চিত্রা ভট্টাচার্য্য
''সৃষ্টি সুখের উল্লাসে 'মাতোয়ারা কবির সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার বিভিন্ন ধারায় অফুরান রত্নমালারাজি তে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৈচিত্র্যময় এক বিরল প্রতিভার অধিকারী নজরুল তাঁর সৃজনে বীররস, করুণ রস, হাস্যরস মুক্তধারার মত মুখরিত। কবিতায় গানে প্রেমে ও বিদ্রোহে বাঙালির প্রাণের মানুষ--বঙ্গ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গহয়ে প্রতিবাদী কবি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যায় অবিচার আরোপিত শোষণের বিরুদ্ধে সর্বদা বীর বিক্রমে গর্জে উঠেছেন। তাঁর রোমান্টিক অনুভবে মানবতার সপক্ষে উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী। সত্য সুন্দর মঙ্গল ও শান্তির বাসনায় বিদ্রোহ তাঁর অবিরত।
যাবতীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে, ধর্মীয় শোষণ এবং জীর্ণ-সনাতন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে সোচ্চার কবি।শাসকের অধীন অবিভক্ত ভারতে শোষণ তাঁকে আঘাত করলে তিনি সমগ্র অত্যাচারিত মানুষের হয়ে প্রত্যাঘাত হেনেছেন তাঁর অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে। তাঁর ঐশ্বরিক প্রভাবে বঙ্গীয় সাহিত্যের ধারা ভেসেছিল এক ভিন্ন স্রোতের প্লাবনে। বাঙালির সাহিত্য,সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে রইলেন প্রতিবাদি কবি। তাঁর রচিত কাব্য সাহিত্য ও সংগীতের জনপ্রিয়তা বাংলাভাষী পাঠকের হৃদয় স্পর্শী সম্পদ হয়ে উঠলো ।
🍂
দোলনচাঁপা" কাব্যগ্রন্থ--- .
অগ্নিবীণার পর বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, দোলনচাঁপা" ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে মোট ৪৬টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। রোমান্টিকতা, সৌন্দর্য, প্রেম ও বিরহ দিয়ে রচিত এই কাব্যের কবিতাগুলোর মধ্যে পরিব্যাপ্ত। প্রিয়তমার কাছ থেকে দূরে জেলখানায় থাকার বেদনা কবিকে আলোড়িত করেছিল।বাংলার ১৩৩০ সনের আশ্বিনে দোলন-চাঁপা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন শরৎচন্দ্র গুহ। গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে সৌন্দর্যের প্রতীক কবির প্ৰিয় ফুল"দোলনচাঁপা"র নামানুসারে ।
"দোলনচাঁপা" কাব্যের মূল বিষয়েও বিদ্রোহ ও বিপ্লবের চেতনার সাথে প্রেম প্রকৃতির মর্মস্পর্শী প্রকাশ "কবির বিভিন্ন ধরনের আবেগ ও অনুভূতি '' যা বাংলা সাহিত্যকে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ করেছে---
প্রিয়! সামলে ফেলে চলো এবার চপল তোমার চরণ!
তোমার ঐ চলাতে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন-মরণে॥
কোথায় দূরে নূপুর বাজে তোমার পায়ে,
হেথায় রোদন আমার ওঠে উথলায়ে,
তোমার উদাসীন ঐ বিষম চলার ঘায়ে
আজ কাঁপে আমার সকল শরম-ভরম।
এখন ঐ দ্বিধাহীন চরণ করো মোর বুকে সম্বরণ।
"দোলনচাঁপা" কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। প্রেম ও বিরহের গভীরতা এবং বিচ্ছেদ-বেদনার অনুভূতি রক্তে সাড়া জাগিয়ে তোলে। দোলনচাঁপা কাব্য গ্রন্থের তাঁর বহু বিখ্যাত
""আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে" কবিতাটিতে
কবি লিখলেন ----
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডাকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার ভাঙা কল্লোলে।
এইকাব্য গ্রন্থে তাঁর প্রথম দিকের বিভিন্ন কবিতা সংকলিত হয়েছে। এবং এই কবিতাগুলি লেখার সময় তিনি জেল কর্তৃপক্ষের অগোচরে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সহায়তায় তা বাইরে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ ওই সময়ে তাঁকে বসন্ত নাটক উৎসর্গ করেছিলেন।কথিত আছে , সংবাদ পেয়ে আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে কবি এ কবিতা মারফত নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। বিশেষত এ কবিতায় সৃষ্টির সুখ আর উল্লাসের তীব্রতা প্রকাশ পেয়েছে,। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল-এর প্রথম সংখ্যায়, ১৩৩০ সালের বৈশাখে। কিন্তু নজরুল গবেষক গোলাম মুরশিদের অনুমান এ কবিতা আরও আগে লেখা যখন কবি কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় লেখা ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটি র সাথে যে ‘সৃজনশীলতার প্রবল আলোড়ন লক্ষ করা যায়’, আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতার সঙ্গে তার গভীর মিল আছে। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতায় আছে সৃষ্টিশীলতার অমিতাচারী উদ্যাপন; আছে অমিতাচারকে প্রমিত শরীরে বেঁধে ফেলার এক বিস্ময়কর অনুভব। এক বিপ্লবী কবির কাব্যিক আহ্বান যেখানে পুরাতনকে সরিয়ে নতুন কে গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।
প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বর-ধারিণী মা, আগমণী, ধূমকেতু, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণভেরী, শাত-ইল-আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবানী, মোহররম.এই কবিতাগুলি ছাড়াও, "দোলন চাঁপা" তে নজরুল বিভিন্ন ধরনের আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
তাঁর বিষের বাঁশী কাব্য গ্রন্থ : খুলে বসলে মনের অন্ধকারে ঢাকা কোনগুলো অজান্তে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁর মানব প্রেম দেশ প্রেমের ধারায় সিক্ত হয়ে উঠি।
নজরুল গবেষক দের মতে ১৯২৪ সালে রচিত কবির "বিষের বাঁশি" কাব্য গ্রন্থটি ছিল ব্রিটিশ শাসন ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে নজরুলের সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রকাশ। বিদ্রোহের আগ্নেয়াস্র স্বরূপ বিদ্রোহ ও প্রেমের সংমিশ্রনে এক অনন্য সাধারণ সাহিত্য কীর্তি। কবির স্বদেশপ্রেম ও জাতিগত-সচেতনতার এক মূর্ত প্রতীক এই কাব্যগ্রন্থটি ’। যতদিন পর্যন্ত বাঙালি জাতি নিজ দেশ ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অচেতন থাকবে;ততদিন পর্যন্ত এই বিষের বাঁশীর দংশনে তারা নীল হতে থাকবে। নজরুলের কবিতা আর চেতনা প্রবলভাবে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত সুলভ চাতুরি ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত এক সরল প্রাণের অঙ্গীকার ।
আজ থেকে প্রায় একশত বছরের আগে প্রকাশিত গ্রন্থটি যার প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল অপূর্ব। একটি কিশোর রিক্তপাত্র হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশী বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে বিশাল এক বিষধর সাপ। কিন্তু কিশোরের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আর তার বাঁশীর সুরে জেগে উঠছে নতুন দিনের সূর্য। ৩৩ পাতার এই গ্রন্থে ২৭ টি কবিতা সম্বলিত বিষেরবাঁশী একটি অধিক পঠিত কাব্যগ্রন্থ যা আগামী প্রকাশনী প্রথম প্রকাশ করে।'প্রচ্ছদ টি এঁকেছিলেন কল্লোল পত্রিকার সম্পাদক দীনেশ রঞ্জন দাশ। এই কাব্য গ্রন্থের মধ্য দিয়ে কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবি সত্ত্বার সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
কবি স্বয়ং বইটি সম্পর্কে বলেছেন,''‘বিষের বাঁশীর বিষ জুগিয়েছে আমার নিপীড়িত দেশ-মাতা,আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার। চক্রবাক" এর মত রোমান্টিক আবহ এই কাব্য গ্রন্থটিতে অনুপস্থিত। তবে প্রথম কবিতা দু'টি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ।
''আমি বিধির বিধান ভাঙিয়াছি, আমি এমনি শক্তিমান!
মম চরণের তলে, মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান।''
বিপ্লবের দিশারী এই কাব্যগ্রন্থ যার কবিতাগুলো যুগপৎ ধ্বংস ও সৃষ্টির বার্তা বহন করে আছে যুগে যুগে। এই কাব্যে "আগুনের ফুলকি", "প্রলয়োল্লাস", "বিদ্রোহী" প্রভৃতি কবিতায় ব্যবহৃত অগ্নি, ঝড় ও ধ্বংসের চিত্রকল্প কেবল ধ্বংসাত্মক শব্দ নয়; যেন নবসৃষ্টির পূর্বশর্ত—বারবার পুরাতন ব্যবস্থাকে উৎখাতের আহ্বান জানিয়েছে পরিবর্তনের দাবিতে ,মুক্তির দাবিতে অনড় থেকে । ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কবির সরাসরি চ্যালেঞ্জ। "কারার ঐ লৌহকপাট" বা "শিকল পরা ছল" এর মতো পংক্তিগুলো সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ ও প্রতিবাদ জানায়। ব্রিটিশ আমলে প্রকাশিত অসম সাহসিকতার এই কাব্য সম্ভারটি একটি জ্বলন্ত দলিল।
এই কাব্যের সংগীতের অসামান্য সুর ও ছন্দময়তা এটিকে কেবল পাঠ্য নয়, এক প্রতীকী শক্তির প্রকাশ হয়ে গীত হওয়ার যোগ্য করে তুলেছে। "বিষের বাঁশী র "- কবিতাগুলোর গীতিময়তা সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছিল। নজরুলের সর্বতোমুখী বিদ্রোহ শুধুই কেবল রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ও প্রবল ধিক্কার জানিয়েছে । নজরুল গবেষকদের মতে এইকাব্য গ্রন্থ টিতে তাঁর ভাষার অভিনবত্ব, মর্ম স্পর্শী ছন্দের ব্যবহার এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাহসিক প্রয়োগ যা বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সূচনা করেছিল। কবি-ব্যক্তিত্বের শাণিত প্রকাশ "বিষের বাঁশি"- —একদিকে আগুনঝরা বিদ্রোহ, অন্যদিকে সৃজনশীলতার উজ্জ্বল দীপ্তি। এটি বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী চেতনার এক মাইলফলক, যার প্রভাব শুধু সাহিত্যেই নয়, সমাজ ও রাজনীতিকে ও প্রবল ভাবে আলোড়িত করেছিল। ''
এই গ্রন্থের অন্তর্গত ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় দেখাযায় বারাঙ্গনাদের সম্মানিত করেছেন নজরুল। ‘মা’ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন।
‘কালের চরকা ঘোর,
দেড়শত কোটি মানুষের ঘাড়ে চড়ে দেড়শত চোর’।
নজরুলের এমন বাণী প্রতিধ্বনিত হয় দুরাচার ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে ।
‘ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর’। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় ভাঙা-গড়ার খেলা দেখিয়েছেন। আবার ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’ কবিতায় বলেন,
‘রক্তাম্বরধারিণী মা,
ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
সৃষ্টি নব পূর্ণিমা।’
প্রলয়োল্লাস কবিতায় হিন্দুদের ঐতিহ্য ব্যবহার করে ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টির প্রার্থনা করে কবি লিখলেন ।
''ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?—
প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!
আসছে নবীন, জীবন-হারা
অ সুন্দরে কর্তে ছেদন!
তাই সে এমন কেশে বেশে
প্রলয় বয়েও আস্ছে হেসে—
মধুর হেসে !''
ধ্বংসের মধ্যে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনাকে কবি স্বাগত জানালেন । ধ্বংস মানেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। পুরাতন জীর্ণ ধ্যান ধারণা ,কাঠামো ভেঙে নতুনের আগমন কে বরণ করে নেওয়া তাকে জীবনের মাঝে প্রতিষ্ঠা করা চাই । তাই, ধ্বংসকে ভয় না পেয়ে বরং গ্রহণের কথা বলেছেন। প্রলয়ঙ্করী শক্তি যেমন ধ্বংস ডেকে আনে, তেমনই তা নতুন সৃষ্টির পথও খুলে দেয়। তাই, ধ্বংসকে ভয় না পেয়ে, তার মধ্যে নিহিত নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে মানব মনে ভরসার বাণী যোগালেন কবি।
এই গ্রন্থে জাতের বজ্জাতি কবিতায় ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’। মানুষের কল্যাণে ধর্ম সৃষ্টি। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে শোষণ ত্রাসন সৃষ্টি করা হয় বলে কবি নজরুল মনে করতেন। কার্ল মার্ক্সের ‘আফিম তত্ত্ব’র মতো প্রলয় শিখা কবিতায় নজরুল বললেন,
‘কাটায় উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা,
ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা ,
ভাঙি ‘মন্দির’, ভাঙি মসজিদ
ভাঙিয়া গীর্জা গাহি সঙ্গীত-
এক মানবের এক রক্ত মেশা’ ।
''আরেকটি কবিতায় লিখলেন---
'‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করোনি প্রভু।
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।’
সাম্যবাদী কাব্যের ‘মানুষ’ কবিতায় স্রষ্টার প্রতি ‘ভুখা মুসাফির’র আত্মকথন। কবি নজরুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রধান দুটি ধর্মের অনাচার-অসাম্যের প্রতি হাতুড়ির বারি মেরে চেতনায় সমান আঘাত করা । মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের তথাকথিতদের ওপর আক্রোশ ঝরে পড়েছে কবিতার ভাবে শব্দের ঝঙ্কারে । তাঁর কবিতায় ‘মানুষ’ই মূখ্য উপজীব্য। তাঁর মত মানবিক অসাম্প্রদায়িক এমন সাহিত্যিক এই বিশ্বে বিরল।
কাজী নজরুল ইসলামের বাজেয়াপ্ত ৫টি গ্রন্থের মধ্যে বিষের বাঁশী বইটি অন্যতম। ১৯২৪ সালে এই গ্রন্থ টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথম এ বইটি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান বাবু অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত। ১৯২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি সরকারের পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের কাছে ‘বিষেরবাঁশী ’ থেকে উদ্ধৃত অংশ ইংরেজিতে লিখে পাঠান। এবং বইটি সম্পর্কে মতামত নেওয়ার জন্য তিনি তা গোয়েন্দা বিভাগে পাঠানোর সুপারিশ করেন। এই সুপারিশের ভিত্তিতে পুলিশ কমিশনার টেগার্টও চিফ সেক্রেটারিকে চিঠি লেখেন। টেগার্ট সুপারিশ করেন, ‘কবিতাগুলো মারাত্মক, অবিলম্বে বইটি বাজেয়াপ্ত করা উচিত।’ এর কয়েক দিন পরই ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর বইটি বাজেয়াপ্ত হয়। বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালিয়ে কবির রচিত প্রায় ৪৪টি বই আটক করা হয়েছিল।
কিন্তু তাতে ‘বিষের বাঁশী’র চাহিদা আরও বেড়ে যায়। বইয়ের ফর্মা তো ছাপা হয়েছিল আগে, সব বই তো বাঁধাই হয়নি। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের বইগুলো নানা সভায়, সম্মিলনে প্রায় প্রকাশ্যেই বিক্রি হতো। কলকাতায় অলি-গলি-ফুটপাতেও তা বিক্রি হয়েছে। তবে এই বিক্রির লভ্যাংশ নজরুলের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন নজরুলের বন্ধু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।
কবির মানবিকতা, ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ ,ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধতা বোধ এবং নারী-পুরুষের সমতার বন্দনা ও মানুষের ওপর মানুষের পাশবিক অত্যাচার এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতেন প্রতিটি কবিতার ভাষায় । তাই কবি কে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে হাজত বাস করতে এবং তাঁর লেখনী কে স্তব্ধ করে আরও কিছু বই বাজেয়াপ্ত করতে সময় বিশেষ লাগলো না ইংরেজ সরকারের।
তথ্য সূত্র: বিশ্বজিৎ ঘোষ /নজরুল জীবন ও সাহিত্য।
শিশির কর/ ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই।
অনুপম হায়াৎ / বিষের বাঁশির মধ্যে অগ্নিবীনা। ড:রফিকুল ইসলাম/ কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা।
0 Comments