জ্বলদর্চি

দুই নদী /পুলক কান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

দুই নদী

পুলক কান্তি কর

সারির ঘরের ছিটকিনি তোলার শব্দটা পেয়ে অনুষ্কা কিছুটা বিষন্ন হয়ে পড়লো। এরপরে সারি যা যা করবে, সেটা এক প্রকার ওর মুখস্থ। বারো থেকে চৌদ্দ মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলবে। প্রমিতকে ভেতরে বসিয়েই সারি বাথরুমে গিয়ে ঢুকবে। পাক্কা এক ঘন্টা দশ মিনিট শাওয়ারের জল ছেড়ে স্নান করবে। জলের ঝাপটা মেরে মেরে আর ছোবড়া ডলে ডলে সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কলা-কোষ গুলোকে পুনর্জীবিত করে যখন বেরোবে, তখন ওর চোখগুলো টকটকে লাল, মুখটা থমথমে। ওদের অলিখিত নিয়ম, এই ফাঁকে অন্যকেউ মানে অনুষ্কাই হোক বা অর্পিতা – কেউ একজন চা বসাবে। সেটা অনুষ্কার কাছে পর্ণাভ এলে সারিও ও চা করে দেয়। বছর তিনেক হল ওরা তিন বন্ধু একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বাগবাজারের কাছাকাছি থাকে । প্রথম প্রথম যে অস্বস্তি ছিল, বাধ্যতায় সেসব এখন আর মাথায় আসে না। তবে অর্পিতার স্টেডি কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই, কেউ হলেও অর্পিতা এতদূর কাউকেই অ্যালাউ করে না । ফলে বাকি দুজনের ঘরে বয়ফ্রেন্ড এলে ও খানিকটা কৌতুক করে। বিশেষ করে অনুষ্কাকে। সারি  এমন একটা মুড নিয়ে বাইরে বেরোয়, ওকে ঠিক রসিকতা করার ইচ্ছে আর থাকে না। আজ অর্পিতা নেই। প্রমিতও বোধহয় আজকে আগে থেকে বলে আসেনি। সারির আজ বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। যাই হোক একটু পরে সারি এসে রান্নাঘরে দাঁড়ালো, ‘দে চা টা নিয়ে যাই ভেতরে।’
– আমি একটা কথা বলব সারি ?
– বল না।
– আচ্ছা থাক, তুই এখন চা টা নিয়ে যা, রাতে কথা বলব। আর শোন না, ঘরে তো কিছু তেমন নেই; বিজয়ার পরে প্রমিত প্রথম এল, একটু কিছু বানিয়ে দেবো কি?
– থাক দরকার নেই। আমি তো বেরোবো একটু পরে। বাইরে কিছু নিয়ে নেব ।
– রাতে তুই কি তাহলে ঘরে খাবি না?
– না রে। আজ তোর মত শুধু করে নে।
    বাইরের দিকে হঠাৎ চোখ গেল অনুষ্কার। ‘সারি বাইরে দেখ, বিরাট মেঘ । তুই বেরোবি কী করে? তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’
    বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। চা খেতে খেতেই হাওয়ার তীব্র আওয়াজ আর তার সঙ্গে দরজা-জানলার লুটোপুটির শব্দ কানে এলো সবার। সারি চিন্তিত হয়ে বলল, ‘তুই কী করে যাবি প্রমিত?’
 – তাই তো রে! দ্যাখ দেখি ওলা-উবের কিছু পাওয়া যায় নাকি। নেটটাও ভালো কাজ করে না এই ফ্ল্যাটে। তাও অনেক চেষ্টা করে একটা ক্যাবও পাওয়া গেল না এই মুহূর্তে। ঘন্টা দুয়েক কেটে গেল। বৃষ্টি থামার নাম নেই কোনও। সারি বাইরে এসে অনুষ্কাকে বলল ‘কী করি বল তো! এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তো প্রমিতকে যেতে বলতেও পারি না। সবচেয়ে বড় কথা যাবেই বা কীভাবে?’
– তা তো ঠিক সারি। দেখ আর ঘন্টাখানেক ।
– তাতেই বা কী লাভ অনু! এই বৃষ্টি থামবে না। নেটে দেখলাম বৃষ্টির ফোরকাস্ট অলরেডি ছিলই। ডিপ্রেশন হয়েছে কোথাও, আমারই শুধু খেয়াল করিনি।
– তাহলে উপায়?
–  আমিও তো তাই ভাবছি রে। বাড়ীর মালিকের কানে গেলে অনর্থ করবে। রাত্রে থাকাটা তো অ্যালাউড না।
– প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে মানুষ কী করবে? কিছুটা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে কথাটা বলল অনুষ্কা।
– আরও একটা সমস্যা আছে অনু। ধর প্রমিত থেকেও গেল। রাতে শোবে কোথায়?
– ন্যাকামী দেখলে বাঁচিনা সারি, কোন কাজটা বাকী রেখেছ সোনা যে রাতে একসাথে শুলে দোষ হবে? এতক্ষণ তো তাই করে এলে!
–  ও তুই বুঝবি না অনু। একসাথে রাতে ওর সাথে আমি থাকতে পারবো না।
– মানেটা কী?
– মানেটা তোকে বলতে পারব না অনু। সারির গলাটা নীচু স্বরেই ছিল; কেমন যেন আর্তনাদের মতো শোনালো। অনুষ্কা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। কথাটা ওর বেজেছে। আসলে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব এতখানি খোলামেলার যে সারি ওকে কিছু বলতে পারে না – এটা ভাবতে ওর চোখে জল চলে এল। সারি  ওর হাত দুটো মুঠোয় ধরে বলল, ‘রাগ করিস না ভাই। আমার বলাটা রূঢ় শোনালো, কিন্তু আমি নাচার।’
– ঠিক আছে, এসব কথা পরে আলোচনা করা যাবে। রাতের জন্য খিচুড়ী বসিয়ে দেব তিনজনের মত?
– তুই বোস অনু। আমি বসিয়ে দেব ।
– তা কেন? তুই ভিতরে যা না! গল্প কর গিয়ে প্রমিতের সাথে। প্রায় একমাস পরে এল। 
– এখন আমার ওর সাথে  গল্প করতে ইচ্ছে করছে না অনু। ইনফ্যাক্ট এখুনি আমার ওর মুখ দেখতেও ইচ্ছে করছে না।
🍂
ad

  স্ট্রেঞ্জ! মনে মনে ভাবলো অনুষ্কা। কই পর্ণাভ এলে তো এর এমন মনে হয় না! বরং উল্টোটা মনে হয়। এক মুহূর্তও ওকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। সব সময় মনে হয় ওর বুকটার মধ্যে মুখ গুঁজে কুঁকড়ে ছোট হয়ে শুয়ে থাকে সারা সময়টুকু । 'তুই এক কাজ কর সারি, প্রমিত না হয় তোর ঘরেই থাকুক; তুই আমার ঘরে চলে আয়। একসঙ্গে শুয়ে যাব।’
– আগে থেকে বুঝতে পারলে অর্পিতার থেকে ওর রুমের চাবিটা চেয়ে রাখতাম ।
– সে আর কী করা যাবে সারি। তুই তাহলে চালটাল গুলো ধো, আমি বরং একটু চানাচুর আর স্ন্যাকস কিছু প্রমিতের কাছে রেখে আসি; দু দশ মিনিট কাটিয়েও আসি – নইলে ওর খারাপ লাগবে।
    অনুষ্কার চলে যাওইয়াটা একমনে দেখলো সারি। মেয়েটার মনটা ভারী ভালো। সারি জানি আজ ওর কথায় মেয়েটা দুঃখ পেয়েছে,  কিন্তু কী আর করা যাবে। অনুষ্কা রাগ পুষে রাখার মেয়ে নয়। সারির মা বলেন ভালো খিচুড়ি রাঁধতে হলে তিনভাগ মুসুরির ডালের সাথে এক কাপ সেদ্ধ চাল দিতে হয়। সারি ওই মাপে তিনজনের মতো খিচুড়ির চাল ডাল নিল। ওমলেটটা একটু টমেটো কুচি আর পেঁয়াজ দিয়ে স্টিম  করে বানালে বেশ ফুলো হবে। এসব করতে করতে বেশ দেড় দু'ঘণ্টা কেটে যাবে, আর প্রমিতের মুখোমুখি হতে হবে না ভেবেই ভালো লাগলো তার। অনান্য দিন রাঁধতে তার একটুও ভালো লাগে না, আজ ইচ্ছে করে টাইম নিয়ে নিয়ে সে এক একটা কাজ করতে লাগলো। সমস্যা হল প্রমিত যদি রাতেও একসাথে শোয়ার বায়না করে, ওকে থামবে কী বলে। ‘অনুষ্কা কী ভাববে’ – এই অজুহাত চলবে না, কেননা প্রমিত ভালো করেই জানে অনুষ্কার কাছে ওদের রিলেশনের কথা গোপন নেই। কোনোরকম বাড়িওয়ালার কথা বলে ভুজুং ভাজুং দিতে হবে, যদিও বিশ্বাস করানোটা শক্ত। ওদের ফ্ল্যাটের উপরের তলাতেই বাড়িওয়ালা থাকে, মধ্যরাত্রে তারা নিশ্চয়ই সরজমিনে দেখতে আসবে না। তবুও এই পয়েন্টে স্টিক করে থাকতে হবে ওকে। কোনওভাবে ওখান থেকে নড়লে হবে না। এক অনুষ্কা যদি না কিছু আলটপকা উপদেশ দিয়ে বসে। 'নে নে  কিছু হবে না’, বা ‘আরে কেউ এলে তো আগে বেল বাজাবে না কি?’ – এই জাতীয় কিছু বললে মুশকিল। তবে আজ সারি যেরকম ইঙ্গিত দিয়েছে মনে হয় না অনুষ্কা এ জাতীয় কোনও ভুল করবে। হঠাৎ শুনল ওর মোবাইলের রিংটোন বাজছে। মোবাইলটা ওর ঘরেই রাখা। তাকিয়ে দেখলে অনুষ্কা ফোনটা নিয়ে এলো বাইরে – ‘নে রে অর্পিতার ফোন।’
    সারি ফোনটা তুলতেই কল কল করে কত কী বলে গেল অর্পিতা। অধিকাংশই হাসি মষ্করা প্রমিতকে নিয়ে। নির্ঘাত অনুষ্কা বলে দিয়েছে। 'কী রে সারি, মোম জোছনা তো নেই, এত বৃষ্টি বাদল, তাহলে সারারাত কি অঙ্গ ভিজিয়ে গল্প হবে, নাকি অন্য কিছু? হিহি করে আবার হাসতে শুরু করলো অর্পিতা। সারির কানে যেন কেউ সীসা গরম করে ঢেলে দিল, অথচ বলার কিছু উপায় নেই। ও জোর করে একটু হাসিমুখে টেনে বলল, ‘আজি বরিষন মুখরিত শ্রাবণ রাতি/ ব্যথা বেদনার মায়া একলা গাঁথি...’
–  কেন সোনা , একলা গাঁথবে কেন ? শুক-সারি একসাথে থাকলে তো রাই জাগার গানই হয়। 
– ও তো কীষণ জনমমে বেটা! তবু তো তব মখখন মিলতা থা। আভি তো স্রিফ দারু হ্যায়, ঘুট ঘুটকে পীনা পড়ে গা। শুক-সারি কা স্টোরি অভি খতম।
 – দারুন মুডে আছিস মনে হচ্ছে সারি। জিসম খুশ তো দিল খুশ। বাঃ বাঃ । বেস্ট অফ লাক।
– ফর ?
– ফর ইয়োর রেস্ট নাইট। হাঃ হাঃ হাঃ। বাই দা বাই, তোকে একটা খবর দেবার জন্য ফোন করেছিলাম।
– কী ব্যাপারে রে? 
– তোর অফিসের দীপাংশু আজ আমাকে প্রপোজ করেছে।
– ভালো খবর তো রে ! ও ভালো ছেলে।
– হ্যাঁ, ভালো টাইম পাস।
– না রে অপু। ও ঠিক টাইম পাসের এলিমেন্ট নয়। ও বিয়ের এলিমেন্ট।
– ইনফ্যাক্ট ও আমাকে বিয়ের প্রপোজালই দিয়েছে । বলছে আমি যদি ইন্টারেস্টড হই, তবে ওর বাবা-মা এসে আমার বাড়িতে কথা বলবে।
– ওর তো বিদেশে যাওয়ার কথা চলছে। বোধ হয় তার জন্য বিয়েটা সেটেল করতে চাইছে।
– কিন্তু তোর পেছনে ঘুরঘুর করছে বলেছিলি তার কী হল? 
– ওভাবে বলিস না । অতটাও কিছু নয়। একটু ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছিল।
– ভাগালি কী করে? প্রমিতের কথা বলে দিলি নাকি?
– না না। ওর কথা অফিসে কেউ জানে না। 
– তবে? কাটালি কী করে? 
– আরে ছেলেটা খুব ভাল রে। দু একবার আমার ঠান্ডা ব্যবহার দেখেই বুঝে গেল। তুই তো ওকে দেখেছিস, ও খুবই ভদ্রলোক। তোর সাথে তো হোয়াটস অ্যাপ ফেসবুকে যোগাযোগ আছে। দেখবি খুব ইন্টেলেকচুয়াল। ওর ব্যাপারে ভাবতে পারিস সেটেলমেন্টের ব্যাপারে। খারাপ হবে না।
–  সে না হয় ভাবলাম।  তুই নিজের ব্যাপারে কী ভাবছিস? প্রমিত কি বিয়ে টিয়ে নিয়ে কিছু বলছে?
– না।
– তবে তুই মিছিমিছি ওর সাথে পড়ে আছিস কেন? আর দীপাংশুর কথা তো তুইও ভাবতে পারতিস! বা অন্য কোনও ছেলের সম্বন্ধে। তোর অ্যাডমায়ারার তো কম নয়!
– ছাড় এসব কথা। আমি এখন রান্না চড়াবো।
– অনুষ্কাটা কি আজীব রে! আজকে তোকে রাঁধতে দিয়েছে? পর্ণাভ এলে তো ঘরের দরজাই খোলে না। তোকে রিলিফ দিতে পারল না আজ? দাঁড়া, আচ্ছা করে ঝাড় দিই ওকে।
–  না রে অপু , ওকে কিছু বলিস না। ও করতেই চেয়েছিল, আমি বারণ করলাম। 
– কেন সখি। রাতের আগে কি বিরহ বেদনা বাড়িয়ে দিতে চাইছো বেচারা প্রমিতের ।
    মৃদু হাসলো সারি। ফোন রাখার আগে বলল, ‘দীপাংশুর ব্যাপারটা ভাবতে পারিস অপু।’
    রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় বারোটা বাজল। সারি ইচ্ছা করেই দেরি করে অনুষ্কার ঘরে এল খানিকটা ওকে এড়ানোর জন্য। যদিও জানে আজ এই নিয়ে কথা উঠবেই এবং ওকে বিশ্বাসযোগ্য কিছু বলতেই হবে। কিন্তু কীই যে বলবে মাথায় এলো না তার। অনুষ্কার সাথে প্রায় দশ বছরের বন্ধুত্ব, সেই কলেজ জীবন থেকে। ওকে কোনওভাবে দুঃখ দিতে মন চায় না। ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে অনুষ্কা বলল, ‘কীরে, প্রমিতকে ম্যানেজ করতে পারলি?’
– কোনও রকমে।
– কীভাবে রে ? ওতো ছাড়ার লোক নয়।
– হ্যাঁ ! একেবারে ছিনে জোকঁ।
–  তাঁ জোকেঁর মুখে নুনটা দিলি কী বলে?
–  বললাম পিরিয়ড হয়ে গেছে।
– বিশ্বাস করল।
–  না বিশ্বাস করার কী আছে? হতে পারে না? 
– তা নয়। পর্ণাভ হলে করতো না। আমার ডেট ফেট সব ওর মুখস্থ থাকে। 
– ভাগ্যিস প্রমিত এসব মনে রাখে না!
 – জানিস সারি আমার কিন্তু পর্ণাভের এই ব্যাপারগুলো ভালো লাগে। আমার সবকিছু ও যেভাবে খেয়াল রাখে, তা সত্যিই কোথাও যেন আমাকে ভিজিয়ে দেয়। সম্ভাব্য ডেট এলে ও আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে শুরু হয়েছে কিনা, ব্যথা হচ্ছে কিনা, ওষুধ নিয়ে আসবে নাকি – এরকম কত কী! আমি ঠিক বুঝিনা তুই এইসবে এত বিরক্ত হোস কেন!
– আমি সব বিষয় শেয়ার করতে পারি না অনু। সে যত প্রিয়জনই হোক। এটা একেবারেই একটা নিভৃত বিষয়। 
– সবাই আর হবু বর কি এক হল। বরদের কারবার তো নিভৃক বিষয় নিয়েই, সুতরাং তার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে অসুবিধে কি? আমার  সবকিছু যেমন ও জানবে, ওর সবকিছুও তেমনি আমি জানবো।
 – সবাই তো একই রকম হয় না অনু । আমার একদম ভালো লাগে না এসব। 
– তোকে আমি মাঝে মাঝে এরকম বুঝতে পারি না সারি। যে তুই এতখানি রিজার্ভড সেই আবার এমন করে প্রাক বিবাহ রিলেশনশিপে এভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে আমার মাথায় ঢোকে না। সত্যি বড় অদ্ভুত চিড়িয়াখানা। 
– তা ঠিক বলেছিস। খানিকটা এড়িয়ে যাওয়ার ঢঙে বলল সারি।
– সবচেয়ে আমার একটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগে সারি; আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি প্রমিতের সাথে তোর এই ব্যাপারটা তুই একেবারে এনজয় করিস না।
    সারি চুপ করে রইল। অনুষ্কা আবার বলল, ‘কীরে ঠিক বলেছি তো?’
   একটু চুপ করে সারি বলল ‘হ্যাঁ। কিন্তু তোর এটা মনে হল কেন? আজ রাত্রে ওর সাথে থাকলাম না বলে?’ 
– না রে! আমি অনেকদিন থেকেই বিষয়টা নোটিশ করছি। তুই বেরিয়ে এসে যেভাবে স্নান করিস, মেথরেরা ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করেও বুঝি এতখানি স্নান করে না। তোর নর্মাল দিনে স্নান করতে হার্ডলি দশ মিনিট লাগে। আর শ্যাম্পু করলে এক্সট্রা পনেরো মিনিট। 
    সারি কিছু উত্তর দিল না এ কথার! অনুষ্কা আবার বলল, ‘এনজয় যদি না করিস, সারাজীবন ওর সাথে কাটাবি কী করে?’
– ওর সাথে সারা জীবন কাটাবো কেন?
– মানে? আকাশ থেকে যেন পড়লে অনুষ্কা। বলল, ‘তুই একে বিয়ে করবি না?’
– না ।
– তবে?
– তবে কী?
 – তবে এর সাথে এত সব সম্পর্ক বাড়তে দিয়েছিস কেন?
– ভাগ্য ! সারি নিস্পৃহ ভাবে বলল।
– আমার কেমন হেঁয়ালির মতো লাগছে সারি। এর মধ্যে ভাগ্যটা আসছে কোত্থেকে। আমার এই ব্যাপারটা ভালো লাগছে না ।আমি অ্যালাউ করব কেন ? কোনও ব্ল্যাকমেল টেলের ব্যাপার আছে নাকি?
– না না। সেসব কিছু না। আমার ভালো লাগে না ঠিক, তবে তার মানে এই নয় যে প্রমিত আমাকে জোর করে।
– তবে তুই করতে দিস কেন?
– তুই অগ্নিশ্বর ফিল্মটা দেখেছিস অনু?
–  হ্যাঁ ।
 –ওখানে একটা রোলটা মনে আছে?
– কোনটা বল দেখি?
–  ওই যে একজন নিম্নবিত্তের এক মধ্যবয়সী মহিলা গনোরিয়া রোগ নিয়ে অগ্নিশ্বরকে দেখাতে এসেছিলেন! মনে পড়ছে?
– অনেকদিন আগে দেখা তো! তুই বল ঘটনাটা।
– তা অগ্নিশ্বর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার এই রোগ হলো কী করে ? তোমার স্বামীর কি কোনও যৌনরোগ আছে?’ তখন মেয়েটি বলল, ‘না স্বামীর কোনও রোগ নেই।’ 'তাহলে তোমার হল কোত্থেকে?' মহিলাটি একজন কেতাদুরস্ত সৌখিন লোককে দেখিয়ে দিল। ওই লোকটিও এই রোগ নিয়ে অগ্নিশ্বরকে দেখিয়ে গেছে একটু আগেই। অগ্নীশ্বর কিছুটা কৌতুহলী ইঙ্গিত করতে মেয়েটি বলল, 'আপনাকে কেউ ভিখ সাংগলে আপনি কিছু দেন না বাবু ?’
– মানেটা কি সারি? এইরকম যে কেউ এসে ভিক্ষা চাইবে, তুই দিবি?
– ব্যাপারটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। সবার জন্য কেন হবে? কিন্তু যে দ্বারটা একেবারে খুলে গেছে, তা না বলি কী করে? 
– প্রমিত নিজে বোঝেনা তুই বিষয়টা একদম এনজয় করিস না? বা র‍্যাদার তোর মনে ব্যাপারটা নিয়ে বিদ্বেষ আছে?
– জানি না।
– জানি না মানেটা কি? ওরকম সময়ে মানুষের মুখ দেখেও তো বোঝা যায়। 
– আমি সে সময়টা ওর মুখের দিকে তাকাই না অনু। আমি চোখ বন্ধ করে নিই। যান্ত্রিক ভাবে সব কিছু চলে। আমি তখন নিজের ভেতরে চোখ মেলি অনু। আমার ভেতরের সর্বাঙ্গ তখন কষ্টে ভিজে যায়, বাইরের খবর আমি রাখি না।
– এটা তো সুস্থতা নয় সারি। তুই সেরকম হলে প্রমিতকে বল তোর সমস্যার কথা। ডাক্তার দেখা।
– কোনটা সুস্থতা নয় অনু? মুখের দিকে না তাকানোটা?
– ওটাও বটে! তবে আমি এনজয় করা না করার ব্যাপারটা বলছিলাম। তোর এখন যৌবন বয়স। আমি তো দারুণ এনজয় করি, তোর ভালো লাগে না কেন ?
– আমি তো এমন সুস্থতা চাইনা অনু। আমি এ বিষয়টা এনজয় করতে চাই না।
– ঠিক আছে, মেনে নিলাম। কিন্তু সারি তোর এখন ছাব্বিশ বছর বয়স। তুই জীবনটা একটা অসম্পূর্ণতা নিয়ে কেন কাটাবি? আমার কথা শোন, ডাক্তার দেখা। আর একটা কথা। প্রমিতকে বিয়ে করবি না কেন? ওর কি অন্য কোনও দোষ আছে? আই মিন ছেলে হিসেবে কি খারাপ?
– না না। প্রমিত এমনিতে খারাপ নয়। ভাল চাকরি করে। স্বভাব চরিত্রে অন্য কোনও দোষ আছে কিনা জানিনা।
– তাহলে সমস্যাটা কী?
– ও আমার রিলেশনের মধ্যে হয় অনু। ও আমার মাসতুতো দাদা।  
    প্রায় অর্তনাদ করে উঠল অনুষ্কা, ‘বলিস কী? এমন সম্পর্কে তুই জড়ালি কেন?’
–  দ্যাখ অনু প্রমিত আমার প্রায় পিঠোপিঠি। মেরেকেটে ও আমার থেকে বছর দেড়েকের বড়। আমরা ছোটবেলায় নিয়ম করে দুবার মামার বাড়ি যেতাম, শীতে আর গরমের ছুটিতে। একসাথে বড় হতে হতে কখন পরস্পরের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেল – বুঝতে পারিনি। প্রমিত খুব ভালো ছবি আঁকত, খুব ভালো খেলাধূলোয় ছিল বলে আমাদের ভাই বোনের মধ্যে একটু ওর হিরোগিরি চলতো বেশি। তাছাড়া দেখতে শুনতে তো ভালোই ছিল। ওর যখন টুয়েলভের পরীক্ষা শেষ হল তখন একবার আমাদের বাড়িতে এল। রোজ দুপুরে চিলেকোঠায় উঠে খেলার ফাঁকে একদিন হঠাৎ আমায় বলল আমার একটা পোট্রেট আঁকবে। সেদিন বাড়ীতে কেউ ছিল না, মা আর মাসী দুপুরের শো এ সিনেমা গিয়েছিল।  ভাই ইস্কুলে আর বাপি অফিসে। আমাকে পোজ দেওয়ার ভঙ্গি দেখাতে এসে কখন আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল, আমি বুঝতেই পারলাম না। মিথ্যে বলে লাভ নেই, আমিও তখন ওকে পছন্দ করতাম, আমি বাধা দিই নি। সেই শুরু। তারপর ও কলকাতা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এল...
– তোর তখন কোন ক্লাশ?
– ইলেভেন।
–  তারপর?
– তারপর আমারও হায়ার সেকেন্ডারি কমপ্লিট হল। আমিও কলকাতা এলাম। তখন থেকে ও নিয়মিত ব্যাপারটা নিয়ে মাতামাতি শুরু করল।
– তখন কি তুই এনজয় করতিস? নাকি তখনও এখনকার মতন গ্লানি এসে চেপে ধরতো মাথায় ?
– কলকাতায় এসে প্রথম দু-একবার ব্যাপারটা বেশ থ্রিলিং ছিল। মাস চার পাঁচ পর থেকে আমার কেমন একটা অপরাধ বোধ জাগতে শুরু করল ।
– অপরাধ বোধ, নাকি পাপ বোধ।
– হয়তো দুটোই। তখন থেকেই আমি ক্রমশ নিজের গর্ত্তে ঢুকে যেতে লাগলাম।
– যখন তোর খারাপ লাগতে শুরু করল তখন না বলিস নি কেন? তখনই তো তোর বাধা দেওয়া উচিৎ ছিল।
– হয়তো ছিল। কিন্তু প্রমিত এমন করুণ মুখে করে চাইতো, না বলতে পারতাম না।
– ব্যাপারটাকে তো তুই সত্যি সত্যি ভিক্ষে দেওয়ার স্তরে নামিয়ে এনেছিস সারি।
– আমার কাছে তো ব্যাপারটা তাই ।
– জানিস সারি, আমার মনে হয় তোর এই অপরাধ বোধটা কেটে গেল তোর এই স্টিফনেসটা কেটে যাবে। তুই আর শারীরিক কষ্ট গুলো পাবি না । 
– শারীরিক কষ্টগুলোকে আমি গুরুত্ব দিই না অনু। আমার কষ্ট হয় মনে।
– আমি তো সেই কথাই বলছি সারি। মনকে মিছিমিছি কষ্ট দিচ্ছিস কেন? তোর হয়তো মনে হচ্ছে মাসতুতো ভাই-বোনের এই সম্পর্ক নিষিদ্ধ। কিন্তু স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে তো আজকাল এসব রিলেশনে বিয়ে হচ্ছে। আমাদের মধ্যে চেনা পরিচিত অনেকে এরকম বিয়ে করছেন। সমাজে খুব উঁচুতলাতেও এর উদাহরণ বিরল নয়। তাঁরাও তো দীর্ঘ জীবন সুখী দাম্পত্যই কাটিয়েছেন সারি!
– হয়তো তুই ঠিক বলেছিস। কিন্তু আমার মন সায় দেয় না।
– তোকে প্রমিত কখনও বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি।
– না। আমি জানি ওর সে হিম্মত নেই। ও শান্তিপ্রিয় গুডি গুডি বয়। ঝঞ্জাট এড়িয়ে থাকতে ভালবাসে। ওর মা বাবা সাঙ্ঘাতিক কড়া। ওদের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কিছু করা ওর দ্বারা সম্ভব নয়। 
– আমি বুঝেছি । ওর এই অক্ষমতাই তোর মধ্যে এরকম একটা উদাসীনতা এবং কাঠিন্য এনে দিয়েছে । সেরকম হলে আমি কথা বলছি ওর সাথে।
–  তুই হাতি বুঝেছিস অনু। ছেলেরা বড় বড় বিদ্রোহ বা বিপ্লব কখন করে? যখন তার সাথীটিও তাকে এই ব্যাপারে প্ররোচিত করে। হয় তার কাছে এবং এই সুযোগে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতেই মানুষ এমন সামাজিক বিপ্লব করে। প্রমিত যখন দেখছে আমি এ বিষয়ে একেবারে নিরুত্তাপ এবং আমার এ বিষয়ে একেবারে চাহিদা নেই, ও মিছিমিছি আগ বাড়িয়ে রাজা রামমোহন হতে যাবে কেন?
– তাহলে তুই তাকে প্ররোচিত কর। উত্তপ্ত কর ওকে প্রতিদিন।
– আমি তো ওটাই চাই না রে। তুই বিশ্বাস কর, আমি নিজে এক বিন্দু চাই না ও প্ররোচিত হোক বা আমাকে বিয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ুক। আমি ওর সাথে সারা জীবন কাটাতে পারব না অনু। এর থেকে আমাকে ফাঁকা বনে ছেড়ে দিলে বোধহয় আমি বেশী সুখী হবো।
– কিন্তু এভাবে কি জীবন চলবে সারি? ঠিক আছে, একে পছন্দ না হয় ছেড়ে দে। অন্য কোনও সম্পর্কে জোড় নিজেকে, তাকে বিয়ে কর ।
– আমি জানি না অনু, ভবিষ্যতে কী হবে! কিন্তু আজকাল বিয়ের কথা ভাবলেই গাটা কেমন করে ওঠে। বিয়ে মানেই তো দেহ। আর দেহ মানেই গা ঘিনঘিন করা বিরক্তি। তোকে বোঝাতে পারবো না অনু, আমার তো তখন খালি মনে হয় যদি র‍্যাঁদা ঘষে ঘষে শরীরের ছাল চামড়া তুলে দিতে পারতাম তো দেহে শান্তি আসতো! 
– এতই যখন তোর বিরক্তি তোকে তো কোথাও না কোথাও থামতে হবে। কোনওদিন তো তাকে না বলতেই হবে ! কেন নিজেকে মাসে একবার দুবার এরকম দগ্ধে মারিস? না বলে দে। কাল সকালে উঠে বলে দে, অনেক হয়েছে। দয়া করে আর আসিস না।
– সেটাই তো সমস্যা রে। সেইটাই তো বলতে পারছি না।
– কেন? তোর কোনও ভয় আছে? আই মিন ওর কাছে এমন কিছু কি আছে যাতে ও তোকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে? 
– না বলেই তো মনে হয়। আর প্রমিত মনে হয় সেই টাইপের ক্রিমিন্যাল নয়। ও তো ভালো ছেলেই ছিল আগে। এখন কেমন যদিও জানিনা । 
– তাহলে তুই কী ভেবে এখনও কন্টিনিউ করে যাচ্ছিস? ও নিজে থেকে কোনও এক ফাইন মর্নিং এসে বলবে 'টাটা বাই বাই’?
– ভাবছিলাম, যদি ওর বিয়ে হয়ে যায় এর মধ্যে। বয়স তো ওর সাড়ে সাতাশ আঠাশ হল।
– ওর বিয়ের কথাবার্তা কি চলছে? খবর পেয়েছিস কিছু?
– মা'র মুখ থেকে তো শুনি মাসি সম্বন্ধ দেখছে অনেক ক'টা। 
– প্রমিত কি না বলে দিচ্ছে।
– জানি না ।
– প্রমিত নিজে এসব কথা কখনও তোলে না?
– না। আমিও তো এড়িয়ে যাই। এসব কথা আলোচনা করতে আমারও অস্বস্তি হয় ।
– আচ্ছা সারি, প্রমিত কি তোকে ভালবাসে? নাকি দেহের টানেই এতসব – এই যতদিন পাওয়া যায় আর কি?
– জানি না।
– মানুষের সাথে মিশলেই তো বোঝা যায় সারি। এজন্য বিরাট মনোবৈজ্ঞানিক হতে হয় না।
– গত সাত আট বছর আমি নিজে কে শামুকের খোলসে বন্ধ করে রেখেছি অনু। ওর জন্য আমার কোনও দুয়ারই খোলা নেই। সুতরাং ও আমাকে বাসে, বাসে না – কোনও কিছু আমার মনের তরঙ্গকে ছোঁয় না অনু।
– কিন্তু ধর প্রমিত যদি তোকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে? সে যদি এরকম দায়িত্ব বহির্ভূত সম্পর্ক বয়ে নিয়ে চলে বছরের পর বছর, তখন কী হবে? ততদিনই কি তুই সহ্য করবি?
– মানুষের তো একদিন ক্লান্তি আসবে এসব নিয়ে! একদিন তো এসব বোরিং লাগবে! 
– সবার যে লাগবে, এমন তো নয় সারি। বহু দম্পতি আছে বৃদ্ধাবস্হা পর্যন্ত রেগুলার দেহসেবা করে। আর তাছাড়া যেখানে মাসে দু মাসে একবার রিলেশন হয় সেখানে আকাঙ্ক্ষা সহজে মরার নয়।
    সারি হঠাৎ করে অনুষ্কাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠল। ‘তুই ঈশ্বরকে প্রার্থনা কর অনু, ওর যেন শিগগিরি কোথাও বিয়ে হয়ে যায়।’
     অনুষ্কা সারির পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ‘ঈশ্বরের ভরসায় বসে থাকিস না সারি। কোনও অঙ্গে যদি পচন লাগে তাকে তক্ষুনি কেটে ফেলতে হয়। সেটা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। সমস্যা থেকে পালিয়ে লাভ হয় না সারি। সমস্যাটাকে সামনে থেকে ফেস করতে হয়।’
– হঠাৎ পাশের ঘরে খুট করে একটা আওয়াজ পেয়ে অনুষ্কা বলল, 'প্রমিত মনে হয় বাথরুমে উঠল রে!
– সারি এ কথার উত্তর কিছু বলল না। চট করে বেড সুইচটা টিপে ঘরের আলোটা নিভিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অনুষ্কাকে। এই অন্ধকারের মধ্যে পাশাপাশি বহমান দুই নদী যেন পরস্পরের তীর গুলোকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো এত দিনের লুকিয়ে রাখা স্রোতের আবেগে।

Post a Comment

0 Comments