অ্যাকসিডেন্ট
পুলককান্তি কর
একটা বিজাতীয় আওয়াজ শুনে ষ্টীম জেনারেটরের দিকে চোখ গেল রঞ্জনের। হঠাৎ সে দৌড়ে গিয়ে প্রায় চোখের পলকে হুইল চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে যেই সিস্টারদের বসার জায়গার কাছে পৌঁছালো অমনি বুম করে একটা আওয়াজ আর সাথে সাথে ধোঁয়ায় ভরে গেল পুরো ঘরটা। রঞ্জন অনুভব করল তার কোলে থাকা মেয়েটি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সে জিজ্ঞাসা করলো, 'কত নম্বর বেড?' মেয়েটি কোনও উত্তরই দিতে পারলো না। মুখ থেকে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোতে লাগল। সিস্টার বললেন-' এখানেই ওকে নামিয়ে দিন'। রঞ্জন কোনও মতেই নামাতে পারলো না মেয়েটিকে। বলল 'আপনি ওর বেড নম্বর বলুন, ওখানেই দিয়ে আসছি'।
-- না না আপনি নিজেই পেশেন্ট, আপনি কী করে নিয়ে যাবেন? আয়া নিয়ে যাবে।
-- উনি তো কেমন করছেন। আমার ড্রেসটা কেমন করে মুঠি করে ধরে আছেন দেখুন না!
-- ঠিক আছে নিয়ে যান। উনি ফিমেল কেবিন থ্রি। আর উপরে গিয়ে একটু ফ্লোর সিস্টারকে বলুন নিচের ষ্টিম চেম্বারটা বার্ষ্ট করেছে, যেন শিগগিরিই নীচে নামেন। বলেই দ্রুতপদে অকুস্হলের দিকে হাঁটা লাগালেন সিস্টার।
রঞ্জন ওই ভাবেই কোনওরকম সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল উপরের ফ্লোরে। মেয়েটি পুরো ওজন টাই ছেড়ে দিয়েছে তার উপর। যদিও একটা হাত দিয়ে ওর ঘাড়টা জড়িয়ে রেখেছে, তবে সে নামমাত্র। লিফ্টের সুইচ টিপে টিপে হয়রান। লিফ্ট ম্যান লিফ্ট ছেড়ে কোন চুলোয় গেছে কে জানে? ওকে দেখেই হাঁ হাঁ করে এলেন জনা দুই সিস্টার। কী হয়েছে? কেবিন থ্রি এভাবে কেন?
-- নিচের ষ্টিম চেম্বারটা বার্স্ট করেছে। রঞ্জন শান্ত গলায় বলল।
--বার্ষ্ট করেছে? কী করে? কেবিন থ্রি র বার্ন হয়েছে নাকি? একসাথে একগাদা প্রশ্ন ধেয়ে এল রঞ্জনের দিকে।
-- কী করে করেছে জানি না। ওই ষ্টীম চেম্বারেই সেঁক নেওয়ার ছিল বোধ হয় এনার। হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন। একটা অন্যরকম কিছু আন্দাজ করে আমি ওঁকে ওখান থেকে সরিয়ে এনেছি।
-- আপনি কোন পেশেন্টের পার্টি?
-- না না আমি পার্টি না, আমি নিজেই পেসেন্ট।
-- কোন ওয়ার্ডের? বেড নম্বর কত?
-- ডব্লিউ সেভেন্টিন।
-- ঠিক আছে আপনি ওই কেবিনটায় ওঁকে নামিয়ে দিন, আমরা বাকিটা দেখছি।
রঞ্জন এক সিস্টারের পিছু পিছু এসে কেবিন থ্রির বেডে মেয়েটিকে নামাতে গেল। মেয়েটি তখনও শক্ত করে ধরে আছে তার ঘাড়ের কাছের ড্রেসটুকু। ওকি অজ্ঞান হয়ে গেছে নাকি? মুখে বলল, 'নামুন, বেডে শুয়ে পড়ুন।' মেয়েটি ততোধিক জোরে আঁকড়ে ধরল ওকে।
-- বোধ হয় ঘটনার আকস্মিকতায় প্যানিকড হয়ে গ্যাছেন। রঞ্জন কিছুটা সাফাই দেওয়ার ঢঙে বলল। সিস্টার আর ও ধরাধরি করে মেয়েটিকে নামিয়ে দিল বেডে। সিস্টার বললেন, 'আপনার চেনা নাকি?'
-- না না ওই থেরাপি রুমে দিন চারেক হল দেখছি। নতুন ভর্তি বোধ হয়।
-- হ্যাঁ হ্যাঁ। গত বুধবারই ভর্তি হয়েছে ডাঃ সান্যালের আন্ডারে।
-- ওঃ। ইনিও ডাঃ সান্যালের পেশেন্ট? আমিও ওনার আন্ডারে ভর্ত্তি আছি প্রায় মাস তিনেক। রঞ্জন বলল।
-- কী হয়েছিল আপনার?
-- আমার? অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলোসিস।
-- দুরারোগ্য রোগ তো!
-- হ্যাঁ। নেট ফেট দেখে তো হালই ছেড়ে দিয়েছিল আমার বাড়ীর লোকেরা। এ রোগ নাকি সারে না। পরে খবর পেলাম এই হাসপাতালের। ডাঃ সান্যালের অসীম কৃপা। এখন আমি প্রায় সুস্থ।
-- সত্যি ডাঃ সান্যাল খুবই ভালো ডাক্তার। ঠিক আছে। আপনি এখন যান। হাসপাতালের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি এত বড় বিপদ থেকে পেশেন্টটিকে রক্ষা করেছেন।
-- না না। ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমি আমার কর্তব্যটুকু করেছি মাত্র।
-- বাই দা বাই আপনার নাম কী?
-- রঞ্জন। রঞ্জন পুরকায়স্থ। আচ্ছা, আমি কি বিকেলবেলা ভিজিটিং আওয়ার্সে এসে ওনাকে দেখে যেতে পারি?
-- না। আপনি নিজেই ভর্তি আছেন তো! উপরের সিস্টাররা নামতে অ্যালাউ করবেন না।
-- তাহলে?
সিস্টার হাসলেন। বললেন- থেরাপি রুমই ভরসা। ওখানেই দেখা পাবেন রোজ। একটা অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করে সিস্টার চলে গেলেন ওয়ার্ডে।
রঞ্জন একটু আলতো করে মেয়েটির মাথায় হাত রাখল। বলল, 'চলি?' মেয়েটি চোখের ইঙ্গিতে নিষেধ করল তাকে।
-- কিন্তু আমাকে এখানে বেশীক্ষণ থাকতে দেবে না যে? মেয়েটি নিরুত্তর।
-- আপনি কথা বলতে পারেন?
চোখের পাতা নামিয়ে মেয়েটি জানালো তার সক্ষমতার কথা।
-- তাহলে কথা বলছেন না কেন? ভয় পেয়ে গেছেন?
আবার চোখের পাতা ঝপকালো মেয়েটি।
-- ঠিক আছে। আপনি বড় বড় কুড়িটা শ্বাস নিন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। নিন করুন।
মেয়েটি ধীরে ধীরে করার চেষ্টা করল। অস্ফুটে বলল- 'পারছি না, ব্যথা।'
-- তাও চেষ্টা করুন। পারবেন। এতে দেখবেন ব্যথাও কম হবে।
ধীরে ধীরে কুড়িটা গভীর শ্বাস নিল মেয়েটি। রঞ্জন জিজ্ঞাসা করল- কি নাম আপনার?
-- তুলিকা।
-- কী করেন?
-- পড়ি। টুয়েলভে।
-- তুমি আমার চেয়ে অনেকটাই ছোটো। তোমাকে 'তুমি' করেই বলি কেমন?
মেয়েটি আবার ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
রঞ্জন বললো, 'সাবধানে থেকো। ভয়ের কিছু নেই। আমি যাই নীচে, দেখি থেরাপি আর হয় কিনা।'
রঞ্জন নীচে চলে গেল। এটি একটি বেসরকারি আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল। কলকাতা থেকে দূরে বারাসাত বামনগাছি এরিয়াতে প্রায় চার একর জায়গা জুড়ে মস্ত হাসপাতাল। কত ধরনের রোগীরা আসে এখানে। বিশেষ করে নানান নার্ভের রোগ, হাড়ের রোগীদেরই বেশী ভিড়। অধিকাংশই খঞ্জ পঙ্গু। ছ তলা এই হাসপাতালটি এতটাই সুসজ্জিত যে মাঝে মাঝে বড় হোটেল ভেবেই ভুল হয়। সামনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে কেয়ারী বাগান। ফুলের গাছই মূলত সামনে। হাসপাতালের পেছনের বাগানে নানান ঔষধি গাছের চাষ। একবার বাইরে এলে মনে হয় প্রাণভরা হাওয়া যেন একটা বলয়ের মতো ঘিরে রেখেছে পুরো প্রাঙ্গণটিকে। চারপাশে যেন আরোগ্যের সুবাস। ডাঃ সান্যালই এখানকার প্রাণপুরুষ। মালিকানা যদিও তাঁর নয়, তবে মূল চালিকা শক্তি তিনিই। মালিকপক্ষ তাঁকে সমস্ত রকম সুবিধা দিয়ে রেখেছে। ডাঃ সান্যাল নিয়ম করে দিয়েছেন ভিজিটিং আওয়ার্সে পেশেন্টরা পার্টি সহ বা নিজেদের আয়া নিয়ে এই বাগানে যেন এসে বসে, হাঁটাচলা করে। এত অক্সিজেন ফুসফুসে গেলে শরীর এমনিই ভালো হবে। অবশ্য যে পেশেন্টরা একেবারে পঙ্গু বা যাদের অবস্থা বেশী ভালো নয় তাদের ক্ষেত্রে আলাদা নিয়ম।
রঞ্জন থেরাপি রুমে গিয়ে দেখল ইলেকট্রিকের লোক, সিকিউরিটির লোক - সব মিলে থেরাপি রুম সরগরম। আজ আর এখানে কিছু হবার নয়। ভাগ্য ভালো কোনও রোগী বা স্টাফের তেমন কোনও বড় বিপদ হয় নি। ডাঃ সান্যাল নিজে এসেছেন। রঞ্জন কে দেখে হাল্কা পিঠ চাপড়ে দিলেন তিনি। 'ভাগ্যিস তুই ছিলি এখানে!' ডাঃ সান্যাল বেশীদিন আপনি আজ্ঞে করতেন না। পেশেন্ট একটু পুরনো হলেই 'তুই' 'তুমি' তে চলে যেতেন তিনি। রঞ্জন একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল- 'কী যে বলেন স্যার। সব আপনারই দয়া।'
-- তুই ব্যাটা আবার বেশী বিনয়ী। এতে আমার দয়াটা দেখলি কোথায়? কপট ধমক দিলেন ডাঃ সান্যাল।
-- স্যার। কী অবস্থায় এসেছিলাম! ব্যাঙের মতো হাত পা বেঁকিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতাম। আজ আপনার দয়ায় এতটা সক্ষম হয়েছি যে এত বড় মেয়েকে তুলে উপর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছি- সেটা কার দয়া স্যার?
-- তুই কি বোষ্টম নাকি রে ব্যাটা? এত বিনয়! মৃদু হেসে ডা সান্যাল বললেন। 'ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ী যা।'
-- আপনি আশীর্বাদ করুন স্যার। ঝপ করে ডাঃ সান্যালকে একটা প্রণাম ঠুকে দিল রঞ্জন।
বিকেলবেলা নিচের লনে এসে বসল রঞ্জন। সে এখন রোজ এখানে এসে বসে, প্রাণভরে শ্বাস নেয়। আজ ওর বাবা এসেছেন সাথে। তিনি নিচের ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে পেপারে মন দিয়েছেন- রঞ্জন এখান থেকে বসেই দেখতে পাচ্ছে। রঞ্জন মনে মনে তুলিকাকে আশা করছে নীচে, কিন্তু চারপাশে তাকে দেখতেই পাচ্ছে না। হুইল চেয়ারে বসা কাউকে নীচে দেখলেই অনুমান করার চেষ্টা করছে- ওটা তুলিকা কিনা। তুলিকার হাত-পা যা ফুলে আছে, সে কি এখন নীচে আসার অনুমতি পাবে? নিজেকেই প্রবোধ দিল সে। সারা বিকেল মনের অবচেতনে তুলিকার কথা ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো তার। তখন তেমন কিছু মনে হয়নি, তবে এমন যেন কেমন একটা রোমাঞ্চ অনুভব করল সে। জীবনে কখনও এভাবে কোনও প্রায়-যুবতীকে পাঁজাকোলা করার অনুভব হয়নি তার। অপর্ণার সাথে ছুটকো ছাটকা দু একবার জড়িয়ে ধরাধরি যদিও হয়েছে। তা এতখানি দীর্ঘস্থায়ী বা এতটা সন্নিকট হয়নি কখনও। সারাটা রাত এক অনির্বচনীয় আনন্দে কাটলো তার।
পরের দিন থেরাপি রুমে যাওয়াটা যেন তার মনে আনন্দের ঝর্না খুলে দিল। কখন নটা বাজবে - এই আনন্দে সকাল ছটায় উঠেই রেডি হয়ে নিল সে। যা এতদিন করেনি, আজ হালকা একটু পারফিউমও মেখে নিল। সারাক্ষণই এক অজানা তরঙ্গ বইতে লাগলো বুকের ভেতর। নটা বাজতেই দ্বিগুণ জোরে বইতে লাগলো বুকের ধুকপুকানি। কী হল? প্রেমে পড়ে গেল না কি সে? নাকি বিরাট কিছু একটা নিজেকে বোধ হচ্ছে? মনে মনে ধমকে উঠল রঞ্জন। নীচে দেখল হুইল চেয়ারে যথারীতি বসে তুলিকা। সাথে ওর আয়া। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কী গো কেমন আছো?'
-- খুব ব্যথা বেড়েছিল কাল। রাতে একটুও শুতে পারেনি।
-- সেঁক টেঁক নিয়েছো তো ঠিকঠাক? দীর্ঘদিন এই হাসপাতালে থেকে রঞ্জনের একটা হালকা আইডিয়া হয়ে গ্যাছে কিছু কিছু বিষয়ে। ব্যথা বাড়লে ডাঃ সান্যাল নানান ধরনের সেঁক নিতে বলেন।
-- নিয়েছি তো। তবে কাল ভালোমত থেরাপি হয়নি, সেজন্যই বোধহয় ব্যথা বেড়েছে।
-- ডাঃ সান্যাল কী বললেন?
-- বললেন এখন ঘি খাওয়া চলছে তো, তাই ব্যথার কোনও ওষুধ দেওয়া যাবে না। শুধু সেঁক দিতে বললেন ভালো করে।
-- তাই দাও ভালো করে। ডাঃ সান্যালের হাতে যখন পড়েছো, নিশ্চই সুস্থ হয়ে যাবে।
-- এ রোগ সারে না শুনেছি?
-- কী রোগ তোমার?
-- রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস। নেটে তো দেখলাম সবাই এতে পঙ্গু হয়ে যায়।
-- আরে ছাড়ো তো ওসব কথা! কত রিউমাটয়েড এখানে ভালো হয়ে যেতে দেখেছি। তুমিও ভালো হয়ে যাবে, চিন্তা করো না।
-- তাহলে নেটে লেখেনি কেন?
-- সব কথা কি নেটে লেখা থাকে তুলিকা? আয়ুর্বেদ তো এখন তত জনপ্রিয় নয়! তাই এতে যে তোমার মতো রোগী ভালো হতে পারে, সে কথা কানে যায়নি নেট ওয়ালাদের। এই দ্যাখো না আমার রোগও তো সারে না শুনেই এসেছিলাম। একেবারে পঙ্গু দশা থেকে আজ দ্যাখো কতখানি সুস্থ। তুলিকাকে কিছুটা আশ্বস্ত করার ঢঙ্গে বলল রঞ্জন।
-- আপনি একদম সেরে গেছেন?
-- প্রায় সেরে গেছি। হাঁটা চলা ওঠা-বসা কিছুই তো করতে পারতাম না আগে। এখন তো সব পারি। তবে ডাক্তারবাবু বলেছেন আরো মাসখানেক থাকতে।
-- ওঃ।
-- এই যে কেবিন থ্রি। এবার বক্সে ঢোকো। আয়া এসে তোলার চেষ্টা করল তুলিকাকে।
-- আমি কি সাহায্য করব? রঞ্জন জিজ্ঞাসা করল।
-- না। কড়া গলায় উত্তর দিল আয়া। আমার চাকরী খাবেন নাকি? যান ওদিকে।
রঞ্জন কিছুটা থতমত খেয়ে চলে গেল ওর থেরাপির জায়গায়। মেয়েটির বাড়ীর লোককে দেখলো না তো সে! একা একটা আয়া তুলতে পারে এমন পেশেন্ট কে? বাড়ীর লোক থাকলে একটু সুবিধা হতে পারতো তুলিকার। ওর নিজের যখন ওরকম অবস্থা ছিল, ওর বাবা দিনরাত এসে পড়ে থাকতো এখানে। তুলিকার কি সেরকম আপনজন কেউ নেই? একটু পরে আবার এসে উঁকি দিল সে। তুলিকা বক্স থেকে বেরিয়ে বাইরে ওয়েট করছে। কাছে এসে সে বললো, 'বিকেলে তোমার বাড়ির লোক আসে না তুলিকা?'
-- আসে কোনও কোনও দিন।
-- আজ আসবে?
-- না বোধহয়।
-- তাহলে তোমার আয়াকে নিয়ে নীচে আসতে তো পারো। নীচের বাগানটা ভারি সুন্দর। বসলে দেখবে মন ভালো থাকবে।
-- আমাকে কি যেতে অ্যালাউ করবে?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ, সিস্টারদের বলে যেও। কেউ আপত্তি করবে না। এসো কিন্তু, আমি অপেক্ষা করব।
বিকেলবেলা রঞ্জন নেমে দেখল তুলিকা তখনও আসেনি। এক ঘন্টা পার হয়ে যেতেও এলো না যখন, দুশ্চিন্তা হল তার। তাহলে কি ব্যথা আবার বাড়ল? এটা সেটা ভাবতে ভাবতে ভিজিটিং আওয়ার্স পার হয়ে গেল। তুলিকা এলো না। ওপরে ওঠার সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না সে। গিয়ে উঁকি দিল কেবিন থ্রি'র সামনে। দেখলো দু তিনটে অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে বসে আছে ওখানে। তুলিকারই বন্ধুবান্ধব বোধ হয়। হালকা অভিমান হল তার। ভেতরে না ঢুকে ফিরে গেল নিজের বেডে। সন্ধ্যার দিকটা ওয়ার্ডের টিভি চলে দু'ঘণ্টা। হালকা মিউজিকের চ্যানেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লাগানো হয়। এছাড়া এই সময়টা মোবাইল বা ওয়াকম্যানও অ্যালাউড। বারণ না থাকলে রোগীরা কানে ব্লু-টুথ দিয়ে গানও শুনতে পারে। রঞ্জনের টিভির প্রোগ্রামে মন লাগে না। নিজের ব্লু-টুথটা কানে দিয়ে গান শুনতে শুরু করে দিল সে। কিন্তু কিছুতেই গানে মন লাগলো না। বিরক্ত হয়ে গান বন্ধ করে দিল সে।
পরের দিন সকালে থেরাপি রুমে দেখল তুলিকা হুইল চেয়ারে বসে। কিন্তু ইচ্ছে করেই রঞ্জন আজ আর তার কাছে গেল না। জিজ্ঞাসাও করলো না কেমন আছে সে। নিজের যা যা থেরাপি নেওয়ার, নিয়েই উপরে চলে গেল আজ কিছুটা তাড়াতাড়ি। আজ আর নীচেও যাবে না সে। বিকেল ঠিক চারটে বাজতেই কিছুতেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না রঞ্জন। এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে চললো নীচের প্রাঙ্গণে। আজ ওর বাবাও আসেন নি। কেন সে মনে মনে এখন তুলিকাকে নীচে চাইছে? দুদিনেরও আলাপ নয়। এতটা সে ভুল চেনে নিজেকে? নীচে এসে একটা বোগেনভেলিয়ার নীচের বেদিতে বসলো সে। এদিকটা দিয়ে লিফটের সামনেটা দেখা যায়- কে নামল উঠল। একটু বাদে দেখল তুলিকার হুইল চেয়ারটা ধরে ওর আয়া এনে বসাল ওর থেকে একটু দূরে একটা শিরীষ গাছের তলায়। রঞ্জন প্রথমে না দেখার ভান করে রইল কিছুক্ষণ। একটু বাদে দেখল ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তুলিকা।
-- স্যরি। কাল আসতে পারিনি। আমার বন্ধুরা এসেছিল তো। তুলিকা বলল।
-- এতে স্যরির কী আছে! আসো নি, আসো নি।
-- না, আপনি আজ থেরাপি রুমে আমার দিকে তাকালেনই না, ভাবলাম রাগ করেছেন বুঝি।
-- রাগ করতে হলেও একটা সম্পর্ক লাগে তুলিকা।
-- সম্পর্ক তো সেদিনই হয়ে গেছে, যেদিন আমাকে আপনি বাঁচিয়েছেন রঞ্জন'দা।
-- তুমি আমার নাম জানলে কী করে?
-- কেন আমার সামনেই তো সিস্টারকে বললেন।
-- ওঃ। ভুলে গেছি একেবারেই। তা তুমি আজ আছো কেমন?
-- ভালো আছি আজ একটু। ব্যথা, ফুলো দুটোই কম আছে আজ।
-- তুলিকা, তোমার বাবা মা কাউকে দেখি না কেন? মানে, স্যরি জিজ্ঞাসা করছি বলে - ওঁরা কেউ আসেন না?
-- মা রোজই আসে, তবে সকালের দিকে, বাবা ভর্ত্তির দিন এসেছিল।
-- বাবা কী করেন?
-- স্কুল টিচার।
-- কোথায় চাকরী করেন?
-- ওই জয়নগরের দিকে।
-- ওঃ। সেজন্যই আসতে পারেন না। সমবেদনা জানালো রঞ্জন। 'তা মা বিকেলে আসেন না কেন?'
-- ছোট একটা ভাই আছে তো। বিকেলে ওর কাছে থাকতে হয়।
-- সকালে ওর কাছে কে থাকে?
-- ওই কাজের মাসীর কাছে রেখে মা এদিকে আসে।
-- তোমার বুঝি মন খারাপ হয় তুলি?
-- না। আমার অভ্যেস হয়ে গ্যাছে।
-- অভ্যেস হয়ে গেছে মানে?
-- মানে আমি মেয়ে তো। বাড়ীতে আমার ভাই আমার চেয়ে অনেক বেশী আকাঙ্ক্ষিত। তার উপরে আমার এমন একটা রোগ। দিনরাত ব্যথা জ্বর। বাড়ির লোক কাঁহাতক আর সহ্য করবে বলুন!
-- দূর বোকা! এরকম করে ভেবো না। তোমার কথা না ভাবলে এরকম একটা কষ্টলি জায়গায় রেখে তোমার চিকিৎসা করাতেন তোমার বাবা-মা?
-- সে কথা ঠিক। শিক্ষিত লোকজন তো! একেবারে গরিব গুর্বোদের মতো বিভাজন করে না সেটা ঠিক। আর জন্ম দিয়েছে তো, একেবারে অস্বীকার করে না।
-- গরিব গুর্বোরা বুঝি ছেলেতে মেয়েতে বিভাজন করে?
-- আমি সে অর্থে বলতে চাইনি। আসলে যাদের শিক্ষা কম অথচ মনে করে ছেলে সংসারে থাকলে সহায় হবে, বিয়ে দেওয়ার খরচ নেই - তাদের কথা বলতে চাইছি আমি।
রঞ্জন খানিকক্ষণ চুপ করে শুনলো। না বুঝেই ওর ব্যথার জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে সে। তাই কথা ঘোরানোর জন্য বলল 'তোমার পরীক্ষা কবে?'
-- টুয়েলভ ফাইনাল তো গত বছরই দেওয়ার কথা ছিল। এমন রোগে ধরল একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। এবারও দিতে পারবো কিনা ঠিক নেই। আর্দ্র হয়ে গেল তুলিকার কন্ঠস্বর।
-- ঠিক পারবে তুলি। এখনও তো সময় আছে, ঠিক পারবে।
-- শুধু পারলেই তো হবে না রঞ্জন'দা, আমাকে অনেক ভাল করে পারতে হবে। আমি চাই- ভালো রেজাল্ট করে অন্য কোনও ষ্টেটে চলে যাই- যাতে বাড়ীতে ঘন ঘন না আসতে হয়।
-- কী পড়তে চাও তুমি?
-- আই.আই.টি পেলে তো ভালো হত। তার জন্য কোচিং নিতে হয়। আমি রোগ জ্বালা সামলাবো না কি পড়ায় মন দেব?
-- সব হবে তুলি। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নাও।
-- তুমি কী কর রঞ্জন'দা? স্যরি তোমায় তুমি বলে ফেললাম।
-- ও ঠিক আছে। ভালোই করেছ। আপনি আজ্ঞে করে বেশীক্ষণ কথা চালানো যায় না।
-- তুমি এখন কী কর? আবার প্রশ্ন করল তুলি।
-- আমি? আমি বি.কম পাস করে বাবার ব্যবসা দেখি।
-- কিসের ব্যবসা তোমাদের?
-- কাটারিং। বেশ বড়সড় ব্যবসা। আমার ঠাকুরদার আমলের।
-- তোমার বাবা-মা আসেন না?
-- হ্যাঁ, দুজনেই আসে ভাগাভাগি করে, তবে আজ কোথায় একটা বড় প্রোগ্রাম আছে, বাপি আসবে না।
-- তোমার মা?
-- মা সকালে এসেছিল তো। এই নাও তোমার জন্য মিষ্টি এনেছি, মা এনেছিল সকালে।
-- আমার তো এখন মিষ্টি খাওয়া বারণ রঞ্জন'দা।
-- ও স্যরি। একেবারেই ভুলে গেছি। ঠিক আছে, একটু মাথায় ছুঁইয়ে দাও। আমাদের বাড়ীর কাছে একটা কালীবাড়ী আছে, ওখানকার প্রসাদ।
-- তোমার বাড়ী কোথায় রঞ্জন'দা?
-- ওই তো আবদালপুর। এখান থেকে খুব বেশী দূর না। তোমার বাড়ী?
-- আমাদের বাড়ী নরেন্দ্রপুর।
-- ও বাবা! সে তো একেবারে দক্ষিণ!
-- হ্যাঁ এখান থেকে অনেকটা দূর।
-- সত্যি সত্যি তোমাদের বাড়ী থেকে রোজ এখানে আসা খুবই মুশকিল।
তুলিকা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, 'রঞ্জন'দা আমার মতো রোগে এখানে কতদিন থাকতে হবে জানো?
-- মাসখানেক তো বটেই। তুমি বইপত্র এনে এখানেও তো পড়তে পারো
-- তা পারি, কিন্তু এখন এত বেশী ব্যথা আর জ্বর থাকে, পড়ার জন্য বসতেই পারিনা।
-- দ্যাখো দশ- বারো দিন পার হয়ে গেলে নিশ্চই পারবে।
-- ডাক্তার বাবুও তো তাই বললেন, দেখি কী হয়।
-- আচ্ছা তুলি, কালকের অ্যাকসিডেন্টের কথা তোমার বাড়ীর কেউ জানে?
-- আয়া বোধ হয় আজ মাকে বলেছে। আমি কিছু বলিনি।
-- মা কী বললেন শুনে?
-- জিজ্ঞেস করল কোথাও পুড়ে টুড়ে গ্যাছে কিনা? আমি না বলে দিলাম। মা খানিকক্ষণ আদিখ্যেতা করল। আমি পাত্তা দিই নি।
-- দ্যাখো তুলি তুমি বড় হয়েছো- আমার বোধ হয় বলাটাও শোভা পায় না... চুপ করে গেল রঞ্জন।
-- কী হলো? থেমে গেলে কেন? বলো?
-- না থাক। সব ব্যাপারে আমার কথা না বলাই উচিৎ।
-- রঞ্জন'দা আমার সব ব্যাপারেই তুমি বিনা দ্বিধায় কথা বলতে পারো। তুমি আমার পুনর্জন্ম দিয়েছো। ঈশ্বর তোমাকে সে অধিকার দিয়েছেন?
-- কী বলছো এসব তুলিকা? পুনর্জন্ম? সামান্য একটা বিষয়কে এতবড় ভেবো না তুলি।
-- সামান্য বলছো। আমি নড়তে পারি না। অত বড় স্টিম চেম্বার বার্ষ্ট করল - আমি ওখানে থাকলে বাঁচতাম? আর বাঁচলেও যা বার্ণ হত কল্পনা করতে পারো?
-- থাক তুলি, ও কল্পনা করে লাভ নেই। ভালো মত সুস্থ হয়ে থাকো, ভগবান তাই করুন।
-- তুমি বল, কী বলছিলে?
-- দ্যাখো আফটার অল তিনি তোমার মা। তাঁকে তোমার কষ্ট দেওয়াটা কি ঠিক হল?
-- তুমি জানো আমার আর আমার ভাইয়ের বয়সের ডিফারেন্স কত?
-- কত?
-- পনেরো বছর। তুমি ভাবতে পারো? পনেরো বছর ধরে তারা শুধু একটা ছেলের জন্য লালায়িত ছিল।
-- এভাবে ভাবছো কেন? এটা একটা অ্যাকসিডেন্টও তো হতে পারে!
-- একেবারেই না। এটা পুরোপুরি প্ল্যানড।
-- ছেলে নাও তো হতে পারতো। মেয়ে হলে?
-- আমি জানি বাবা চেনাশোনা জায়গায় ইউ. এস. জি করে কনফার্মড হয়েই এটা রেখেছে। এর আগে বার দুই নাকি মায়ের অ্যাবরশনও করিয়ে নিয়েছে মেয়ে ছিল বলে।
-- যাঃ। এ আবার তোমার বেশী বেশী। আজকাল ছেলে মেয়ে নিয়ে কেউ এত অবসেসড নয়।
-- আমি নিজের কানে শুনেছি একবার ঝগড়ার সময় মা, বাবাকে গালি দিচ্ছিল এসব বলে।
-- তোমার সামনেই বলছিল?
-- না। আমি পাশের ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভেঙে বাথরুমে যেতে গিয়ে শুনি মা এই নিয়ে বাবাকে আরও অনেক কথা বলছিল। পুৎ নামের নরক থেকে ভাই ই তো উদ্ধার করবে তাদের। আমার আর প্রয়োজন কি?
-- এভাবে ভেবো না তুলি। অনেকের হয়তো একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে ছেলে বা মেয়ের। তোমার অযত্ন তো করে না।
-- অযত্ন করলে তো ভালোই হত রঞ্জন'দা। সামনা সামনি শত্রু তাও সওয়া যায়। আমি এখানে কিছুতেই ভর্তি হতে চাইনি। মাসখানেক এখানে থাকলে যা খরচা, বাবার তো বুকটা ধপাস করে ফেটে যাবে। ছেলের জন্য সঞ্চয়টা কমে যাবে না কিছুটা!
-- তোমার মায়ের মোটিভটা?
-- মা অতটা নয়। আমার প্রতি দয়া মায়া আছে। কাঁদে টাঁদে দেখি তো।
-- তাহলে তুমি তাঁর ওপর নির্দয় হও কেন তুলি? হয়তো চাপে পড়ে....
-- চাপের কী আছে? বাড়িতে মায়ের যথেষ্ট চলে। একেবারেই বাবার দ্বারা শোষিত' - এমনটা ভেবো না। ভাইয়ের যদি একটু জ্বর ফর হয় বাবার মুখটা যদি দেখো রঞ্জন'দা! যেন পুত্রের মৃত্যুশোক। ভাই এর জন্মদিনে কী ঘটা! আমার জন্মদিন হলে এক বাটি পায়েস - ব্যস। আমি যদি কোনওক্রমে একবার বাইরে সেটল করতে পারি রঞ্জন'দা জীবনে এদের মুখ মনেও করব না।
-- ছিঃ তুলি। এভাবে ভাবতে নেই। তাঁরা তোমাকে জন্ম দিয়েছেন ...অতএব...
-- অতএব কী রঞ্জন'দা? পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম? নাকি জননী জন্মভূমিশ্চ?
-- তুমি কেন নিজেকে ছোট করছো তুলি? সারাক্ষণ এরকম স্ট্রেস থাকলে তো তোমার রোগও সারবে না!
-- কী করে এসব ভুলি বলো তো? পোড়া রোগও তো আমাকে ছাড়ে না।
-- এখন না হয় ভাই হয়েছে। যখন ছোট ছিলে, তখন তোমার জ্বর-টর হলে বাবা-মা কী করত? ডাক্তার ফাক্তার দেখাতো?
-- সেসব ত্রুটি আগেও করতো না, এখনও করে না। তবে ভাই এর জ্বর হলে বাবা যেমন দেখি সারা রাত জেগে বসে আছে, আমার এই সতেরো বছরের জীবনে আমার কোনও কিছুতে বাবা-মাকে এরকম দেখিনি। আর তাছাড়া আমি কষ্ট হলেও প্রকাশ করি না পাছে ওদের সহানুভূতি দেখাতে হয়।
-- তুমি বয়সের অনুপাতে অনেক বেশী ভাবো তুলি। ডাক্তার সান্যাল সবসময় মন ভালো রাখার কথা বলেন। তুমি যদি মন ভালো না রাখতে পারো, এই রোগ থেকে মুক্তি পাবে না তুমি। ঠিক আছে চলো এবার। তোমার আয়া আসছে। নিয়ে যাবে বোধহয়।
-- কাল আসবে তো?
-- আসবো। তুমি ঠিক মত সেঁক টেঁক নিও।
এরপর প্রতিটি বিকেলে ওদের নীচে দেখা হওয়াটা প্রায় নিয়মই হয়ে গেল। এখন তুলিকা আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ। জ্বর আর আসে না। ফুলো টুলো গুলো নেই। এখন হুইল চেয়ার আর লাগে না। একটা ওয়াকার নিয়েই চলতে পারে সে। একদিন তুলির বাবার সাথে আলাপ হলো রঞ্জনের। বেশ সদালাপী, ভদ্র কথাবার্তা। মেয়ের প্রতি যথেষ্ট অনুভূতিশীল বলেই তো মনে হ'ল তার, অথচ তুলির মনে কত বিরাগ ওঁর প্রতি। আজ তুলির নামতে কিছুটা দেরীই হয়েছে। এসে দ্যাখে রঞ্জন ব্লু-টুথ কানে দিয়ে মোবাইলে মগ্ন। ও এসে ওর কাঁধটা ধরে ঝাঁপিয়ে দিল একটু - কী গো কিসে মগ্ন ছিলে?
-- গান শুনছিলাম।
-- এতটাই মগ্ন যে কখন এসেছি টেরই পাওনি।
-- না। আসলে দেরী দেখে ভাবলাম তোমার কেউ এসেছে টেসেছে বোধ হয়। তুমি আর নামবে না।
-- সে এসেছিল অবশ্য।
-- কে?
-- বন্ধুরা।
-- বিশেষ বন্ধু কেউ না কি? তুলিকা কিছু না বলে একটু হাসল। বলল কী গান শুনছিলে? রবীন্দ্র সঙ্গীত?
-- না না- ওসব রবীন্দ্র সঙ্গীত ফঙ্গীত আমি শুনি না। ওসব আমার প্যানপ্যানানি লাগে।
কী বলবে এর উত্তরে ভেবে পেলো না তুলিকা। তবে মর্মাহত হলো খুব। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রঞ্জন বলল- 'তুমি ভালোবাসো বুঝি?'
-- হ্যাঁ।
-- আমার বাবা ওইসব ভালো লাগে না। আমার একদম হিন্দি মুভির লা রে লাপ্পা গানই পছন্দ। ডিগ ডাগ ডিগ ডাগ! একটু অঙ্গভঙ্গি করে দেখালো রঞ্জন।
-- পুরোনো হিন্দি গানও শোনো না তুমি? বেশ আশাহত শোনালো তুলিকার গলা।
-- একদম কী আর শুনি না? ভালো গান পুরোনো দু-একটা শুনি। তবে এখনকার গানই আমার পছন্দ। আমি বাবা সাধারণ মানুষ। অত গভীর আঁতলামি আমার নেই। গভীর কিছু ভাবি না, বুঝিও না। তুমি তো ওই রসে রসিক, আমার সাথে তোমার জমবে না তুলি। আসলে কী জানো পরিবেশটাই বড় কথা। আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। মাইক- প্যান্ডেল- ক্যাটারিং এইসব নিয়েই কারবার। এসব গানই বাড়ীতে বাজে, অনুষ্ঠানে বাজে। আলাদা অন্য কোনও গান শোনার কানই তৈরী হয়নি তুলিকা।
-- বই টই পড়ো?
-- না। পরীক্ষার পড়া যবে থেকে শেষ - অন্য সব পড়াও ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মাঝে একটা আধটা নভেল পেলে পড়ি - পড়বো বলে উদ্যম নিয়ে পড়ি না। আর একটা কথা, কবিতা ফবিতা আমি একদমই বুঝি না। তুমি আজ কী বই নিয়ে নেমেছো? কবিতার?
-- হ্যাঁ। পুর্নেন্দু পত্রীর। নাম শুনেছো?
-- এতখানি আবার আন্ডারএস্টিমেট ক'রো না তুলি। এনার ডাইরেকশনের একটা বাংলা ফিল্ম দেখেছি। রঞ্জন আড়চোখে দেখল তুলিকার মুখটা থমথমে। তাকে যেন আরও রাগানোর জন্য বলল, ভালো লাগেনি যদিও। কবিতা কেমন লেখে? ভালো?
তুলিকা উত্তর দিল না কোনও। জিজ্ঞাসা করল তোমার ছুটি হয়ে যাবে বলছিলে, কবে?
-- এই শনিবার বোধ হয়। ডাক্তারবাবু কয়েকটা রিপোর্ট করতে দিয়েছেন। সম্ভবত বৃহস্পতি বা শুক্রবারেই রিপোর্ট এসে যাবে। ওটা দেখলেই ছুটি।
-- খুব খুশী বুঝি? বাড়ী যেতে পারবে!
-- তা পারবো। তবে অনেকদিন এখানে থাকতে থাকতে একটা অভ্যাস হয়ে গেছিল।
-- আমার তো আরও কতদিন, কে জানে!
-- তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে রোজ দেখতে আসবো।
-- রোজ দেখতে আসবে মানে? তোমার বিকেল বেলা অন্য কোথাও যেতে হয় না? মুচকি হাসলো তুলি।
-- প্রেম ট্রেমে ডিউটি দেওয়ার কথা বলছ? সে পাঠ চুকে গেছে। অপর্ণার সাথে রিলেশন ছিল বছর পাঁচেক। আমার অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডেললোসিস রোগ আর সারবে না শুনে টা-টা করে দিয়েছে।
-- এখন তো তুমি সুস্থ হয়ে গ্যাছো। খবর পায়নি?
-- পাওয়া তো উচিত। কমন বন্ধু তো আছে অনেক।
-- তবে?
-- তবে আর কী? আমি দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছি ওর জন্য।
-- যদি ফিরে আসে?
-- ফেরার পথ কেটে দিয়েছি তুলি। আসবে কী করে?
-- তুমি কি গান শোনার মতো জীবনের ক্ষেত্রেও লেটেস্ট টাই ফলো করো?
-- লেটেস্ট বলতে?
-- মানে এখন যেমন চলছে - এই ধরা-ছাড়া সব কিছু ক্যাজুয়াল!
-- অপর্ণার ব্যাপারটা কি মিন করতে চাইছো? তুমি হলে কী করতে? তোমার এরকম রোগের জন্য যদি তোমার বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে যেত - কী করতে তুমি?
তুলিকা চুপ করে রইল।
-- কী হলো? বল কী করতে?
-- ত্যাগ করতাম। দৃঢ়স্বরে বলল তুলিকা। হঠাৎ তার চোখের কোণা আর্দ্র হয়ে গেল। রঞ্জন বিস্মিত স্বরে বলল, 'কী হল তুলি? কাঁদছো কেন?
-- না না। এমনি।
-- এমনি তো নয়! বল। তোমারও কি আমার মতই কেস?
-- না না। ও কিছু নয়। আমি এসব ভাবতে চাই না রঞ্জন'দা। আমার এখন একটাই চিন্তা। ক্লাস টুয়েলভ টা ভালো করে পাশ করতে চাই। জয়েন্ট বা আই.আই.টি- কিছু একটা লাগাতে চাই।
-- সে তুমি পারবে তুলি। তুমি তো ভালো মেয়ে। লক্ষ্য যদি স্থির থাকে, লক্ষ্যভেদ কঠিন হয় না মোটেও। দেখো না হুইল চেয়ার থেকে তুমি আজ প্রায় নর্মাল হাঁটতে পারছো সেই মনের জোর ছিল বলেই না!
-- তুমিও ছিলে বলে আমার মন শক্ত করা সহজ হয়েছে রঞ্জন'দা। তুমি আমাকে ক্রমাগত আত্মবিশ্বাসী হতে শিখিয়েছো। ধৈর্য্য ধরতে শিখিয়েছো। এত কষ্টেও আমি হাল ছাড়িনি।
-- আমি নিজেও তো এভাবেই সুস্থ হয়েছি তুলি। আমি আজ যখন নিজের কথা ভাবতে বসি, বিশ্বাসই হয় না। নিজের দেহের মতো মনটাও ভেঙেচুরে গেছিল। একদিকে রোগের ব্যথা যন্ত্রণা, অন্যদিকে অপর্নার চলে যাওয়া। কী যে দিন গেছে তখন! নিজেকে শুধু বলছি ধৈর্য্য ধরো, ধৈর্য্য ধরো।
-- তোমার সাথে তো শুধু কাল আর পরশু দেখা। শনিবার যদি ছুটি হয়, নিশ্চই বিকেলে নিচে আসবে না?
-- দূর পাগলি। শুধু তো শনিবারটাই দেখা হবে না। আমি এরপরে রোজ এসে দেখা করে যাবো।
-- তোমাকে ঢুকতে দেবে কী করে? তোমার কাছে তো ভিজিটিং কার্ড থাকবে না তখন!
-- সে চিন্তা তো তোমার নয়। ও আমি ম্যানেজ করে নেব। চল এখন। সময় হয়ে গেছে।
গোনা গুনতি দিন কখন ফুরিয়ে যায় বোঝাই যায় না। দেখতে দেখতে শুক্রবার এসে গেল। বিকেলবেলা তুলিকা নীচে এসে দেখল রঞ্জন তখনও আসেনি। বিগত এতদিনে রঞ্জন রোজ দিনই তার আগে আসতো। কী হল তার? আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেলো, তখনও দেখা নেই। এমনটা তো কথা ছিল না। হঠাৎ একটা বিষন্নতা এসে গ্রাস করলো তাকে। যাক ভালোই হল। যে চলে যাবে, মিছিমিছি এক বেলার জন্য মায়া বাড়িয়ে লাভ কী। হঠাৎ দেখলো পেছন থেকে কেউ এসে ওর দুচোখ হাত বন্ধ করে দিয়েছে।
-- কে? ওঃ রঞ্জন'দা।
-- কী করে বুঝলে? রঞ্জন বিষ্ময় প্রকাশ করল।
-- ও বোঝা যায়। নাও চোখটা ছাড়ো এবার।
-- না। চোখ বুজে থাকো। আমি বললে খুলবে। এক মিনিট পরে বলল, 'নাও এবার খোলো।'
চোখ মেলে দেখলো রঞ্জন আজ সুন্দর পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে এসেছে। হাসপাতালের ড্রেস এখন ওর গায়ে নেই। কীভাবে ম্যানেজ করেছে কে জানে? ওর হাতে খান চারেক বই, প্যাকেট করা নয়। রঞ্জন বলল - 'নাও ধরো।'
-- কী এগুলো?
-- দেখতেই তো পাচ্ছো, বই।
-- সে তো পাচ্ছি কিন্তু কী বই?
-- ভয় নেই। তোমার পছন্দেরই। কবিতার বই।
তুলিকা দেখল জয় গোস্বামীর লেখা চারটে কবিতার বই, পাগলী তোমার সঙ্গে, ও স্বপ্ন, পাতার পোষাক আর বিষাদ।
-- তুমি জানলে কী করে জয় গোস্বামী আমার প্রিয়?
রঞ্জনও হেঁয়ালি করে বলল, 'ও বোঝা যায়।'
-- তুমি পড়েছ এ বইগুলো? তুলিকার চোখে বিষ্ময়।
-- পাগল। নামই শুনিনি। তবে আমার এক আঁতেল বন্ধু আছে - ও বলল বইগুলো ভালো। ওকে দিয়ে বইগুলো আনিয়েছি কাল। দু-একটা উল্টেপাল্টে দেখলাম, বুঝলাম না কিছুই। পারলে বুঝিয়ে দিও।
তুলিকা চুপ করে রইল। রঞ্জন বলল, 'দূর বোকা। এখনি বোঝাতে হবে না। এখন পড়ার বই পড়ো। যখন পড়তে ভালো লাগবে না বা মনটা ভালো লাগবে না, তখন একটা আধটা পড়ো।'
0 Comments