিল্পীর ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্র। দুজনের শিল্প মাধ্যম আলাদা। চিন্তার জগতও ভিন্ন। তবু দুজনের মনুষ্যত্বের মানসিকতা এক। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প একটা সরলরেখা ধরে নির্দিষ্ট গতিতে চলে, যেটুকু বাঁক আছে তা সহজেই পেরিয়ে যাওয়া যায়। সত্যজিতের গল্প সরলরেখা ধরে চলে না সিনেমার খাতিরে কারণ সিনেমায় উত্তেজনার ছিটে রাখতে হয় দর্শককে বসিয়ে ছবি দেখানোর জন্যে। তাই সত্যজিতের ছবিতে যা দেখা যায় আর যা বলতে চায় গল্প তার মধ্যে একটা দ্বৈত থাকে যা অনেকসময় সমালোচকের ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ হয়। তবে ছবির শেষে আমরা যখন একটা পজিটিভ বক্তব্য দেখি তখনই সার্থক হয় সেই ছবি।
1 Comments
খুব সুন্দর হয়েছে
ReplyDelete