শূন্য দৃশ্যের ছবিওয়ালা
শাশ্বত বোস
প্রকান্ড একটা সাদা ক্যানভাসের গায়ে ফ্ল্যাট ব্রাশটা দিয়ে আঁকিবুঁকি, অবাধ্য আঁচড় কাটছে সমীরণ। আজ অনেকদিন পর ছবি আঁকবে ও। হাফ হাতা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্টে লিখে ফেলবে স্ব-যাপনে আত্মমগ্ন একটা শরীরকে। শরীরের ভিতর ভাঁজ হয়ে থাকা আরেকটা শরীর! বহুদিনের পুরোনো একটা শরীর! সম্ভবত কয়েক শতাব্দী পুরোনো। সে শরীরে কোন জানালা নেই। শরীরটার মুখে চোখে খানিকটা ভয় লেগে থাকে হয়তো। হয়তো লেগে থাকে অনেকটা বিস্ময়! সর্বদর্শী শরীরটা হয়তো আচমকা দেখায়, ক্লান্ত পতঙ্গের মতো ঘুমে ঢলে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে, কারো উপর জাদুপ্রভাব বিস্তার করতে পারে। সেই শরীরটার চামড়া ফেটে বেরিয়ে এসে বেশ খানিকটা মায়াবী আলো সমীরণের মন মাথায় ধীর গতিতে মাকড়সার জাল বোনে। অঝোরে বৃষ্টির পর গজিয়ে ওঠা আঠালো জীবনটায় নিষ্প্রাণ গাঢ় শ্যাওলা রং লাগে। এরপর সেই ধূসর শরীরটা ছায়া ছায়া অন্ধকারে ধীরে, অতি ধীরে নেমে যাবে কোনো অন্ধকার কুয়োয়, পড়ার টেবিলে ছড়ানো ছেটানো এক রাশ বইয়ের মত অনিয়মের অস্থির আকুলতা নিয়ে! জলপাই রঙের মৃত্যুর আধিপত্য আর তার অলোকিক ও জটিল বর্গক্ষেত্রে, একটা কৌণিক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায় সমীরণ। ওর দুচোখে গলগলিয়ে সন্ধে নামে, মাথা ভার হয়ে আসে, শরীর এলিয়ে দেয়। তবু ছবি আজ ও আঁকবেই!
🍂
সমীরণ দিব্যি টের পায় ওর বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখটা বড় হয়েছে বেশ। গোড়ার দিকে মোটা কিন্তু আগার দিকটা সরু হয়ে ছুঁচোলো হয়েছে, ঠিক মুখ ভোঁতা ছুরির মত। প্যালেট থেকে ওই নখে করেই বেশ কিছুটা ক্যাডমিয়াম রেড, ইয়েলো অকর্, আল্ট্রাম্যারিন ব্লু আর টাইটেনিয়াম হোয়াইট খামচে তুলে এনে, রতিস্নাত জ্যোৎস্নার মত ক্যানভাসটার সারা শরীরে হরবোলা পাখির সুর এঁকে দিতে ইচ্ছা করে ওর। বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে আসে পাখিটার শিস। আধ পোঁড়া ইটের ভাঁজে ভাঁজে চাপা পড়ে থাকা স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তুলতে তার জুড়ি মেলা ভার! এটাই হয়তো পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া প্রথম গান। এর আগেও কেউ কোনদিন গান গায়নি, পরেও না। প্যালেট নাইফটার কাজ কেড়ে নিল শুধু ওর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে গজিয়ে ওঠা এই নখটাই! বিষয়টা ওকে ভিতরে ভিতরে ভীষণ তাঁতিয়ে দেয়! ক্যানভাসটা জুড়ে তখন বিস্তৃত একটা নিবিষ্ট সমকোণী সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ। কোন অজানা মানবীর মুখের বেস লাইনস এগুলো! পোট্রেট পেইন্টিং এর একদম প্রাথমিক ধাপ! সমীরণের জীবনটা যেন তার ঠিক দুটি বাহুতে এসে দাঁড়িয়েছে, যেন গন্তব্যের দুদিক! আজকাল ও যেন দুটি সম্পূর্ণ পৃথক মানুষ! দুটি আলাদা আলাদা রঙের মন ওয়ালা দুটি পৃথক জীবন যেন সর্বক্ষণ ভর করে থাকে ওর ওপর। কোড়া কাপড়ে বেশ খানিকটা সাদা আর অল্প কালো মিশে গিয়ে তৈরী হওয়া ছাই রঙের একটা জীবন! তোলপাড় ধুলোঝড়ের মত আস্তে আস্তে সে জীবন কালো হয়ে আসে, মিহি সুতোপাড়ে জমা হয়ে আসা থকথকে আলকাতরার মতন। নির্জন, নির্বাক, নগ্ন! আবার ঠিক তার উল্টোপিঠে হলুদ, কালো আর লাল মিশে সঙ্গম লবণের ভারে মেহগনি রঙের ঘনঘোর, অশিষ্ট একটা মন। ভিজে নিঃশেষ হয়ে যাবার মত্ত একটা জেদে যার অসুখের পরোয়া নেই। যেন রুক্ষ্ম মরুভূমির মতন। এই প্রবল জলকষ্ট আবার এক ঢোঁকেই ভেতরে জল থৈ থৈ! ভ্রম আর ভ্রমর সেখানে বাস করে আলোর সমকামী হয়ে। এই প্রখর মে মাসের দুপুর, যে দুপুরে ঠাঠা রোদে তৃষ্ণার্ত কাক একফোঁটা জল না পেয়ে ছটফট করে। বছর বেয়াল্লিশের বিধবাকে একমাত্র ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ট্রেনে ট্রেনে হকারি করতে হয়, পেন-পেন্সিল-চিরুনী ফেরি করতে হয়। গনগনে ইমারতের গা বেয়ে ইঁটের পাঁজা মাথায় নিয়ে বারোতলার ছাদে উঠতে হয় বছর ছত্রিশের স্বামী পরিত্যক্ত বিলকিসকে। একটা নিরেট লালসার প্রতিক্রিয়াহীন অভিব্যক্তি যখন পোড়ায়, ভেপ্সে যাওয়া ঘামের গন্ধে বিবর্ণ শরীরগুলোকে, তখন সেই অপরিসীম কষ্ট আর লড়াইয়ের সমান্তরাল জগতে বসে কেবল ছবি আঁকে সমীরণ, মধ্য কলকাতার পুরোনো, জীর্ণ বাড়িটার দোতলার এই বন্ধ ঘরটায় বসে।
ঠিক এখানটাতেই রক্তগোলাপের ছিটে হয়ে ক্যানভাসটায় প্রবেশ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে বিকশিত হওয়া সুররিয়েলিজমের দৃশ্য ও পোশাকের কাল্পনিক বন্ধনে তৈরী ইমেজারি আর ‘কাইফোর্ড স্টিল’ এর হাত ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চালু হওয়া ‘এবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিসম’ এর নীলচে মিশেলে মূর্ত, রাতের বাঁকে পথ হারিয়ে ফেলা উতল চন্দ্রভাগা! সমীরণের শুধু মনে হয় যেন প্রাগৈতিহাসিক কালের থেকে ও দাঁড়িয়ে আছে ইজেলটার সামনে। ক্যানভাসটা ধুপকাঠির মত নগ্ন হয়েছে, শুধু ব্রাইট ব্রাশ, ওয়াশ ব্রাশ, ফিলবার্ট ব্রাশ আর এগবার্ট ব্রাশের খোঁচায়। ড্রাই ওয়াশিং, স্ক্র্যাম্বলিং, গ্লেজিঙ, হ্যাচিং ইত্যাদি স্পেসিফিক ব্রাশিংয়ের সোহাগে আদরে! এখন ছবিটার জায়গায় জায়গায় ইম্পেস্ত করার জন্য ২৪ নম্বরের স্টিফ ব্রাশটাও বড় অপ্রয়োজনীয় মনে হয় ওর কাছে। শুধু এই নখ আর রং দিয়েই হয়তো ও এঁকে ফেলতে পারবে সেই মুখ! সুন্দর আর মাঝামাঝি রকম দেখতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে যে মুখ, গন্ধ ফুরোনো আরব্যরজনীর সময় থেকে স্মৃতির ঘুঙুর পায়ে! ঘন-ঘিঞ্জি-ভয়-হত্যা-আতঙ্কের গলিতে বসে যে মুখটার ধ্যান করেছে ও সেই কিশোরবেলা থেকে। আবার সেই মুখটা দেখলেই হয়তো ওর মাঝে মাঝে স্বমেহনের ইচ্ছে জেগেছে! কয়েকটা মুখ অনায়াসে ও এনে বসাতে পারে এই মুখটির জায়গায়। সাইকেলের চাকার ধুলোকাদা মেখে কয়েকটা মানুষ এভাবেই বেঁচে আছে আজও, অনিবার্য্য ঘুম ঘুম নির্জনতার হাত ধরে। যেমন টুকিদি।
বৈজয়ন্তীমালার মত ধীর এক্সপ্রেশন খেলা করে যেত টুকিদির গোটা মুখ জুড়ে! ওর জমে যাওয়া কাফ সিরাপের মত ওয়াইন কালারের দুটো ঠোঁটে, কন্সেন্ট্রেটেড চুমু খেতে চেয়েছিল সমীরণ! টুকিদি মুখ সরিয়ে নিয়েছিল। কোন এক অনুভূতি প্রখর দুপুরে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়ানোর সময় মুখটা গাঢ় সেপিয়া টোনে হালকা ব্রাউনিশ হাইলাইটিং এর মত করে টুকিদি বলেছিল, “তুই বাড়ি যা বাবলু, কাল থেকে আর আসিস না।” সেই টুকিদির বডিটা যখন শেষবারের মত এল এ পাড়ায়, ফর্সা মুখখানা জুড়ে ছোপ ছোপ নীল! যেন লাইট বেসের উপর আর্টিস্ট স্পঞ্জে করে উইনসর ব্লু ছুপে দিয়েছে কেউ! হয়তো এরই ভালো নাম নিঃসঙ্গতা! এই নিঃসঙ্গতার উপর মাদুর পেতে দীর্ঘ্যদিন শুয়ে থেকেছে সমীরণ টুকিদির ডেডবডিটার দিকে চেয়ে। একটা ভীষণ টাটকা বডি। আইভরি কালারের একটা ব্যাকলাইট এসে পড়েছে মুখটায়! যেন এক্ষুনি ডাকলেই উঠে বসবে। নিজের মন এবং অঙ্ক কষতে না পারা জীবনের সবটুকু অভিজ্ঞতা ছেঁচে নিয়ে, সব স্বপ্নকে হিঁচড়ে নামিয়ে এনেছে সমীরণ সেই অন্ধকার কুয়োটার ধারে, যেখান থেকে কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে! ছোটবেলায় ওর মা ওকে আঁকা শেখাতেন। মায়ের সেই ঢলঢলে মুখটা যেন খুব বেশী মনে পরে ওর ইদানীঙ। দুটো চোখের বিস্তৃত দেখায় ও দেখতে পায়, দেখতে পাওয়াকে ছাড়িয়ে অসীমে। ঠিক যেখান দিয়ে চলে গেছে একটা ফাঁকা রাস্তা! যে রাস্তাটা দিয়ে কেউ কখনো হেঁটে আসেনি।
তবু ক্ষণজন্মা শিল্পীর মতন আলুথালু স্বপ্নের স্পাইরাল পথ বেয়ে, একবার ঠিক করে মুখটা এঁকে ফেলতে চায় সমীরণ! ডার্ক ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুটে ওঠা মুখটার নাকের কাছে রিগার ব্রাশটা ঘষে ঘষে নোজ ব্রিজটা সরু করতে থাকে, উপরের ঠোটটাকে আরেকটু মোটা। চোখদুটো আরো সাদা হবে! তিরিশ বছর আগের দিনে ফুলশয্যায় পাতা চাদরের মত সাদা। বেশ সতর্ক তুলির আঁচড়! আয়নার ওপর থেকে এক্ষুনি হয়তো উঁকি দেবে একগাদা লোক। অনেকটা একরকমের দেখতে! বসিয়ে দেবে গোল টেবিল! বলে উঠবে, “জন সিঙ্গার বা গুস্তাভ ক্লিমত্ তো গুলি মার ছোকরা! তোমার ছবি, তোমার তুলি এক্সপ্রেশনিজমের ধার দিয়েও যায় না! কিচ্ছু হয়নি! আবার শেখো নতুন করে। নন্দলাল, যামিনী রায়, হেমেন মজুমদার, যোগেন চৌধুরী দেখো। হেঁটে যাও নির্জন পথের সেই রাস্তা দিয়ে, যেখানে আশেপাশে ছড়িয়ে আছে শুধু কটা ল্যাম্পপোস্ট আর কটা গাছ। সেদিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলে ওঠো তারপর, ‘ফুল ধরেছে।’” ঠিক এর পরেই লোকটার মুখের ভাব ভঙ্গি পাল্টে যাবে। মুখাবয়বে ধীরে ধীরে ফুটে উঠবে বিপন্নতা আর বিষন্নতার আখ্যান, বলে উঠবে, “মেয়েদের বুকে মাথা রেখেছ কোনোদিন? মেয়েদের বুক আঁকতে শিখেছ? নিটোল দুটো বুক, তিতির পাখির মত নরম!” আয়নার ওপারের সারা শরীর জুড়ে তখন চিৎকার করতে চায় সমীরণ! পৌরাণিক অভিশাপের মত নিশ্চল কেউ তখন মন্ত্রের মত বলে যায় ওকে, “শান্ত হ, শান্ত হ।” মন্ত্রের ভেতর থেকেই যেন একটা তোলপাড় ফেনিয়ে ওঠে! ওর খুব ইচ্ছে করে পালক বিহীন পাখিদের মুখ আঁকে, বদলে দেয় গোটা পৃথিবীর জ্যামিতি! ‘ইথানেশিয়া’, এই একটা শব্দ। তাকে ঘিরে যেন অনেকে এসে দাঁড়ায়। সমীরণ ঠিক মাঝখানে, একেবারে একা! এই পাল্টে যাওয়া সময়টাতে নিজেই নিজের সাথে কথা বলে সমীরণ। ওর সাথে কথা বলার যে আর কেউ নেই। ও এখন নিজেই নিজের বন্ধু, নিজেই নিজের অভিভাবক, আবার কখনো নিজেই নিজের শত্রুও! নিজেই একহাতে নিজের গায়ে চিমটি কাটে, অপর হাত দিয়ে শান্ত করে। “ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার!” রোগটার আগে নাম ছিল বোধহয় “মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার।” আমার আমিটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। এ রোগের যত বয়স বাড়ে তত মানুষ আরো বিবর্ণ, অস্পষ্ট ও অগভীর হয়ে যায়। শুধু তার মাথার মধ্যে সেঁদিয়ে থাকা লোকগুলো তখন বেরিয়ে আসে বেশী করে। চেঁচামেচি করতে থাকে ব্যস্ত রাস্তায় যান্ত্রিক হর্ন দিতে থাকা গাড়িগুলোর মত।
সমীরণ পাশের টেবিলে রাখা বিষের শিশিটার দিকে হাত বাড়ায় ধীরে ধীরে। সেটার শরীরে তখন কচুরিপানার নীল! ঠিক যেমন একটা নীল প্রজাপতি বসেছিল সেদিন টুকিদির গালে, শরীরে যার অজস্র ক্ষত!
2 Comments
শাশ্বত বোসের এই অনবদ্য গল্পটি পড়ে আমি অভিভূত। অত্যন্ত দক্ষ বাংলায় ঘটনার প্রেক্ষিত তিনি নিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন। ছোটগল্পের ইতিহাসে এই গল্পটি যে একটি স্থায়ী জায়গা করে নেবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ
Delete