সংগ্রাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক-শম্ভু দাস, গ্রাম-যুগীশোল, থানা-নয়াগ্রাম, জেলা-ঝাড়গ্রাম
অনেকবছর আগে অনেকদূর রাজ্যে এক ছোটো কুটিরে এক বৃদ্ধ বাস করত। সেই বৃদ্ধ ছিল খুবই গরীব। তার বয়স হয়ে যাওয়ার জন্য সে কোনো কাজকর্ম করতে পারত না। অনেক দুঃখ কষ্টে তার দিন কাটত। বৃদ্ধের একটি মেয়ে ছিল, মেয়েটি ছিল অনেক সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী। সারাদিন মেয়েটির মুখে হাসি লেগে থাকত। মেয়ের হাসিমুখ দেখে বৃদ্ধের কষ্ট একটু হলেও কম হত। বৃদ্ধ ও তার মেয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে যেত, আর সারাদিনে যা ভিক্ষা পেত তাই দিয়ে নিজেদের পেট চালাত। এমনকি কোনো কোনো দিন তাদের না খেয়েও থাকতে হত। কিন্তু তাদের আর কোনো উপায়ও ছিল না। বৃদ্ধের খুব কষ্ট হত, সে ভাবত-“আমি এমনই এক বাবা যে নিজের মেয়েকে ঠিকমতো খাওয়াতে-পরাতে পারি না।” কিন্তু এত কষ্ট সত্ত্বেও তার মেয়ের মুখে সে কোনোদিন কেনো অভাব অভিযোগ শোনেনি। কোনোদিন খাবার না জুটলে বৃদ্ধ কষ্ট পেলে তার মেয়ে বলত-“কষ্ট পেয় না বাবা, আজ খাবার পাইনি তো কী হয়েছে, ভগবান কাল ঠিক আমাদের খাবার জুটিয়ে দেবেন। তুমি কোনো চিন্তা করো না।” তখন বৃদ্ধ বলত-“তোমার মতো মেয়ে পেয়ে আমি ধন্য। কিন্তু আমি তোমাকে কিছু দিতে পারছি না।” তখন বৃদ্ধের মেয়ে বৃদ্ধকে বলত-“চিন্তা করো না বাবা, আমি খুব ভালোই আছি। তুমি আমাকে যা দিয়েছ তাই অনেক।” এইভাবে দুঃখ কষ্টে বৃদ্ধ ও তার মেয়ের দিন কাটতে লাগল। কিন্তু বৃদ্ধ তার মেয়েকে ঠিকমতো খাওয়াতে-পরাতে না পারায় এমনকি তাদের অভাব সহ্য করতে না পেরে একদিন বাধ্য হয়ে রাজার কাছে গেল। সে রাজপ্রাসাদে গিয়ে দেখে রাজা প্রাসাদেই রয়েছেন। বৃদ্ধ রাজাকে গিয়ে বলে-"আমি অনেক ভাগ্যবান মহারাজ, যে আপনার সাক্ষাৎ পেলাম। রাজামশাই, আপনার কাছে আমি কোনোদিন কিছু চাইনি। আজ আপনি যদি আমাকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দেন তাহলে আমি আমার মেয়েকে ঠিকমতো খাওয়াতে-পরাতে পারব। আর কোনোদিন আপনার কাছে আমি কিছু চাইব না। আমাকে দয়া করুন মহারাজ।” রাজা বৃদ্ধকে ভালোভাবে দেখেন, বৃদ্ধের পোশাক-আশাক দেখে গরীব মানুষ বলে মনে হলেও তার কথাবার্তা শুনে রাজা খুবই অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বৃদ্ধকে বললেন-“আপনাকে দেখলে গরীব মানুষ বলে মনে হলেও আপনার কথা শুনে আপনাকে অনেক জ্ঞানী বলে মনে হয়। আপনি এত সুন্দর করে কথা বলা শিখলেন কীভাবে?।” বৃদ্ধ বলে-“এত সুন্দর কথা বলা আমাকে আমার মেয়ে শিখিয়েছে।
আমার মেয়ে বলে - মানুষের কথাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। কথার মাধ্যমে মানুষের চরিত্র বোঝা যায়।জানেন মহারাজ, আমার মেয়ে খুব বুদ্ধিমতী। ওছাড়া এ পৃথিবীতে আমার কোনো মূল্য নেই।” মহারাজ তখন বৃদ্ধের মেয়ের বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে চাইলেন। তাই তিনি বৃদ্ধকে বলেন-“আমি আপনাকে স্বর্ণমুদ্রা দেব কিন্তু তার আগে আমি আপনার মেয়ের বুদ্ধির পরীক্ষা করতে চাই।” এরপর মহারাজ কয়েকটি ডিম বৃদ্ধকে দিয়ে বললেন-“আপনার মেয়েকে গিয়ে বলুন যে, রাজামশাই বলেছেন কালকের মধ্যে এই ডিমগুলো থেকে বাচ্চা বের করতে। ডিমগুলো থেকে বাচ্চা বের করতে পারলে আমি আপনাকে স্বর্ণমুদ্রা দেব, আর যদি আপনার মেয়ে এটি না পারে তো তাকে এর শাস্তি দেওয়া হবে।” বৃদ্ধ তখন আর কিছু না বলে মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে এল। বৃদ্ধকে চিন্তিত দেখে তার মেয়ে বলল-“কী হয়েছে বাবা?।” বৃদ্ধ বলল-“রাজামশাই এই ডিমগুলো দিয়ে তোমার বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে চান। তিনি বলেছেন কালকের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা না বের করতে পারলে তোমাকে শাস্তি দেবেন।” তখন বৃদ্ধের মেয়ে বলে-“কিন্তু বাবা এগুলো তো সেদ্ধ ডিম। এর থেকে বাচ্চা বের হবে কী করে?।” তখন বৃদ্ধ আরও দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু বৃদ্ধের মেয়ে বলে-“তুমি কোনো চিন্তা করো না বাবা, এখন অনেক রাত হল তুমি ঘুমিয়ে পড়বে চলো। কাল সকালে আমি এর একটা উপায় বের করব।” এরপর পরেরদিন সকালে বৃদ্ধের মেয়ে বৃদ্ধকে বলে-“বাবা, আমি তোমাকে কিছু সেদ্ধ ছোলা দিচ্ছি। তুমি এগুলো নিয়ে গিয়ে জমিতে ফেলতে থাক্, রাজা যখন সেই রাস্তা দিয়ে যাবেন তখন তুমি জোরে জোরে বলবে- হে ভগবান, এই সেদ্ধ ছোলা থেকে যেন খুব তাড়াতাড়ি গাছ বের হয়।” বৃদ্ধ তার মেয়ের কথা মতো জমিতে গিয়ে সেদ্ধ ছোলা ফেলতে থাকে আর রাজাকে আসতে দেখে জোরে জোনে বলতে থাকে তার মেয়ে যে কথাগুলো বলতে বলেছিল। রাজা কথাগুলো শুনে বৃদ্ধের কাছে এসে বললেন-“বৃদ্ধ তুমি কী পাগল হয়েছ, সেদ্ধ ছোলা থেকে কী গাছ হয়।” তখন বৃদ্ধ বলে-“মহারাজ, আমার মেয়ে বলেছে যদি সেদ্ধ ডিম থেকে বাচ্চা হতে পারে তো সেদ্ধ ছোলা থেকে গাছ হবে না কেন?” রাজা তখন বুঝতে পারেন যে সত্যিই বৃদ্ধের মেয়ে খুবই বুদ্ধিমতী। কিন্তু তবুও তিনি বৃদ্ধের মেয়ের কাছে হার মানতে চাননি, তাই তিনি বৃদ্ধের মেয়ের আর একটি পরীক্ষা নেন। তিনি বৃদ্ধকে একটা বাটি দিয়ে বলেন-"বৃদ্ধ তুমি তোমার মেয়েকে গিয়ে বল যে,এই বাটির মধ্যে সে যেন সাগরের সব জল ভরে নিয়ে আসে। আর তার না হলে ওকে শাস্তি পেতে হবে।” বৃদ্ধ বুঝতে পারে যে এটা কখনোই সম্ভব নয়, কিন্তু রাজার মুখের উপরেও কিছু বলতে পারে না। তাই বৃদ্ধ মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে তার মেয়েকে সব কথা বলে। তার মেয়ে বলে-“তুমি চিন্তা করো না বাবা সব ঠিক হবে যাবে।” এর পরের দিন ওই বাটি নিয়ে রাজপ্রাসাদে বৃদ্ধ না গিয়ে বৃদ্ধের মেয়ে রাজার কাছে যায়। রাজামশাই বৃদ্ধের মেয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। বৃদ্ধের মেয়ে রাজাকে বলে-“মহারাজ, আপনি যদি দয়া করে নদী ও ঝর্ণাকে বলেন সাগরে না মিশতে তাহলে আমি এই বাটিতে করে সাগরের সব জল ভরে নিয়ে আসতে পারি।” রাজা তখন বুঝতে পারেন যে সত্যিই এ মেয়ে খুবই বুদ্ধিমতী। রাজা বৃদ্ধের মেয়েকে বলেন-“তুমি সত্যিই খুব বুদ্ধিমতী, আমি তোমার বুদ্ধির কাছে হার মানছি।” এরপর বৃদ্ধের মেয়ে রাজাকে বলে-“তাহলে মহারাজ আমার বাবা আপনার কাছে যা চেয়েছিলেন এখন আপনি তা দেবেন তো?” রাজা তখন বলেন-“হে সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমার বুদ্ধি ও রুপের কাছে আমি মুগ্ধ। তোমাকে আমি আমার পাটরাণী করে রাখব। তুমি কী আমায় বিয়ে করতে চাও।” তখন বৃদ্ধের মেয়ে বলে-“যদি আমার বাবা বলেন তো আমি কোনো অমত করব না। আপনার রাণী হওয়া আমার সৌভাগ্যের ব্যাপার।”এরপর রাজা বৃদ্ধকে বললে বৃদ্ধ আর না বলে না বরং আরও খুশি হয়। তারপর রাজা ও বৃদ্ধের মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। আর বৃদ্ধের মেয়ের বুদ্ধির জোরে রাজ্যের উন্নতিও হতে থাকে। এর কিছু বছর পর রাণীর কোল আলো করে এক রাজপুত্রের জন্ম হয়। এরপর রাজা ও রানী রাজপুত্রকে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে থাকেন।
0 Comments