জ্বলদর্চি

নিষ্কাম কর্ম ও আত্মজ্ঞানের সন্ধান: গীতার কর্মযোগ ও জীবনচেতনা” /সত্যজিৎ পড়্যা

নিষ্কাম কর্ম ও আত্মজ্ঞানের সন্ধান: গীতার কর্মযোগ ও জীবনচেতনা”

সত্যজিৎ পড়্যা

“কর্ম কর, ফলের আশা ত্যাগ কর”—এই কথাটি যেন ভারতীয় দর্শনের নৈতিক মেরুদণ্ড। শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার অন্যতম কেন্দ্রীয় ধারণা ‘কর্মযোগ’ কেবল ধর্মীয় উপদেশ নয়, এটি এক গভীর অস্তিত্ববাদী চেতনা, যা যুগে যুগে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে কর্মের মাধ্যমে আত্ম-উত্তরণে। আজকের জটিল ও গতিশীল সমাজে, যেখানে মানুষ কর্ম আর ফলাফলের বেড়াজালে বন্দী, সেখানে গীতার কর্মযোগ একটি মুক্তির দিশা দেখায়।গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন—“নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ”
🍂
ad

অর্থাৎ, “নিয়মিতভাবে কর্ম করো, কারণ কর্মই অকর্ম অপেক্ষা শ্রেয়।”এখানে “কর্ম” বলতে বোঝানো হয়েছে সজাগ দায়িত্ববোধপূর্ণ কাজ, যা সমাজ ও আত্মার কল্যাণে নিবেদিত। গীতার কর্মযোগ কোনও এক নিষ্ক্রিয় আত্মত্যাগ নয়, বরং তা নিষ্কাম কর্ম—যেখানে কর্মই সাধনা, কর্মই ধ্যান।আজকের কর্মজীবী মানুষ প্রায়শই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়—আমার কাজ কি শুধু জীবিকা, নাকি জীবনের লক্ষ্য? অধিকাংশ মানুষ চাকরি বা জীবিকার প্রয়োজনে কর্ম করেন, কিন্তু সেখানে যদি অন্তর্নিহিত এক আত্মদায়িত্ব ও স্বার্থহীনতা না থাকে, তবে সেই কর্ম অর্থহীন হয়ে পড়ে। গীতা বলে, কর্মই প্রকৃত যজ্ঞ, যদি তা আত্মতৃপ্তি এবং সমাজকল্যাণে নিবেদিত হয়।বর্তমানে কর্পোরেট সংস্কৃতিতে কর্ম মানে শুধুই ফলভোগ, টার্গেট পূরণ, পদোন্নতি, বা আর্থিক লাভ। ফলস্বরূপ, দেখা যাচ্ছে উদ্বেগ, হতাশা, মানসিক অবসাদ, এবং কর্মে আগ্রহহীনতা। গীতার কর্মযোগ এই সংকট নিরসনে বলিষ্ঠ দার্শনিক হাতিয়ার।গীতায় কৃষ্ণ বলেন-“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
অর্থাৎ, “তোমার কর্তব্য কর্মে, কখনোই তার ফলে নয়।”এই বাণীকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হলে মনে হতে পারে ফলকে অবহেলা করতে বলা হচ্ছে। আদতে, গীতা চায় কর্মে পূর্ণ মনোযোগ ও নিষ্ঠা, কিন্তু ফলের প্রতি অন্ধ আসক্তি যেন আমাদের চিত্তকে আবদ্ধ না করে। এই দর্শনে দেখা যায়—মানুষ কর্মের মধ্য দিয়েই মুক্ত হতে পারে, যদি সে কর্মকে আরাধনার রূপ দেয়।শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসন ও সেবামূলক পেশায় কর্মযোগের তাৎপর্য-শিক্ষক যদি শিক্ষাদানকে কেবল বেতননির্ভর পেশা মনে করেন, তবে সেই শিক্ষা আত্মাহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি শিক্ষকতা হয় নিষ্কাম কর্ম, তবে তা হয়ে ওঠে চরিত্রগঠন ও সমাজগঠনের মূল হাতিয়ার। একইভাবে, একজন চিকিৎসক, বিচারক বা প্রশাসক যদি কেবল স্বার্থ ও সুবিধা ভাবেন, তবে তাঁর কর্ম অন্যায় ও অবিচারে পরিণত হয়। গীতার কর্মযোগ এই পেশাগুলিকে নৈতিক আদর্শে স্থাপন করে।গীতার দর্শনে আত্মউন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ বিচ্ছিন্ন নয়। ব্যক্তি যদি নিজের কর্মকে ঈশ্বরার্পণ করে, তবে সে কর্ম সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। কর্মযোগ মানে নিজের কর্মের মাধ্যমে বৃহত্তর কল্যাণে ব্রত হওয়া। তাই কৃষক, কারিগর, শ্রমিক, শিল্পী—সকলেই যদি নিষ্ঠা ও নির্লোভতায় কাজ করেন, তবে সমাজও উন্নত হয়।বর্তমান যুগে কর্মচাপ, হতাশা, কর্মবিরাগ, ‘বার্নআউট’ ইত্যাদি মানসিক সমস্যা ব্যাপক হারে দেখা যায়। গীতার কর্মযোগ এই সমস্যাগুলিকে সমাধান করার চাবিকাঠি হতে পারে। যদি কর্ম হয় আনন্দময়, দায়বদ্ধ এবং নির্লোভ, তবে তা মানসিক প্রশান্তি আনে।কর্মযোগ বলে—কর্ম এক ধ্যান, কর্ম এক যোগ। এই যোগই জীবনের ভারসাম্য, শান্তি ও উপলব্ধির পথ।

গীতার কর্মযোগ আমাদের শেখায়, জীবন মানে শুধু সফলতা নয়, বরং দায়, দায়িত্ব ও আত্মতৃপ্তির মধ্য দিয়ে এক বৃহত্তর সত্যের উপলব্ধি। কর্মকে যদি আরাধনা করি, তবে সে কর্ম আমাদের মোক্ষের পথ দেখায়। গীতার এই চিরন্তন বাণী আজও সমান প্রাসঙ্গিক, সমান প্রজ্ঞাময়।
আমরা যদি গীতার কর্মযোগকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তবে আমাদের ব্যক্তিজীবন, কর্মক্ষেত্র ও সমাজ হয়ে উঠবে আরও মানবিক, নৈতিক এবং অর্থপূর্ণ।

Post a Comment

0 Comments