জ্বলদর্চি

কালো মেয়ে/ সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস /কথক- বিজয় দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম

কালো মেয়ে 

সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 

কথক- বিজয় দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম 


এক গ্ৰামে বাস করত গৌরী নামের এক মেয়ে। আর তার সাথে থাকত তার সৎ মা ও সৎ বোন সোনা। গৌরী ছিল খুবই ভালো মনের মেয়ে, কিন্তু তার গায়ের রং ছিল কালো। 

গৌরীর মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা আবার বিয়ে করে, যাতে গৌরী মায়ের অভাব বুঝতে না পারে। কিন্তু তার সৎ মা তাকে ভালোবাসত না। এর কিছুদিন পর গৌরীর বাবাও মারা যায়। ফলে গৌরীকে ভালোবাসার মতো এ পৃথিবীতে আর কেউ থাকে না। 

গৌরীর সৎ মা গৌরীকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাতো। এমনকি কাজ করতে না পারলে কথাও শোনাত। সৎ মেয়েকে দিয়ে কাজ করালেও নিজের মেয়েকে দিয়ে সে কোনো কাজই করাতো না। 

🍂
ad

একদিন গৌরী কলতলায় বসে বাসন মাজচ্ছিল। সেইসময় তার সৎ মা এসে তাকে বলে-“এই যে মেয়ে, তখন থেকে তো শুধু একটা বাসনই মেজে যাচ্ছিস। বলি ঘরের বাকি কাজগুলো কে করবে শুনি? তোর মরা মা এসে কী কাজগুলো করে দিয়ে যাবে।”

তখন গৌরী বলে-“এই তো মা, এই বাসনগুলো ধুয়ে আমি ঘরের বাকি কাজগুলো ঠিক সময়মতো করে দেব। আসলে আজ অনেক বাসন ছিল তো, তাই একটু দেরি হয়ে গেছে।”

এই কথা শুনে তার সৎ মা বলে-“বা-বাবা-বা, এ মেয়ের মুখে তো খই ফুটছে। তোর মরা মা তো মরার আগে বেশ ভালোই শিক্ষা দিয়ে গেছে তোকে। বড়োদের মুখের উপর কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে ঝগড়া করতে হয়? বেশ ভালোই শিক্ষা দিয়েছে তো।” 

গৌরী এইসব কথা শুনে কিছু না বলে শুধু কাঁদতে থাকে। সেইসময় গৌরীর সৎ বোন সোনা সেখানে আসে। সোনা তার মাকে বলে-“কী হয়েছে মা, সকাল সকাল এত চিৎকার করছ কেন?” তখন তার মা তাকে সব কথা বলে। সব শুনে সোনা বলে-“বাদ দাও তো মা। এইসব ছোটোলোকের সঙ্গে মুখ লাগাতে যেও না।” 

এরপর সোনার মা সোনাকে বলে-“আচ্ছা মা, তোর আজ ঘুম ভালো হয়েছে তো। ঘুম ভালো করে না হলে তোর তো আবার চোখের নীচে কালি পড়ে যাবে। যা মা যা আর একটু ঘুমিয়ে নে।” 

তখন সোনা বলে-“না-না মা, ঘুম ভালোই হয়েছে। এবার একটু কড়া করে চা পেলে শরীরটা একেবারে তাজা হয়ে যাবে।” এই বলে সোনা সেখান থেকে চলে যায়।

সোনার মা তখন গৌরীকে বলে-“শুনলি তো আমার মেয়ে কী বলে গেল? যা যা এখনই ওর জন্য চা করে দে। আর চা করতে যদি দেরি হয়েছে তাহলে তোর আজ রক্ষে নেই।”

গৌরী তখন তাড়াতাড়ি হাতের সব কাজ শেষ করে তার সৎ মা ও সৎ বোনের জন্য চা করে নিয়ে যায়। 

চা দেওয়ার পর গৌরী তার সৎ মাকে বলে-“মা আমি তো সব কাজ করে দিয়েছি। এখন আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমাকে কিছু খেতে দাও না।” 

তখন তার সৎ মা বলে-“কী বলছিস তুই, দুটো কাজ করেই খিদে পেয়ে গেল। সারাদিন শুধু খাই আর খাই। বলি এত খিদে আসে কোথা থেকে শুনি।” 

গৌরী তখন আর কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে যায়। তারপর সে তার ঘরে এসে তার মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। 

কাঁদতে কাঁদতে সে বলে-“মা, এ জন্মে কী আমার কষ্টের শেষ হবে না। এরা কী কোনোদিন আমাকে ভালোবাসবে না? জানো মা! এরা না আমাকে দিয়ে দিন-রাত কাজ করায়। খিদে পেলে খেতেও দেয় না। এমনকি তোমাকে নিয়ে নানা আজেবাজে কথা বলে। আমি আর পারছি না মা আর সহ্য করত পারছি না।” এইসব কথা বলতে বলতে গৌরী তার মায়ের ছবির সামনে কাঁদতে থাকে।

এইভাবে দিন কাটতে থাকে। একদিন গৌরী তার সৎ বোনের ঘরে খাবার দিতে যায়। গিয়ে দেখে তার বোন ঘরে নেই। তবুও সে অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে সে ঘরে ঢুকে। 

ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখে একটা টেবিলে অনেক সাজবার জিনিস রাখা আছে। গৌরী সেইসব সাজার জিনিস দেখে মনে মনে ভাবে-“ইস্! কত সাজবার জিনিস। আমারও যদি এইসব থাকত।”

এইসব ভাবতে ভাবতে সে সেই সাজার জিনিস থেকে একটু পাউডার নিয়ে মুখে মাখে। সেইসময় তার বোন সেখানে চলে আসে। সে এইসব দেখে চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকারে তার মা সেখানে ছুটে আসে। 

তার মা এসে বলে-“কী হয়েছে, এত চিৎকার করছিস কেন?” তখন সোনা তার মাকে সব কথা বলে। 

সব কথা শুনে তার মা গৌরীকে বলে-“কী রে তুই, তোর কী সব বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? আমার মেয়ের এত দামী দামী জিনিসে তুই হাত দিয়েছিল কেন?” 

গৌরী তখন তার সৎ মাকে বলে-“আমি কিছু করিনি মা। শুধু একটু পাউডার মুখে লাগিয়েছি।”

তার মা তখন হাসতে থাকে, আর বলে-“কালো মেয়ে আবার ফর্সা হতে চাইছে। বলি এই তো রূপের ছিরি, তাতে আবার রঙ লাগাচ্ছিস। এই রুপ দেখলে মানুষ তোকে একবারের বেশি ঘুরেও তাকাবে না।” 

এইসব কথা শুনে গৌরী খুব কষ্ট পায়। সে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে আসে। এইভাবে কয়েকমাস চলে যায়। সৎ মা ও সৎ বোনের অত্যাচারে তার দিন কাটতে থাকে। কিন্তু গৌরী এটা জানত না যে আর কিছুদিনের মধ্যে তার সব দুঃখ-কষ্ট দূর হতে চলেছে। 

একদিন গৌরীকে তার সৎ মা বলে-“এই মেয়ে শুনে যা, কাল সোনাকে দেখতে ছেলের বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। তুই তাদের জন্য ভালো ভালো খাবার বানিয়ে রাখবি। আর হ্যাঁ, নিজেও একটু ভালো ভালো জামাকাপড় পরে থাকবি। নাহলে ওদের কাছে আমার নাক কাটা যাবে।”

তখন গৌরী বলে-“মা আমার তো কোনো ভালো জামা নেই।”

তার সৎ মা তখন বলে-“নেই কোথায় রে! তোর ঘরে খাটের নিচে একটা ট্রাঙ্ক আছে। সেই ট্রাঙ্কে তোর মরা মায়ের অনেক শাড়ি আছে। তার মধ্যে থেকে একটা পরে নিলেই তো হল। আর মনে রাখিস-যারা আসবে তারা খুবই বড়লোক। তাদের সামনে যদি উল্টোপাল্টা কিছু করেছিস তো, কালই এ বাড়িতে তোর শেষ দিন হবে।” 

গৌরী বলে-“ না-না মা, আমি কিছু করব না। তুমি কোনো চিন্তা করো না।”

এরপরের দিন সকালে ছেলের বাড়ির লোকজন সোনাকে দেখতে আসে। সোনাও তৈরি হয়ে ছেলের বাড়ির লোকজনের সামনে এসে বসে। আর লোকজন আসতে দেখে গৌরী এদিকে শাড়ি পরার জন্য খাটের নীচ থেকে ট্রাঙ্কটা বের করে।

ট্রাঙ্কটি দেখে সে বলে-“এই খাটের নিচে যে একটা ট্রাঙ্ক আছে তা তো আগে জানতামই না। আর জানবই বা কেমন করে, এর আগে তো আমি কখনো ভালো জামাকাপড় পরার সুযোগই পাইনি।” 

এইসব ভাবতে ভাবতে সে সেই ট্রাঙ্কটি খুলে, আর ট্রাঙ্কটি খুলে সে অবাক হয়ে যায়। সে দেখে ট্রাঙ্কের ভেতরে অনেক সুন্দর সুন্দর শাড়ি রয়েছে। গৌরী সেখান থেকে একটা শাড়ি বের করে।

শাড়িটি হাতে নিয়ে সে ভাবতে থাকে-“বা! কী সুন্দর শাড়িগুলো। আমার মায়ের যে এত সুন্দর সুন্দর শাড়ি ছিল তা তো আগে জানতামই না। মায়ের এই শাড়িগুলোতে মনে হচ্ছে যেন মায়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে। মনে হচ্ছে যেন মা আমার সঙ্গে সঙ্গেই আছে।” 

এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে তার সৎ মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পায়। তার সৎ মা অতিথিদের জলখাবার দেওয়ার জন্য ডাকাডাকি করতে থাকে। 

তখন গৌরী আর কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি করে শাড়িটা পরে নেয়। কিন্তু শাড়ি পরার সঙ্গে সঙ্গেই অবাক করা এক কান্ড ঘটে। শাড়িটা গায়ের দেওয়া মাত্রই গৌরীর গায়ের রঙ পাল্টে যায়। সে কালো থেকে একেবারে ফর্সা হয়ে যায়। তাকে একেবারে পরীদের মতো দেখতে লাগে। গৌরী কিছুই বুঝতে পারে না। সে ভাবে এটা কী করে হল।

সেইসময় আবার তার সৎ মা তাকে ডাকতে থাকে। তখন সে আর কিছু না ভেবে জলখাবার নিয়ে অতিথিদের সামনে যায়। তাকে দেখে ছেলের বাড়ির লোকজন অবাক হয়ে যায়। 

ছেলের বাবা গৌরীর সৎ মাকে বলে-“এ কে? এ কী আপনার মেয়ে?” 

তখন গৌরীর সৎ মা আমতা আমতা করে বলে-“হ্যাঁ মানে, না মানে, হ্যাঁ,ওই আর কী।”

এদিকে গৌরীর সৎ বোন গৌরীকে বলে-“কী রে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? যা এখান থেকে যা।”

তখন ছেলের বাবা বলে-“না না মা, তুমি এখানেই থাকো।” আর গৌরীর মাকে বলে-“আপনার যে এত সুন্দরী একটা মেয়ে আছে তা তো আপনি আগে বলেননি। এইরকম সুন্দরী মেয়েই তো আমার ছেলের বউ হওয়ার যোগ্য। আমি এই মেয়েকেই আমার ছেলের বউ করব।” 

এছাড়া ছেলেরও গৌরীকে খুব পছন্দ হয়। এরপর ছেলের মা গৌরীর মাকে বলে-“আগামী মাসেই আমি এই মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যাব।” এই বলে ছেলের বাড়ির লোকজন সেখান থেকে চলে যায়।

এদিকে গৌরীর সৎ মা ও সৎ বোন এইসব শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। তারা গৌরীকে বলে-“বল এটা কী করে হল? তুই কালো থেকে এত সুন্দর হলি কীভাবে?” 

তখন গৌরী তার সঙ্গে যা যা ঘটেছে সব বলে। সে বলে-“তার মায়ের শাড়ি পরে সে এত সুন্দর হয়েছে।”

তখন তার সৎ মা ও সৎ বোন বলে-“তুই মিথ্যে কথা বলছিস। শাড়ি পরে কেউ আবার সুন্দর হয় নাকি?”

গৌরী বলে-“না আমি মিথ্যে বলছি না। সত্যি শাড়ি পরে আমি এত সুন্দর হয়েছি।” 

তখন গৌরীর সৎ বোন সোনা বলে-“দে তাহলে আমাকেও সেই শাড়ি, আমিও সেই শাড়িটা পরব। আর আগের চেয়ে আরও সুন্দর হয়ে যাব।” 

এইবলে সে শাড়িটা গৌরীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজের গায়ে দেয়। কিন্তু শাড়িটা পরার সঙ্গে সঙ্গেই তার গায়ের রঙ একবারে কালো হয়ে যায়। সে কিছু বুঝতে পারে না। এমনকি গৌরীর সৎ মাও সেই শাড়িটা গায়ে দেয় যাতে সেও সুন্দর হয়, কিন্তু সেও সুন্দর না হয়ে আরও কুৎসিত হয়ে যায়। 

তারা কিছু বুঝতে পারে না। তারা ভাবে এইসব কী হচ্ছে তাদের সঙ্গে। এই একই শাড়ি পরে গৌরী এত সুন্দর হয়ে গেল। কিন্তু তারা এত কালো বা কুৎসিত হল কীভাবে। 

সেইসময় গৌরীর মায়ের আত্মা তাদের সামনে আসে, আর তাদের বলে-“এই শাড়ি যে সে শাড়ি নয় এ হল জাদু শাড়ি। এই শাড়ি পরলে মানুষের অন্তরের রূপ বাইরে প্রকাশ পায়। আর গৌরীর অন্তরটা ছিল খুবই সুন্দর তাই সে এত সুন্দরী হয়েছে। কিন্তু তোমাদের অন্তর হল কুৎসিত তাই তোমরা সুন্দর থেকে কুৎসিত হয়েছ। আর একটা কথা- এই কুৎসিত বা কালো রূপ থেকে তোমরা আর কোনোদিন সুন্দর হতে পারবে না, কারণ তোমারা খুবই লোভী ও স্বার্থপর।”

এরপর গৌরীর মায়ের আত্মা গৌরীকে বলে-“ভয় নেই মা, আমি সবসময় তোমার সঙ্গেই আছি। এবার থেকে তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না।”

এই বলে তার মায়ের আত্মা অদৃশ্য হয়ে যায়। এরপর বেশ ধূমধাম করে গৌরীর বিয়ে হয়। আর সে সুখে শান্তিতে সংসার করতে থাকে। কিন্তু এদিকে তার সৎ মা ও সৎ বোন তাদের পাপের ফল ভোগ করতে থাকে।

Post a Comment

0 Comments