মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬০
আকিঞ্চন চক্রবর্তী (মধ্যযুগের কবি, ক্ষীরপাই)
ভাস্করব্রত পতি
'কন্যার গমনে রানী করে হায় হায়।
ধৈরজ না ধরে ধরে ধনপতির পায়।।
বৈবাহিক জীবপ্রাণে যাবে নাঞি খেদ।
কৃষ্ণচন্দ্র করিলেন কন্যার বিচ্ছেদ।।
রাখিল ঝিয়ের খোঁটা রাজা দুরাচার।
মোর কন্যা কবে হৈল তনয়া তোমার'।।
--- আকিঞ্চন চক্রবর্তী
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ধারার শেষতম কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে কবি আকিঞ্চন চক্রবর্তীকে। চণ্ডীমঙ্গলের মূল কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীকে অনুসরণ করেই তিনি কাব্য রচনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কবি চন্দ্রকোনা থানার ক্ষীরপাইয়ের কাছাকাছি (চেৎবরদা পরগনা) আটঘরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কাব্য প্রতিভার গুণে সবাই তাঁকে 'কবীন্দ্র' উপাধিতে ভূষিত করেন।
নিজের আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন,
'বসতি বরদা বদনে সারদা চণ্ডীকা দেবীর আদেশে।
নূতন মঙ্গল প্রবণে কুশলে কবীন্দ্র ব্রাহ্মণ ভাষে।।
বিপ্রকূলোৎপতি আটঘরা স্থিতি ঠাকুর পুরুষোত্তম।
তাহার নন্দন কবীন্দ্র ব্রাহ্মণ রচে কাব্য মনোরম'।।
যদিও পরবর্তীকালে তিনি আটঘরা থেকে উঠে গিয়ে ঘাটাল থানার বেঙ্গরাল গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন।
কবির পিতামহ ছিলেন হরিহর আচার্য। পিতার নাম পুরুষোত্তম এবং মাতৃদেবী ছিলেন গঙ্গা। কবির বড় দাদার নাম গোবর্দ্ধন। কবির তিন পুত্র। তাঁরা হলেন রামদুলাল, রামচন্দ্র এবং শিবানন্দ।
বর্ধমান রাজার আনুকূল্যে থেকে তিনি কাব্য সাধনা করে গিয়েছেন। কবি আকিঞ্চন চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল কাব্য অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাব্য। এছাড়াও কিছু কিছু দুর্গা ও শ্যামাসংগীতও তিনি লিখেছেন বলে জানা যায়। তাঁর লেখা এইসব কাব্যে বর্ধমান রাজাদের স্তুতি গেয়েছেন বিভিন্ন অংশে --
'ভূপতি তিলকচন্দ্র বর্দ্ধমানে যেন ইন্দ্র
তেজচন্দ্র তাহার নন্দন।
নিবাস তাঁহার দেশে চণ্ডীকামঙ্গল ভাষে
কবীন্দ্র ব্রাম্ভণ আকিঞ্চন'।।
আরেকটি ভণিতায় কবি উল্লেখ করেছেন --
'ভূপতি তেজশ্চন্দ্র বর্দ্ধমানে যেন ইন্দ্র পৃথিবীপালনে যুধিষ্ঠির।
প্রতাপে প্রচণ্ড রবি সভাতে পণ্ডিত কবি ক্ষেত্রিয়নন্দন রণধীর।।
নিবাস তাঁহার দেশে গঙ্গার মঙ্গল ভাষে কবীন্দ্র ব্রাহ্মণ সুবিদ্বান'।
পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ কবি আকিঞ্চন চক্রবর্তী সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, 'তাঁহার কাব্যের ভাষা খুবই পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। মুকুন্দরামকে অনুসরণ করিলেও তাঁহার কাব্যের কোন কোন স্থানে মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। আঠারো শতকের প্রথম পাদ হইতে আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত তিনি বর্তমান ছিলেন বলিয়া অনুমান করা যায়। গঙ্গামঙ্গল পুথির দুটি অংশের একটি ১১৮১ ও অপরটি ১১৮৩ সালে রচনা করিয়াছিলেন বলিয়া কবি উল্লেখ করিয়াছেন'। এই গঙ্গামঙ্গল কাব্য লেখা হয়েছে ১৭৭৬ সালে। এটি তাঁর শেষ রচনা। অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, কবি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটি লিখেছিলেন ১৮ শতকের শেষ ভাগে। আবার সুকুমার সেনের মতে এটি ১৭৫৭ সালে লেখা হয়েছিল। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটিতে দুটি খণ্ড (কান্ড) রয়েছে যা আরও ১৬ টি পালায় বিভক্ত।
গবেষকদের উপলব্ধি যে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মূল কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর জনপ্রিয়তার কাছে ম্লান ছিলেন আকিঞ্চন চক্রবর্তী। ধারে এবং ভারে আকিঞ্চন এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন বলা যায়। তবুও তাঁর লেখা চণ্ডীমঙ্গল কাব্য ছিল স্বতন্ত্র। পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ লিখেছেন, 'তাঁহার চণ্ডীমঙ্গল পুথিতে সুন্দর সুন্দর চরিত্র চিত্রনে, প্রাকৃতিক বর্ণনা প্রভৃতিতে তিনি যে অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন, তাহা অতুলনীয়'। কবির চণ্ডীমঙ্গল তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও তাঁর লেখা শীতলামঙ্গল পালা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঘাটাল এলাকার বিভিন্ন স্থানে আজও শীতলাপূজার সময় কবি আকিঞ্চন চক্রবর্তীর শীতলামঙ্গল পালা গাওয়া হয়। ড. ত্রিপুরা বসুর মতে 'আকিঞ্চনের কাব্যে মুকুন্দরাম অপেক্ষা রামেশ্বর যেন বেশী প্রভাব বিস্তার করেছেন। গাহর্স্থ্য জীবনের বাস্তব চিত্র অঙ্কনে আকিঞ্চনের কৃতিত্ব অসীম। করুণ রসের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি মঙ্গলকাব্যের গতানুগতিক পথ অনেকাংশেই পরিহার করতে পেরেছেন বলে মনে হয়'।
🍂
0 Comments