জ্বলদর্চি

দূরত্ব /বাপন দেব লাড়ু

দূরত্ব

(একটি সম্পর্ক, ভুল বোঝা, আর নীরবতার গল্প)

বাপন দেব লাড়ু 

এক
কলেজের করিডোরে প্রথম দেখা—তৃষা আর অয়ন।
একজন কথা কম বলে, চোখে স্থির জলধারার মতো গভীরতা। অন্যজন প্রাণবন্ত, গল্পে গানে ব্যস্ত এক খোলা জানালা। প্রথম পরিচয় ছিল নিছকই এক পরিচয়। তারপর ধীরে ধীরে গল্প জমে ওঠে, চোখে চোখে হাসি লাগে, আর একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা বিকেল জন্ম নেয়।
তাদের বন্ধুত্ব ছিল রোজকার ক্যান্টিনে এক কাপ কফির ভাগাভাগি।
তৃষার ডায়রির শেষ পাতায় লেখা হতো অয়নের বলা কথাগুলো।
অয়ন কবিতা পড়তে গিয়ে তৃষার প্রতিক্রিয়া খুঁজে নিত মুখের কোণে।
একদিন বৃষ্টিভেজা ছাদে দাঁড়িয়ে অয়ন হঠাৎ বলল,
—“তৃষা, জানো? তোমাকে নিয়ে ভাবি আমি।”
তৃষা মাথা নিচু করে বলল,
—“ভেবো।”
সেই এক শব্দেই যেন তাদের সম্পর্কটা অন্য উচ্চতা ছুঁয়ে ফেলল।

তবে ভালোবাসা সহজ গল্প নয়।
সেখানে যেমন ভালোবাসার আভা থাকে, তেমনি ছায়া হয়ে থাকে কিছু না-বলা, কিছু না-বোঝা ভুল।

🍂
ad

দুই
প্রথমে শুরু হলো কিছু ছোট ছোট অপারগতা।
অয়ন হয়তো দেরি করল ফোন করতে—তৃষা ভাবল, অমনোযোগী হয়ে উঠছে।
তৃষা হয়তো একদিন অতিরিক্ত অনুভূতিতে ভেসে বলল,
—“তুমি আগের মতো ভালোবাসো না?”
অয়ন অবাক হয়ে বলল,
—“ভালোবাসা কি প্রতিদিন বলেই প্রমাণ করতে হয়?”
তৃষা চুপ করে রইল। সেই চুপ থাকাই জন্ম দিল নীরব দূরত্বের।

আসলে কেউ কাউকে দোষ দেয়নি।
শুধু, বোঝাপড়ার ফাঁকে কোথাও হয়তো
এক-দুটো শব্দ ভুল বোঝা গিয়েছিল।
সেই ভুলই জমতে জমতে একদিন একটা অদৃশ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল।


তিন
মাস্টার্স শুরু হলো দুজনের ভিন্ন শহরে।
তৃষা মাঝে মাঝে অয়নকে মেসেজ করত,
—“আজও সেই গানটা শুনে মনে পড়ল তোমাকে।”
অয়ন রিপ্লাই দিত দেরি করে, হয়তো ব্যস্ততায়, হয়তো দ্বিধায়।
তৃষা ভাবত,
—“সে আর আগের মতো নেই।”
অয়ন ভাবত,
—“তৃষা বুঝতে পারছে না, আমি কতটা চেষ্টা করি।”

সম্ভবত ভালোবাসার মাঝখানে আসলে ভালোবাসারই ভাষাহীনতা ছিল।
কেউ কাউকে ছেড়ে যায়নি, কিন্তু কেউই আর একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারেনি ঠিকভাবে।

একদিন তৃষা নিজের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করল।
উৎসর্গ পাতায় লেখা ছিল—
“তাকে, যে থেকেও দূরে ছিল।”

অয়ন সেই বই হাতে নিয়ে বসেছিল একলা সন্ধ্যায়।
পড়তে পড়তে থেমে গিয়েছিল এক জায়গায়,
যেখানে কবি লিখেছেন—
"ভুল বোঝা জমলে নীরবতা হয়, আর নীরবতা থেকেই জন্ম নেয় দূরত্ব।"
তার চোখ ভিজে উঠেছিল, কিংবা হয়তো কেবল আলো কম ছিল ঘরে।


চার
দু’বছর পর, এক সাহিত্য উৎসবে দেখা হল আবার।
তৃষা তখন নিজের লেখায় প্রতিষ্ঠিত।
অয়নও শহরের একটি সংবাদপত্রে সাহিত্য সম্পাদক।

চোখাচোখি হলো। কথা হলো অল্প।
অয়ন বলল,
—“তোমার কবিতা পড়ে বুঝি, তুমি বড় হয়ে গেছো।”
তৃষা হেসে বলল,
—“না, আমি শুধু শিখেছি—কিছু দূরত্ব কোনোদিনই মুছে না।”
অয়ন মাথা নোয়াল। কিছু উত্তর হয় না।

চলে যাওয়ার সময় তৃষা থেমে বলল,
—“আমরা একে অপরকে হারাইনি অয়ন, শুধু সেই জায়গাটা হারিয়েছি, যেখানে একসাথে থাকা যেত।”
অয়ন তাকিয়ে থাকল দীর্ঘক্ষণ। বলল না কিছু।

তৃষা চলে গেল।
পেছনে থেকে গেল একটা পলকহীন দৃষ্টি—সম্ভবত ক্ষমা, কিংবা নীরব স্বীকারোক্তি।


পাঁচ
শেষ শব্দ নয়, শেষ অনুভবটা ছিল এই—
ভালোবাসা সব সময় না ফুরালেও, সম্পর্ক কখনও কখনও শেষ হয়ে যায়।
ভুল বোঝা জমলে সেটা শুধু প্রেমের নয়, আত্মার মধ্যেও দেয়াল তোলে।
আর সেই দেয়ালের নামই—দূরত্ব।

Post a Comment

0 Comments