নীলম সামন্ত
কৈলাস গলে পড়ছে, কারা যেন এর ওর গায়ে কামড়ে নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন দিচ্ছে৷ কাগজের ঠোঙায় ঠোঙায় তা বিলি হল, বিলি হল গোপন রক্ত। রক্তে কি কি লেগে থাকতে পারে তা নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, শব্দের ভেতর রিনরিন করছে ক্ষুধার্ত জিভ৷ এই খিদে এক প্রকার চর্মরোগের আলোকিত অংশ ৷ চর্মরোগীদের জল খাওয়ার তীব্র বাসনা অপূর্ণ থাকার কারণে ঠান্ডা মাথায় দাঁড়িপাল্লার এক দিককে শিখণ্ডী বানিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। দলে দলে আসে পাল্লা ভারী করতে৷ তাদের সন্তানসন্ততিদেরও একদিন চর্মরোগের পথে এগিয়ে দিয়ে ছিল, আর পেজ থ্রি-তে লিখেছিল 'কারুবাসনায় একটা কিনলে একটা ফ্রি, এখানে সবই খোলামেলা'।
এই 'খোলামেলা' শব্দটি ঘিরে আলোড়ন তৈরি হতেই পারে, কিন্তু শুক্রের মহাদশা ফুরনোর পর যখন হাতে আঁকা তারা মুছে গিয়েছিল তখন পূর্ব দিকে সূর্য ওঠার আগে গোপনে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল স্থুলকায় ট্রানজিস্টর। এসব ঈশ্বরের কতখানি গোচর সে বিষয়ে না গিয়ে বলব নেশাগ্রস্ত চোখের জাল ছিঁড়ে মাছ পালিয়েছে৷ চোখ বোঝেনি যারা নদী পারাপার করতে আসে তাদের কাছে পিণ্ডদান অথবা শ্রাদ্ধের গল্প শোনাতে নেই৷ মৃত্যু কেবল মাত্র ঘটনা। সে সম্পর্কই হোক কিংবা মানুষ কিংবা সময়। তাছাড়া নৌকাযাত্রীরা বোহেমিয়ান। পারানীর কথায় আমার সব সময়ই মৎসগন্ধার কথা মনে পড়ে৷ গায়ের গন্ধ কে না চায় দূর করতে!
🍂
আচ্ছা পারানীর দৃষ্টিনন্দনে যদি নৌকাডুবি ঘটে আর সেই নৌকায় হাজারখানেক পাখি ঠুসে দেওয়া অপরাজিতার কোলেই শুয়ে প্রিয় মাছ, না না, রাখাল বালক, এই তলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে তার চোখ কতখানি নীল হবে? হিসেব কষেছে? আগুন আর জল দুইই খেলার উপযোগী উপাদান, অবশ্য তারজন্য রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়। পারানীরা জলবিদ্যায় পারদর্শী হয়। আবহাওয়া বিদ্যেতেও৷ তারা জলের তল মেপে দাঁড় টানে, আর বাতাসের গতি বুঝে পাল তোলে৷ বাকিটা উহ্যই থাক।
উহ্য কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করব না। ওপরের অংশটিকে নাতিশীতোষ্ণ ভাবতে চাইলেও তা যে গ্রীষ্মের দাবদাহ তা অনস্বীকার্য৷ তাই কার্ড রাইস দিয়ে শরীর ঠান্ডা করার ভাত পাতে আমন্ত্রণ না জানালেও থালায় সাজিয়েছি অপরাজিতা পোলাও। সত্যবতীরা গায়ের গন্ধ মুছে রাজপ্রাসাদে পাড়ি দেবার আগে নীলমুখ করে নিক। আর ঢেকুর তোলার সময় হজম করে ফেলুক গোপন যৌনসুখের দিনপাত।
তাহলে? ঘুরে ফিরে সেই গুহালিপির গল্প? মানুষ মুখে না বললেও গুহালিপি যে মস্ত লিপি সে তারা ভালোই জানে৷ অথচ প্রকাশ্য খাজুরাহো কিংবা কোনারক দেখলে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে, এতোটাই গুটিয়ে যেতে চায় কেন্নোও ভাবে 'আহা! এ কোন এক্সিবিশন'। আর গোপন! পর্দা টেনে শুধু চেষ্টাই চালিয়ে যায় পার্টনারকে বলে ' ওপরের ডানদিকে ওটা কোন পোজ ছিল যেন?' আসলে মুখ মুখোশ সবারই আছে। যে মানুষটা ধোপদুরস্ত সেজে রাস্তায় হেঁটে যায় তার পেটে লাথি মারলে যে চার অক্ষরে দান শেষ তা দেখে ঘুনাক্ষরেও টের পাওয়া যাবে না। কিংবা হাসতে হাসতে যখন বলবে 'ইস আমাদের ভদ্রবাড়িতে কোন গালিগালাজ চলে না' বুঝে নিতে হবে পর্দাবিহীন খোলা দরজায় বুকের ওপর শায়া তুলে কিংবা লুঙ্গির গিঁট আলগা করে চার-অক্ষর, পাঁচ-অক্ষরের ফোয়ারা ওড়ে।
এই কথাগুলো লিখতে লিখতে আমার প্রথম হোস্টেল জীবনের কথা মনে পড়ছে৷ যৌনতা আর মুখ মুখোশ। এই টাইটেলে উপন্যাস নেমে যেতে পারে সহজেই। সেই ছোট বয়সে কিছু করার আগে মুখোশটা যেন খুব জরুরি ছিল। সে রুম পার্টনারের ঠোঁটে ঠোঁট ঢুকিয়ে বুকে হাত বোলানোই হোক কিংবা সিগারেটে টান। শেষপর্যন্ত নিজেদের সমকামীতা অনেকেই বজায় রাখতে পারল না। মুখের ওপর মুখোশ, মুখোশের ওপর মুখোশ চাপিয়ে যে যার গাছের কাঁঠালে মন দিয়েছে আর নিজেদের জন্য কলাবাগান খুঁজে নিতে দেরী করেনি৷ আমাকে যেটা ভাবায়, ওই মুহুর্তগুলো কি আদৌ সমকামীতার মুহুর্ত ছিল নাকি বয়ঃসন্ধির হরমোনের কার্যকলাপ। নাকি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কোথাও না কোথাও সামান্য হলেও সমকামীতা লুকিয়ে আছে? এগুলো নিয়ে অনেক ভেবেছি। কোথাও পৌঁছোতে না পারলেও বারবার 'ভালোবাসা' শব্দটি পোশাকহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ তাই সম্পর্কের পোস্টমর্টেম না করে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে নৌকায় তুলে দিই৷
ঘুরে ফিরে সেই নৌকাতেই এসে দাঁড়াই, হয়তো পারানীর ছায়া পিছু ছাড়ে না, হয়তো কেন ছাড়েই না৷ কথায় বলে স্বভাব যায় না মলে, এও তাই। রাস্তায় হোঁচট খেলে অ্যাক্সিডেন্ট না ভেবে আঙুল উঠে যায় শিখণ্ডীর দিকে যেন মুখের সামনে সবসময়ই ভীষ্ম! আরেহ কিসের প্রতিশোধ? কিসের এতো রোষ? যে নদীতে অপরাজিতা অর্পণের পরেও গা ভাসায় না সেই নদী বিষয়ক পৃথিবী নিয়ে তার জন্মলগ্ন বদলাবে না৷ জন্মেছে যখন বেড়েই যাবে আর থোকা থোকা ফুলে ভরে উঠবে রাখালিয়া রাজপ্রাসাদ। এতো আর দড়িটানাটানি খেলা নয়, পড়ে গেছে বলে ব্যথায় কেঁদে উঠবে। সময়টা ছিল দাঁড় টানার৷ সাথে জলের ঘনত্ব বুঝে ছিপ ফেলার৷ এ এক ভয়ানক নেশা, নেশায় উন্মত্ত হয়ে সে ভুলে যায় যে মাছ সে পুষতে চাইছে সে অ্যাকোয়ারিয়ামের নয়৷ আর যে জল থেকে মাছ তুলেছে তার রঙ নীল।
ক্যালকুলেশনের ভুল সকলেই করে৷ অংকের সুত্র আওড়ালেও তা প্রাথমিক ধাপেই আটকে৷ কলঙ্ক ঢাকতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় চার দিকে। নাটকের উপস্থাপনা হয়। ফিরে আসে মুখোশ সংক্রান্ত চর্যাপদ। আমি এখনও পর্যন্ত দর্শক। বিচারকের আসন শূন্য। টেবিলে রাখা আছে স্তন ও বিভাজিকা সংক্রান্ত তথ্য। মঞ্চের মাঝে মস্ত অ্যাকোয়ারিয়াম। মাছ নেই। মাছের থাকার কথাও ছিল না।
এই যে এতো লিখে গেলাম কেউ পড়ে ভাবতেই পারে ব্যক্তিগত আক্রোশ নিয়ে বমি করে গেছি, ব্যপারটা কিন্তু তা নয়৷ আমার শিরায়-উপশিরায় রাজরক্ত। অহংকারের শেকড় যেখানে যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে সেখান থেকে ব্যক্তিগত আক্রোশ জন্মায় না৷ জন্মানোর কথাও না৷ আমি সিংহাসন চিনি৷ তাই ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম সংক্রান্ত জীবনযাপন নিয়ে আমার মাথা ব্যথা একটু হলেও কম। ব্যক্তিগত স্তর ছেড়ে আমি ভাবতে শিখেছি আপামর জনসাধারণের জন্য৷ যাদের কাছে বড় পর্দার সিনেমা শুধুই সিনেমা আর গোপন প্রেম হারেমের বিপরীতে বসে থাকা প্রাচীন উদ্ভিদ। আমার রাজ্যের নদী, নৌকা পারানী উন্মুক্ত, পাঠাগারের মেঝেতে আলপনা এঁকে কাটিয়েছে তাদের শিক্ষার্থীবেলা। এখানে সত্য গোপনে নিরুদ্দেশ হতে হয় না। কিংবা কলঙ্ক ঢাকতে মুখোশ পরতে হয় না৷
আমি ও আমাদের প্রতিটি দিনই অপরাজিতার সাম্যবাদ।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments